তন্ময় সরকার
ভুলু আজ ভোট দিতে গিয়ে খিচুড়ি খেয়ে এসেছে। কোনও অভিযোগ নেই, কোনও ক্ষোভও নেই।
ভুলুর ক্ষোভ শুধু নিজের নামের বিরুদ্ধে। আসলে ক্ষোভ নিজের বাবার বিরুদ্ধে। কোন কুবুদ্ধিতে এই নাম দুখানা সে রেখেছিল কে জানে! অথচ মানুষটার অনেক বুদ্ধিশুদ্ধি ছিল। ভুলুরা পাক্কা হিন্দু। অথচ ভুলুর ভাল নাম নজরুল বৈরাগী।
ভুলুর চোদ্দপুরুষ চাষি হলেও গান-বাজনায় পারদর্শী ছিল সবাই। ভুলুর বাবা, শচীন বৈরাগী ছিল যাত্রার বিবেক। আর তার জীবনের আদর্শ ছিল নজরুল। অবসরে মগ্ন হয়ে থাকতেন নজরুলের গানে। কলকাতা থেকে মাঝে মাঝেই শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা আসত তাঁর গান শুনতে। শচীন বৈরাগী এক একটা গান শেষ করতেন, আর সেই গানের নীতিশিক্ষা গ্রামের সহজ ভাষায় বলে যেতেন। অশিক্ষিত শচীনের সেই কথাগুলো হা করে গিলত শহরের শিক্ষিত বাবুরা।
প্রথম ছেলে হলে শচীন নাম রেখেছিলেন নজরুল। অনেকে হেসেছিল। কেউ কেউ বাধা দিয়েছিল, হিন্দুর ছেলে হয়ে মোচলমানের নাম! এ চলবে না।
কিন্তু শচীনকে কেউ টলাতে পারেনি। হেসে বলেছিলেন, “মানুষের একটাই ধর্ম, মানুষ-ধর্ম। আর কোনও ধর্ম নেই রে। তালে নামের আবার ধর্ম কী?”
মুসলিমদের আড়ালে কোনও কোনও হিন্দু ভুলুকে খেপায়, “তোর বাপ তো তোরে মোল্লা করে রেখে গেছে!”
ভুলু খেপে না। কিন্তু মনের মধ্যে অস্বস্তি হয়। এসবও মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু এই বিশেষ পশুশ্রেণির ইঙ্গিতবাহী ডাক নামটা! এই নামটা ছিল না ছোটবেলায়। একটু বড় হলে ভুলু যখন বাবার গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশগুলো প্রায়শই ভুলে যেত, বাবা তখন আদর করে ডাকতে শুরু করলেন ‘ভুলু’ বলে। নামটাও চালু হয়ে গেল।
গ্রামের সবচেয়ে জমজমাট মোড় বলতে বিডিও অফিসের মুখটা। পাঁচ গ্রামের লোক আসে আর জামশেদ চাচার চায়ের দোকানটা ভিড়ে ভরে যায়। ভুলু চায়ের দোকানের চালার নীচে কোনওরকমে একটা দাঁড়ানোর জায়গা করে বলে, “জামশেদচা, একটা চা দেও দিকি, আর একটা ভাল বিস্কুট।”
পাশের রবীন টোন কাটে, “জামশেদচা, ভুলুরে একটা টোস্ট বিস্কুট দেও। লালু-ভুলুরা টোস্ট ভাল খায়।”
অরবিন্দ আর রফিক হো হো করে হেসে ওঠে। জামশেদ চাচা সজোরে হাসে না, কিন্তু তার ঠোঁটের কোণ দুটো সামান্য প্রসারিত হয়, চোখের মধ্যে তামাশা ছোটাছুটি করে। ভুলুর মুখ লাল হয়ে যায়। রাগে হাঁটা লাগায় বাড়ির দিকে। আর সেই রাগের চোটে ভুলে যায়, বৌ কিলো খানেক চাল নিয়ে যেতে বলেছিল।
এসব ঘটনা ভুলু ভোলে না। কিন্তু পরের দিন রবীনের উপর রাগ করে থাকতে সে ভুলে যায়। ভুলুর ভুলে যাওয়া নিয়ে গ্রামময় অনেক সত্যি-মিথ্যে গল্প রটে আছে। সেসব গল্প মাঝেমাঝেই জামশেদ চাচার চায়ের দোকানের তাসের আড্ডার বিনোদন হয়ে ওঠে। একবার ভুলু বউ নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিল চিড়িয়াখানা। ফেরার পথে শিয়ালদা স্টেশনে এসে বউকে দাঁড় করিয়ে রেখে গিয়েছিল বোতলে জল ভরতে। তারপর একা একা ট্রেনে উঠে বাড়ি ফিরেছিল। সে নাকি বেমালুম ভুলে গিয়েছিল সাথে বউ আছে।
