আপনি কি তিতলিকে চেনেন? বা তিতলির মতো আর কাউকে?

আত্রেয়ী কর

 




লেখক জনসংযোগ ও সমাজকর্মী।

 

 

যেদিন প্রথম তিতলি শুনেছিল এই ভাইরাসটার কথা, সেদিনই মনটা কু ডেকেছিল ওর। তারপর, থেকে-থেকেই ওর মনে হচ্ছিল, খুব খারাপ একটা কিছু হবে। মনে-মনে প্রার্থনা করে চলেছিল, মোবাইলে পাওয়া মেসেজগুলো যেন সত্যি হয়। ভারতের মতো গরম দেশে এই ভাইরাস বাঁচবে না, বলেছিল সকলে। ভারত সরকার নাকি খুব ভাল কাজও করছে। কারণ, দেশগুলো যখন সব মুখ থুবড়ে পড়েছে, তখনও ভারতে ব্যাপারটা মোটের ওপর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। কিন্তু, তবুও মনটা শান্ত হচ্ছিল না। কে জানে, কী হবে।

এরই মধ্যে একদিন খবরে শুনল ইতালিতে নাকি মানুষ গৃহবন্দি, স্পেনেও। আমেরিকাতেও নাকি বেশ বাড়াবাড়ি অবস্থা। ব্রিটেনে প্রিন্স চার্লসেরও ধরা পড়েছে এই অসুখ। এবার কী হবে? তিতলি ভয়েই মরে যাবে। গৃহবন্দি হয়ে পড়বে নাকি এ-দেশের মানুষও?

দেখতে দেখতে মার্চ মাসের ২০ তারিখ। প্রধানমন্ত্রী আজ দেশবাসীকে জানাবেন, ভারতে ঠিক কীভাবে আমরা মোকাবিলা করব এই বিশ্বব্যাপী মহামারির। ঘরে ঘরে সবাই টিভির সামনে। তিতলি রান্নাঘর থেকে কান পেতে শোনার চেষ্টায়। যেই উনি বললেন আগামী ২২ তারিখ ‘জনতা কারফিউ’, তিতলির হাত-পা ভয়ে ঠান্ডা হয়ে গেল।

কী ভাবছেন? তিতলির অসুখবিসুখে বড় ভয়? বয়স বেশি, তাই ভয় পাচ্ছে, করোনা ভাইরাসে ও মরে যাবে? ওর মধ্যে অসুখের লক্ষণ দেখা দিয়েছে এর মধ্যেই?

না।

সোম থেকে শনি, তিতলির বর অফিস করে, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে বাড়ি ফেরে রাত দশটায়। সকাল দশটা থেকে রাত দশটা, এই বারোটা ঘণ্টা তিতলির নিজস্ব সময়। এই সময়ে সে বাড়ি পরিষ্কার করে, রান্নাবান্না করে, টিভি দেখে, পাশের বাড়ির বউদির সঙ্গে সুখদুঃখের গল্প করে একটু। আর রবিবারের বিকেল পাঁচটা থেকে রাত এগারোটা। বর যায় মদ খেতে, বন্ধুদের সঙ্গে। তখন তিতলির একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার অবসর।

ব্যস? এইটুকুর জন্য এত? কী, স্বার্থপর একটা মেয়ে রে বাবা! বর বাড়িতে থাকবে, তাতে এত সমস্যা!

একটু মন দিয়ে পড়ি তা হলে তিতলির কথা। সোম থেকে শনি, সকাল দশটা থেকে রাত দশটা– এই সময়টায় আসলে সে আগের দিনের ক্ষতগুলোর ওপর ডেটল লাগিয়ে, ব্যথা বেশি থাকলে ওষুধ খেয়ে, বাড়ি পরিষ্কার করে, মুচড়ে দেওয়া হাতের যন্ত্রণা উপেক্ষা করে রান্নাবান্না করে, কষ্ট ভুলতে টিভি দেখে, পাশের বাড়ির বউদিকে আগের রাতের মারের ফিরিস্তি দেয়। আর রবিবারের সকাল থেকেই কথায়-কথায় বউকে গালাগালি আর চড়-থাপ্পড় দেওয়ার পর, বিকেল পাঁচটা থেকে রাত এগারোটা বর যখন মদ খেতে যায় বন্ধুদের সঙ্গে, তখন তিতলি একটু নিঃশ্বাস নেয়। তৈরি হয় রাতের প্রহসনের জন্য। যেদিন-যেদিন মদ খেয়ে আসে লোকটা, সেদিন যেন মাত্রা হারায় অত্যাচার। আগে থেকে মন শক্ত করে না থাকলে রবিবারের রাতগুলোর বিভীষিকা সামলে উঠতে পারবে কি তিতলি? আড্ডা বাতিল হয়ে গেলে বাড়িতেই খাবে। বাতিল হওয়া আড্ডার রাগটাও যে তিতলির ওপরেই…

