রুখসানা কাজল
লেখক গল্পকার ও গদ্যকার। ঢাকা তেজগাঁও মহিলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান।
মার্চ ৩০ তারিখ সকাল
কর্মসহায়িকা বুয়া বেশি টাকা চেয়ে ফোন দিয়েছে। “শইল ভালা না। পাঁচশ টাহার ওষুদ লাইগছে গো মা।” স্বাভাবিক। শরীর খারাপ হতেই পারে। তারচে বড় কথা বুয়ার মন খারাপ। সিরিয়ালগুলো মিস করছে। জি বাংলা, জলসা না থাকলে সে বাসায় ও কাজ করে না। এতই মগ্ন থাকে যে আমি আর ওকে চা বানাতে দিই না। নিজেই বানিয়ে বুয়াকে দিয়ে ওর চোখ মুখের এক্সপ্রেশন দেখি। খারাপ চরিত্রের অভিনেতা দেখলেই একহাতের উপর আরেক হাতের কিল বসিয়ে আচ্ছাসে মেরে দেয়। যা তা গালি দেয়। দুঃখে কেঁদে ভাসায়। অনেকবার চেষ্টা করেছি বাংলাদেশি নাটক, অনুষ্ঠান দেখাতে পারিনি। সিরিয়ালের অবাস্তবতাও তুলে ধরেছি। বুয়া পরদিন আসেনি। অন্য বাসায় টিভি দেখতে চলে গেছে।
বুয়াকে বলেছি, এপ্রিল মাসেও তুমি এসো না। বেতন পেয়ে যাবে। বুয়া এক অমোঘ সত্যের সামনে ফেলে দিয়ে ফোন রেখে দিয়েছে, আপনার বাসায় নাই আসলাম। অন্যেরা কি কাম ছাড়া বেতন দিবে গো। তাই তো! এদিকটা তো ভেবে দেখিনি। ঠিকা কাজের নিয়মই হচ্ছে, নো ওয়ার্ক, নো ওয়েজ। আমিও কি পারব দরকারে বুয়াকে ছয়মাস টেনে নিতে?
ছেলে ঘুমচোখে ঢুলতে ঢুলতে এসে আমার গলা মুখ ছুঁয়ে ঘুতঘুতে গলায় জানতে চাইল, কাশি দাওনি তো মা? জোরে নিঃশ্বাস নাও দেখি। নিঃশ্বাস নিই।
বুকে কোনও ডিস্টার্ব ফিল করছ? বোঁচাখোচা ঘুমে ফোলা মঙ্গোলিয়ান চেহারা।
চা খাবে? নোপ, ঘুমুব। নিজের বানানো স্যানিটাইজার ঘ্যাস ঘ্যাস করে স্প্রে করে চলে গেল নিজের রুমে। এবার ঘুমুবে বেলা ৩টা পর্যন্ত। কী দুনিয়া রে বাবা। সারারাত কাজ করে দিনভর ঘুমুনো! আমি আর্লি রাইজার। অন্ধকার থাকতেই গাছে পানি দিয়ে বারান্দা পুঁছে পাখিদের দানাপানি দিয়ে অন্য কাজ শুরু করি। ঢাকা শহরে কাকই বেশি। ছেলের বাবা বলত, প্রিন্সেস অফ ক্রো।
হরলিকসে চুমুক দিয়ে ছেলে জানতে চাইত, হোয়াই নট স্পারো অর পিজিয়ন ড্যাড্যা? মানুষটা বিব্রত হয়ে তুতলে যেত। তাড়াতাড়ি বলে উঠত, তোমার দাদিম্মা আর আম্মু ত ব্ল্যাক ডায়মন্ড। দেখো না সবাই কত ভালোবাসে। এমন সুস্থতার ভেতর আমরা বুঝতেই পারিনি কখন সিজোফ্রনিয়া থাবা মেরেছে মানুষটাকে।
