পাখির কলকাকলির পাশাপাশি মুখর রয়েছে বিশেষজ্ঞদের কচকচি আর মধ্যবিত্ত অনিশ্চয়তাবোধ

সত্যব্রত ঘোষ

 




লেখক চলচ্চিত্রনির্মাতা, চলচ্চিত্রের শিক্ষক।

 

 

 

এমন দীর্ঘ নীরবতা পৃথিবী স্মরণাতীত কালেও দেখেছে কিনা সন্দেহ। বহু অত্যাচারে জর্জর এই গ্রহটির হয়তো বা এখন মেরামতি পর্ব চলছে। কিন্তু মানুষ আজ ভাল নেই। অনিশ্চয়তায় ভরা আপন কোণগুলিতে শুয়ে বসে নিজের অসহায়তাকে নিয়তি না ভেবে, তার এখন গভীর আত্মসমীক্ষা প্রয়োজন।

মানুষের– বিশেষত শিক্ষিত আত্মসচেতন মানুষের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং বেপরোয়া মানসিকতার কারণেই আজ আমরা ঘরবন্দি। তবুও দীর্ঘকালের অভ্যাস ত্যাগ করা সহজ নয়। তাই, বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও আমাদের অনেকে এখনও যেখানে সেখানে থুতু-কফ ফেলা বন্ধ করিনি। হাঁচি বা কাশির তোড়ে আমরা ভুলেই বসেছিলাম যে হাতের ঊর্ধ্বাংশ দিয়ে মুখ চাপা দেওয়াটা সাহেবি কেতা নয়, একটি বুনিয়াদি স্বাস্থ্যবিধি।

করোনা ভাইরাস নিয়ে কিছু সময় ধরে টেলিভিশন চ্যানেল, ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ প্রভৃতি মাধ্যমগুলিতে প্রচুর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা চলছে। ভাইরাসটির প্রকোপের জন্য চিন দোষী না আমেরিকা– তা নিয়ে তথ্য আদান-প্রদানের শেষ যেন আর নেই। কিন্তু যে বিপজ্জনক প্রবণতাগুলি বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এখনও প্রবল, এই তর্কাতর্কির ভিড়ে তারা মিলেমিশে লুকিয়ে আছে।

সমস্যা হল, গুজব রটনা এবং কালোবাজারি যে আজ রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে গেছে, তার প্রধান কারণ আমরা কমবেশি সুযোগসন্ধানী। বিভ্রান্তি আর ত্রাস যতই বাড়তে থাকে, নিজেদের আখের-টুকু গুছিয়ে নেওয়ার প্রবৃত্তিকে আর রাশ টানা যায় না। অনুতাপের বিষয়, তথাকথিত ‘শিক্ষিত ও সচেতন’ মানুষেরাই পরিস্থিতি আগাম আন্দাজ করে সঙ্কটকে তুঙ্গে নিয়ে যেতে পারদর্শী।

করোনা ভাইরাস যখন বিভিন্ন দেশে ব্যাপকহারে সংক্রমিত হচ্ছিল, তখন চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও গবেষকেদের সূত্রে জানা যায় যে দুটি বিশেষ ওষুধের সাহায্যে ভাইরাসটিকে অকেজো করা সম্ভব। কিন্তু নোভেল করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক রূপে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগেই এত বেশি পরিমাণে উৎপাদিত ওষুধগুলি কিনে নেওয়া শুরু হয়ে যায়, যে ভারতে সরকারিভাবে কড়া নির্দেশ জারি হয়: ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া যেন কোনও দোকান ওষুধগুলি বিক্রি না করে। “শিক্ষিত ও সচেতন’ মানুষরা যখন পয়সা খরচ করে ওষুধগুলি (এছাড়া N-95 Mask আর হ্যান্ড স্যানিটাইজারও আছে) এনে ঘরে জমা করছেন, তখন তাঁরা কি সেই স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকদের কথা একটুও ভেবেছেন– যারা প্রতিদিন ভাইরাস আক্রান্তদের সংস্পর্শে এসে নিজেদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বাড়াচ্ছেন। ‘চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা’– এই মূলমন্ত্র যখন অজ্ঞতা আর সচেতনতার মধ্যরেখাটি মুছে দেয়, তখন দেশ বা দশের মঙ্গলচিন্তা ক্রমশ দুর্বল হওয়া কি অস্বাভাবিক?

