এ অবরোধে রবে কে

যশোধরা রায়চৌধুরী

 




লেখক কবি,গদ্যকার ও গল্পকার।

 

 

১১ মার্চ বুধবার ২০২০

আজ কলকাতা থেকে ভুবনেশ্বর ফিরলাম। প্লেনে অনেকে মুখোশ পরে আছে। আমিও মুখোশ পরেছিলাম, আগের দিনও পরেছিলাম। এয়ারপোর্টের সিটে বসলাম কিন্তু না বসাই ভাল বলে মনে হচ্ছিল। এয়ারপোর্টে বেশি ভয়, প্লেনে ১০০ শতাংশ বাতাস রিসাইকল করা হয়। প্রচুর ছেলেমেয়ে, তরুণ তরুণী সবাই বকরবকর করছে, মুখে মুখোশ।

বিদেশ থেকে আসা ফ্লাইটগুলোর যাত্রীদের সঙ্গে এই ডোমেস্টিক ফ্লাইটের যাত্রীদের কতটা ছোঁয়াছুঁয়ি হয়? হচ্ছে? কে দেখছে? করোনা নিয়ে যত লেখা পড়ছি এই সাংঘাতিক ছোঁয়াচে ব্যাপারটাই আর অচেনা ভাইরাস নিয়ে ভীতিটাই চোখে পড়ছে।

১৬ মার্চ সোমবার ২০২০

দ্রুত পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। উড়িষ্যায় একটি কেস পাওয়া গেছে। অসংখ্য লেখা, অসংখ্য আর্টিকল, ভিডিও, সব করোনা বা কোভিড নিয়ে, পড়ছি, দেখছি, ফেসবুকে হোয়াটস্যাপে কাগজে। আমার বর পর পর দু উইকেন্ড বাড়ি যেতে না করেছে। তাই টিকিট কাটিনি আগে থেকে। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।

গোছা গোছা ভারতীয় ছেলেমেয়ে বিদেশ থেকে ফিরে আসছে, কোয়ারান্টাইন না করে ভিড়ে মিশে যাচ্ছে। আমার সহকর্মী বিভুদত্তকে আমরা অনেক বলেকয়ে বুঝিয়েছিলাম। সে নিজেও বুঝেছিল। গত ৮ তারিখ তার ইউরোপ সফর আধখানা রেখেই সে ফিরেছে। ইতালিতে মিলান ও রোম যাবার কথা ছিল। মিলানে প্রথমে, পরে রোমেও কোভিডের মিছিল শুরু হয়ে গিয়েছে। গোটা ইতালি চোখের সামনে লকডাউনে চলে গেল। বিভুদত্ত টিকিট ক্যানসেল করে তাড়াতাড়ি ফিরে এল। এখন বাড়িতেই আছে। আমি বার বার করে বলেছিলাম যেন হোম কোয়ারান্টাইন করে। তবু পরশু, শনিবার অফিসে হাজির হয়েছিল। আজ সোমবার ওর জয়েন করার কথা। তবে দু সপ্তাহ হোম কোয়ারান্টাইন করার কথা। তাই ও এ সপ্তাহটা বাড়িতে ফাইল নিচ্ছে। সেটাও কি খুব যুক্তিযুক্ত?

১৭ মার্চ মঙ্গলবার

এখন প্রয়োজন বাস্তববুদ্ধির। স্যানিটাইজ়ারের থেকেও। মাথাটা ঠান্ডা করে হাতে সাবান দিতে যে কুড়ি সেকেন্ডের ধৈর্য, তাও আমাদের আছে কি? প্রতি মুহূর্তে করোনাভাইরাস নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে আর ফেসবুকে রাশি রাশি তথ্য, সত্য, মিথ্যা, ঝাঁপিয়ে পড়ছে মাথার ওপর। আর সেই সব ছবি ভিডিও, কথা, হজম তো হচ্ছেই না, মাথা জ্যাম করে দিচ্ছে। কেউ গ্রীষ্মের রোদ্দুরে করোনা মরবে, এই আশায় বাঁচছেন। কেউ পানীয়-উৎসব করে ছোট গ্লাসে গ্লাসে গোমূত্র খাইয়ে বলছেন, সেই অমৃতই করোনা থেকে বাঁচাবে…

