চার নম্বর নিউজডেস্ক
‘বইয়ের খবর’ চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর হুইলার্স বিভাগের অন্তর্গত একটি নতুন উপবিভাগ যা এই সংখ্যা থেকে চালু হল। এখানে যা প্রকাশিত হবে তা যে কোনও প্রথাগত রিভিউ নয়। বরং দীর্ঘ সমালোচনার পরিবর্তে অল্প পরিসরে একাধিক ভালো লাগা নতুন বইয়ের খবরাখবর এই উপবিভাগে পরিবেশিত হবে। প্রসঙ্গত, ‘ভালো লাগা’ বিষয়টি সম্পূর্ণ আপেক্ষিক, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর হুইলার্স কমিটির যা ভালো লাগবে, তা সমস্ত পাঠকের পছন্দ হবেই, এমন কোনও স্বতঃসিদ্ধ নেই, তবে এটুকু আশ্বাস দেওয়াই যায়, এই পরিসরে আলোচিত প্রতিটি বইকে ভিড়ের মধ্যে থেকে আলাদাভাবে চোখে পড়বে বিষয় নির্বাচনের গুণে। আসুন, শুরু করা যাক।
প্রথম আলোচ্য বইটি Navayana প্রকাশনার। এই প্রকাশনা সংস্থাটি অতি অল্প সময়ে নজর কেড়েছে মূলত দলিত সাহিত্য নিয়ে সিরিয়াস কাজ করার সুবাদে। অরুন্ধতী রায়ের দীর্ঘ প্রস্তাবনায় বাবাসাহেব আম্বেদকরের ‘Annihilation of Caste’ একটি সটীক নতুন সংস্করণ এই প্রকাশনার সম্পদ। বর্তমানে আলোচ্য বইটিও আম্বেদকরের লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ ‘The Untouchables’ (১৯৪৮)-এর একটি সুনির্বাচিত অংশ। নতুন বইটির সম্পাদক-প্রদত্ত নাম- ‘Beef, Brahmins & Broken Men’। এই বইটিতে মূলত ‘The Untouchables’- এর থেকে কিছু অধ্যায় তুলে এনেছেন দুই সম্পাদক-লেখক, অ্যালেক্স জর্জ ও এস. আনন্দ এবং সম্পাদনা করেছেন মূল বইটির এমন কিছু অংশ যা প্রাচীন ভারতে শূদ্রদের গোমাংস ভক্ষণের অভ্যাসের সঙ্গে তাদের সামাজিকভাবে অধোগমনের যোগসূত্রটি স্পষ্ট দেখিয়ে দেয়৷ বি আর আম্বেদকর প্রায় গোয়েন্দাসুলভ দক্ষতায় প্রাচীন ভারতের টেক্সটগুলিকে ঘেঁটে একজন শূদ্রের শূদ্র হয়ে ওঠবার প্রেক্ষিতটি স্পষ্ট করেছেন এবং সেইসঙ্গে নগ্ন করেছেন ব্রাহ্মণ্যবাদের স্বরূপকে। আম্বেদকর দেখাচ্ছেন, কীভাবে একজন ব্রাহ্মণ যার কাছে একদা প্রায় প্রতিটি দিনই ছিল beef-steak খাওয়ার দিন, ক্রমে নিরামিষাশী হয়ে উঠছেন এবং কীভাবে যে সকল বৌদ্ধ গোমাংসভক্ষণ করতেন, সমাজের মূল স্রোত থেকে বিতাড়িত হয়ে অস্পৃশ্য হিসেবে গণ্য হচ্ছেন। ‘Beef, Brahmins & Broken Men’ বইটি আম্বেদকরের সেই গবেষণামূলক কাজটিকে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠা করে। মনে করিয়ে দেয়, ২০১৫-তে হায়দ্রাবাদের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোহিত ভেমুলার কথা, যিনি আম্বেদকরের মৃত্যুবার্ষিকী ও বাবরি মসজিদ ভাঙার দিনটিতে (৬ ডিসেম্বর) ক্যাম্পাসে ‘গোমাংস উৎসব’ আয়োজন করার ‘অপরাধে’ ছাত্রাবাস থেকে বিতাড়িত হন ও ক্রমশ বেড়ে ওঠা মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে কয়েকদিন পর আত্মহত্যা করেন। দলিত লেখক কাঞ্চা ইলিয়া শেপার্ডের কথামুখ এই বইটির অমূল্য সম্পদ যা আজকের এই বইটির প্রাসঙ্গিকতা দেখিয়ে দেয়। বইটি আপাদমস্তক রাজনৈতিক, কারণ প্রতিটি মানুষের বেঁচে থাকাই এই সময়ে চূড়ান্ত রাজনৈতিক। এই বই ইতিহাসের উপাদান খুঁড়ে বের করে এক তুলনামূলক আলোচনায় ‘গণতান্ত্রিক’ ভারতবর্ষে বর্তমান শাসকের আমলে নিরন্তর ঘটে চলা শোষণ, আধিপত্যবাদ ও অসাম্যের ক্ষতমুখটি খুলে দেখিয়ে দেয়৷ আজকের ভারতবর্ষে যিনি দলিত এবং যিনি দলিত নন, অথচ দলিতের সমস্যাগুলি নিবিড়ভাবে বুঝতে চান, আম্বেদকরের এক মহাগ্রন্থ তাদের কাছে অবশ্যপাঠ্য।
Beef, Brahmins & Broken Men’- An annotated critical selection from The Untouchables : B R Ambedkar.