ভুলুর এহেন ভুলো মন তবু ভুলে যায়নি গত পঞ্চায়েত ইলেকশনের কথা। তাই ভুলু আজ ভোট দিতে গিয়ে খিচুড়ি খেয়ে এসেছে। ভোট দিয়ে নয়, ভোট না দিয়ে খিচুড়ি খেয়ে এসেছে সে। ভোট দিয়ে খালি পেটে থাকার মত বোকা আর ভুলু নেই।
গতবার ভোটের আগে ভুলুর একটা স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন ছিল না, স্বপ্ন দেখিয়েছিল মিল-মালিক সামন্ত মণ্ডল। বলেছিল, “ভুলু, এবার ভোটটা আমাদেরকে দিবি। আমরা গ্রামের চাষীদের জীবন পাল্টে দেব। ফসলের দাম দেব। আমরা সবাই খেয়ে পরে বাঁচব।”
তাই গতবার ইলেকশনের আগে ভুলুর এই স্বপ্নটা ছিল, দু’বেলা খেয়ে বাঁচার স্বপ্ন। আর মনে ছিল বাবার শিখিয়ে যাওয়া একটা কথা— ভোট দেওয়া আমাদের অধিকার।
সেই স্বপ্ন আর বাবার শিক্ষা বুকে নিয়ে ভুলু ভোট দিতে গিয়েছিল সকাল-সকাল। সাথে অনেকেই। হাতে ছিল সামন্তর দেওয়া ভোটার স্লিপ। বুথে ঢোকার মুখে বিষ্ণু স্লিপটা কেড়ে নিয়ে একটা খিচুড়ির স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, “ভোট দিতে হবে না। মোব্বাশেরের বাড়ি খিচুড়ি হচ্ছে। খিচুড়ি খেয়ে বাড়ি চলে যা।”
ভুলু খিচুড়ির স্লিপটা কুটিকুটি করে ছিঁড়ে বিষ্ণুর চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “আমি ভোট দেব।”
মুহূর্তে পালটে গিয়েছিল বিষ্ণুর রূপ। কোমরে গোঁজা মেশিনটা বের করে ভুলুর কপালে ঠেকিয়ে বলেছিল, “বেশি বাড়াবাড়ি করবি তো একদম দানা গেঁথে দেব, শালা!”
সবাই পেছন থেকে চিল্লিয়ে উঠেছিল, “জেদ করিস নে, ভুলু! চলে আয়।”
যেন সবাই বলছে, ‘ভুলু, তুই অন্যায়কে ভয় পা; ভয় পেয়ে পালিয়ে আয়।’ কিন্তু ভুলু অসহায়। নিজের মনের মধ্যে ক্ষণিকের জন্যে একবার তাকিয়ে নিয়েছিল। না, একটুও ভয় করছিল না তো! মনে পড়েছিল বাবার একটা কথা, “অন্যায় করা আর অন্যায় সহ্য করার মধ্যে কোনও ফারাক নেই, ভুলু। দুটোই ঘেন্নার কাজ।”
তাই চোখের পলকে বাঁ হাতের থাবায় মেশিনটা কেড়ে নিয়ে ডান হাত দিয়ে বিষ্ণুকে এক ধাক্কা দিয়ে বলেছিল, আমি ভোট দেব।
ছিটকে গিয়েছিল বিষ্ণু। আর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামের মানুষরা যেন হঠাৎ করে সাহস পেয়ে রে-রে করে ছুটে এসেছিল। পালাতে হয়েছিল বিষ্ণুদের। ভুলুদের বুথে তাই গতবার সত্যি সত্যি ভোট হয়েছিল। শুধু ভুলুদের বুথে নয়, গোটা পাঁচ গ্রামের মানুষ খেয়ে পরে বাঁচার স্বপ্নে ভোট দিয়েছিল। জিতেছিল সামন্ত মণ্ডলরা।
গেলবারের আগের বার অঘ্রাণে ভুলুর স্বপ্নের ধান উঠল পনেরো কুইন্টাল। ভুলু গেল বিডিও অফিসে নাম লেখাতে, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট দিতে। সরকার ঘোষণা করেছে চাষিদের ধান বাজার ছাড়া চারশো টাকা বেশি দরে কেনা হবে। তিন দিনের মধ্যে অ্যাকাউন্টে ঢুকে যাবে টাকা।
