সুমন গুণ
লেখক কবি ও অধ্যাপক
টেমসের পাশের রাস্তায় দেখা হয়েছিল এক পথশিল্পীর সঙ্গে। নদীর মতই শান্ত অথচ স্বতশ্চল সেই শিল্পীর সঙ্গে আমার কথাবার্তার কিছুটা আমি ফিরে এসে লিখেছিলাম একটি সাময়িক পত্রিকায়। এখন, বিশ্বময় এই গণঅপহরণের মুহূর্তে তিনি কোথায় আছেন? টেমস-লাগোয়া গোটা পথটি পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তের নাগরিকের ভিড়ে সবসময় মুখর। যাঁরা হেঁটে চলাফেরা করছেন লন্ডনে, অন্তত লন্ডনের চেনা অঞ্চলগুলোর আশেপাশে, তাদের আশিভাগই তো আমার আপনার মতোই ভ্রমণার্থী, হাতে একটি অবধারিত ম্যাপ, যেখানে চোখ রেখে, মিলিয়ে নিয়ে সবাই নিজের নিজের গন্তব্যের দিকে সহর্ষে ধাবমান। কোনও সন্দেহ নেই যে এই ছবিটি লন্ডনে, শুধু লন্ডনে নয় পৃথিবীর কোনও সরণিতে আর ফিরবে না। যে আতঙ্ক, অবিশ্বাস আর অনিশ্চয়তার কবলে আমাদের ফেলে দিয়েছে একটি ঘাতক ভাইরাস, তা আমাদের জীবনযাপনের, আমাদের আকাঙ্ক্ষার, আমাদের লক্ষ্যের সব ব্যাকরণ চিরকালের জন্য বিধ্বস্ত করে দিয়েছে।
লন্ডন, শেলির মনে হয়েছিল, এক বিরাট সমুদ্র, যার ঢেউয়ের ওঠাপড়া ক্ষয় আর নবান্নকে একই সঙ্গে ডাকে। কলকাতাও তো তাই। উদার ও শহুরে ব্যস্ততা লন্ডনকে আমাদের কলকাতার সঙ্গে মিলিয়ে দেয়। তুলনার রাজনৈতিক মজাটুকু উহ্য রাখলে আমরা টের পাব এই দুটি শহর ধ্বংসের ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই আবার উড়াল দেবার জন্য ডানা মেলে দিতে চায়।
কিন্তু এই মুহূর্তে কলকাতার দিকে তাকালে আমার মনে হয়, চারদিকে পাতার পর পাতা শুধু সাদা, কোথাও কোনও হস্তাক্ষর নেই। যে-নাগরিক জটিলতার টানে জীবনানন্দ ছুটে আসতেন কলকাতায়, আমাদের প্রতিমুহূর্তের রসদ উপচে দিয়েও যে শহরের ভাঁড়ার কখনও খালি হয় না, তাকে এমন নিঃস্ব, নিরক্ত, নিরলঙ্কার কখনও দেখতে হবে তা কি ভেবেছিলাম? এখন একজন-দুজন মানুষকে দূরে দেখলে মনে হয় বেঁচে আছি, জীবনের মধ্যে আছি। বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে, বারান্দায় বসে দূরের জানালার দিকে কাতরভাবে তাকিয়ে থাকি: যদি কোনও অন্তরালবর্তিনীর গ্রীবা চোখে পড়ে। বিকেলের বারান্দায় এসে কেউ গুটিয়ে নিচ্ছেন কি না তাঁর গোধূলিকালীন শাড়ি— খুঁজতে খুঁজতে অন্ধকার নেমে আসে।
এই অন্ধকার আসলে এখন আমাদের সারাদিন জড়িয়ে নিয়েছে। মৃত্যুর দিকে, মৃতদেহের দিকে সারাক্ষণ আমাদের চোখ। আমাদের কৌতূহল এখন মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে, অসুখের বিস্তার নিয়ে। নিজেদের বিচ্ছিন্ন রাখার, প্রিয়তমজনের থেকেও দূরে থাকার নির্দেশ পালন অভ্যেস করতে করতে বয়স্ক হচ্ছি আমরা।
এটা আমাদের কারওই অভিজ্ঞতায় ছিল না, সবাই নিজেদের সমস্যা নিজের মতো করে সামলে নিচ্ছি, কিন্তু যাঁদের আজকের খাওয়াপরা আজকের রোজগারেই চলে, তাঁরা কেমন আছেন ভাবলে নিজেদেরই বিপন্ন মনে হচ্ছে। এতদিন সেইসব জীবনের খবর না নিয়েই বড় হয়েছি, কিন্তু আজ সঙ্কট এতটাই থাবা বাড়িয়েছে যে বিপর্যয়ের ছালচামড়াছাড়ানো চেহারাটা আস্তে আস্তে আকার পাচ্ছে। এই বিপদ আমাদের কীভাবে হরণ করবে আমরা কেউ জানি না। হয়তো সবাই অপেক্ষায় আছি, প্রস্তুত হচ্ছি শেষের সেই ভয়ঙ্কর দিনের জন্য।