অন্য একটি প্রসঙ্গ এই সূত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন। আমাদের দেশে সবকিছুতেই যে ঢিলেঢালা ভাবটা দেখা যায়, করোনা ভাইরাসের প্রতিরোধেও তা দেখা গেছে। সংক্রামক এক অতিমারির কথা বলা হচ্ছে। অথচ যারা এই যুদ্ধের সম্মুখসেনানী– সেই ডাক্তার, নার্স আর অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সেই সংক্রমণ করবার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ঘাটতি। প্রশ্ন উঠলে কাঁচুমাচু হয়ে আধিকারিকদের বলতে শুনছি, পরিস্থিতি যে এতটা ঘোরালো হয়ে যাবে তা আগে বোঝা যায়নি।

এমন অনেক কিছুই আমরা বুঝিনি। ভারতের মতো অসাম্যে ভরা একটি দেশে বেকারিত্ব আর কর্মহীনতার বিশাল ছায়াটির মাঝে যে ধূসর অংশটি কর্মমুখর, তার প্রায় নব্বুই শতাংশ মানুষ অসংগঠিত শ্রমিক ছাড়া আর কিছুই নয়। দৈনিক মজুরিটুকুই তাঁদের সম্বল। একা প্রধানমন্ত্রীই নন, আমরা যারা স্বচ্ছলতার অল্প স্বাদটুকুও পেয়েছি, তাঁদের চোখে এই দিন-এনে-দিন-খাওয়া মানুষগুলির অস্তিত্ব নিছক ব্যবহারিক ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই জনতা কারফিউ আর লকডাউনের কয়েক দিন পরে যখন তাঁরা রাজধানীর ঝা-চকচকে সড়কগুলি দিয়ে সার বেঁধে নিজেদের গ্রামে ফেরে, তা আমাদের আপন বিভ্রান্তি আর অনিশ্চয়তার মাঝে বিড়ম্বনা জাগায়। ‘দেশবাসীয়োঁ’-দের উদ্দেশ্যে কাঁদুনি গেয়ে মোদি যখন লকডাউন জারি রাখেন, স্বাভাবিকভাবেই তাঁর মনে পড়ে না সেই শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারদের কথা– অন্ন আর আশ্রয়, দুইই থেকে যারা বরাবর বঞ্চিত। ঢিলে ঢালা দেশের প্রশাসন যখন গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে এই ক্ষুধার্ত-তৃষ্ণার্ত মানুষের মিছিল দেখে তৎপর হওয়ার অভিনয়ে সামিল হল, তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। দেশের বিবেক যাতে না জেগে উঠে আরও বিব্রত করে, প্রচারযন্ত্রে রাষ্ট্র করে দেওয়া হল নিজামুদ্দিনের তবলিগি জামাত মারকাজ-এর দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কথা। ভাবখানা এমন, করোনা যুদ্ধ আমরা প্রায় জিতেই গেছিলাম এক সপ্তাহ লকডাউন করে। এই ধর্মান্ধ মানুষগুলির গোঁড়ামির কারণে তা হল না। পাখির কলকাকলির পাশাপাশি মুখর রয়েছে তাই বিশেষজ্ঞদের কচকচি আর আমাদের মধ্যবিত্ত অনিশ্চয়তাবোধ।

লকডাউনের দ্বিতীয় দিন সকালে চাকুরিজীবী প্রতিবেশীটি পাড়ার মুদিখানায় পাঁচশো গ্রাম পোস্ত চাইলেন। দোকানদার তাঁকে তিরস্কার করা সত্ত্বেও তিনি নড়ছেন না। পিছনের লম্বা হতে থাকা লাইনের তোয়াক্কা না করে ‘অন্তত আড়াইশো গ্রাম দাও’ বলে কাকুতিমিনতি চালিয়ে গেলেন। তারপরেও যে অপমানের পালাটি শুরু হয়, তা হাসি ও করুণার উদ্রেক ঘটিয়ে অনুভূতিগুলিকেই যেন ভোঁতা করে দেয়। দুই কিলোর বদলে এক কিলো চিনির প্যাকেট নিয়ে খিচখিচে মন নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে ভাবি, প্রতিবেশী আর আমার মধ্যে ফারাকটুকু আদৌ আছে কি?

