শৈলেন সরকার
লেখক গদ্যকার, ঔপন্যাসিক। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।
করুনা (উচ্চারণ মুফতি কাজী ইব্রাহিম) ভাইরাসের ইন্টারভিউ— স্বপ্নযোগে। ইতালির বাংলাদেশী যুবক মামুন মারুফের কথা। তিনি এক স্বপ্ন দেখেছেন। যে স্বপ্নে স্বয়ং ‘করুনা’ ভাইরাস কথা বলেছেন তাঁর সঙ্গে। তিনি তাঁর এই স্বপ্নের কথা বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন বাংলাদেশের মুফতি কাজী ইব্রাহিমের মাধ্যমে। হ্যাঁ এই মুফতি কাজী ইব্রাহিমের পরিচয় না দেওয়া গেলেও ইনি যে অসাধারণ কেউকেটা কেউ তা জানতে কষ্ট করতে হয় না। মুফতি কাজী ইব্রাহিম জানাচ্ছেন ইতালির সেই মামুন মারুফ পৃথিবীর মানুষকে মহামূল্যবান বার্তাটি জানাবার জন্য হন্যে হয়ে উপযুক্ত মানুষ খুঁজেছেন। শত শত বার মুফতি কাজী ইব্রাহিমকে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। শেষমেশ কাজী ইব্রাহিম সাহেবের সেক্রেটারিকে ধরে তাঁর সন্ধান পেয়ে…। ইতালির মামুন মারুফ বা বাংলাদেশের মুফতি কাজি ইব্রাহিমের আকর্ষণীয় গল্পটা আপাতত বসিয়ে রেখে বরং বাংলাদেশের পশ্চিমের ভারতবর্ষ নামক দেশেই যাওয়া যাক একবার।
২৮ মার্চ তারিখ এক টেলিভিশন চ্যানেলে দেখি বিজেপি-র দিলীপ ঘোষ বলছেন, ‘তাঁর লোকেরা পশ্চিমবাংলার ৩০ লাখ মানুষের কাছে সরাসরি খাদ্য পাঠাবে।’ খাদ্য পাঠাবে, কারণ কেন্দ্রীয় সরকার নির্দেশিত লক-ডাউন পালন করতে গিয়ে দিন আনি-দিন খাই মানুষেরা খুব দুর্দশায় পড়েছে, পশ্চিমবঙ্গে ৫৫ হাজার বুথের প্রতিটির জন্য তাঁর পার্টির প্রতি বুথের বুথকর্মীরা… ইত্যাদি ইত্যাদি। ভাবলাম ভুল দেখছি। ভাবলাম, নিশ্চিত ফেক নিউজ জাতীয় কিছু। কেননা ঘরে ঘরে গোমূত্রের শিশি-বোতল না পাঠিয়ে তিনি খাদ্য পাঠাবেন কেন? সেই একই দিলীপ ঘোষ তো? কিন্তু তিনি এত কিছু করতে যাচ্ছেন কেন? কেনই বা সরকারের প্রধান মোদি মহাশয়কে তিনি ‘শনির দশা’র কথা জানাবেন না, কেন বলবেন না, ‘মিত্রোঁ, এটা জাস্ট শনির দশা, ২৫ মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।’ ২২ মার্চের ‘এই সময়’ পত্রিকায় দেখতে পাচ্ছি রীতিমতো পণ্ডিতি ঢং-এ তিনি বলছেন, ‘একটি ভিডিওতে দেখলাম, পুরাণের শ্লোকে এমন একটি ভাইরাসের কথা বলা হয়েছে। শনির যে বছর এমন প্রকোপ হয়, সে বছর এমন মহামারি হয়। আগামী ২৫ মার্চ পর্যন্ত এমন চলবে।’ এই সময় কাগজে ‘শনির দশা’র আয়ুস্কাল ২৫ মার্চ পর্যন্ত বলা হলেও Snews নামের এক ইউটিউব চ্যানেলে দেখছি উনি দু মাসের কথা বলছেন। সঙ্গে নিদান নিমপাতা আর গোমূত্র। ওঁর কথায় কেউ যদি গোমূত্র আর নিমপাতা খেয়ে সুস্থ আছেন ভাবেন তা হলে অসুবিধাটা কোথায়? তার মানে, প্রধানমন্ত্রী মোদি মহাশয়ের সঙ্গে হয়তো ওঁর বাতচিত হয়নি, বা হলেও মোদি মহাশয় হয়ত ওঁর কথায় তেমন ভরসা পাননি। সে যাই হোক, ভদ্রলোকের পুরাণজ্ঞান অসাধারণ। ইতিমধ্যে জনতা কার্ফুর সন্ধেবেলা শঙ্খধ্বনির বিজ্ঞানগ্রাহ্য যুক্তি খোলসা করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, শঙ্খধ্বনি জীবাণুমুক্ত করে… ইত্যাদি ইত্যাদি। সরলমতি ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ, ট্রোল হবেন জেনেও তিনি বলতে পারেন, ‘আমি জানি একটু পরেই এসব নিয়ে হাসাহাসি শুরু হবে। সে হোক ওদেরও তো কাজ দরকার।’ আসলে ‘ত্বয়া হৃষিকেশ হৃদিস্থিতেন…।’ তিনি যা বলাবেন, তিনি যা করাবেন—, দিলীপবাবু নিমিত্তমাত্র। একটা কথা, ওই যে ভেবেছিলাম, প্রধানমন্ত্রী মোদি মহাশয়ের সঙ্গে হয়তো ওঁর বাতচিত হয়নি, ওটা নিশ্চিত ভুল। কেননা, ইকনমিক টাইমস-এর খবরে দেখছি মোদি-অমিত জুটির রাজ্য গুজরাটে দুধের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিক্রি হচ্ছে গোরুর মুত। গুজরাটের রাষ্ট্রীয় কামধেনু আয়োগের চেয়ারম্যান বল্লভ কাঠারিয়া জানাচ্ছেন গুজরাটে গোরুর মুতের বিক্রির পরিমাণ দিনে ৬ হাজার লিটার। একেবারে খোলামেলা বিজ্ঞাপন দিয়ে। দুর্গা আয়ুর্বেদিক ফার্মেসির গোমূত্র ১৫০ টাকা লিটার। দীপবিজয় প্যাকেজিং ইনডাস্ট্রিজের ৫০ মিলি-র দাম ১০ টাকা। কৃষ্ণার ইন্ডিয়ান গোমূত্র আরক (আয়ুস্কাল ১২ মাস) ৫০০ সিসি ১৯০ টাকা। আহমেদাবাদের মনিনগরের এস কুমার ট্রাস্ট বিজ্ঞাপন দিয়েছে ফিল্টার করা গোমূত্রের যা নাকি অন্তত ৬০ থেকে ৭০ রকমের অসুখ সারাবে, যার মধ্যে কী নেই! আছে ক্যান্সার, অ্যাজমা, জয়েন্ট পেইন, কিডনির রোগ, ইনফ্লুয়েঞ্জা। এদিকে আবার অনন্য হেলথকেয়ার বের করেছে ‘অনন্য কাউ ইউরিন পাউডার ট্যাবলেট’। গুজরাটের গ্রামের মানুষ বা দলিত শ্রেণির অবস্থা যতই শোচনীয় হতে থাকুক এ রাজ্যের নরেন্দ্র মোদি-সহযোগী আদানি-আম্বানি-অমিত শাহ-জয় শাহরা কি এমনি এমনি বিলিয়নার বা ট্রিলিয়নার হচ্ছেন?