দুপুরে অভদ্রতা ঘটে গেল। খুবই বিরক্ত হয়েছি। অহম এবং আত্মবিশ্বাসের প্রয়োজন আছে। কিন্তু তা থাকবে মাখনের ছুরির ভেতর নম্র মায়াময় মর্যাদায়। আমি লিখি আনন্দে। অমরতার লোভ কিম্বা জনপ্রিয়তার লালচ্ আমার নেই।
এবার অসুখের সময় প্রমিজ করেছিলাম, নিজেকে বদলে ফেলব। লেখালিখির এই জগতকে ইচ্ছেখুশির মত ব্যবহার করব। কোনও প্রত্যশা রাখব না। কারও প্রত্যাশাও নেব না। যদিও জানি একজন সম্পাদকই পারে কোনও লেখক বা কবিকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে তুলে দিতে। তা করুক। আমি এমন কিছু লিখি না যে আমাকে জনপ্রিয় হতেই হবে। এবার থেকে আমি আমার মত চলব ফিরব বাঁচব ঘুরব।
সন্ধ্যায় পাড়ার জাতীয়তাবাদী নেতানেত্রীভাইভাবী হাঁটতে বেরিয়েছে। কি ভাবী মাস্ক কই? ভাবী খোঁচা মারে, আওয়ামি করো না? আপনার নেত্রী দিলে তো পরব। আমিও খোঁচাই, আইসেন রাসেল স্কোয়ারে। একটা নিলে আরেকটা ফ্রি আওয়ামি মাস্ক দিবানি।
রাতে হিসাব করতে বসি। কেউ কি কিছু পাবে আমার কাছে? আর্থিক ঋণ নেই আমার। একটি বইয়ের রিভিউ করে দেওয়ার কথা। বইটা পেতেও দেরি হয়েছে। তার উপর করোনায় এলোমেলো হয়ে গেছিলাম। ওটা নিয়ে বসব আবার। সম্পর্কের ঋণ আছে। কিছু কিছু সম্পর্কের ঋণশোধ হয় না।
৩১ তারিখ সকাল
নিউইয়র্কের অবস্থা খুবই খারাপ। ওখানে কিছু আত্মীয় আছে। তারা দোয়া দরুদ সূরা পাঠাচ্ছে। বিপদে আল্লাহর কাছে হাতজোড় করি আমরা। উদ্ধার পেলেই ফুৎফক্কা। কিন্তু এবারের বিপদ বড় নিদারুণ। মক্কামদিনা বন্ধ, আজানের ভাষাও বদলে গেছে কোনও কোনও দেশে। ব্যতিক্রম কেবল পাকিস্তান ভারত বাংলাদেশ। তাবলিগ, জুম্মা, শোকরানা, রামনবমী, উৎসব তিথি, স্নান উদযাপন ও পূজার ধুম পড়েছে। পত্রিকায় পড়লাম ভারতের দুজন যাজক বিদেশ ঘুরে এসে অনেকগুলো গ্রাম ঘুরেছেন ধর্মীয় কাজে। এদিকে রংপুরে প্রবাসী কোয়ারান্টাইন ভাগ্নেকে দেখতে আত্মীয়রা পোলাউ কোর্মা ফলমূল নিয়ে এসেছে। মানিকগঞ্জের এক বধু বলেছে, এতদিন পর সে আইসে। মনে বুঝি সোহাগ জাগে না!