১৮ মার্চ বুধবার

ইটালি ফ্রান্স স্পেনে অসংখ্য মৃত। চিনে, জাপানে, কোরিয়াতে নৃত্য করে ভাইরাস ইউরোপে ঢুকেছে, ইরানে ঢুকেছে। লন্ডন লকডাউনে। লন্ডনে আমার আশি বছর বয়সি আত্মীয়া এখন সেল্‌ফ আইসোলেশন করছেন, মানে বাড়িতে তিনি একা, কোনও মানুষের প্রবেশ নিষেধ। ইটালির ভিডিও আসছে, খেলা গান পানশালাপ্রেমী ইটালীয়েরা জানালা থেকে জানালায় আড্ডা জমাচ্ছেন যে যার বাড়ির চৌহদ্দিতে। গান গাইছেন জোরে। টুরিস্টপ্রিয় শহর রোম শূন্য, সুনসান, মৃত্যুপুরী ভেনিস।

সারা বিশ্ব লকডাউনে। এ যেন ভুবনায়ন বা গ্লোবালাইজেশনের অভিশাপ। এ যেন, চোখের পলকে নেটে টিকিট কেটে বিশ্বভ্রমণ করে আসার হাতছানির উল্টোপিঠ। এ যেন, কোরিয়ার মানুষের চিনে কাজ শিখে ব্রিটেনে কাজ করে আমেরিকায় বেড়াতে গিয়ে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মানুষের প্রেমে পড়ার বিপরীত। সবচেয়ে কাছের মানুষটির ছোঁয়াও এখন বিষবৎ। ইতালিতে ডাক্তাররা খুঁজে ফিরছেন কে সেই পেশেন্ট জিরো। যার থেকে প্রথম করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে! অসম্ভব এই খুঁজে পাওয়ার অভিলাষ।

সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং বলে একটা ভৌতিক জিনিস করতে হবে ভারতে, সংক্রমণ স্টেজ টু থেকে স্টেজ থ্রি-তে যাতে না যায়। এখনও অব্দি ভারতের প্রতিটি রুগির বিদেশে যাবার ইতিহাস খুঁজে পাওয়া গেছে। অথবা বাড়ির অন্য কোনও সদস্যের বিদেশে যাওয়ার ইতিহাস।

অপরিচিতকে ভাইরাসটা দান করার সম্ভাবনা কতটা, কীভাবে ছড়াতে পারে রোগ, আর না ছড়াবার জন্যই একমাত্র নিদান, লকডাউন, ভিড় কমানো, ঘনসন্নিবদ্ধভাবে মানুষ যেখানেই, সেখান থেকে মানুষ সরানো। ফাঁকা করে দেওয়া। ব্রেক দ্য চেইন। কাতারে কাতারে লোক যাতে না মরে।

করোনার পদধ্বনি এগিয়ে আসছে ভারতে। স্কুল কলেজ বন্ধ। ছেলেমেয়েদের ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছে সব কলেজ ইউনিভার্সিটি, উড়িষ্যার সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হল। প্রাইভেট সেক্টরগুলো, বিশেষত মুম্বই এবং বেঙ্গালুরু হায়দ্রাবাদে, ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছে।

পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্যে তাতে কীই বা হবে? ট্রেনে বাসে কিলবিল করছে লোক। আর ভিন প্রদেশে, কেরল বা কর্নাটকে বা মহারাষ্ট্রে যেখানে রোগ ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে, সেখান থেকে রোগের স্পর্শ নিয়ে বাঙালি শ্রমিক তো এবার ট্রেনে চেপে বাংলায় ফিরছে। তারা কি জন্ম দেবে করোনার তৃতীয় তরঙ্গের? ভাবতেও বুক কাঁপে।

আমাদের আপিসে গত শনিবার থেকে বায়োমেট্রিক অ্যাটেন্ডেন্স তুলে দেবার আর্জি আসতে শুরু করল। আঙুলের ছাপ, একজন দেবার পর অন্যজন সেখানেই দেন। একেবারে রোগের আঁতুড়ঘর হতে পারে তো। আমরা সোমবার সার্কুলার বের করলাম। ইতিমধ্যেই উড়িষ্যা সরকার বায়োমেট্রিক অ্যাটেন্ডেন্স তুলে দিয়েছে। আমরা কেন্দ্র সরকার, আমাদের সব দিল্লির মুখাপেক্ষী থাকা। আমরা উড়িষ্যা সরকারকে অনুসরণ করার তিনদিন পর ডিওপিটির অর্ডার এল। দিল্লির সব মিনিস্ট্রিতেও সোমবার থেকেই বায়োমেট্রিক বন্ধ। এবার আমাদের ক্যাগ আপিস সেই অর্ডার আমাদের জন্য বহাল করলেন। আমার তো আগেই কাজ সারা।