ওদিকে দিল্লিতে আবার হিন্দু মহাসভার এক স্বামী চক্রপাণি তুলকালাম কাণ্ড করে এক ‘গোমূত্র পার্টি’ দিয়েছেন। ১৪ মার্চ সেখানে ঢাকঢোল বাজিয়ে পূজা-অর্চনা করে পুজোশেষে মাটির ভাঁড়ে করে প্রসাদ হিসাবে উপস্থিত শতাধিক পূণ্যার্থী ও করোনাভীত গোমাতার সন্তানকে গোরুর ‘পেচ্ছাব’ খাইয়েছেন। আমাদের বাংলার প্রণম্যপুরুষ দিলীপ ঘোষের মতো ইনিও পুরাণপণ্ডিত। এঁর এই ‘গোমূত্র পার্টি’তে যজ্ঞানুষ্ঠানের সঙ্গে পূজা হয়েছে ‘করোনা জীবাণু’রও। হ্যাঁ এঁদের কাছে কোভিড-১৯ কোনও ভাইরাস নয়, জীবাণু। যজ্ঞানুষ্ঠানের ব্যাকগ্রাউন্ডের পর্দায় ছিল দেবতা ‘করোনা জীবাণু’ রূপ নরসিংহের ছবি। স্বামী চক্রপাণির মতে কোভিড-১৯ আসলে এক অবতার। উনি মর্তে এসেছেন আমিষাশীদের শাস্তিদানের উদ্দেশ্যে। এই স্বামী চক্রপাণি আবার গোটা পৃথিবীকে বাঁচাতে চান। সর্বশক্তিমান ‘তিনি’ যেহেতু শুধু ভারতীয় গোরুর পেচ্ছাবে থাকেন, হ্যাঁ ইউরোপ-আমেরিকার গোরুর ভিতর যহেতু ‘মাতা’ নেই, স্বামী চক্রপাণি তাই ভারতের বাইরের দেশগুলিতে এই পবিত্র ভারতীয় গোমাতার পেচ্ছাব রফতানি করতে চান। অর্থাৎ তিনি আর এক বাবা রামদেব হত চান। উদ্দেশ্য মহৎ।
ভলতেয়ার বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর একজন কমেডিয়ান, কিন্তু তিনি এমন একদল দর্শকদের সামনে তাঁর রঙ্গতামাশা প্রদর্শন করছেন যারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে হাসতে ভুলে গেছে।’ পৃথিবীতে এখন কিন্তু ঈশ্বরের ভূমিকায় ঈশ্বরের সন্তানরাই কমেডিয়ানের রোলে নেমে পড়েছেন। তাঁরা এখন ঢাল-তলোয়ার নিয়ে ঈশ্বরের হয়ে যুদ্ধে নেমে পড়েছেন। এবং ঠিক ঈশ্বরের কমেডির ক্ষেত্রে যা হয়েছিল, অর্থাৎ দর্শককুল ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে হাসতে ভুলে গিয়েছিল, এই দিলীপ ঘোষ বা স্বামী চক্রপাণি বা মামুন মারুফ বা মুফতি কাজী ইব্রাহিমের বেলাতেও তাই হয়েছে। কেননা, এরা রীতিমতো কেউ শাসক দলের সাংসদ, কেউ বা বিপুল জনপ্রিয় ধর্মীয় নেতা— ভবিষ্যতের হর্তা-কর্তা-বিধাতা। সন্ত্রস্ত না হয়ে উপায় আছে?
