কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়
লেখক গল্পকার এবং ব্লগার।
কবে যেন মুদির দোকানে গিয়েছিলাম। বারটার মনে নেই। করোনা এসে আমার শুক্রবারের রাতের উল্লাস, রবিবারের শোক, সোমবারের আত্মসমর্পণ, বুধবারের টানেলের মধ্যবিন্দু, বৃহস্পতিবারের আশার আলো সব ঘণ্ট পাকিয়েছে। আপাতত চব্বিশ ঘণ্টা, তিরিশ দিন, বারো মাস করোনাবার, করোনামাস, করোনাবছর। ২০২০, কী খেলই দেখালে মা।
দোকানের সামনে ক্রেতারা দূরে দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সামনের লোক সরে যাওয়ার পর এগিয়ে গিয়ে ম্যাগি চাল ডালের অর্ডার দিচ্ছি, চারহাত দূরে ডানদিকের লোকটাও দিচ্ছে। লোকটাকে চোখে পড়েছে আমার আগেই। বলা ভালো লোকটার কনফিডেন্স। মাস্কের আড়ালে মুখচোখ বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু কোমরে হাত দিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো বা কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট। অ্যাই, চিজ দে। পাস্তা এসেছে?… না না পোস্ত না, পাস্তা… এক কাজ কর, চিলি ফ্লেকস আর অরিগ্যানোও দিয়ে দে।
এই সব চলতে চলতে এক অতি নিরীহ চেহারার জেঠু এসে আমাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কী সব টোস্ট বিস্কুট সুজিমুজি কিনে চলে গেলেন।
খানিক পর আমারও হয়ে গেল। “হেঁইও” বলে বোঝা তুলে চলে আসছি, কানে এল, “যত্তসব ইডিয়টস। নিয়ম না মানলে পরিষ্কার মাল দিতে রিফিউজ করবি।”
কাকে রিফিউজ করতে বলল কে জানে। হয় নিরীহ জেঠুকে, যিনি আমাদের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। নয়তো আমাকে। কারণ আমি মাস্ক পরে ছিলাম না।
পাঠক, পুলিসে খবর দেওয়ার আগে আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিন। ঘটনার আগের রাতে আমি ডাক্তার দেবী শেঠির বক্তৃতা শুনেছি— যেখানে তিনি পষ্ট বলেছেন সর্দি হাঁচি কাশি না হলে খামোকা মাস্ক পরে ঘুরবেন না। বাজারে মাস্ক থাকলে স্বাস্থ্যকর্মীরা মাস্ক পরে বাঁচবেন। কাজেই আমি নিজেকে সামাজিক দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে প্রমাণ করার জন্য মাস্ক না পরে বাজারে গিয়েছিলাম। পরিস্থিতি বদলেছে। গোচরে এসেছে হার্ভার্ড থেকে প্রকাশিত কোন পেপারে নাকি লিখেছে (আমি পড়িনি, বুঝব না, চেষ্টা করে লাভ নেই) হাঁচাকাশার দরকার নেই, নিঃশ্বাস থেকেও নাকি ভাইরাস ছড়াতে পারে। কাজেই সচেতনতার প্রমাণ দিতে আমি এখন পায়ে চটি গলানোরও আগে মুখে মাস্ক গলিয়ে বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি। দেবী শেঠির থেকে হার্ভার্ডকে আমি বেশি বিশ্বাস করি।
তবে হার্ভার্ড, দেবী শেঠি এগুলো অজুহাত, আসল তাগিদ পিঠ বাঁচানোর। সচেতনতার দৌড়ে পিছিয়ে পড়লে চলবে না। তখন ম্যাগির সাপ্লাই বন্ধ করার হুমকি দিয়েছিল, এখন গণধোলাই দেবে। মার বেটিকে, পাকিস্তানে পাঠা।