উত্তেজনা, চাপা ফিসফাস। সারা অফিসে কাগজ চিপকে দেওয়া হয়েছে, ১৭ থেকে তিন দিন ধরে অফিসের সামনে হাত ধোওয়া ও অন্যান্য কী কী করণীয় তার ট্রেনিং দিচ্ছে রেড ক্রসের টিম। বেশ কিছু হ্যান্ড স্যানিটাইজার আনা হয়েছিল সেগুলো নিমেষে শেষ। আমরা সেই টিপিকাল সরকারি আপিসের সাদা তোয়ালের পাট তুলে দিলাম। টিসু দিয়ে হাত পুঁছে টিসু ফেলছি। দিনে দশবার হাত ধোয়া আর চোদ্দবার স্যানিটাইজার লাগানো কাঁহাতক করা যায়, কে হেঁচেকেশে কোন ফাইল পাঠাল কে জানে বাপু।

আপিসে দুদিন সকালের দিকে গেলামই না। বিশেষত অস্বস্তি ওই ফাইলপত্র নিয়েই। শুনলাম আপিসের এক বাবু তিনি রোজ আপিসে আসছেন। এদিকে ছেলে কুয়েত থেকে চারদিন আগে জ্বর নিয়ে ফিরেছে। প্লেন থেকে নামার আগে প্যারাসিটামল খেয়ে নিয়েছিল। তাই এয়ারপোর্টে কোনও স্ক্রিনিং-এ ধরা পড়েনি। বাবাটি আদৌ ছেলেকে আলাদা রেখেছেন কিনা কে জানে।

চা, জল এগুলো যে ছেলেরা দেয় তাদের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করতে খারাপ লাগে। তবু সরাসরি বোতল থেকেই জল খাচ্ছি। চা চাইছি না। এত মানুষের হাতের স্পর্শ অনায়াসে আমাদের মুখে ঠোঁটে লাগতেই থাকবে অফিস গেলে। ওয়ার্ক ফ্রম হোমের দাবি গুনগুন করছে অফিসময়।

আবার বন্ধুদের কেউ কেউ এরই ভেতর বেড়াতেও গেছে। কী সাহস! খুব রটনা, যে কোনওদিন ডোমেস্টিক এয়ার ট্র্যাভেল বন্ধ হবে। আন্তর্দেশীয় এয়ার ট্র্যাভেল বন্ধ হয়ে গেল। অসংখ্য ভারতীয় নানা বিদেশি এয়ারপোর্টে আটকে গেলেন অনির্দিষ্টকালের জন্য। আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর মেয়ে লন্ডনে লকডাউনে। ইউকে-তে ছড়াচ্ছে রোগ খুব দ্রুতহারে। অথচ ওর রেশন নেই যথেষ্ট। অন্য এক বান্ধবী জানাল আমেরিকা থেকে ছেলে ফিরতে পারেনি, অন্য শহরে অন্য বান্ধবীর বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছে।

১৯ মার্চ বৃহস্পতিবার

ভারতে ৪ মৃত্যু। ১৭৪ আক্রান্ত। বাংলায় দুজনের ধরা পড়েছে। তার ভেতরে একজন, বিসিএস-এর উচ্চপদস্থ অফিসার ভদ্রমহিলার পুত্র। তিনি সোজা ছেলেকে জ্বরাক্রান্ত অবস্থায় নিয়ে নবান্ন চলে গিয়েছিলেন। স্বাস্থ্য দপ্তরের জরুরি মিটিং করেছেন। পরে ছেলের করোনা পজিটিভ বেরিয়েছে। নবান্ন ধোয়াধুয়ি চলছে টিভিতে দেখাল। স্বাস্থ্য সচিব আলাপন ও তাঁর স্ত্রী সোনালি হোম কোয়ারান্টাইনে চলে গেলেন।

আমার তো সেই ১১ থেকেই সেলফ আইসোলেশন চলছে। একা একা অসহ্য টেনশনে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী রাত আটটার ঘোষণায় ধামাকেদার “জনতা কার্ফু”-র ঘোষণা করলেন। ২২ তারিখ রবিবার সারাদিন সবাই বাড়িতে থাকবে।

