আনন্দ তেলতুম্বড়ে
গত সোমবার বোম্বে হাইকোর্ট দ্বারা তেলতুম্বডে-কে গ্রেপ্তার না করার নির্দেশটির সময়সীমা চার সপ্তাহ বৃদ্ধি করবার নির্দেশ দিলেও পুনে পুলিশ যে এফআইআর-টি তাঁর বিরুদ্ধে আনে তা রদ করেনি সুপ্রিম কোর্ট। এফআইআর-এ অভিযোগ করা হয়েছে ভীমা-কোরেগাঁও হিংসাকাণ্ডে ওনার ভূমিকা আছে এবং উনি মাওবাদীদের সঙ্গে যুক্ত। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের উদ্দেশ্যে ওনার এই খোলা চিঠি, যার একটি অংশের বাংলা ভাষান্তর ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মের পাঠকসমাজের জন্য। দ্য ওয়্যার নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত এই চিঠিতে তেলতুম্বড়ে বলছেন তাঁর বিরুদ্ধে আনা যাবতীয় অভিযোগ যে ‘জালিয়াতি’, তা প্রমাণ করবার সব আশাই ‘সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে’। সমাজকর্মী, ঔপন্যাসিক ও নিবন্ধকার অরুন্ধতী রায় ওনাকে সমর্থন জানিয়ে বলেছেন তেলতুম্বড়ে-কে গ্রেপ্তার করলে একটি শক্তিশালী এবং অভূতপূর্ব দলিত কণ্ঠকে স্তব্ধ করা হবে। বাংলা ভাষান্তর: সত্যব্রত ঘোষ।
আমি আইআইএম-এর এক প্রাক্তনী, আইআইটি-র এক অধ্যপক, বিপিসিএল-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং পেট্রোনেট ইন্ডিয়ার প্রাক্তন এমডি, ২৬টি বইয়ের লেখক, এবং গণতান্ত্রিক ও শিক্ষার অধিকাররক্ষা কর্মী হিসেবে যে কোনও মুহূর্তে ‘আরবান মাওয়িস্ট’ হিসেবে গ্রেপ্তার হওয়ার হুমকির সম্মুখীন।
আমি আপনাদের সমর্থন চাইছি।
আপনারা হয়তো ইতিমধ্যে জেনেছেন পুনে পুলিশ আমার বিরুদ্ধে যে এফআইআর জমা দেয়, তার প্রতিবাদে আমি যে আবেদন করেছিলাম তা সুপ্রিম কোর্ট রদ করে দিয়েছে। সৌভাগ্যবশত, সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় থেকে আমাকে উপযুক্ত আদালতে চার সপ্তাহের জন্য আগাম জামিনের আবেদন করবার অনুমতি মিলেছে।
এযাবৎ আমার বিশ্বাস ছিল পুলিশ আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলি এনেছে তা আদালতে মিথ্যা বলে প্রমানিত হবে। কিন্তু আমার সব আশা এখন ভেঙে চুরমার। শুধু চাইছি পুনে দায়রা আদালতে আমার জামিনের আবেদন মঞ্জুর হোক। আমাকে সমর্থন করবার একটি আন্দোলন গড়ে তোলবার সময় এসেছে এখন।
অনেকে হয়তো জানেন না Unlawful Activity (Prevention) Act –এ গ্রেপ্তার হওয়ার অর্থ বহু বছরের কারাবাস। একজন দাগী অপরাধীকে এক বা দুই বছরের মধ্যে মুক্তি দেওয়া হয়, কিন্তু রাজনৈতিক কর্তাদের ইচ্ছানুযায়ী পুলিশ যদি কোনও নির্দোষ মানুষকে ধরে বলে যে তাঁর বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট প্রমাণ আছে, তাহলে তাঁকে বহু বছর কারাগারে বন্দি থাকতে হবে।
