পারভেজ হুডভয়
পারভেজ হুডভয় (জন্ম ১৯৫০) পাকিস্তানের প্রথিতযশা পরমাণু বিজ্ঞানী। ভারতীয় উপমহাদেশের একজন সর্বশ্রেষ্ঠ মানের পদার্থবিজ্ঞানী আচার্য আবাদুস সালাম-এর এই প্রিয় ছাত্রটি বিজ্ঞানবিমুখতার বিরুদ্ধে সারা জীবন লড়াই চালিয়ে আসছেন। তার 'ইসলাম অ্যান্ড সায়েন্স' অতি মূল্যবান এক গ্রন্থ। বর্তমান নিবন্ধটি ডন পত্রিকায় গত ৪ঠা এপ্রিল ইংরাজিতে প্রকাশিত। বাংলায় তর্জমা করেছেন আশীষ লাহিড়ী।
ডারউইনকে ঘেন্না করতে শেখানো হয় পাকিস্তানিদের। যেসব স্কুলশিক্ষক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের ঘাড়ে ডারউইনের বিবর্তন-তত্ত্ব পড়ানোর ভার চাপানো হয় তাঁরা সচরাচর সে-ভার এড়িয়ে যান; আর যদি-বা পড়ান, তাহলে প্রথমে প্রচুর পরিমাণ গালমন্দ দিয়ে তত্ত্বটাকে নরমসরম করে নেন। জীববিজ্ঞানের একটি বহুপঠিত স্কুলপাঠ্য বইতে বিবর্তন তত্ত্বর বারোটা বাজানো হয়েছে স্রেফ এই যুক্তিতে যে, প্রজাতির বিবর্তনকে মেনে নিলে এ-ও মানতে হয় যে দুটো রিকশার সংঘর্ষ বাধলে তার পরিণামে ‘একটা মোটর গাড়ির বিবর্তন হয়।’ ২০০২ সালে ইমরান খান একটি প্রবন্ধে পাশ্চাত্য জগতের ভুলভ্রান্তিগুলোর জন্য দোষ দিয়েছিলেন ‘ডারউইনের মতো দার্শনিকদের, যিনি একটা আধা-খেঁচড়া বিবর্তন তত্ত্ব দিয়ে নাকি প্রমাণ করে গিয়েছিলেন যে মানুষের সৃষ্টিকাহিনি ভুল, তাই ধর্মও ভুল। এইসব তত্ত্ব লোকে সম্ভ্রম সহকারে পড়েছে।’
আজ যখন করোনা-বিপর্যয় আসন্ন, তখন একথা মনে করিয়ে দিয়ে কোনও লাভ নেই যে ডারউইন ছিলেন একজন প্রকৃতিবিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী এবং ভূতত্ত্ববিদ; তিনি দার্শনিক ছিলেন না। খ্রিস্টান, ইহুদি আর হিন্দু মৌলবাদীদের হাতেও যে ডারউইন নিয়তই চাবকানি খেয়ে চলেছেন, সেকথাও মনে করিয়ে দিয়ে লাভ নেই। অথচ আজকের এই মারণ-ভাইরাসকে ঠেকানোর যা-কিছু আশা আমরা পোষণ করছি, তা কিন্তু পুরোপুরি ডারউইনের ওই দুশো বছরের পুরনো আবিষ্কারটির ভরসায়— যার নাম প্রাকৃতিক নির্বাচন।
সংক্ষেপে: প্রাকৃতিক নির্বাচনের বক্তব্য, ঐতিহ্য যাই বলুক, পৃথিবীতে প্রাণ কোনও পূর্ব-নির্ধারিত উদ্দেশ্য কিংবা পূর্ব-নির্ধারিত রূপ নিয়ে আসেনি। বরং প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব অনুযায়ী প্রাণের সেইসব রূপই টিকে যায় যারা একটা সুনির্দিষ্ট পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের সবচেয়ে ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পারে। যারা তা পারে না, তারা ধ্বংস হয়ে যায়। কথাটা জীবাণু আর মানুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তার চেয়েও বড় কথা, বিবর্তন তত্ত্ব অনুযায়ী প্রাণের নতুন নতুন রূপ আর নতুন নতুন অণু নিয়মহারা বা যদৃচ্ছভাবে দেখা দেয়। তাদের মধ্যে অল্প দু-চারটে— যেমন করোনা ভাইরাস— ঘটনাচক্রে উপযুক্ত কোনও প্রাণী বা মানুষের কোষে আস্তানা গাড়ে এবং বংশ বিস্তার করে।