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মানুষ নিজেকে ঈশ্বরের কেউ পুত্র, কেউ বা বার্তাবাহক কেউ বা আবার অবতার হিসাবে জাহির করে পৃথিবীর মানুষকে উদ্ধার করতে এসেছেন। সৃষ্ট মানুষের অধঃপতন দেখে ঈশ্বর নিজেই স্তম্ভিত হয়ে গেছেন। তখন তিনি তাঁর একেবারে কাছের কোনও একজনকে বা তাঁর সৃষ্ট সর্বোত্তম গুণের অধিকারী মানুষকে, হতে পারেন তিনি পুত্র যীশু বা নবি হজরত মহম্মদ বা হতে পারেন তিনি রাম বা কৃষ্ণ বা বুদ্ধ বা রামকৃষ্ণ বা বিবেকানন্দও হতে পারেন— পৃথিবীতে পাঠাবেন। ঈশ্বরের হয়ে এঁরাই ‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত। অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্॥ পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাং। ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে॥’ এবং এই সব অবতার, ঈশ্বরের পুত্র বা বার্তাবাহকদের পৃথিবীতে আসার পর মানুষের আর কী কাজ রইল? কিছুই না। মানুষের কাজ শুধু তাঁদের কাছে নিজেদের সমর্পণ করা। স্থানে স্থানে এঁদের নামে মঠ-মন্দির-মসজিদ স্থাপন করে এঁদের নাম জপ বা এঁদের নির্দেশিত পথ অবলম্বনে এদের এক-একজনের (সেই পুত্র, বার্তাবাহক বা অবতারের) প্রভাবের পরিসর বাড়ানো। আরও অনেক মানুষ, অনেক রাজ্য, অনেক সম্পদ আহরণের চেষ্টা করা। কেননা ঈশ্বর জাঁকজমক চান। তনি মানুষকে সন্ত্রস্ত দেখতে চান। তাঁর কথার এতটুকু হেরফের তিনি সহ্য করেন না। ‘আমাকে, শুধু আমাকেই, আমার একত্বকেই তুমি বিশ্বাস কর।’ তাহলেই ‘রণে বনে জলে জঙ্গলে তোমাকে রক্ষা করব।’ ‘লা ইলাহ ইল্লা আল্লাহ মহম্মদ রসুল আল্লাহ।’
করোনা বা প্লেগ বা কালাজ্বর বা কলেরার মতো কোনও মহামারি বা অতিমারি এলেই অবশ্য সমস্যা তৈরি হয়। মানুষ আর পুরোপুরি ‘তাঁর’ উপর বিশ্বাস রাখতে পারে না। মানুষ তখন হাসপাতালের দোরগোড়ায়। পাদ্রি বলুন আর মৌলবী বা পুরোহিত সবাই তখন অস্তিত্বের সীমানায়। তখন ভ্যাটিকান বন্ধ হয়, বন্ধ মক্কা-মদিনা, বন্ধ বেলুড় মঠ, মায়াপুর, সোমনাথের মন্দির। বলা হয় আর এখানে আসতে হবে না। বলা হয় এখন হাসপাতাল, এখন ডাক্তার। এখন শুধুই চিকিৎসাবিজ্ঞান। এমন ভয়ঙ্কর এক সঙ্কটে কি তাহলে ঈশ্বরের করার নেই কিছু? ঈশ্বরের এই অসহায়ত্ব একবার ছড়িয়ে পড়লে মানুষ কি আর কোনও দিন মঠ-মন্দির-মসজিদ-গীর্জা মুখী হবে? তাহলে যাঁরা ঈশ্বরকে দেখিয়ে বছরের পর বছর রাজনীতি বা ধর্মনীতি করে খেলেন তাঁদের কী হবে? এবার তাঁরা তাই আপ্রাণ চেষ্টা করেন এটা দেখাতে যে এটা আসলে এক শাস্তি। মানুষের বহু দিনের জমা পাপের এই শাস্তির কথা ‘তিনি’ তাঁর নির্দেশনা দেওয়া বেদ-গীতা-বাইবেল-কোরান বা হাদিসে অনেক অনেক আগেই বলে গেছেন। আর তাই দিলীপ ঘোষ বা স্বামী চক্রপাণি বা মুফতি কাজী ইব্রাহিমের বেদ-গীতা-পুরান বা কোরান-হাদিসের কথা বলতে হয়। কিন্তু শুধু কি দিলীপ ঘোষ বা স্বামী চক্রপাণি বা মুফতি কাজী ইব্রাহিম? তা কেন হবে, ধর্ম দেখিয়ে ঈশ্বরের নামে জীবিকা বা সামাজিক প্রাধান্য অর্জনের সহজ উপায় রাজনীতি বা ধর্মনীতির পথের পথিক সেই আদিকাল থেকেই একেবারে গণনার অতীত। আর এবারের এই করোনা এদের সবার অস্তিত্বকেই একেবারে অস্থির করে তুলেছে। মানুষ আবার শয়তানের খপ্পরে পড়বে না তো!
