হয়তো প্রথমবার, পৃথিবী সত্যিকারের সমতল

বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

 





লেখক গল্পকার, তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী।

 

 

 

করোনার দিনগুলোয় নতুন একটা শব্দের সঙ্গে পরিচিত হলাম। সিটজফ্লিশ (sitzfleisch)। অভিধান ঘাঁটলে তার দুটো মানে দেখায়— ১। পাছা ২। লেগে থাকার ক্ষমতা। করোনার চাপে তিন সপ্তাহ আগে যখন অফিসে এসে ‘আর কাজ কোরো না’ এই নির্দেশ জারি হল এবং বাড়িতে বসে কাজ করা বহাল হল, বুঝলাম দুটো মানেই আসলে একই দিকে আঙুল তুলেছে। কানে ফোনের তার গুঁজে বসে বসে স্ক্রিনের দিকে সারাদিন তাকিয়ে কাজ তুলতে গেলে লেগে থাকার ক্ষমতা চাই আর এই লেগে থাকতে গিয়ে দিনের শেষে পাছার থেকে দাগ ঘষে তুলতে হয় সেটাও সত্যি।

কথা হল, করোনায় যখন সব বন্ধ তখন আমরা এত কাজ করছি কোথায়? আমি যেহেতু তথ্যপ্রযুক্তিতে কাজ করি, এমনিতেই ফোনে আর ভিডিওতে দূরকে কাছে এনে কাজ করতেই হয়। অফিস এসে কেবলমাত্র এক দল কর্মীর সঙ্গে দেখা হয়। আর ভিনদেশি দলের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা অবরেসবরে। অথবা সামনাসামনি মোলাকাত হয় না কখনওই।

এমনিতে সেই দূরত্ব অনুভব করা যায় না সেভাবে। অভ্যাস হয়ে গেছে বলেই বোধহয়। কিন্তু এখন যখন সবাই নিজের নিজের ঘরে বন্দি, কারও সঙ্গেই আর দেখা হওয়ার উপায় নেই, তার অভিঘাতটা অনেক বেশি। এর উপরে বাড়ির বাইরে যাওয়া যাচ্ছে না, রেস্তোরাঁ বার বন্ধ, গ্রসারি কিনতে গেলেও সামাজিক দূরত্ব– একরকম বাইরের লোকের সঙ্গে মুখ দেখাদেখিটাই বন্ধ। দেখা হয় তো শুধু ভিডিওতে। আগে মিটিঙের সময় ভিডিও ব্যবহার কম ছিল, এখন বেশ বেড়ে গেছে। কোনও কোনও সময় বাধ্যতামূলক। সেখান থেকেই বুঝতে পারলাম করোনা আমেরিকার সামাজিক জীবনে কীরকম পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে।

আমেরিকার মিড ওয়েস্টে খোলামেলা ছড়ানো ছিটানো বাড়ি, বাড়ি থেকে কাজ করার জন্য অফিস ঘরও থাকে। কিন্তু এবার মিটিং শুরু হতে দেখা গেল বেশিরভাগই তার মিটিং রুম থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। তার কারণ বিভিন্ন।

অনেকেরই ছেলেমেয়ে যে যেখানে থাকে, সাময়িক পাততাড়ি গুটিয়ে বাবা মায়ের কাছে চলে এসেছে। সঙ্গে হয়তো এসেছে তাদের প্রেমিকও। যারা বিবাহিত তারাও বাবা মায়ের কাছে এসে জুটেছে। তাই বাড়িতে জায়গার অভাব, শোরগোলও যথেষ্ট। নিজেকে নীরব রাখার বাটনটি ভুল করে দেওয়া না থাকলে, অনেক সময় পিছন থেকে আপত্তিকর আওয়াজ বা শব্দগুচ্ছ এসে সবার কাছে হাসির খোরাক হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা। অতএব অবস্থা বুঝে কেউ কেউ দিনের বিভিন্ন সময়ে বাড়ির নানা আপাত শান্ত নিরালা খুঁজে মিটিঙের জায়গা বানিয়ে নিয়েছে। এমনকি গ্যারাজেও। কিন্তু কারও ছোট বাচ্চা থাকলে কিংবা অনেক সময় ভুল করে পিছনে কেউ খালি গায়ে চলে এলে সে আরেক খোরাক। কারও বাড়িতে লন্ড্রিরুমেই ইন্টারনেট কানেকশান সবচাইতে ভাল, তাই হয়তো ল্যাপটপ রেখেছে ওয়াশিং মেশিনের উপরে। এই অবস্থায় নিজের ব্যাকগ্রাউন্ডে কী আছে সেটাও অনেকে দেখাতে রাজি নয়। তার একটা উপায় অবশ্য হয়ে গেছে। এইসব ভার্চুয়াল মিটিং রুমে নিজের পিছনে আনা যাচ্ছে ইচ্ছামতন ব্যাকড্রপ।