আমার কাছে গ্রেপ্তার হওয়ার অর্থ শুধু কঠোর কারাবাস নয়। কারাবাস হলে আমার ল্যাপটপ থেকে দূরে চলে যাব আমি, যা এখন আমার শরীরেরই একটা অঙ্গ হয়ে গেছে, আমার লাইব্রেরি থেকে দূরে থাকব, যা আমার জীবনের একটা অংশ হয়ে গেছে। প্রকাশকদের কাছে প্রতিশ্রুত আমার যে পাণ্ডুলিপি, গবেষণাপত্র সেগুলি বিভিন্ন পর্যায়ে অসমাপ্ত রয়ে যাবে, আমার ছাত্রদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হবে যারা আমার পেশাদার সুনামের প্রতি নির্ভরশীল। যে প্রতিষ্ঠান আমার নামের ভরসায় বিভিন্ন সম্পদ সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট বিনিয়োগ করেছে এবং আমাকে সম্প্রতি তার বোর্ড অফ গভর্নরস-এ নিয়োগ করেছে, তারা অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হবে।
কারাবাস হলে দূরে চলে যাব আমার অসংখ্য বন্ধু এবং আমার পরিবার ও স্ত্রীর থেকে, যিনি বাবাসাহেব আম্বেদকরের দৌহিত্রীও বটে, আমাদের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কন্যাদের মুখ চেয়েও ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দেননি এবং জানেনও না গত বছর আগস্ট মাস থেকে আমার সঙ্গে যা কিছু ঘটেছে, তার পরিণতি কী হবে।
আমার জন্ম অত্যন্ত দরিদ্র এক পরিবারে। তারপর দেশের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে সসম্মানে কৃতিত্বসহ উত্তীর্ণ হবার পর চারপাশের সামাজিক বৈষম্যগুলিকে অগ্রাহ্য করে আরামপ্রদ একটি জীবন আমি সহজেই বেছে নিতে পারতাম।
কিন্তু মানুষের জীবন কীভাবে একটু উন্নত হবে, সেই লক্ষ্য নিয়ে আমি সিদ্ধান্ত নিই পরিবারের সচ্ছলভাবে চালানোর জন্য যতটুকু অর্থ প্রয়োজন, ততটুকুই উপার্জন করব। ঠিক করে নিই বাকি সময়টা পড়াশুনা করব। চেষ্টা করব আমার সীমিত অবদানের দ্বারা পৃথিবীতে যেন আরেকটু ন্যায় প্রতিষ্ঠা হয়।
এই অনুভূতি থেকেই কমিটি ফর প্রোটেকশন অফ ডেমোক্রেটিক রাইটস-এ যুক্ত হই, বর্তমানে যার সাধারণ সম্পাদক আমি এবং অল ইন্ডিয়া ফোরাম ফর রাইটস টু এডুকেশন-এর একজন প্রেসিডিয়াম সদস্যও বটে।
এতদিন আমি যা কিছু লিখেছি বা যে সামাজিক কাজগুলিতে নিজেকে নিয়োজিত করেছি তাতে একচুলও আইনবিরুদ্ধ কিছু নেই। আমার চার দশকের শিক্ষাগত জীবন এবং কর্পোরেট কেরিয়ারে একফোঁটা দাগ নেই।
তাই দুঃস্বপ্নেও আমি কল্পনা করিনি যে এই দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র– যাকে সমৃদ্ধ করতে আমার সমগ্র পেশাদার জীবন ব্যয় করেছি– সে আমার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এমন অপমান করবে যেন আমি একজন অপরাধী।