দক্ষিণ কোরিয়ায় ৭ মার্চ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৬৭৬৭, তার শতকরা ৬৩.৭ ভাগই দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের শহর ডেইগু-র শিঞ্চিওনজি চার্চ অব জেসাসের সঙ্গে যুক্ত। চার্চের প্রতিষ্ঠাতা ও ধর্মীয় নেতা লি মান হি এক সাংবাদিক সম্মেলনে একেবারে হাঁটু গেড়ে সবার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি বলেন তাঁর এই কাজ ইচ্ছাকৃত নয়। তাঁর অনুগামীরা করোনায় সংক্রমিত হয়েছিলেন, আর তিনি সম্মিলিত প্রার্থনার মাধ্যমে এই সংক্রমণ রোধ করতে চেয়েছিলেন। ৮৮ বছর বয়সের এই ধর্মগুরুর ধারণায় প্রার্থনা করলেই বিশ্বপিতা তাঁদের করুণা করবেন, আর বিশ্বপিতার করুণায় সব রোগাক্রান্ত মানুষই ভাল হয়ে যাবে। কিন্তু যা হয়েছে, তা হল দলবদ্ধ প্রার্থনার ফলে সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। কিন্তু লি মান হি-র আর দোষ কোথায়, তাঁর বিশ্বপিতার সর্বাধিক প্রিয় পুত্র অনেক আগেই মৃত বালিকার জীবনদান করেছেন, জলের উপর দিয়ে হেঁটেছেন। আর বেশি কী, এই কিছু বছর আগে ভারতের সন্ত মাদার টেরেসা ক্যান্সারাক্রান্ত মানুষের শুধু স্পর্শ করে ক্যান্সার সারিয়েছেন।
এবার আসি ইতালির সেই মামুন মারুফের গল্পে। ‘চন্দ্রবিন্দুর চ, বেড়ালের তালব্য শ, রুমালের মা— হল চশমা।’ মনে পড়ছে? হ্যাঁ, সুকুমার রায়ের সেই হ য ব র ল। এবার আসুন একটা ফর্মুলায়। 1.Q(7)+6=13। বুঝলেন কিছু? বুঝলেন না তো! বুঝতে হলে আমাদের যেতে হবে সেই মুফতি ইব্রাহিম কাজীর কাছে। আর এক স্বপ্ন ব্যাখ্যাকার মুফতি ইউসুফ মহম্মদের কথায়, এই মুফতি ইব্রাহিম কাজী নাকি বাংলাদেশে প্রবল জনপ্রিয় ও বিশাল পণ্ডিত। হাজার হোক ইতালির সেই স্বপ্ন-দেখা মামুন মারুফ প্রথমে তার কাছেই ফোন দেওয়ার চেষ্টা করেন। এবার দেখা যাক কী বলেন মুফতি ইব্রাহিম কাজী। মুফতি ইব্রাহিম কাজী জানিয়েছেন, একবার নয় উনি কয়েকবার করে সেই স্বপ্নের বিবরণ শুনে নিয়েছেন ইতালির মামুন মারুফের কাছ থেকে। তিনি জানিয়েছেন, ‘সে (ইতালির মামুন মারুফ) বলল, আমি রাত বারোটার দিকে বাসায় গিয়ে ঘুমোতে যাই, ঘুমিয়ে পড়লাম, দেখি যে কদম ফুলের মতো করুনা (উচ্চারণ মুফতি ইব্রাহিম কাজীর) ভাইরাস, করুনা ভাইরাসকে দেখতে অনেকটা গোলাকার কদম ফুলের মতো কাটা কাটা। কদম ফুলের মতো সেই ভাইরাসটা তার (মামুন মারুফের) সামনে আসল।’ এরপর মুফতি ইব্রাহিম কাজী জানিয়ে দেন, এটা তাঁর (মামুন মারুফের) স্বপ্ন, কোরানও নয়, হাদিসও নয়। তাঁর কথায়, স্বপ্ন সত্যিও হতে পারে আবার মিথ্যাও হতে পারে, তবে কেয়ামতের আগের মোমিনদের দেখা স্বপ্নগুলো যেহেতু সত্য হবে বলে ডাইরেক্ট হাদিসে সার্টিফাই আছে, অর্থাৎ কেয়ামতের আগে মোমিনদের স্বপ্ন সহজে মিথ্যা হবে না। ‘সে (মামুন মারুফ) বলছে, সেই ভাইরাসটা তাঁর সঙ্গে কথা বলছে, কয় যে, আমি (মামুন মারুফ) তাকে প্রশ্ন করলাম, তোমরা পৃথিবীতে কখন এসছ? সে (করুনা ভাইরাস) বলল ২৩ অক্টোবর চিনে আমরা এসেছি, যখন আয়েশা নামের এক মুসলিমা মেয়েকে তিনজন চাইনিজ সৈন্য ধর্ষণ করে, এবং সে ধর্ষণে সে (আয়েশা) নিহত হয়। আয়েশা চিৎকার করলে তাঁর মুখ সিলাই করে দেওয়া হয়। দুই জন সৈন্য পাহারায় থাকে আর ধর্ষণ করে তিন জন। তখন আল্লাতালা ভাইরাসকে— করুনা সোলজার্সকে কমান্ড করলেন, তোমরা যাও, ওদেরকে আক্রমণ কর। উইঘুররা চিনে ভয়ঙ্কর নির্যাতিত। আর ওদের ডাইরেক্ট যত আর্তনাদ, চিৎকার সরাসরি আল্লার সঙ্গে। ওই আয়েশা নামের মেয়ের ধর্ষণজনিত হত্যাকাণ্ডের পরে আল্লাতালা করুনাকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাও, এবার প্রতিশোধ নাও। এরপর কাজী ইব্রাহিম জানান তাঁর (মামুন মারুফের) স্বপ্নের বর্ণনার এই ডিজাইনটা আমার কাছে সত্য বলে মনে হচ্ছে।
চিনে করুনার সংক্রমণের কারণ তাহলে জানা গেল, এবার আসা যাক সেই ফর্মুলায়। নিরাময় কী, একটা প্রশ্ন ছিল, (সেই ভাইরাস) উত্তর দিয়েছিল, 1.Q(7)+6=13। আল্লার পাঠানো করুনা ভাইরাসের নিজের মুখে বলা এই ফর্মুলার ব্যাখ্যা দিয়েছেন মুফতি কাজী ইব্রাহিম। তার নিজের কথায়, তিনি এই সূত্রটার ব্যাখ্যা দিচ্ছেন কোরান আর হাদিস থেকে। যদিও উনি জানিয়েছেন বাংলাদেশের খুব একটা ভয় নাই, কেননা, ওরা বলেছে যারা আল্লাবিরোধী কোরানবিরোধী আমরা (তাদের) ছাড়ব না। যুগে যুগে আল্লাতালা এইসব মহামারি দিয়েছেন ইমান আনাবার জন্য, মানুষকে ইসলামমুখী করাবার জন্য। অর্থাৎ আল্লাকে যে বা যারা শরণ নিয়েছে তার বা তাদের ‘করুনা’ ভাইরাস থেকে কোনও ভয় নাই। (প্রসঙ্গত, মনে করুন গীতায় অর্জুনকে বলা শ্রীকৃষ্ণের কথা, ‘সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং রজ/ অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামী মা শুচঃ।’)