কিন্তু ঐ নাম লেখানো পর্যন্ত, ধান আর কেনা হয় না। এদিকে সারের পয়সা, বীজের পয়সা, জলের পয়সার জন্যে পাগল করে দিচ্ছে পাওনাদাররা। মানুষগুলো যেন রাতারাতি একেবারে অবুঝ হয়ে উঠেছে। রাস্তাঘাটে অপমানে আর হুমকীতে রাস্তার মাটির সাথেই মিশে যাচ্ছে ভুলু।
খবর পাওয়া গেল জামশেদ চাচার চায়ের দোকানে। বিডিও অফিস ধান কিনে পাঠাবে সামন্তর মিলে, সামন্ত চাল করে পাঠাবে গোডাউনে। কিন্তু সামন্ত বেঁকে বসেছে। এখন কোনও ধান সে মিলে ঢোকাবে না। অফিসারকে পালটা হুমকি দিয়েছে, সামন্তর কথা না শুনলে অবস্থা খারাপ করে দেবে।
উদ্ভ্রান্তের মত এদিকওদিক ছুটছে ভুলু। দু’-এক জন নাকি দশ কুইন্টাল করে ধান বেচতে পেরেছে। কিন্তু সে কবে কখন পেরেছে তা ভুলু জানে না। ভুলু পারেনি।
কুড়ি দিন কেটে গেল। সবে হিম পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু সে দিন রাতে শিশির পড়ছে খুব। বারান্দার এক পাশে চাটাই পেতে চুপ করে বসে আছে ভুলু আর ভুলুর বউ। বাকি বারান্দা জুড়ে লাট দেওয়া রয়েছে পঁচিশ বস্তা ধান। ভুলু পরিষ্কার দেখতে পায়, বাল্বের আলো গায়ে মেখে শিশিরকণাগুলো উড়ে এসে খুব শান্তভাবে বসছে বস্তাগুলোর গায়ে। যেন ভুলুর স্বপ্নের গায়ে এক একটা বিষাক্ত কীট দংশন করছে। সে উঠে গিয়ে ঘর থেকে পলিথিন এনে বারান্দায় একটা ঘেরা দেওয়ার চেষ্টা করল।
স্বপ্নগুলো মরে গেছে। হাতের কাছে আছে এক গাছা দড়ি আর বাবার শিখিয়ে যাওয়া একটা নীতিবাক্য— আত্মহত্যা মহা অন্যায়। হাসি পায় ভুলুর। উপরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বাবাকে বলে, ‘ন্যায়-অন্যায়ের হিসেব এখন উলটে গেছে, বাবা। এখন বেঁচে থাকার মত মহা অন্যায় আর কী আছে?’
সকালবেলা লোক পাঠিয়ে মিলে ডেকে নিয়ে গেল সামন্ত। বলল, “বাজার খুব খারাপ, ভুলু। অফিস আর ধান কিনবে না। আমিও এত ধান নিয়ে কী করব, বল? দুশো টাকা কম দরে যদি বেচিস, আমি তোর ধানগুলো নিয়ে নিতে পারি।”
ভুলু কোনও কথা বলে না। জলের দামে সব ধান বেচে দেয় সামন্তর কাছে।
বৈশাখ মাস। ভুলু সারাদিন শুয়ে থাকে শমসেরদের আমবাগানের মাচায়। পাশেই সম্প্রীতি সঙ্ঘের মাঠ। কাত হয়ে শুয়ে ভুলু ছেলেদের ফুটবল খেলা দেখে। জামশেদ চাচার চায়ের দোকানে আর যেতে মন চায় না। আজ সকালে একবার গিয়েছিল। রজত খবর দিয়েছে, অফিস নাকি বলেছে— এখন যত খুশি ধান বেচতে পারবে চাষিরা।
ভুলু কেন, কোনও চাষির কাছেই এখন ধান নেই। শোনা যাচ্ছে সামন্ত নাকি হাজার হাজার কুইন্টাল ধান বেচেছে সরকারের ঘরে। বাজার ছাড়া চারশো টাকা বেশি দরে। আর পাশেই অরবিন্দ আজকের খবরের কাগজ পড়ে শোনাচ্ছিল, “এ বছর চাষিদের কাছ থেকে রেকর্ড পরিমাণ ধান কিনেছে সরকার।”