কোভিড-১৯ মানুষকে বিষময় করে তুলছে। বাঁচতে চাইলে ঘরে থাকুন। কে শোনে কার কথা। সবাই ছুটছে। এ মৃত্যুপুরীতে বসে আবার পরস্পর সাম্প্রদায়িক গালিবাজিও করছে। এ ব্যাপারে দুতরফেরই চরম ঐক্য। ভাবা যায়। ইচ্ছে করে রাজা হই। গর্দান নিই এদের সবার।
কিন্তু হায়। গণতন্ত্র হচ্ছে এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্র যদি বলে, ওহে জনগণ এই যে কলা ছিলে দিলাম। অমনি জনগণ ফেটে পড়ে প্রতিবাদে, ছিল্লে ক্যান তুমি ছিল্লে ক্যান। বুজোয় দেও এহনি। কলা বুজিয়ে দিলে চেঁচিয়ে ওঠে, মিয়ারব্যাটা গাড়োয়ান হইছ তাই না। কিডা কয়িছে বুজোয় দিতি। এহনি ছুলি দেও। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারল্ড লাস্কি তাই বলেছিলেন, গণতন্ত্র হচ্ছে মূর্খের শাসন। শিয়রে মৃত্যু। লকডাউন। হ্যা হ্যা করতে করতে বেরিয়ে পড়েছে জনগণ।
সেনাবাহিনী কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে। রাস্তাঘাট সুনসান। নীচে হালকা কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। একজন ড্রাইভার নিধুয়া দুপুরে বাঁশিতে সুর তুলেছে, হলুদিয়া পাখি সোনারই বরণ পাখিটি ছাড়িল কে—
মন খারাপ হয়। লকডাউনে সবচে বেশি কষ্টে পড়েছে গরীব, ভবঘুরে মানুষরা। করোনার ভয়। তারচে বেশি কষ্ট পেটের দায়। সরকার চেষ্টা করছে। ত্রাণ চুরির খবরও আসছে। সবচে ভয়াবহ হচ্ছে ডাক্তার নেই চেম্বারে। হাসপাতাল ক্লিনিক থেকে রুগী ফিরিয়ে দিচ্ছে। করোনার বাইরের রুগীরাও মারা যাচ্ছে বিনা চিকিৎসায়।
সন্ধ্যায় করোনা সংক্রান্ত বুলেটিনে জানা গেল মাত্র ৬ জন মারা গেছে। তবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সর্দি, কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্টে অনেকেই মারা যাচ্ছে। শীতল একটি ধারণা বয়ে যায় শিরদাঁড়া বেয়ে। মুড়িকে খৈ আর খৈকে মুড়ি বললে কি চালের মৌলিকত্ব মুছে যায়!
রাতে অশেষকে আলুপকান দিই, বাবু তুমি নেড়া হবে? হও। তোমার যে গাদা গাদা চুল! বাতাস ঢোকে না। দেখো খুশকি মরে যাবে। ঘরেই তো আছ।
কাজ হয় না। উলটে আমাকে নেড়া হতে বলে খাবার নিয়ে চলে যায় ওর রুমে। এক বন্ধু প্রতিদিন ফোন দেয়। বেশ করোনা প্রেম জেগে উঠছে। তবু ভয়টা কাটে না। খামচি মেরে ধরে আছে হৃৎপিণ্ড। টিভি বকে যাচ্ছে। আমি আস্তে করে দরোজা খুলে বারান্দায় যাই। অল্প আলোয় ভূতুড়ে লাগে রাস্তাটাকে। আমাদের গেট থেকে এক ফালি আলো লম্বালম্বি পড়ে আছে রাস্তায়। যেন রক্ষাকবচ। দূরের রাস্তা দেখার জন্যে মাথা ঝোঁকাতেই দড়াম করে বাড়ি খাই গ্রিলে। মাথাটা যেন দুলে উঠল ব্যথায়। মুখ চেপে ঘরে চলে আসি। অশেষ জানলে হুলুস্থুল করবে। ওরা ফেসবুকে বাবামাদের বোকামি নিয়ে ফান করছে। ধুয়ে দিচ্ছে বাবামাদের। একাই পানি দিই ব্যথার জায়গায়। ভয় কাটাতে নেটফ্লিক্সে যাই। ড্রাগন হার্ট। বাচ্চাদের ফিল্ম। সো হোয়াট। আমি তো বাচ্চাই। দেখতে দেখতে ভাবি, আল্লাহ ঈশ্বর ভগবান। কত কোটি টাকা না জানি খর্চা হয় এমন একেকটা ফিল্ম বানাতে।
১লা এপ্রিল সকাল
ছেলে রাজি হয়েছে নেড়ু হতে। চুলের বোঝা নামিয়ে দিতেই দেখা যায় খুশকির উদ্বাহু বিস্তার। বেচারা এত কিছু করেও খুশকি সারাতে পারছে না। আসলে চুল আঁচড়ায় না মোটেও। বার বার বলেছি। যত ভাল মনে হয় তত সুবোধ নয় অশেষ। ঘ্যাম আছে। আমিও কিছু বলি না। জানি সময় হাতেকলমে শিখিয়ে দিবে জীবন কাহাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি!
পাশের ফ্ল্যাটের ডাক্তার আপার ফ্রিজ বিগড়েছে। আপার ছোট ছেলেটার থ্যালাসেমিয়া। ওর ওষুধগুলো আমাদের ফ্রিজে রাখতে রেখে গেছে দরোজার সামনে। সাথে আধাটা পাকাকুমড়ো একমুঠ বরবটি। এগুলো আমার জন্য। করোনার আগে আমাদের দু ফ্ল্যাটে সারাক্ষণ যাতায়াত ছিল। উনার নাতিদুটোকে মিস করি। বড়টা কথা বলতে স্লো। মেয়েটার দেড় বছর বয়স। আমাকে দেখলেই ডাক দেয়, দাইদি দাইদি। আথো আথো।
দুপুরে বিড়ালদের হাউকাউ শুনে পাশের বারান্দায় গিয়ে বেকুব হয়ে যাই। এখন কি বিড়ালদের প্রজনন সময়! কে জানে। আমি পোষ্য রাখতে ঘোর অরাজি। অশেষ কতবার কুকুর থেকে বিড়াল, খরগোশ পাখি কচ্ছপ ইঁদুর পুষতে চেয়েছে! ফ্ল্যাট বাড়ির স্বল্প জায়গা। শেষবার ওকে বুঝিয়েছি, যে খরচ তুমি করবে তা দিয়ে একজন মানুষকে সাহায্য করতে পারবে। কোনটা ভাল? মেনে নিয়েছে।
সন্ধ্যায় শিলাবৃষ্টি বয়ে গেল। আমি খুব করে আল্লাহকে ডাকলাম। কেন যেন আমার ধারণা জন্মেছে, রোদ্দুরের তাপে করোনা ভাইরাস মরে যাবে। এক জানালা থেকে আরেক জানালায় গিয়ে আল্লাহকে অভিযুক্ত করি, তুমি, হ্যাঁ তুমিই অনিঃশেষ মহাশক্তি। তোমার যখন এতই শক্তি, তো থামাও তোমার করোনা রানিকে। জিও পলিটিসিয়ানদের মত হরদম খেলে যাচ্ছ। কত যে ভয় পাই তা কি জানো! তুমি তো বাবা নও, কোনদিনও মা হতে পারবে না। তুমি ভাই নও। বোনের মমতা নেই তোমার। বন্ধুর বন্ধুতা। প্রেমিকের সাহসও নেই তোমার। তুমি অন্ধ কালা বদ্ধ উন্মাদ। তুমি আড়াল। কেবলই আড়াল অন্ধকার। অনাদ্যন্ত শাস্তি দিয়ে তুমি অমঙ্গল অমঙ্গল খেলা করছ মানুষের সাথে। থামাও তোমার খেলা। দেখি কেমন শক্তি তোমার।
ট্রেডমিলের ধাতব কোলে বসে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকি। অশেষ শুনলে ছুটে আসবে। অনন্ত অসীম হে দয়ালু তুমি তো জানো না, মায়ের চোখে জল দেখলে সন্তানের বুক কেমন ফেটে যায়। পাঁজরের হাড় খুলে খুলে আসে। অভিমান আর অবিশ্বাস জন্মে যায় তোমার উপর! তুমি সহায় হয়ে এসো। আরোগ্যের ভোর দাও প্রভু।