ফেসবুকে নিন্দার ঝড়। একদিনের কার্ফুতে কী সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং হবে! মনে হচ্ছে এটা টেস্ট কেস। এর পর আসল কার্ফু আসবে।

আপিসে দিল্লি থেকে অর্ডার এল ৫০ শতাংশ কর্মীকে নিয়ে কাজ চালাতে হবে। সেই অনুযায়ী রোস্টার তৈরি হচ্ছে। মনের অবস্থা খুব খারাপ। এত অনিশ্চয়তা, এত ভয়, এত রকম ভাবনা, অফিসে কীভাবে সব চলবে, চালানো হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা।

 

২০ মার্চ শুক্রবার

উড়িষ্যাতে নবীন পট্টনায়ক লকডাউন অর্ডার আনলেন। বেশ কিছু জেলার নাম দিয়ে বলা হয়েছে ৩০০০ ছেলেমেয়ে বিদেশ থেকে এসেছে। এদের সবার হোম কোয়ারান্টাইন এবং সোশাল আইসোলেশনের জন্য এই লকডাউন অর্ডার। ভাষা বেশ জোরালো।

সারাদিন ফোন আসতে লাগল আপিস থেকে। এই অর্ডারে বলা হচ্ছে ১০ শতাংশ স্টাফ দিয়ে কাজ করাতে হবে। প্রত্যেককে আলাদা পাস দিতে হবে। স্কেলিটার স্টাফের তালিকা পাঠাতে হবে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ও পুলিশের কাছে।

ছুটির দিন বলে বোঝা যাচ্ছে না। সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে নিতে জেরবার। বাড়িতে বসেই, কিন্তু আপিস যেন ঘাড়ে এসে পড়েছে।

হোয়াটস্যাপ গ্রুপে ডাক্তার বন্ধুরা একইরকম উদ্বিগ্ন ব্যতিব্যস্ত, প্রবলভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে হাসপাতালগুলোকে কোভিড পেশেন্টের সম্ভাব্য আইসোলেশন ওয়ার্ডে পরিণত করার। এই বান্ধবী প্রাইভেট হাসপাতালে আছে। কিন্তু এখন সরকারি নির্দেশিকা বলবৎ। এইসব নিয়ে সূক্ষ্ম চাপা টেনশন। সেবক ও ডাক্তারদের পিপিই বা পার্সোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্টই যথেষ্ট পরিমাণে নেই।

 

২২ মার্চ রবিবার

জনতা কার্ফুর দিন। সকালটা ভরে গেছে শুধু কোকিলের ডাকে। কানে এসে লাগে গাড়িঘোড়া না থাকার অপার্থিব নিঃশব্দতা। পাখির ডাক অনেক দিন পর যেন সে অর্থে শোনা গেল। শোনা হল আমাদের।

অবরোধ মানুষের আনা, কিন্তু মানুষের এযাবতকালের পাপকর্মগুলোকে যেন শোধন করছে এই অবরোধ। এমনই এক সদর্থক চিন্তা উদ্ভূত হল আমাদের সেইদিন সকালে। যখন পিউ পিউ পাপিহার ডাকে ভরে উঠল চরাচর, যখন অসম্ভব আলোড়ন উঠল গাছে গাছে। ঘুঘুর ডাকে ভরে গেল দুপুর।

এ কি তবে প্রকৃতির প্রতিশোধ? ফিরে আসছে প্রাকৃতিক জীবন? লও এ নগর। দাও ফিরে সেই গাছের তল, বনের ফল, ঝরনার জল। শুকনো কাব্যিকতা, না প্যারাডাইম শিফট?

দুপুর বিকেল থেকে শান্তি সম্পূর্ণ বিগত। ফোনের পরে ফোন। আগামীকাল কীভাবে আপিস হবে তার কথা কেবল। তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে খবর এল মমতা ব্যানার্জি লকডাউন অর্ডার এনেছেন সোমবার বিকেল থেকে।

উড়িষ্যায় কিন্তু লকডাউন রবিবার ২২ থেকেই শুরু হয়ে গেছে। আমি ভাবলাম হোয়াট উড়িষ্যা থিঙ্কস টুডে, বেঙ্গল থিঙ্কস টুমরো? আসলে তখনও বুঝিনি ব্লুপ্রিন্ট তৈরি হচ্ছে দেশময় অবরোধের আর দুদিন পর থেকেই। তখনও জানিনি প্রতি রাজ্য আলাদা আলাদা করে অর্ডার আনছেন লকডাউনের, সেও এক গ্র্যান্ড প্ল্যানেরই অংশ।

