সৌম্য শাহীন
লেখক অর্থনীতির অধ্যাপক।
নোভেল করোনা ভাইরাস আজ গোটা মানবসভ্যতাকে এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণুর সামনে নতজানু আজ পারমাণবিক শক্তিধারী তাবড় তাবড় সব রাষ্ট্র। এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশ তাদের সাধ্যমত প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা করছে। এই মুহূর্তে প্রধান কর্মসূচি হচ্ছে আক্রান্তদের জন্য উন্নত চিকিৎসার পরিকাঠামো গড়ে তোলা, যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে গৃহবন্দি জনতার খাদ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করা, বৃদ্ধবৃদ্ধা সহ অন্যান্য রুগ্ন মানুষের চিকিৎসা ও নিত্যআবশ্যকীয় পণ্যের জোগান চালু রাখা। এর জন্য সরকারি স্তরে আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা এবং সক্রিয়ভাবে বিপর্যয় মোকাবিলায় বিনিয়োগ করা একান্তই জরুরি। পুঁজিবাদী দুনিয়ার পোস্টার বয় ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই বাবদ একশো ছেষট্টি লক্ষ কোটি টাকার ত্রাণ ঘোষণা করেছে, যা তাদের জাতীয় আয়ের ১০ শতাংশ। কানাডা সরকার বিপর্যয় মোকাবিলায় ৮২০০ কোটি ডলার বরাদ্দ করেছেন যা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় সাড়ে চার লক্ষ কোটি টাকার সমান। সমস্ত নাগরিকের খাদ্য, স্বাস্থ্য, ঘরভাড়ার মত মৌলিক চাহিদাগুলোর ভার রাষ্ট্র বহন করবে— এই মর্মে বিবৃতি দিয়েছেন সেখানকার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো।
আমাদের দেশের অধিকাংশ রাজ্যেই সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামো অপ্রতুল। বিপুল জনসংখ্যা এবং তার ঘনবদ্ধতার নিরিখে যেকোনও মহামারির ক্ষেত্রেই তাই ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশী। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি যে এই রোগের তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা খুব দ্রুতগতিতে (অঙ্কের ভাষায় এক্সপোনেনশিয়াল রেটে) বাড়ে। এই অবস্থায় তাই সাময়িকভাবে অন্তত সমস্ত বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিং হোমকে অধিগ্রহণ করে আক্রান্তদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত। এই বিষয়ে ইতিমধ্যেই স্পেন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভারতবর্ষে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ এখন স্টেজ টু-তে রয়েছে। এই মুহূর্তে ব্যাপক সংক্রমণ রোধের একটাই পন্থা— সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং। সেই হেতু দেশব্যাপী শুরু হয়েছে লকডাউন কর্মসূচি, যার ফলে আপামর জনতা আজ গৃহবন্দি। এই দুর্যোগ পরিস্থিতিতে দেশবাসীর কাছে এটা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় যে যেখানে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে মূলত অন্যান্য দেশ থেকে আগত মানুষদের থেকে, সেখানে বিরোধীদের আবেদন সত্ত্বেও কেন কেন্দ্রীয় সরকার আন্তর্জাতিক উড়ান বন্ধ করতে এত দেরি করল। কেনই বা বিদেশি নাগরিকদের দেশে ঢোকার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ জারি করার ক্ষেত্রে শিথিলতা দেখাল। এছাড়াও এই সময়কালে বিদেশ থেকে ফিরলেন যে সব ভারতীয়রা, তাঁদের চিহ্নিত করে অন্তত কিছুদিনের জন্য আইসোলেশনে রাখা হল না কেন? উদাহরণস্বরূপ মনে করা যাক কলকাতার প্রথম করোনায় মৃত ভদ্রলোকের কথা, ছেলে ও বৌমা সদ্য ইতালি থেকে ফেরার পরেই আক্রান্ত হয়েছিলেন যিনি। বিমানবন্দর বন্ধ করার ক্ষেত্রে এই গড়িমসির ফলে আদতে সরকার দেশের আপামর দরিদ্র সাধারণকে যে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে ফেললেন, তা শুধু যে রোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলল, তাই নয়, এর ফলে তাঁদের জীবন ও জীবিকার উৎস সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেল।