আষাঢ়ের মাঝামাঝি। আজ সকালে নতুন বীজ ফেলেছে ভুলু। মনটা কোনও অজানা কারণে খারাপ হয়ে আছে। সকাল থেকে একটানা বৃষ্টি হয়ে এই বিকেলে একটু থেমেছে। আর অনেক দিন পরে ভুলু এসেছে জামশেদ চাচার চায়ের দোকানে।
সামন্ত বসে আছে দলবল নিয়ে এক পাশে। ওপাশে রবীন রফিক অরবিন্দরা গোল হয়ে বসে তাস খেলছে। ভুলুকে দেখে সামন্ত ডেকে বলল, “আয়, ভুলু, চা খাবি? জামশেদচা, ভুলুরে একটা চা দেও। আমি টাকা দেব।”
ভুলু হেসে বলল, “তুমি আমারে কীভাবে চা খাওয়াবা, সামন্তদা? তুমি তো নিজেই খাও আমার পয়সায়।”
বিস্মিত হয়ে যায় সামন্ত। হতবম্ব হয়ে তাস ফেলে ভুলুর দিকে তাকায় রবীন রফিক অরবিন্দ। পেছন থেকে সামন্তর সাগরেদ শাজান আওয়াজ দেয়, “হিসেব করে কথা বল ভুলু।”
ভুলু অত্যন্ত সরলভাবে আবার সামন্তকে বলে, “আমারে খাওয়ানো মানে তোমার গঙ্গাজলে গঙ্গা পুজো করা।”
সামন্ত উঠে দাঁড়ায়। দু’চোখ গুটিয়ে ভুলুর দিকে তাকিয়ে ধমক দেয়, “চুপ কর! শালা রাস্তার কুত্তা! আবার বড় বড় কথা!”
ভুলু অবাক হয়ে যায়। কুকুরের ইঙ্গিত করে যে রবীন রফিক অরবিন্দ ভুলুকে তামাশা করে হাসে, ওরা কেউ সামন্তর এই স্পষ্ট সম্বোধন শুনে হাসল না। বরং মুখটা কেমন পাংশু হয়ে গেল সবার। দলবল নিয়ে চলে গেল সামন্ত। জামশেদ চাচা শুধু বলল, “বাবার মতই ঠোঁটকাটা হয়েছে ছেলেটা।”
এই ঠোঁটকাটা ভুলু আজ ভোট না দিয়ে খিচুড়ি খেয়ে এসেছে। বিডিও অফিস লাগোয়া স্কুলঘরেই ভুলুদের বুথ। ভাবখানা এমন করেছিল যেন ভোট দিতেই সে গেছে। সামন্তর সাগরেদ বিষ্ণু একটা কাগজের স্লিপ দিয়ে বলল, “শমসেরদের আম বাগানে খিচুড়ি হচ্ছে। খেয়ে বাড়ি চলে যা।”
দল পাল্টে বিষ্ণু এখন সামন্তর চ্যালা।
খিচুড়ি খেয়েছে ভুলু, কিন্তু বাড়ি যায়নি। এসে বসেছে জামশেদ চাচার চায়ের দোকানে। অনেকেই আছে। সবাই বেশ উত্তেজিত। একটু আগে শাজানদের সঙ্গে রজতদের জোর ঝামেলা হয়েছে। তিনটে বোম পড়েছে সম্প্রীতি সঙ্ঘের মাঠের কোণে। জয়ন্তর নাকি হাত উড়ে গেছে শোনা যাচ্ছে। ভোট দিতে না পেরে পাশে বসে থাকা জাফর চাচা গজরাচ্ছে, “দেশটারে এরা দোজখ বানায় ফেলল।”
সব শুনছে ভুলু। কিন্তু কোন কথাই তার মনকে স্পর্শ করছে না। নির্বিকার হয়ে সে বিড়ি টানছে। হঠাৎ রজত ঢুকল হন্তদন্ত হয়ে। সামনেই বসে থাকা ভুলুর দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখছিস তো কী অবস্থা! এটা কোনও ভোট হচ্ছে? কী দরকার ছিল এই ভোট করার?”
কেউ কেউ রজতের কথায় ঘাড় নেড়ে সায় দিল। কেউ মাথা নীচু করে বসে রইল। রজত এবার ভুলুকে বলল, “দেখ, ভুলু, এভাবে চলতে পারে না। এবার আমাদের পার্টিটা কর। আমাদের পার্টি যদি ক্ষমতায় আসে, আমরা দেখিয়ে দেব ভোট কীভাবে করতে হয়। দিন পাল্টে দেব আমরা।”
কথাটা শুনে ভুলু হাসে। মনের চোখে ভেসে ওঠে সামন্তর প্রতিশ্রুতি, শিশিরে ভিজে যাওয়া পঁচিশ বস্তা ধান, এক গাছা দড়ি আর বাবার বলে যাওয়া সেই কথা— আত্মহত্যা মহা অন্যায়!