নবীনবাবুর প্রশংসায় আমি পঞ্চমুখ, উনি ফণীর সময়ে হাতজোড় করে লোকেদের তটভূমি থেকে সরিয়ে এনেছিলেন। এবারও পেরে যাবেন। সকাল থেকে পুলিশে ছয়লাপ। কোনও গৃহকর্মী এল না। শুনলাম রাস্তায় রাস্তায় বিশাল করে বাঁশ বেঁধে রাস্তা বন্ধ করা হয়েছে। শুধু একটা করে গাড়ি জিজ্ঞাসা করে পাস করানো হচ্ছে। মজা করতে বেরোলে সোজা বাড়ি ফেরত। এসেনশিয়াল সার্ভিস ছাড়া অনুমতি নেই।

হ্যাঁ, অনেক দেরিতে জানা গেল, খাবার সংগ্রহ করতে যাওয়া যেতে পারে।

 

২৩ মার্চ সোমবার

সারা ভারতে ডোমেস্টিক এয়ারলাইন্স চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে মঙ্গলবার থেকে। বন্ধুরা যারা নানা জায়গায় গিয়েছিল ফিরে আসুক চটপট।

কলকাতায় লকডাউন শুরুর আগে বাজারে দোকানে পাগলের মত ভিড় হয়েছে।

চায়ের দোকানের আড্ডা থামছে না।

লকডাউন অর নো লকডাউন, ভিড় করা কোথাও কমছে না। ফেসবুক জনতা বলছি, একশো চুয়াল্লিশ ধারা চাই। লাঠিপেটা করতে হবে তবে লোকে সরবে। মানুষ বুঝছে না।

 

২৪ মার্চ মঙ্গলবার

আবার এলেন প্রধানমন্ত্রী, সেই আটটায়। বললেন আজ মাঝরাত থেকে কড়া কার্ফু। ২১ দিনের লকডাউন।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাল হয়ে গেল ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটির অর্ডার। নিশ্ছিদ্র, প্রায় এমার্জেন্সি জারি করার মত, বিন্দুমাত্র ফাঁক না রাখা অর্ডার। ভীতির আবহ। আগামী ২১ দিন আটকে যেতে হবে!

 

২৫ মার্চ বুধবার

হাহুতাশ, মুদি দোকানে পাগলের মত ভিড় করে রাশি রাশি চাল ডাল তেল নুন তুলে নেওয়া। সব চলছে। মধ্যবিত্তের মাথায় বাজ। কাজের লোক আর আসছে না। সব কাজ নিজেদের করে নিতে হবে। কাপড় কাচা, বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার। রান্না।

স্থির শান্ত বাগানে কেবল পাখির ডাক।

আগামী ২১ দিনের ভয়াবহ সব ভবিষ্যদ্বাণী আসছে, ফুড রায়ট হবে এমন ইঙ্গিত।

দিল্লির পুলিশ পিটিয়ে সিধে করছে রাস্তায় কারুকে দেখলেই। খাবার কিনতে গেলেও। অথচ লকডাউন অর্ডারে স্পষ্ট বলা আছে খাবারের দোকান খোলা থাকবে। সুইগি জোমাটোর ছেলেদের বেরোতে দিচ্ছে না পুলিশ। আমাজন প্যান্ট্রি বা বিগ বাস্কেটের মত নেটভিত্তিক মুদির দোকান সম্পূর্ণ ফেল পড়েছে। গোটা ব্যবস্থা তছনছ।

আমাদের কলকাতার মত শহরের ফুচকাওলা, ইস্ত্রিওয়ালা, রাস্তার ধারে মুড়িবেগুনি বিক্রি করা মাসি, এদের কী হবে ভাবছি। দিন আনি দিন খাই এই বিশাল জনগণের কী হবে। কীভাবে পেটে খাবার জুটবে এদের।

মাইনে দিয়ে ছুটি দেওয়া হয়েছে বাড়ির কাজের লোকেদের ২০ তারিখেই। আমার মেয়ে আর বর পালা করে বাসন মাজছে আর ঘর মুছছে।