প্রত্যয় হল না? বেশ, তাহলে গোটাকতক স্লাইড আর একটা দামি অণুবীক্ষণ জোগাড় করুন। লাখ দশেক ডলার দামের একটা ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ হলেই সবচেয়ে ভালো হয়। তারপর ধৈর্য ধরে দেখতে থাকুন, কোষগুলোর প্রজনন। খানিক পরেই দেখবেন, কতকগুলো কপি বেরোচ্ছে যা নিখুঁত নয়। এইসব খারাপ কপির বেশিরভাগই মরে যায়। কিন্তু অল্প দু-একটা টিকে যায় আর তারাই বংশবিস্তার করে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এইভাবেই ক্যান্সার-কোষগুলো তৈরি হয়। স্লোন কেটারিং ক্যান্সার সেন্টারে যেসব পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো হয়েছে তা থেকে দেখা যায়, পরিবেশ বদলে দিলে কতকগুলো সুপরিচিত ব্যাকটেরিয়ার ওপর তার প্রভাব ঠিক কীভাবে পড়ে। এসব দেখে প্রসিদ্ধ আণবিক জীববিজ্ঞানী হার্মিট মালিক মন্তব্য করেছেন, প্রাকৃতিক নির্বাচন হল ‘পৃথিবীতে বেড়াল-ইঁদুর খেলার সবচেয়ে আদর্শ পদ্ধতি। ভাইরাসরাও বিবর্তিত হয়, তাদের আশ্রয়দাতারা মানিয়ে নেয়, প্রোটিনগুলো বদলে যায়, আর ভাইরাসেরা তাদের পাশ কটিয়ে যায়। এ খেলা কখনও শেষ হয় না।’
পদার্থবিজ্ঞানে নিউটনের সূত্র যতখনি মৌলিক, জীববিজ্ঞানে ডারউইনীয় নির্বাচন ঠিক ততখানিই মৌলিক। মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব না মানলে মাধ্যাকর্ষণ যেমনটি ছিল তেমনিই থাকবে, কিন্তু আমাদের পদার্থবিজ্ঞান চর্চা করার ক্ষমতা আর থাকবে না। একইভাবে, বিবর্তন তত্ত্ব না-পড়ালে ঝা-চকচকে নতুন নতুন ভাইরাসের উদ্ভব থামবে না, কিন্তু রোগ আর মহামারির সঙ্গে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মোকাবিলার কথা আপনাকে ভুলতে হবে।
ডারউইনের নির্বাচন তত্ত্ব ব্যতিরেকে আমরা জীবাণুর সঙ্গে তার আশ্রয়দাতার আন্তঃক্রিয়া সম্বন্ধে কিছুই বুঝে উঠতে পারব না। রোগজীবাণুর বিবর্তন বুঝতে পারব না। ওষুধ আর ভ্যাকসিন তৈরির কাজ শুরুও করতে পারব না। তা নাই-বা পারলাম, তবু এগিয়ে চলো ভাই, ডারউইনকে গাল পাড়ো, কেননা তিনিই তো ওই ‘যোগ্যতমের উদ্বর্তন’ ধারণাটির উদ্গাতা। বেশ, ভালো কথা। কিন্তু একই সঙ্গে নিউটনকেও সাজা দাও, কেননা আপেলগুলো যে ওপরে উঠে যাওয়ার বদলে কেবলই নীচে পড়বার জন্য জেদ করে।