মোদ্দা কথা বাড়িতে পরিবারের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির চাপে কাজ করতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে, অথচ ভিডিওতে কাউকে আনন্দের হাসি গোপন করতে দেখলাম না। করোনা কি তাহলে পরিবারের ছড়িয়ে থাকা সদস্যদের কাছাকাছি এনে দিল? ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের দেশ আমেরিকায় ছেলেমেয়ে কলেজ জীবন থেকেই আলাদা হয়ে যায়। সেটাই স্বাভাবিক, অথচ এখন সেই বড় হয়ে যাওয়া, কলেজে পড়া কিংবা চাকরি করা ছেলেমেয়েরা এক ছাদের তলায় এসে পড়েছে, জায়গার বেশ অসুবিধাই হচ্ছে। কারণ ছুটি তো নয়, কাজ করতে হচ্ছে সবাইকেই। স্কুল কলেজ চলছে জুম কিংবা অন্য কোনও প্ল্যাটফর্মে। তবু এই দুঃসময়ে মিলেজুলে থাকাটা ভাল লাগছে সবার। যেন অসময়ে এসে গেছে থ্যাঙ্কস গিভিং বা ক্রিসমাস। অথবা বাঙালির অকালবোধন।

নিজের পরিবারকে নিয়ে বেঁধে বেঁধে থাকতে তাহলে সবাই ভালবাসে, হোক না কেন যে কোনও দেশ, সমাজ বা জাতের। দুঃখের দিনে এই যূথবদ্ধতা আরও বেশি।

আর একটা ব্যাপারও বিশেষভাবে অনুভব করলাম। যখনই আমরা এরকম কোন মিটিং শুরু করি, প্রথমে একটু খোশগল্প হয়। যেহেতু বেশিরভাগ সময়েই আমেরিকা, ইউরোপ আর ভারতের বিভিন্ন শহরের লোক থাকে এইসব মিটিঙে, কথা শুরু হয় আবহাওয়া দিয়ে। চেন্নাইতে আবহাওয়া হট, হটার না হটেস্ট চলছে সেই নিয়ে মশকরা, মিশিগানে বরফ পড়া বন্ধ হল কিনা অথবা লন্ডনে কবে বৃষ্টি হচ্ছে না সেই নিয়ে টিপ্পনির আদান প্রদান চলে। বিশেষ উৎসবের দিনে চেন্নাইয়ের পোঙ্গল কিংবা দীপাবলি, আমেরিকার ইস্টার অথবা থ্যাঙ্কস গিভিং আলোচনায় বরফ গলানোর কাজ করে। কিন্তু এই প্রথম সব দেশে, সব শহরে একই আবহাওয়া, একটাই উৎসব, একটাই আতঙ্ক। করোনা। হঠাত অনুভব করলাম পৃথিবী এখন সমতল।

একটা অসুখ, পৃথিবীর সব দূরত্ব অস্বীকার করেছে। সমস্ত মহাদেশ একসঙ্গে আক্রান্ত।

একটা অসুখ কোনও শ্রেণিবিভেদ মানেনি। ইংল্যান্ডের রাজা কিংবা প্রধানমন্ত্রী, আমেরিকার ধনপতি অথবা হলিউডি শিল্পী, চিনের ডাক্তার বা ইরানের মৌলানা, ভারতের দিনমজুর অথবা পাকিস্তানের আমলা সবাইকে ছুঁয়ে ফেলেছে।

একটা অসুখ সমস্ত দেশের অর্থনীতির চাকা বন্ধ করেছে। হোক না সেই দেশ সাম্যবাদী, পুঁজিবাদী, গণতান্ত্রিক অথবা একনায়কতন্ত্রী— স্তব্ধ অথবা শ্লথ হয়ে গেছে অর্থনীতির গতি।

চলমান পৃথিবীকে বাইরে দাঁড় করিয়ে নিজের ঘরে বসে থাকার দিনে, তাবৎ দুনিয়াটাকে এই অসুখ পেড়ে ফেলেছে তার করুণ সুরে। করোনা নামের এই বুলডোজার আমাদের চেনা জগতটাকে মাত্র কয়েক মাসেই সমতল করে দিয়েছে এক্কেবারে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4885 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...