আমি ভুবনেশ্বরে চাল ডাল সাবান সবই পাচ্ছি। ফ্রেশ সব্জিও পেয়েছি।

 

২৬-২৭-২৮ মার্চ

দিন ক্ষণ গুলিয়ে গেছে। নিজেকে শক্ত রাখতেই হবে। একের পর এক দিল্লির নানা সার্কুলার এসেই যাচ্ছে। প্রথমে ভাবা গেল এজি অফিস বন্ধ করে দিতে হবে। পরে ক্ল্যারিফিকেশন এসেছে, আমরাও ট্রেজারি ফাংশন করি। পেনশন ইস্যু করি। আমার পে অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস কাজ না করলে কেউ মাইনে পাব না মার্চের। ফলত খুলে রাখা তো যাবেই, শুধু স্কেলিটাল স্টাফের তালিকা দিতে হবে আর ভেহিকল পাস ইস্যু করা হয়েছে প্রত্যেককে। ভুবনেশ্বরে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট প্রায় নেই। সবাই আসে নিজের বাইকে টু হুইলারে বা গাড়িতে। পুলিশ যাতে সে গাড়িগুলো ছেড়ে দেয় সেজন্যেই এইসব পাসের ব্যবস্থা।

মনের অবস্থা অদ্ভুত, একদিন সারাদিন উঠতেই পারলাম না বিছানা ছেড়ে। গা গুলোচ্ছে, মাথা ঘুরছে। কিচ্ছু খাবার মত খিদে নেই, কোনও বোধ নেই খিদের। কোনওমতে পিত্তরক্ষা করলাম।

তিন স্তরে খবর জেনেছি। রাতে জেনেছি আমেরিকায় হু হু বেগে করোনা ছড়িয়েছে। লাখে অসুস্থ, হাজারে মৃত্যু।

সকালে পেয়েছি মেসেজ, সম্ভবত ভারতে এই ২১ দিনের পর আবার ২১ দিনের লকডাউন হতে চলেছে।

আর তারপর আমার সেক্রেটারি জানিয়েছেন, উড়িষ্যাতে তৃতীয় যে আক্রান্ত, তিনি প্রথমে দিল্লি থেকে ফিরেছিলেন অল্প জ্বর নিয়ে। ২১ তারিখ স্থানীয় প্রাইভেট ক্লিনিকে যান। ২৪ তারিখ তার ধরা পড়ে কোভিড। সরকারি হাসপাতালে। ২১ ও তার পরবর্তী কয়েকদিনে ওই প্রাইভেট ক্লিনিকে যে কজন রোগী গিয়েছিল সবাইকে হোম কোয়ারান্টাইন করতে হবে বলে কাগজে দেওয়া হয়েছে। যে কেউ প্রয়োজনে উড়িষ্যা সরকারের করোনা সেলে ফোন করে সাহায্য চাইতে পারে।

২৪ তারিখ ওই ক্লিনিকে আমার অফিসের সহায়ক যে ছেলেটি চা জল দেয় সে সপরিবারে গিয়েছিল জানা গেল। ওরা হোম কোয়ারান্টাইনে।

আমি ভাবছি আমি যদি ২৫ ওয়ার্ক ফ্রম হোম না করে আপিস যেতাম। বা ২৬। ও আমাকে চা দিত। ওর এখনও কোয়ারান্টাইন শেষ হয়নি। রোজ খবর নেওয়া চলছে। এই লেখা লেখার সময়েও জানি না ও আক্রান্ত হবে কিনা।

 

২৯ মার্চ রবিবার

মাথা ঠিক রাখা প্রায় অসম্ভব হচ্ছে। ব্যক্তিগত পরিসর থেকে স্থানীয়, রাজ্যের এবং দেশের, আর সারা বিশ্বের, এই হেন পরিস্থিতি কোনওদিন দেখব ভাবিনি তো।

বন্ধুদের ক্যান্সার আক্রান্ত বাবা মায়েদের কেমো নেওয়া বন্ধ। মাঠে মাঠে ফসল পচে যাচ্ছে। অসংখ্য পরিবার ছিন্নবিচ্ছিন্ন। বহু শহরে আটকে যাওয়া মধ্যবিত্ত মানুষ প্রায় সর্বস্বান্ত।