Navayana. October 2019. Rs. 699/-.
দ্বিতীয় বইটিকে প্রথম বইটির পাঠ-পরিপূরক বলা যেতে পারে। বইটির নাম- মনুসংহিতার শূদ্রভাষ্য। লেখক- ড. সুকুমার সিকদার। প্রকাশক -অনুষ্টুপ। আমরা জানি, ‘মনুসংহিতা’ হিন্দু ধর্মের ব্রাহ্মণ্যবাদী ধারার একটি প্রামাণ্য টেক্সট। হাজার হাজার বছর ধরে ভারতীয় সমাজকে শাসন করেছে এই গ্রন্থ, সংখ্যাগুরু ‘নিচুজাত’-এর ওপর সংখ্যালঘু ‘উঁচুজাত’-এর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার দার্শনিক ভিত্তি ও ন্যায্যতা সরবরাহ করেছে এই কুখ্যাত টেক্সট৷ বর্ণবিভাজিত হিন্দুসমাজে status quo রক্ষায় এই গ্রন্থের প্রাধান্য এতখানিই বেশি ছিল যে ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু আইন রচিত হয়েছিল স্যার উইলিয়াম জোনস অনূদিত মনুসংহিতা-র টেক্সটের ওপর ভিত্তি।করে।
এ হেন গুরুত্বপূর্ণ বইটির বিষয়ভিত্তিক অনুবাদ করে বাঙালি পাঠক সমাজকে ঋণী করলেন লেখক সুকুমার সিকদার। ‘কথাশুরু’তে তিনি জানাচ্ছেন-
‘মনুর নামে প্রচলিত এই সংহিতা গভীরভাবে পাঠ না করলে বোঝা যাবে না যে, সংখ্যালঘু একটি পরিশ্রমবিমুখ সুবিধাভোগী শ্রেণীর গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার জন্য সমাজের উপর কী ভয়ানক কদর্য নীতি আরোপ করা হয়েছিল…।
… তবে হ্যাঁ, মনুসংহিতা মানেই বর্ণভিত্তিক সমাজ অনুশাসন নয়, মনুসংহিতা একখানি সামগ্রিক গ্রন্থ। মানুষের জন্ম, মৃত্যু, পুনর্জন্মের অন্তর্বর্তী সামগ্রিক ক্রিয়াকলাপ এই গ্রন্থের অন্তর্গত। তাই, জন্মসংস্কার থেকে বিদ্যার্জন, আশ্রমধর্ম, রাজধর্ম, বিচারব্যবস্থা, পাপপুণ্য, প্রায়শ্চিত্ত, দায়বিভাগ, বিবাহপদ্ধতি – কী নেই।এখানে! সেই সময়ের সমাজকে বুঝতে হলে মনুসংহিতার নিবিড় পাঠ অতি আবশ্যিক কর্ম!’
বইটি হাতে নিলে বোঝা যায়, ড. সিকদার কী এক অসামান্য অধ্যবসায় নিয়ে কাজটি করেছেন! সম্পূর্ণ মনুসংহিতা-র সরল অনুবাদ এ গ্রন্থ৷ শুধু মূল গ্রন্থের অধ্যায়ভিত্তিক বিভাজনকে বদলে লেখক পুরো টেক্সটটাকে বিষয়ভিত্তিক বিভাজনে নথিবদ্ধ করেছেন৷ তাতে মূল বক্তব্যের কোথাও বিচ্যুতি তো হয়নি, বরং আগ্রহী পাঠক একই বিষয়ের রেফারেন্স একই জায়গায় খুঁজে পেয়ে লাভবান হবেন।
যদিও আলোচ্য বইটি স্বয়ংসম্পূর্ণ, তবু বইয়ের শেষে মনুসংহিতা নিয়ে বাংলায় কঙ্কর সিংহ-সহ অন্যান্য পূর্বাচার্যরা কে কী কাজ করেছেন, তার একখানি তালিকা থাকলে পাঠক আরেকটু লাভবান হতেন৷ আশা করব, লেখক ও প্রকাশক পরের সংস্করণে এই বিষয়টি বিবেচনা করবেন।
মনুসংহিতার শূদ্রভাষ্য। সুকুমার সিকদার। অনুষ্টুপ।
প্রকাশকাল- ২০০৭। পরিবর্ধিত অনুষ্টুপ সংস্করণ- জানুয়ারি, ২০২০। মূল্য- ৩৫০ টাকা।