এর আগে কারফিউ আমরা যে দেখিনি, তা নয়। এমনকি ভারি বর্ষায় জল জমবার পরিস্থিতি আগাম ধরে নিয়ে প্রয়োজনটুকুর বহর আমরা বাড়িয়েই এসেছি এতকাল। সরবরাহে ঘাটতি না হওয়ার প্রশাসনিক আশ্বাস সত্ত্বেও আলু-পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকে। দুর্মূল্য হয়ে উঠলেও কেনাকাটিতে কার্পণ্য দেখাইনি। কারণ আগামীকালের চিন্তায় যে অজানা অসুরক্ষিত মনোভাব তাকে প্রশ্রয় দেওয়াটাকেই দুনিয়াদারি বলে চিনেছি। ফুর্তিবাজ ঘাসফড়িং না হয়ে বাস্তববাদী পিঁপড়েটির খাবার জমানোটিকেই শ্রেয় বলে মেনে নিয়েছি আমরা। বস্তুত পিঁপড়ের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার শিক্ষাটুকুই আমাদের অর্জন। ‘আজ’ বা ‘এখন’ কীভাবে বাঁচছি– তার প্রতি গুরুত্ব দেওয়াটার গ্লানিবোধ আমাদের নিশ্বাসে মিশে আছে। অথচ সমাজে এমন মানুষও তো কম নেই যারা ‘কাল কেয়া হোগা কিসকো পতা / আভি জিন্দগি কা লে লো মজা’ গেয়ে দিব্যি বেঁচে আছে। দালাল স্ট্রিটের ব্রোকারটির হাসিমুখ তো সংবাদপত্রে আমরা লকডাউনের মধ্যেই দেখেছি। করোনা ভাইরাসের প্রকোপের পরেও যখন শেয়ার বাজার চাঙ্গা, তখন তাঁর মতো কত শত মানুষই না হেসেছে।

সংক্রমণের ভয় বা লকডাউনের অনিশ্চয়তা নিয়ে আমরা যতই মাথা ঘামাই না কেন, করোনা ভাইরাসের আমদানিতে আমরা কিছু শিক্ষাও পেলাম। প্রথমত, আমাদের জীবনশৈলী নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য এবং আরাম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে ক্রমশ উচ্চাকাঙ্খাগুলিকে প্ররোচিত করছে। এবার এই প্রথম একটি ভাইরাসের কথা আমরা জানছি, যা মহামারি হয়ে উঠেছে মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতা আর দম্ভের কারণে। এর আগে আমরা এইডস রোগটি সম্পর্কে জেনেছিলাম যা মূলত শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতায় আক্রমণ করে। করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে অপেক্ষাকৃত কম প্রতিরোধ আছে যাঁদের আক্রান্তদের মধ্যে তাঁদের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু ভাইরাসের প্রকোপ যখন এমন মহামারির আকার নিয়েছে, তখন এটুকু তো বলাই যায় যে বয়স এখানে গৌণ। অর্থাৎ, সাধারণভাবে বললে, নগরকেন্দ্রিক মানুষদের শরীরে স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধের শক্তি ক্রমশ কমছে। তার সম্ভাব্য কারণ প্রকৃতি থেকে নগরসভ্যতার বিযুক্তি।