এবার সেই 1.Q(7)+6=13 সূত্রের ব্যাখ্যা। 1 মানে, এক আল্লার প্রতি ইমান। ডক্টর খারুক নূর বাকী আরব জাহানের এক ডক্টর তাঁর বইয়ে লিখেছেন, আল্লার প্রতি ইমান থাকলেই ফিফটি পারসেন্ট ব্যাধি থেকে মানুষ মুক্তি পাবে। এরপর Q মানে কোরান, 7 মানে সাত আয়াতবিশিষ্ট সুরা ফতেহা। সুরা ফাতেহা সাতবার পড়ে ফুঁ দিতে হবে। সুরা ফাতেহার মধ্যে সকল রোগের নিরাময় রয়েছে। ওঁর ব্যাখ্যায় চিকিৎসা নয়, চিকিৎসায় নিরাময় হতেও পারে না হতে পারে, কিন্তু কোরান চিকিৎসা নয়, কোরান ডাইরেক্ট নিরাময়। এবার 6, ছয়ের মধ্যে আছে ডুমুর, অলিভ, কালোজিরা, মধু, আজোয়া খেজুর ও সবকিছুর উপরে থাকবে হিন্দুদের যেমন গঙ্গার জল, ইসলামের তেমনি জমজমের পানি। সবশেষে কাজী সাহেব বললেন, স্বপ্নে যা বলা হয়েছে তা উনি বলেননি, উনি ব্যাখ্যা করেছেন কোরান ও হাদিস মতো করে। কাজী ইব্রাহিমের কথায় কেয়ামতের আগের মোমিনদের দেখা স্বপ্নগুলো সত্য হবে বলে ‘ডাইরেক্ট’ হাদিসে ‘সার্টিফাই’ আছে, অর্থাৎ কেয়ামতের আগে মোমিনদের স্বপ্ন সহজে মিথ্যা হবে না। এখন একই যুক্তিতে মামুন মারুফকে যথার্থ মোমিন ধরলে বলতেই হয়, কেয়ামত তার মানে একেবারে অতি সন্নিকট। আর কেয়ামত সন্নিকট হলেই আসবে শেষ দিনের সেই বিচার। আর কে না জানে শেষ দিনের বিচারের আগে বাদি বা বিবাদির মধ্যে রায় জানার আগ্রহ চরমে পৌঁছে যায়। অর্থাৎ মানুষকে শেষ বারের মতো মন্দির-মসজিদ বা গীর্জার মাহাত্ম্য বোঝাবার শেষ চেষ্টা করতে হবে। অর্থাৎ মৃত্যুর পর আপনার-আমার ভাগ্যে হুরি-পরী আর মোতি-সদৃশ বালকেরা (মনে রাখতে হবে জান্নাতী মহিলারা স্বামীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার পরও কুমারী থাকে।) থাকবে না কি জাহান্নমের আযাব থাকবে। হ্যাঁ, যেখানে জাহান্নমীদের চামড়া যখন জ্বলবে সেখানে আবার চামড়া লাগিয়ে দেওয়াও হবে অনন্তকাল ধরে। হিন্দু-মুসলমান বা যে কোনও ধর্মের স্বর্গ আর নরক একই, আর তা লাভ করতে হলে যেতে হবে মৌলবী হুজুর মুফতি কাজী ইব্রাহিমদের বা পুরোহিত-ব্রাহ্মণদের আর স্বামী চক্রপাণি বা দিলীপ ঘোষদের কাছেই।
বলা যায় মৃত্যুভয়ে পলায়মান ঈশ্বরকে বাঁচানোর কত না চেষ্টা! কিন্তু ‘তিনি’ কি বাঁচবেন? ফিরে আসতে পারবেন আবার? হয়তো আসবেন। ভলতেয়ার বলেছিলেন, ‘অজাচারী মিলন থেকে তৈরি হয় ঈশ্বরের হাজারটা রূপ, এরপর ঈশ্বরকেই খাওয়া বা পান করা, এরপর আর কী, হাগো বা মোতো সেই ঈশ্বরকেই।’