ইচ্ছে করে টিভি খুলিনি এই গত কদিন। এতটাই মুড সুইং, ফেসবুকে শুধু পজিটিভ থাকার জন্য হাসাহাসি করেছি, নিজের পনেরো বছর বয়সের পাগলামি, দুঃসাহসিকতার গল্প বলেছি, অথবা কবিতা অনুবাদ করে পোস্ট করেছি। হোয়াটস্যাপ আটকে রাখা যায়নি। শুধু খবর আর ভিডিও ঢুকেছে। না, করোনা আক্রমণের সংখ্যা ইতিমধ্যে ১০০০ পেরিয়েছে, মৃত্যু ২৯। কিন্তু তা নয়। ভিডিও ঢুকছে কেবল লঙ্গরখানার। দিল্লির বাস টার্মিনাসের। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক, যাদের কাজ নেই আর লকডাউনে, যাদের বাড়িওয়ালা তাড়িয়ে দিয়েছে। তারা ফিরতে চাইছে ঘরে। ৬০০ কিলোমিটার হেঁটে ফিরতে চাইছে, সাইকেলে ফিরতে চাইছে, ঠেলাগাড়িতে ফিরতে চাইছে। মাথায় পোটলা বেঁধে জিনিস নিয়ে, কোলে শিশু নিয়ে, ঘাড়ের ওপর ছেলেকে বসিয়ে, স্বামী স্ত্রী পথ হাঁটছে। হাইওয়ে ভরে গেছে কাতারে কাতারে মানুষে।

কাদের বাঁচাতে লকডাউন? কাদের স্বাস্থ্য রক্ষা করছি আমরা। দেশ আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গেছে। একদিকে ধনীর দুলালরা বিদেশ থেকে ভাইরাস এনেছে বিমানপথে। ধনীর দুলাল দুলালী যারা আটকে গিয়েছিল তাদের জন্য নাকি প্রাইভেট জেটও বাবা মা ভাড়া করেছেন ৮০ লাখ টাকায়…। তারা ঘরে ফিরেছে।

ঘরে ফিরতে পারছে না শুধু লক্ষ লক্ষ শ্রমিক। সরকার বাহাদুর তাদের জন্য বাস রাখেননি, ট্রেন রাখেননি, রেখেছেন পুলিশ আর লাঠি।

ছবি আর ভিডিও এসেছে, উত্তর প্রদেশে গ্রামে পৌঁছনো শ্রমিকদের সমবেতভাবে বসিয়ে তাদের গায়ে রাসায়নিক জীবাণুনাশক স্প্রে করে দেওয়া হচ্ছে। দেখলাম সুরাতে পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের মারামারি হয়েছে।

লকডাউন। আমাদের দেশের লকডাউন এখন প্রতিমুহূর্তের ডিটেনশন ক্যাম্পের গল্প হয়ে গেছে।

আমার ব্যক্তিগত একাকিত্ব, ফুঃ। আমার ব্যক্তিগত অনিশ্চিতি, ছোঃ। এখনও মাথার ওপর ছাদ আছে এই বিশাল প্রিভিলেজের জন্য প্রায় অনুশোচনা বোধ করছি আজ৷ অগুনতি মানুষের কোন আশ্রয় নেই আজ৷

লঙ্গরখানার লাইন মাইল ছাড়াচ্ছে। মানুষ বলছে, আমি রোজ ৫০০ টাকা রোজগার করি রুটির দোকানে তন্দুরি রুটি বানিয়ে। মানুষ বলছে, আমার কোনও আধার কার্ড টার্ড নেই, আমি দিল্লির রেস্তোরাঁয় কাজ করে জিন্দেগি চালিয়ে নিয়েছি এতদিন। এই গত তিনদিনে আমার পেটে একটা কেন, আধখানাও রুটি পড়েনি।

কেউ আমাদের রেশন দেবে না, কেউ আমাদের দেখবে না। করোনায় মরব? তার আগে তো ভুখেই মরে যাব।

বধিরতা পেরিয়ে এখনও কি খোদ পরিচালকদের কানে ঢুকছে না মানুষের কান্না, দেশের কান্না?

দেশ তো এক আশ্চর্য মানবিক সঙ্কটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।

হ্যাঁ আমরা ইতিহাসের সাক্ষী অবশ্যই। শুধু সেটা ভাবার আত্মগৌরবটুকুও অশ্লীল এখন।

চাকা গড়াচ্ছে। গল্পটা এখনও শেষ হয়নি। ডায়েরিটা এখনও শেষ হয়নি।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4881 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...