এবার একটা সুসংবাদ: বেশিরভাগ শিক্ষিত মানুষই বুঝতে শুরু করেছে, কেন বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি কাজে দেয় এবং কেন বিজ্ঞান-বিরোধী পদ্ধতি কাজ করে না। তার চেয়েও ভালো কথা, এমনকী অতি-রক্ষণশীলরাও, বিজ্ঞানকে যারা বাতিল করে দিয়েছে সেইসব বিশ্বনেতারাও, এখন নতজানু হয়ে বিজ্ঞানীদের কাছে প্রার্থনা করছে, যাতে উদ্ধারকাজ ত্বরান্বিত হয়। মুখে তারা যতই ধর্মবিশ্বাসের কথা বলুক, যতই ট্যাং ট্যাং করে বাসনপত্র বাজাবার কথা বলুক আর বারান্দা থেকে হাততালি দেওয়ার ডাক দিক, শেষ পর্যন্ত তারা করোনা ভাইরাস-প্রতিরোধী ভ্যাকসিন আর ওষুধের জন্যই সওয়াল করতে বাধ্য হচ্ছে। ধাপ্পাবাজি, গলাবাজি আর কাঁসর-ঘণ্টা-বাজির একটা সীমা তো কোথাও আছে।
নরেন্দ্র মোদির কথাই ধরুন। তিনি প্রাচীন ভারতের অগাধ চিকিৎসা-ব্যুৎপত্তির কথা বলেন। বহু বছর ধরে তিনি ও তাঁর হিন্দুত্ব-বাহিনী গোমূত্রর নিরাময়-শক্তির কথা বলে আসছেন। আয়ুর্বেদ আর যোগের উচ্ছ্বসিত প্রশংসাও করছেন। কিন্তু ভারতের সবচেয়ে করোনা-আক্রান্ত অঞ্চলগুলিতে ভারত জরুরি ভিত্তিতে ‘কাউ-কা-কোলা’ কিংবা গোবর পাঠানোর আহ্বান জানাচ্ছে না।
সীমান্তের এপাশে আমরা এখনও পর্যন্ত জাহাজ ভর্তি করে সৌদি আরবের আজোয়া-খেজুর আনানোর অর্ডার দিইনি। অথচ পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধর্মপ্রচারক, ঘনিষ্ঠ ইমরান-বান্ধব মৌলানা তারিক জামিল-এর মতে ওই খেজুর নাকি সর্বরোগহর। তাছাড়া সরকার এখনও দশ লক্ষ কালো পাঁঠা বলি দেওয়ার কিংবা বিপুল পরিমাণ অলিভ অয়েল আর কলোন্জি আমদানি করার ব্যবস্থাও করেনি।
তার বদলে ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোতে সবার মেজাজ এখন অপ্রমত্ত, চিন্তাশীল। গত শনিবার ভাটিকানে পোপ ফ্রান্সিস এক নাটকীয়, নির্জন প্রার্থনাসভার আয়োজন করেছিলেন। গা-ছমছম করা শুনশান চৌকের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি তামাম বিশ্বর কাছে আহ্বান জানালেন, যেন কোভিড-১৯ বিশ্বমারি একটা ঐক্য ও সংহতির পরীক্ষা হয়ে ওঠে। প্লেগ আর প্রাকৃতিক বিপর্যয় যে ঐশ্বরিক সাজা নয়, তিনশো বছর আগেই চার্চ শেষ পর্যন্ত তা মেনে নিয়েছিল।
ইরানও এক তিক্ত শিক্ষা লাভ করেছে। গত মাসে তার ধর্মীয় কর্তাব্যক্তিরা বুঝতে পারেন যে, কোম এবং মশাদ-এ তীর্থযাত্রী ঢুকতে দিয়ে তাঁরা এক পর্বতপ্রমাণ ভ্রান্তির শিকার হয়েছেন। সে-অনুমতি অবশ্য পরে তুলে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ইরানের ৩০০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন, আর সীমানা পার হয়ে সে-অসুখ পাকিস্তান আর আফগানিস্তানেও ছড়িয়ে পড়েছে।