একদিনে শেষ হয়নি তিতলির হয়রানি। ২৪শে মার্চ থেকে একুশদিনের লকডাউন ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। মোবাইলে মেসেজ আসছে, #স্টেহোমস্টেসেফ। মেসেজ পড়ে তিতলি হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না। ওষুধ লাগানোর সময় নেই, পুরনো চোটের ওপর রোজ নতুন করে আঘাত পড়ছে। বাড়িতে আটকে থাকায় রাগ বেড়েছে তিতলির বরের। মারধোরও বাড়ছে তাই। আগে আদর করত মাঝে-মাঝে। এখন জোর করে। রোজ। তিতলির শরীর দেয়, দিতে বাধ্য হয় বলেই। আর মন? সেটার কথা ভাবার অবকাশ কই তিতলির? বউদির সঙ্গেও ভাল করে কথা বলতে পারে না তিতলি। বরের বারণ। রাগিয়ে দিলে করোনায় না-মরলেও, হয়তো মার খেয়েই মরতে হতে পারে।

খবরের কাগজে তিতলি পড়েছে, করোনায় লকডাউনের জেরে ঘরোয়া হিংসা বেড়েছে, বাড়ছে, গোটা পৃথিবীতে। কতটা বেড়েছে, সেটা কেউ জানে না। তিতলির মতো কতশত মেয়ে যে অত্যাচারী স্বামীদের সঙ্গে গৃহবন্দিদশা কাটাচ্ছে বাধ্য হয়ে, তার কোনও পরিসংখ্যান নেই।

পরিসংখ্যান নেই, পরিসংখ্যান হয় না বলেই। কী করেই বা হবে? যাদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে, তারা কি অভিযোগ জানানোর মতো অবস্থায় আছে? নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে তিতলি জানে, নেই। আর অভিযোগ জানানোর মতো সচেতনতা? কজন মেয়ে সত্যি-সত্যি জানে, কোথায়, কীভাবে অভিযোগ করতে হয়? জানলেও, অভিযোগ জানানোর সাহস জুগিয়ে উঠতে পারে কতজন? বাড়ি থেকে পুলিশ-থানার সামান্য দূরত্বটুকু পেরনোর পথে– কিংবা, হেল্পলাইনে ফোন করে অভিযোগ জানানোর সময়টুকুর মধ্যে– কতবার তাদের পায়ে-পায়ে বাধা দিতে থাকে মা-ঠাকুমার কাছে শুনে-শুনে মাথায় গেঁথে যাওয়া আজন্মলালিত সংস্কার… চুপ করে থাকো, মানিয়ে নাও, সহ্য করো, মেয়েদের সহ্য করতে শিখতে হয়…

তিতলি বা তিতলির মতো মাঝবয়সি গৃহবধু, কিংবা, সদ্য কৈশোরে পা-রাখা ছোট্ট যে মেয়েটার গায়ে রোজ হাত দেয় তার কাকু, কিংবা যে বাচ্চা ছেলেটা রোজ অকারণে মার খায় বাবার কাছে, যে বউটাকে রোজ তার স্বামী ধর্ষণ করে, যে মেয়েটার ওপর মানসিক নির্যাতন হয় রোজ– তাদের প্রত্যেকের কাছে বাড়ির বাইরের পৃথিবীটাই নিঃশ্বাস নেওয়ার একমাত্র জায়গা। যেখানে যাওয়ার রাস্তা আপাতত গোটা পৃথিবীর অর্ধেকটা জুড়ে বন্ধ। অতএব, তাদের প্রত্যেককেই, এখন শুধু সহ্য করতে শিখতে হয়…

ইউএন উইমেন-এর পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিদিন, নিজের পরিবারের লোকের হাতে খুন হয়ে যান ১৩৭ জন মহিলা। এর অর্থ, তিতলি একা নয়। গোটা বিশ্বকে মারণ ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে ঘরোয়া হিংসায় অত্যাচারিত এই অসুরক্ষিত জনগোষ্ঠীকে হয়তো মরতে হবে– কারণ বাড়িটা তাঁদের কাছে আদৌ নিরাপদ নয়। মরতে হবে– কারণ লকডাউন ঠিক যেমন অসংগঠিত ক্ষেত্রের দিনমজুরদের কথা ভাবে না, তেমনই ভাবে না এদের কথাও।

আপনি কি তিতলিকে চেনেন? বা তিতলির মতো এমন অন্য কাউকে, যে ঘরোয়া হিংসার শিকার? তাকে, বা তাদেরকে এই হেল্পলাইনগুলির সন্ধান জানাতে পারেন–

http://www.ncw.nic.in/helplines

https://www.facebook.com/BreakthroughIN/photos/pcb.10158060198877510/10158060183857510/?type=3&theater

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...