এমনটা নয় যে ভারতের প্রতিশোধপরায়ণ রাষ্ট্রযন্ত্র নির্দোষ মানুষদের দুর্বৃত্ত বানিয়ে সেই চোর আর ডাকাতদেরকেই রক্ষা করে, যারা এই দেশকে পৃথিবীর সবচেয়ে বৈষম্যমূলক দেশ বানিয়েছে। কিন্তু মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেপ্তার করবার জন্য পুনেতে এলগার পরিষদ নামে এক অনুষ্ঠানকে ঘিরে পুলিশ এখন এই ন্যক্কারজনক প্রহসন রচনা করেছে। গণআন্দোলনে যুক্ত বুদ্ধিজীবী ও সমাজকর্মীদের পোষণ করা ভিন্নমতগুলির প্রকাশকে যেভাবে রুদ্ধ করবার চেষ্টা চলেছে ক্ষমতার অপপ্রয়োগের মাধ্যমে তা স্বাধীনোত্তর ভারতে সম্ভবত নীচতম এক ষড়যন্ত্র। রাষ্ট্রের মস্তিষ্কপ্রসূত এমন কিছু এর আগে ঘটেনি। তার নিন্দুকদের বিরুদ্ধে এমন প্রতিশোধপরায়ণতা থেকে এর জন্ম যে তাতে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক সৌজন্যবোধটুকুই নেই।
ভীমা কোরেগাঁও-তে ১৮১৮ সালে যে শেষ ইংরেজ-মারাঠা যুদ্ধ হয়। তার ২০০ বছর পূর্তিতে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি পি বি সাওয়ান্ত এবং বোম্বে হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি বি জি কোলসে পাটিল উপলক্ষটিকে বিজেপি-র সাম্প্রদায়িক ও জাতভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করবার জন্য পরিকল্পনা করেন।
ওনারা সমাজকর্মী এবং প্রগতিবাদী বুদ্ধিজীবীদের একটি পরিকল্পনা সভায় অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানান। আমাকেও প্রথমে বিচারপতি সাওয়ান্তের পক্ষ থেকে নিমন্ত্রণ পাঠানো হয়, এবং তারপরে বিচারপতি কোলসে পাতিলও আমন্ত্রণ করেন। শিক্ষাক্ষেত্রে কিছু কাজ থাকবার ফলে সেই অনুষ্ঠানে যেতে পারব না বলে আমি আমার অনুতাপ ওনাদের জানাই। তবে বিচারপতি পাটিলের অনুরোধক্রমে সেই সভার যুগ্ম-আহ্বায়ক হতে রাজি হই।
এরপর কী ঘটে আমি জানতে পারিনি যতক্ষণ না হোয়াটসঅ্যাপ-এ এলগার পরিষদের একটি লিফলেট দেখি। অত্যাচারী পেশোয়ারাজের অন্ত এবং যুদ্ধে শহীদ যে মাহার সৈন্যদের নাম কোরেগাঁও-র স্মারকস্তম্ভে লেখা আছে, তাঁদের প্রতি আমার সমর্থন রয়েছে।
তবে এলগার পরিষদ যেভাবে ব্রাহ্মণ্য পেশোয়াদের বিরুদ্ধে মাহার সৈন্যদের প্রতিহিংসা হিসেবে যুদ্ধটিকে দেখাতে চেয়েছে, তার সঙ্গে আমি একমত নই। আমার মনে হয়েছে ইতিহাসকে এমন বিকৃতভাবে দেখা হলে শুধুমাত্র দলিতদের মনে হবে আন্দোলনটি যেন শুধু তাঁদেরই জন্য গড়ে তোলা হয়েছে। এমন ভাবনা প্রশ্রয় পেলে আপামর মানুষের সঙ্গে আন্দোলনটির বৃহত্তর ঐক্যসাধন ঘটবে না।
এই নিয়ে আমি যখন ওয়্যার নিউজ পোর্টালে লিখি, তখন দলিতরা আমার প্রতি উষ্মা দেখায়। আমি সেই কারণে আবার ভাবতে বাধ্য হই। এবং ভেবে নিজের অবস্থানে স্থির থাকি, যেভাবে প্রকৃত বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের রাখেন। উল্লেখিত নিবন্ধটি এবং তার উপর যাবতীয় প্রতিক্রিয়া এবং তারপর আমার পূর্ব-অবস্থান বজায় রাখা থেকেই আমাকে এই আরোপ থেকে মুক্তি দেওয়া যায় যে আমি অন্য কারও কথায় দলিতদের প্ররোচিত করিনি। কিন্তু অযৌক্তিকতার যেখানে একচ্ছত্র অধিকার, সেখানে এমন যুক্তি শাসক বা পুলিশ– কারও কানে প্রবেশ করবে কি?