বিষবৎ একটি চক্র এই সূত্রে দ্রুত দেখে নেওয়া যাক। এখন প্রায় প্রতিটি মধ্যবিত্ত ঘরে বাতানুকূল যন্ত্র আবশ্যিক হয়ে উঠেছে। এই বাতানুকূল যন্ত্রগুলি ঘর ঠান্ডা করবার পাশাপাশি বাইরের তাপমানকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দেয়। গরম যত বাড়ে বাতানুকূল যন্ত্রের ব্যবহারও সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাওয়াটাই দস্তুর। কিন্তু যন্ত্রটির বহুল ব্যবহারে শহরের তাপ ও বায়ু কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা রাস্তায় সিগনালে থেমে থাকা একটি বাতানুকূল গাড়ি বা বাসের কাছাকাছি অল্পক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে টের পাওয়া যায়।

দ্বিতীয়ত, যে শিক্ষাটি করোনা ভাইরাসের প্রকোপে আমরা পেলাম তা হল অনিয়ন্ত্রিত শ্লাঘা মানবসমাজের ক্ষতিবৃদ্ধিই করে। এখন কণিকা কাপুর সিনড্রোম হিসেবে যা চিহ্নিত করা হচ্ছে। অনেকেই জানেন, গায়িকাটি লন্ডনে দিব্যি নাচগান করে ভারতে ফিরে নিজের যাত্রা ইতিহাস গোপন করে সেলিব্রিটি জীবনে আবার অভ্যস্ত হওয়ার আগেই করোনা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হন। এবং বিভিন্ন গণ্যমান্যদেরও বিপদে ফেলেন। কলকাতাতেও যারা এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত, তাঁদের ক্ষেত্রেও লক্ষ্যণীয় বিষয় হল বিদেশের সঙ্গে এদের প্রত্যক্ষ সংযোগ। এনারা প্রায় প্রত্যেকেই নিজেদের সাম্প্রতিক বিদেশযাত্রা বা বিদেশঘটিত সংযোগের বিবরণ গোপন করেছেন। হয়তো কোথাও নিজেদের রোগী হিসেবে চিহ্নিত হলে সামাজিক অবনমনের ভয়ও এনাদের ছিল। যা প্রকৃত অর্থে আমাদের শিক্ষা আর সচেতনতার বেলুনটাকেই চুপসে দেয়।

বিদেশ থেকে আগত মানুষগুলি ভারতীয় হলেও সমাজের একটি নেতিবাচক দিক এই করোনা ভাইরাসের সূত্রে অন্যভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইদানিং আমরা দেখছি বিশ্ব জুড়ে মানবপাচার বেড়েছে। গরীব দেশগুলি থেকে মানুষরা গিয়ে তথাকথিত ‘ধনী’ দেশগুলিতে ভিড় বাড়িয়েছে অপেক্ষাকৃত ‘উন্নত জীবনযাত্রা’র লোভে। শিক্ষিত এবং অর্ধশিক্ষিত মানুষের সংখ্যাটি এই ভিড়ে নগণ্য নয়। উচ্চাকাঙ্খাই হোক, বা অসহায় পরিস্থিতির শিকারই হোক, এই মানুষগুলির জীবনযাত্রা দেশে থাকা আত্মীয়-পরিজনদের একাংশকে বিদেশ চলে যাওয়ার দিকে প্ররোচিত করে। ভারত, বাংলাদেশ এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে যে পরিমাণ মানুষ ভিসা ছাড়া ইউরোপে এবং আমেরিকায় বসবাস করছিলেন, তাঁদের কিন্তু দেশে ফিরে আসতে হয়েছে। ‘উন্নত’ এই দেশগুলি এদের দায়ভার নেয়নি। দেশে ফিরে বাধ্যতামূলক কোয়ারান্টাইন বাসের পর সুস্থ শরীর নিয়ে নিজেদের ঘরে ফিরে এসে যখন এই মানুষগুলি তাঁদের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতাগুলি উগরে দেবেন, শ্রোতাদের একাংশ যদি তাতে বিদেশে ‘উন্নত জীবন’ খুঁজে পাবার লোভ সংবরণকেই শ্রেয় মনে করেন তাহলেই মঙ্গল।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...