রাস্তায় লোকে তাকালে আগে ওড়না ঠিক করতাম, এখন মাস্ক সামলাই।
ব্যাপারটা এখন শুধু সচেতনতায় আটকে নেই। সচেতনতার সীমা পেরিয়ে দেশপ্রেমের ডেঞ্জার জোনে গিয়ে পড়েছে। দেশের ডাক্তারদের উৎসাহ দিতে যখন সবাই থালা বাজিয়েছিল খুব মুখ মুচকেছিলাম। আমি যে বিজেপি নই এবং থালাফালা বাজাইনি এ গর্বে নতুন করে বুক ফুলেছিল। তারপর পাঁচ তারিখ রাত আটটা সাতান্নয় বাড়িওয়ালি এসে খটাস করে মেন সুইচ অফ করে দিলেন। সমস্ত প্রগতিশীলতা গিলে নিয়ে মিনমিন করে বললাম, আলো নিভিয়ে তো করোনার কিছু হবে না। বাড়িওয়ালি মিষ্টি কিন্তু কঠিন হেসে বললেন, না নেভালে কে জানে কী হবে, নেভালে ক্ষতি তো কিছু হবে না। অকাট্য যুক্তি। তারপর বলেন কী, চলো আমার সঙ্গে বারান্দায় বসবে, আমার একা একা অন্ধকারে ভয় লাগছে। এদিকে খতরোঁ কা খিলাড়ি-তে জ্যান্ত মানুষের সঙ্গে চৌবাচ্চায় অ্যানাকোন্ডা নামিয়ে দিচ্ছে সেসব সারাদিন বসে বসে দেখতে ভয় লাগে না। গেলাম। চমৎকার পরিবেশ। বাসন্তী বাতাস। দূরে বাজিপটকার ফটাস ফটাস। প্রতিবেশীরা যে যার বারান্দায়। প্রতিবেশিনীরা নাইটির কুঁচি সামলে মোমবাতিতে দেশলাই ছোঁয়াচ্ছেন। কিছু লোক মোবাইলে ছবি তুলছে। প্রোফাইল পিক করবে বোধহয়। প্রদীপের শিখায় তেরঙ্গা ঝাণ্ডা লহরাবে। কে জানে কার বাড়িতে সারাউন্ড সাউন্ডে “আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাআআআণে”।
বাড়িওয়ালি জিজ্ঞাসা করলেন, ভিডিওটা দেখেছ? ওই যে পাঁচশো টাকার নোটে ইউ-নো-হুইচ সম্প্রদায়ের একজন নাক ঝাড়ছে, থুতু ফেলছে— আমাদের ঝাড়েবংশে নির্বংশ করার মতলবে?
দেখার সাহস হয়নি তবে শুনতে হয়েছে তো বটেই। মিডিয়া, সোশ্যাল বা আনসোশ্যাল যে ভ্যারাইটিরই হোক না কেন, আসলে করোনার বাবা। আপনি ব্যক্তিগত সংক্রমণের রাস্তা বন্ধ রাখলে কী হবে, আপনার চেনাজানারা সংক্রামিত হলে আপনার বাঁচার চান্স নেই। কে কোথায় নাক ঝাড়ছে, কে কোথায় মাস্ক পরছে না, হু-র নোটিস, গোমূত্র পার্টির পোস্টার— সবের খবর আপনি রাখতে বাধ্য। আপনার সোশ্যাল সার্কেল বুঝে সেই পোস্টার নিয়ে অষ্টপ্রহর চুটকিও শুনতে হবে। যা, ফ্র্যাঙ্কলি বলছি, পার্টির থেকে কোনও অংশে কম প্রাণঘাতী নয়।
ম্যাগি ফুরিয়েছে, কাজেই কাল আবার যেতে হল বাজারে। মাস্ক পরে, বলাই বাহুল্য। রাস্তায় বেরিয়ে মাস্কের ভেতর থেকেই যতখানি পারা যায় বুক ভরে শ্বাস নিলাম। আহ্। মুক্তি। এজেন্ট বাড়ি দেখানোর সময় বলেছিল, লোকেশন দুর্দান্ত। পা বাড়ালেই বাজার। এই প্রথম মনে হল বাজারটা বড় বেশি কাছে, আরেকটু দূরে হলে ভালো হত। ধীরে ধীরে হাঁটি। পার্কে চুপিচুপি এক পাক দিই। পায়ের নিচে শুকনো পাতার কার্পেট। চোখের সামনে হলদে পাতার ঝর্না। তোমার করোনায় ভয় নেই, ঘোড়ানিম? ঘোড়ানিম খসখসিয়ে হাসে। আরও পাতা ঝরায় আমার মাথার ওপর। ঝেড়ে ফেলতে গিয়েও হাত নামিয়ে নিই। কে জানে আবার কবে এইটুকু ছোঁয়া পাওয়ার সুযোগ হবে।