উষ্মা প্রাকাশ পায় রফিকের গলায়, “তোরা তো দিন পাল্টে দিচ্ছিস দাঙ্গা বাধিয়ে আর মোচলমানদের কচুকাটা করে। তোদের নেতারা জানে তো খালি খুন আর ধর্ষণ।”
ঘেমে ওঠা রজত হঠাৎ চুপসে যায়, কোনও জবাব দিতে পারে না।
“শোন্,” রজত এদিকওদিক তাকিয়ে ঘাড়ে হাত দিয়ে ভুলুকে দোকানের বাইরে নিয়ে আসে। তারপর নীচু গলায় বলে, “এই সবকিছুর মূলে কী জানিস তো? এই শালা মোল্লারা। ওরা শালা হিংস্র জাত। আর ওদের কীভাবে মাথায় তুলছে এরা, দেখছিস তো? আমাদের গাঁয়ে মোল্লারা ক’টা ঘর? তাও কী দাপট! শাজানরা বুথের ধারে-কাছে কাউকে ঘেঁষতে দিচ্ছে না। ধরে ধরে হিন্দুদের মারছে। চল্, লোকজন জুটিয়ে ওদের ভাগিয়ে দিই। গেলবার তুই যা সাহস দেখিয়েছিলি…”
ভুলু স্থির চোখে রজতের দিকে তাকায়। তারপর বলে, “সামন্তর দুই হাত, শাজান আর বিষ্ণু। তুই কার ঠ্যাঙানি খেলি?”
চরম বিরক্ত হয়ে রজত বলল, “তোর নাম তো নজরুল। মোল্লাদের নাম যার, তার বুদ্ধি আর কত বেশি হবে?”
যে নাম নিয়ে ভুলু এতদিন বিব্রত ছিল, সেই নাম নিয়ে ব্যঙ্গ শুনে বলল, “আমার বাবা বলেছিল— নজরুল নাকি এক কবির নাম। আর কবিদের কোনও জাত-ধর্ম হয় না, বৈরাগীদেরও হয় না। দ্যাখ্ রজত, ভোটে তোরা জিতলি, না সামন্ত জিতল তাতে আমাদের মত চাষাভুষোদের কিছু যায় আসে না। আমাদের ধান কে কিনবে?”
রজত বলল, “বেঁচে থাকলে তো ধান বেচবি। মোল্লার যে হারে বাচ্চা পয়দা করছে, জলদি দেশটা পাকিস্তান হয়ে যাবে। তাই ওসব ছেঁদা কথা রেখে আমাদের পার্টিটা ভাল করে কর!”
ভুলু বলল, “যা না, যেখানে ভোট হচ্ছে সেখানে গিয়ে তোর পার্টির ঝাণ্ডা ওড়া। ভয় করছে নাকি?”
রজত বলল, “তোর ভয় করছে? যা, তুই বুথের সামনে গিয়ে বল—এরা চাষীদের ধান কেনেনি, এদের কেউ ভোট দিও না! দেখি কেমন সাহস তোর। ফুঃ, নাম রেখেছে নজরুল!”
ভুলু এবার অঙ্গারের মত চোখ দিয়ে রজতের দিকে তাকাল। তারপর গটগট করে হাঁটা দিল বুথঘরের দিকে। জামশেদ চাচা, রফিক, অরবিন্দ, রবীনেরা পেছন পেছন দৌঁড়াল, “ভুলু দাঁড়া, যাস্ নে। তোকে ওরা মেরে ফেলবে!”
না, ভুলু বুথের সামনে গিয়ে কোনও কথা বলল না৷ স্কুলের সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সামন্তর দলবল অবাক চোখে দেখল ভুলু আসছে, আর তার পেছনে আসছে গ্রামের ছেলেবুড়ো সবাই। কারও হাতে বোমা-পিস্তল কিচ্ছু নেই, একটা লাঠি-সটাও নয়। কিন্তু ঠেকাবে কী করে ওরা এত মানুষকে! শাজান, বিষ্ণুরা ভিতরে ছাপ্পা দিচ্ছিল। ভুলু সটান বুথের মধ্যে ঢুকে তাদের হাত থেকে ব্যালট বাক্সটা কেড়ে নিল। তারপর বাইরে বেরিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল পাশের পুকুরে। গণতন্ত্রের সলিল সমাধির উপরের বুড়বুড়িগুলোর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল রজত।