তবে চরম আঘাতটা এল যখন সৌদি আরব ‘উমরা’ আপাতত বন্ধ রাখল এবং তারপরেই ঘোষণা করল, হজ-যাত্রা সম্বন্ধেও একটা সিদ্ধান্ত শিগ্গিরই নেওয়া হবে। এ খুবই বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত। নিযুত নিযুত মানুষ একসঙ্গে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করবে আর তারপর যার যার দেশে ফিরে গিয়ে ভাইরাস ছড়াবে— এর পরিণাম অত্যন্ত মারাত্মক হতে পারে। প্রতিটি মুসলিম দেশের রাজধানীতে একটি একটি করে পরমাণু বোমা ফাটালে অবস্থাটা যতখানি মারাত্মক হবে, ততখানিই। মনে করে দেখুন, চোদ্দো শতকে ইংল্যান্ডের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ মারা পড়েছিল, আর ইউরোপের অন্যান্য দেশে প্রায় আড়াই কোটি লোক ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
আচ্ছা, এ বছরের হজ যদি মোহাম্মদ বিন সলমান-এর বদলে ইমরান খানের অধীনে হয়, তাহলে কেমন হয়? তিনি কি বকবক করতে করতে সেখানেই গিয়ে হাজির হবেন, যেমনটি তিনি হন পাকিস্তানে? তাঁর সরকার তো পরিস্থিতির গুরুত্বকে বিপজ্জনকভাবে কমিয়ে দেখিয়েছে। তবলিগ ই জমাতের ধর্মসম্মেলন অবশ্য শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ হয়েছে, কিন্তু ততদিনে ক্ষতি যা হবার তা হয়ে গিয়েছে। উপাসনালয়ে দর্শনার্থী ভ্রমণ চলছেই।
সুখের কথা, সিন্ধ আর বালুচিস্তান সরকার এ বিষয়ে খানিকটা বেশি দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছে। তাছাড়া মনে হচ্ছে সামরিক বাহিনী যেন সরকারের বদলে অন্য কোনও জায়গা থেকে অর্ডার নিচ্ছে। তাই তারা সম্ভাব্য সংক্রমণ-আখড়াগুলোকে গায়ের জোরে বন্ধ করে দিচ্ছে। পাকিস্তান জুড়ে এখন শহরগুলোতে চেক-পয়েন্টের ছড়াছড়ি, ফলে মানুষজন এবং তাদের দ্বারা বাহিত ভাইরাসের অবাধ চলাচলে এখন কিছুটা ভাটা পড়েছে। এটুকুই যথেষ্ট কি না তা বলার সময় এখনও আসেনি।
জৈব বিজ্ঞানের দৌলতে— যার ভিত গড়ে দিয়েছিলেন চার্লস ডারউইন— শেষমেশ দেখা যাবে, এই করোনা ভাইরাস খুবই মারাত্মক হলেও নিয়ন্ত্রণের অতীত নয়। শেষ পর্যন্ত দুনিয়া জুড়ে এর শিকারতালিকা হয়তো বহু অযুত, এমনকী বহু লক্ষে গিয়ে পৌঁছবে। তবু, প্রাক্-বিজ্ঞান যুগের প্লেগগুলো যত মানুষের প্রাণ হরণ করেছিল, তার কাছে এ সংখ্যা কমই। হয়তো এমন কোনও ওষুধ বা ভ্যাকসিন আপনার জীবন বাঁচাবে যা এখনও তৈরি হয়নি। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের যারা উপকারভোগী তাদের সকলেরই উচিত ডারউইনের তথাকথিত বিচ্যুতিগুলোকে ক্ষমা করে দেওয়া।
খুবই সময়োপযোগী লেখা। খুব ভালো লাগছে যে আমাদের প্রতিবেশী পাকিস্তানেও অনেকে এই ধরণের চিন্তা করছেন। লেখাটি সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার।
Nice