অন্যান্য দেশগুলোতে এই অবরোধের সময় সরকারের তরফে যে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্ৰী নাগরিকদের কাছে রিলিফ হিসাবে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে, অনুরূপ কোনও সরকারি নীতির সুস্পষ্ট পথনির্দেশিকা পাওয়া যায়নি প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে। রাত আটটায় তিনি জানালেন যে মধ্যরাত্রি থেকে একুশ দিনের জন্য গোটা দেশ লকডাউনে চলে যাবে। এর ফলে কালোবাজারিদের সুযোগ করে দেওয়া হল নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে তুলতে। কেন্দ্রীয় সরকারের এই নীতিপঙ্গুতার মাশুল আজ দিতে হচ্ছে বিপুল সংখ্যক প্রবীণ ও “দিন আনি, দিন খাই” মানুষকে। করোনা না হোক, ক্ষুধার জ্বালায় নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁরা আজ। এছাড়াও ভারতবর্ষে এই মুহূর্তে প্রায় কুড়ি কোটি মানুষ জীবিকার তাগিদে অন্য রাজ্যে থাকেন। এঁদের অধিকাংশই পরিযায়ী শ্রমিক। এঁরা কীভাবে ঘরে ফিরেছেন সারা দেশ দেখেছে। যাঁরা ফিরতে পারেননি, তাঁদের অনেকের কাছেই রেশন কার্ড না থাকায় তাঁরা সরকারি সাহায্য থেকে বঞ্চিত হবেন। শুধুমাত্র নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে জড়িত চার কোটি কুড়ি লক্ষ শ্রমিক। তাঁদের কাছে রিলিফ পৌঁছবে কীভাবে, তার কোনও দিশা এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
এই প্রেক্ষাপটে সারা দেশের চোখ ছিল কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের বিবৃতির দিকে। একশো পঁয়ত্রিশ কোটি মানুষের দেশের জন্য এক লক্ষ সত্তর হাজার কোটি টাকার রিলিফ প্যাকেজ ঘোষণা করলেন তিনি, যা ভারতের মোট জাতীয় আয়ের ০.৮ শতাংশ মাত্র। যেখানে মাত্র সাড়ে তিন কোটি মানুষের রাজ্য কেরল ইতিমধ্যেই বিপর্যয় মোকাবিলায় কুড়ি হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে, সেখানে কেন্দ্রের এই ঘোষণা দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি সরকারের উদাসীন মনোভাবকেই প্রতিফলিত করে। এছাড়াও এই বরাদ্দের কোনও স্পষ্ট প্রকল্প পিছু হিসেব অর্থমন্ত্রী দিলেন না। অনেক ক্ষেত্রেই ইতিমধ্যে চালু প্রকল্পকে ত্রাণের নাম দিয়ে চালিয়ে দেওয়া হল।
আসুন, কেন্দ্রের এই ত্রাণ প্যাকেজকে একটু খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করা যাক।
প্রধানমন্ত্রীর কিষাণ যোজনায় প্রাপ্য দুহাজার টাকা পর্যন্ত ভাতা প্রতি ত্রৈমাসিকের শেষের বদলে প্রথম মাসে দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হল। এটাকে বড়জোর অগ্রিম বরাদ্দ বলা চলে, ত্রাণ নয়।
এছাড়াও প্রত্যেক পেনশন প্রাপক, বিধবা মহিলা এবং বিশেষভাবে সক্ষম মানুষকে এককালীন এক হাজার টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন অর্থমন্ত্রী যা দুই কিস্তিতে আগামী তিন মাসের মধ্যে তাঁদের দেওয়া হবে। এছাড়াও জন ধন একাউন্ট থাকা কুড়ি কোটি মহিলার জন্য মাসিক পাঁচশো টাকা সাহায্য ঘোষণা করা হয়েছে। যে ভয়াবহ দুর্যোগের মুখে দাঁড়িয়ে এই অসহায় মানুষগুলো, তার পরিপ্রেক্ষিতে এই নগণ্য অর্থসাহায্য শুধু অপ্রতুল নয়, দস্তুরমত অশ্লীল।
একটা সদর্থক পদক্ষেপ হল রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে আগামী তিন মাস ধরে মাথাপিছু ৫ কেজি করে অতিরিক্ত চাল দেওয়া হবে। যদি সঠিকভাবে এর প্রয়োগ করা যায়, তবে প্রান্তিক মানুষকে অন্তত না খেয়ে মরতে হবে না।
