চৈতালী চট্টোপাধ্যায়
১
আরও ঘুম, আরও খুব ঘুমের গভীরে যেতে-যেতে আমি
টের পাই পলাশ-পাপড়ি ফুটে ওঠে
কীভাবে যে টের পাই,তুমি জানো। নরকের পথ
ঘুরে এসে শেষে তুমি জানো,অর্ফিয়ুস
বীণাটি অলীক, শুধু ধ্বনি তার বসন্তবাতাসে
২
কে বলেছে রক্তক্ষরণ,আর মুঠো-মুঠো
আবির ঢেলেছে তাকে চাপা দিতে, শোনো
মৃত্যু হয় হোক, আমি
রাতটিকে বৃথা যেতে দেব না কিছুতে
৩
মুখোশের ভাষা কিছু আমিও শিখেছি পড়ে নিতে
মিনারচুড়োর থেকে দ্রুত-পায়ে তাই নেমে এসে
দেখে নিতে চাই স্বেদবিন্দু, তোমার মুখের, ফের
নদীতীর, সূর্যঘড়ির ছায়া সমস্ত উন্মাদ করে দেয়
৪
পথচারীদের জন্য আমরা হাওয়ায় উড়িয়ে দেব বসন্ত, শরীরে
ছড়িয়ে দেব বসন্তের গুঁড়ো গুঁড়ো পরাগ,আর
রাতে বাড়ি ফিরব যখন, নিউমার্কেটের গেটে
শুয়ে-থাকা রূপোপজীবিনীটিকে অস্ফুটে বলব, ‘ক্ষমা কোরো’
৫
আজ ভোরে বনপুলকের ফুলে,ধুলোপথে, দিগন্ত-পেরোনো
মাঠে শুধু তুমি, আনখশরীরে তুমি
শিরামুখে, রক্তে তুমি। এই চৈত্রে
আবারও মানুষজন্ম হল তবে, আবার লিরিক
৬
পকেটে বারুদ ও হাতে হত্যাকারীর কররেখা
হঠাৎ মৃদঙ্গ শুনে চেয়ে দেখে বসন্তের দিন চলে যায়
ছেলেবেলা থেকে খুব জলের অভাবে ওরা পাঁকের ভিতরে
শুয়ে আছে, ফুল ফুটে উঠবার ঘ্রাণে
মাথা মুছে নিয়ে উঠে বসে, ভাবে, ভালোবাসা পেলে বেঁচে যেত
৭
যে-দিক রাত্রির, আমি লিখে রাখি ঘন অন্ধকারময় নদীটিকে, নাম চন্দ্রভাগা
কিন্তু অন্ধকারের গল্প শোনাল যে, তার নাম কাউকে বলি না
যে-দিক ভোরের, আমি লিখে রাখি আলোরং খেত
ট্রেন, লোকজন, প্রতিবেশী শহরের পথগুলি
ঠিক মাঝখানে, একটি বসন্তদিন, তোমার বিচ্ছেদ নিয়ে উড়ে আসে
৮
যে অন্ধ আবেগ ছিল, তাকে আরও তীব্র করো, অ্যাসিড মেশাও
অর্ধেক জ্যোৎস্নার আর অর্ধেক রক্তের ছিল যে-উপমা,
তাকেও কামার্ত করে তোলো
গুঁড়ো করে ঢেলে দাও বৃক্ষমূলে, ঢালো ভাঙা-দম্পতির চুলে
তারপর নিজে হেঁটে হেঁটে ওই টিলার ওপাশে চলে যাও
পরে, বহুদিন পরে নদীর মতন, লোকে তোমাকেও মিথ্ ভেবে নেবে
৯
কে আজ প্রশ্ন তুলল সামাজিক দায়বদ্ধতার
খুন ও ধর্ষণগ্রস্ত খবরগুলিকে আজ কে সাজাল স্বরবৃত্ত-চালে
কী পেল তারপর
যে ভোরে উৎসবে যায়,সন্ধেয় গান গেয়ে ফেরে আনমনে
তার-ই হাতে কিশোরীর তাঁতশাড়ি ছিন্ন হবে
ভবিষ্যদ্বাণী কবিতার
১০
‘পলাশ দেখেছ তুমি?’ কে যেন বলল
বসন্ত-সকালে নাচ চতুর মুদ্রায় তার দেহময় ছড়িয়ে পড়ল
আজ ভোর থেকে, বৃষ্টিগুঁড়োর মধ্যে, উল্লাসের মধ্যে, ঢেউ, স্ফূর্তিসম
ডুবিয়ে দিচ্ছে লাল চোখ। হস্টেলের মেয়েটিকে
আবির মাখাবে বলে এরই কূলে জেগে উঠছে সুযোগসন্ধানী হাত
একেকটা মুহূর্ত, খুব ধরে ধরে নকল করার মতো
ক্রমশ সুন্দর হচ্ছে, হয়ে উঠছে রঙিন
আর ক্রমশ সরে যাচ্ছে জীবন থেকে দূরে, সৌন্দর্য থেকেও দূরে
১১
তাই তোমার কাছেও যেতে ভয় পাই
তাই মাথার মধ্যে বিকট শব্দে প্লেন-ক্র্যাশ হয় সবসময়
বকুলবীথিতে হাঁটতে হাঁটতে আমি আলোর কথা
তুলতে চেয়েছিলাম। তুমি জানো, বৃথা-উৎসবের গর্জন
আমার চোখে জল এনে দিল তারপর
১২
শেষরাতে ঘুম পেলে তোমাকে বলেছি।
তুমি শুইয়ে দিয়েছ নীচে
মাথায় কাঞ্চনফুল, পায়ে মাটি
ঘুমিয়ে পড়ার আগে, রেখে যাচ্ছ বসন্ত-অঙ্কুর
কিন্তু একটি ক্রেয়নরেখা, সমান্তরাল, বিশ্বাসভঙ্গের পাশাপাশি
কতদূর যাবে আজও জানা যায়নি