মরণ হতে যেন জাগি

পূর্বা মুখোপাধ্যায়

 




লেখক কবি ও গদ্যকার।

 

 

 

সত্যি বলতে কী প্রথমটায় অসম্ভব ভয় পেয়েছিলাম, হাড়হিম করা ভয়। কলকাতার দক্ষিণ থেকে উত্তরপ্রান্তে বাইকে আসতে আসতে মনে হচ্ছিল সশরীরে মৃত্যুলোকে উড়ে চলেছি। ২২ মার্চ ২০২০, সকাল থেকে শহরের বেশিরভাগ প্রধান রাস্তা অবরুদ্ধ। বিভ্রান্ত হয়ে বারবার ভুল দিকে চলে যাচ্ছি, মোট তিনবার পুলিশ আটকাল। কৈফিয়ত দিতে গিয়েও মনে হচ্ছিল সময় নেই, এক্ষুনি উড়ে যাই, এক্ষুনি উড়ে যাই… প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আতঙ্কিত পশুর মতো রাস্তায় নেমে আসা মানুষ মার খাচ্ছে, তবু ডেরায় ঢুকছে না, এই দৃশ্য নরকের মতো তাড়া করে আসছিল আমায়।

দেড়ঘণ্টায় বাড়ি পৌঁছলাম। নিজের শরীর ভর্তি সন্দেহ স্যানিটাইজ করে ঘরে ঢুকলাম। অসুস্থ বৃদ্ধ দুজন ডায়াবেটিক মানুষ ফ্যালফ্যাল করে মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। তখনও লকডাউনের সম্যক মানে বুঝতে পারছেন না। শুধু ফোনে বলেছেন, না, বেশি খাবারদাবার নেই। তাঁদের জন্যেই ছুটে আসতে গিয়ে কোনও সর্বনাশের বীজ পথ থেকে আমারই শরীরে কুড়িয়ে এনেছি কি? ভাবতে ভাবতে সত্যিই জ্বর এসে গেল। পরের তিনদিন শুধু ভয়জনিত আচ্ছন্নতা। খিদে নেই তেষ্টা নেই ঘুম নেই আচ্ছন্নতা শুধু। আর ফেসবুকে উঁকি দিয়ে দেখা, পৃথিবী আতঙ্কে শিউরে উঠেছে। একটি আণুবীক্ষণিক ভাইরাস শাসন করছে তাকে।

একটা করে দিন কাটে আর যে-কোনও অভিজ্ঞতার সঙ্গে মানিয়ে নিই আমরা। ঘটনার তীব্রতা সামান্য হলেও লঘু হয়ে আসে। সোশ্যাল মিডিয়ায় পড়ে থেকে থেকে আমরাও অনেকখানি সাহস সংগ্রহ করলাম। ঠাট্টাতামাশা, সুদৃঢ় রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ, সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান, অর্থহীন হাহাহিহি, রান্নাবান্নার ছবি পোস্ট করে করে “আর ভালো লাগছে না” কথাটাকে ফিকে করে ফেললাম আমরা। হ্যাঁ, এরও দরকার ছিল। মৃত্যু কোন অন্ধিসন্ধিতে ওৎ পেতে আছে না জেনেও মানুষকে প্রতিদিনের বাঁচাটা বাঁচতে হয়। এখন জ্ঞাতসারে তার প্রবল সম্ভাবনাটিকেও মানুষ আর তত গ্রাহ্য করছে না। দলে দলে পথে নেমে পড়েছে। প্রতিদিনই কৈফিয়ত দিচ্ছে, না বেরোলে উপায় নেই। আসলে কেউ কেউ নিরুপায়। বাকিরা নিত্যদিনের অভ্যেসের ওপর গৃহবন্দিত্বের এই প্রবল স্নায়ুচাপ আর টানতে পারছে না। বিপর্যয়ের বোধ ঝিমিয়ে আসছে।

লকডাউন চলাকালীন মাত্র দুদিন, আমাকেও নিরুপায় হয়ে বাইরে যেতে হয়েছিল। একদিন দেখলাম পরিচারিকার কাজ হারিয়ে ফেলা মেয়েরা রাত্রিবেলা স্লিপ নিতে যাচ্ছে কোথাও, ফ্রিতে খাবার পাবার স্লিপ। ঘরে টাকা নেই, হাতে কাজ নেই, দশ বছরের ছেলের হাত শক্ত করে আঁকড়ে স্বপ্না, আমাদের পুরনো সাহায্যকারিনী মেয়েটি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। আমি ওর মুখ থেকে চোখ সরিয়ে আকাশে তাকালাম। ঘাঁটা টিপের মতো সোনারঙের বিশাল সুপারমুন… আঃ! জরা ব্যাধি মৃত্যুর ছোবল থেকে এই আর্ত পৃথিবীকে ত্রাণ করবার আমি কে? কে আমি? কেউ না। আমি শুধু অস্তিত্ব। আপনাতে আপনি পূর্ণ হওয়ার জন্যে আমার কান্না, দীর্ঘদিন পর ওই দূষণহীন, নির্মল, নক্ষত্রোজ্জ্বল, জ্যোৎস্নাচন্দনে স্নিগ্ধ ঐশ্বরিকতার কাছে নতজানু আমার উন্মুখ কান্না, শূন্যের ভেতর লুটিয়ে লুটিয়ে চলে যাক!

শান্ত লকডাউন। শান্ত বাড়িঘরগুলি। শান্ত কোয়ারেন্টাইন। সকালের নিয়মে সকাল আসে, দুপুর ঘুরে যায়, বিকেল পড়ে গিয়ে সন্ধে নামলে অলৌকিক চাঁদ ঝকঝক করে আকাশে। শান্ত নিবিড় এই মফস্বলে জীবলোকপালিনী প্রকৃতির রহস্য জেগে ওঠে রোজ। পশু, পাখি, বৃক্ষের সংসার যে একটি পূর্ণতার পরম আভাস বয়ে এনে আশ্বস্ত করছে, সুন্দরের প্রতি নত হতে ডাকছে প্রতিদিন, আপাতত অমৃতরূপের সেই জাদুশক্তিতে আস্থা রেখে স্থির হয়ে আছি। টের পাচ্ছি, আমি কত মহৎভাবে আত্মপরায়ণ।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4881 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...