সংগঠিত ও অসংগঠিত উভয় ক্ষেত্রেই শ্রমিক ও দরিদ্র পরিবারগুলিকে অন্তরীণ থাকার ক্ষতিপূরণ হিসেবে যে অর্থ বরাদ্দ করা হল, তা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। একশো দিনের কাজের মজুরি দৈনিক মাত্র কুড়ি টাকা বাড়ানো হল। গরিব মানুষগুলোর সঙ্গে এ এক নির্মম পরিহাস। যেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হচ্ছে, সেখানে মানুষ কাজে যাবেন কীভাবে? এই মুহূর্তে তাই প্রয়োজন ছিল কানাডা সরকারের অনুকরণে কাজ না থাকলেও প্রত্যেক একশো দিনের কর্মীর কাছে ডাইরেক্ট ক্যাশ ট্রান্সফারের মাধ্যমে সরাসরি মজুরির টাকা পৌঁছে দেওয়া।
ইতিমধ্যেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণে ছাঁটাই শুরু হয়ে গেছে— সরকারের তরফ থেকে সে বিষয়েও কোনও উচ্চবাচ্য করা হল না। অসংগঠিত শিল্প এই লকডাউনের অভিঘাতে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তা ঠেকাতে সরকারের সুস্পষ্ট কোনও পরিকল্পনা অর্থমন্ত্রীর ভাষণে পাওয়া গেল না। এই দুঃসময়ে দেশের কর্পোরেট সংস্থা ও অতি ধনীদের ওপর বিশেষ কর বসিয়ে সামাজিক প্রকল্পগুলোকে জোরদার করার যে আশা করেছিলেন অর্থশাস্ত্রের বিশেষজ্ঞরা, তা অপূর্ণই রয়ে গেল।
আমাদের মনে রাখতে হবে, বেশ কিছুদিন ধরেই ভারতবর্ষ আর্থিক মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় আয়বৃদ্ধির হার নিম্নমুখী, পঁয়তাল্লিশ বছরে সর্বাধিক বেকারত্ব, ক্ষুধার সূচকে বাংলাদেশ-পাকিস্তান-আফগানিস্তানের পিছনে চলে যাওয়া— এ সবের জন্য তাবড় অর্থনীতিবিদরা দেশব্যাপী চাহিদার অভাবকে দায়ী করেছেন। এমনকি অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নোবেল স্মারক বক্তৃতায় বারবার করে গরিব মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর দিকে নজর দিতে পরামর্শ দিয়েছেন। একই সুর প্রতিধ্বনিত হয়েছে অমর্ত্য সেন থেকে রঘুরাম রাজনের গলায়। অথচ আমরা কী দেখলাম? কয়েক মাস আগেই আর্থিক মন্দার ছুতোয় এই অর্থমন্ত্রী এক লক্ষ পঁয়তাল্লিশ কোটি টাকার কর্পোরেট কর ছাড় দিলেন, যাতে করে তাঁর দলের ঘনিষ্ঠ পুঁজিপতিদের মুনাফার ভাঁড়ার ফুলে ফেঁপে ওঠে। একইভাবে, আজ বিপর্যয় মোকাবিলায় যৎসামান্য আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণার মাধ্যমে আবারও সাধারণ মানুষকে ওই কালোবাজারিদের হাতেই মরতে ছেড়ে দিলেন।
সমস্যা যে শুধু চাহিদার, তা কিন্তু নয়। এখন রবি শস্যের মরসুম। লকডাউনের ফলে চাষিরা কীভাবে মাঠ থেকে ফসল গোলায় তুলবেন, কেউ জানে না। মোদি সরকারের আমলে এমনিতেই কৃষি অবহেলিত। লকডাউন কৃষির সেই বিপন্নতাকে আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিল! এরই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, গত কয়েক বছর ধরেই গ্রীষ্মকালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবল জলের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সব মিলিয়ে কৃষিপণ্যের জোগান অব্যাহত রাখাটা সরকারের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে।
উপসংহার: যে কোনও জাতীয় বিপর্যয়ে সবথেকে বেশি বিপদে পড়েন প্রান্তিক মানুষেরা। তাই রাষ্ট্রের উচিত সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর ওপর বিপুল বিনিয়োগ করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে দেখা যায় এই মহামারিগুলোকেও পুঁজিপতিদের মুনাফা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। এই বিষয় নিয়ে ২০০৭ সালে নাওমি ক্লেইন লেখেন “দ্য শক ডকট্রিন— রাইজ অফ ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম।” আমাদের দুর্ভাগ্য, পুঁজিবাদী সমাজে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষকে গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করার ভুরিভুরি নিদর্শন থাকা সত্ত্বেও ইতিহাসের থেকে শিক্ষা নিতে আমরা ব্যর্থ। করোনা ভাইরাস আবারও এই সত্যকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল।