তাবলিগ জামাতের আদর্শ ও কর্মপন্থা: একটি পর্যালোচনা

আশরাফুল আমীন সম্রাট

 




লেখক শিক্ষক, সমাজকর্মী।

 

 

 

তাবলিগ জামাত “বিশুদ্ধবাদী” ইসলামের একটি ধারা। যার সূচনা গত শতাব্দীর ১৯২০-র দশকে। মৌলানা ইলিয়াস কান্দালভীর নেতৃত্বে এই আন্দোলনের সূচনা। আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল ব্যক্তিচরিত্রকে ইসলামীয় মূল্যবোধের আদলে গড়ে তুলে ঘুণ ধরা সমাজের শুদ্ধতা ফিরিয়ে আনা। এই মূল্যবোধ তৈরির জন্য ব্যক্তির সঙ্গে স্রষ্টার সরাসরি আধ্যাত্মিক যোগাযোগ স্থাপন তাবলিগের নানাবিধ কর্মকাণ্ডের লক্ষ্য। ইসলাম চর্চার মাধ্যমে শুদ্ধ চর্চার ধারাকে ফিরিয়ে আনার জন্য ইসলামের ইতিহাস জুড়ে যে স্রোতগুলো এসেছিল তাবলিগ জামাত তাদের অন্যতম। তাদের বিশ্বাস ব্যক্তিচরিত্র পরিবর্তনের মধ্যেই সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব। সামাজিক পরিবর্তন আনার জন্য ইসলামের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন দরকার নেই। রাজনৈতিক ইসলামের সঙ্গে এই জায়গাতেই তাবলিগের বিরোধ। রাজনৈতিক ইসলামের মত তারা ইসলামীয় জাতীয়তাবাদ নয়, ইসলামীয় মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনার কথা বলে। তারা মনে করে অরাজনৈতিক উপায়েই সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব। এরা “দ্বীন” অর্থাৎ ইসলামীয় ন্যায়, নীতি ও আধ্যাত্মিকতা নিয়ে চিন্তিত, “দুনিয়া” অর্থাৎ বস্তুজগৎ নিয়ে নয়। চলমান রাজনীতি নিয়ে তাবলিগ জামাত উদাসীন। “মুসলিম লীগ” বা “জামায়াতে ইসলামী”র মত রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের খোয়াব এরা দেখে না। এমনকি হিন্দু-মুসলিম সহাবস্থানে বিশ্বাসী কম্পোজিট জাতীয়তাবাদী “জমিয়ত উলেমায়ে হিন্দের” মত অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি থেকেও এরা শত যোজন দূরে।

তবে একথা জোর দিয়ে বলা যায় না যে তাবলিগ জামাতের উদ্ভব পুরোপুরিভাবে অরাজনৈতিক। কোনও কোনও সমাজতাত্ত্বিকের মতে তাবলিগ জামাত সৃষ্টি হয়েছে ‘আর্য সমাজ’-এর কাউন্টার ডিসকোর্স হিসাবে। ‘আর্য সমাজ’ ধর্মান্তরিত মুসলামানদের বৃহত্তর হিন্দু সমাজে “ঘর ওয়াপসি” করতে শুরু করে এই সময়। তাবলিগ জামাত হল এর বিপরীতে ধর্মান্তরিত মুসলমানদের স্বধর্মে টিকিয়ে রাখার জন্য সংস্কারপন্থী নীরব আন্দোলন। এই আন্দোলনের সুত্রপাত হয় দিল্লির মেওয়াত অঞ্চলের মেওয়া জনগোষ্ঠীর কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে। বেশিরভাগ মানুষের কাছে মেওয়া জনগোষ্ঠীর মানুষজন “অর্ধ মুসলিম” হিসাবে পরিচিত ছিল। পেশায় শ্রমজীবী হওয়ায় তারা ইসলামীয় জীবনচর্চা থেকে অনেক দূরে ছিল এবং আত্মপরিচয়ের সঙ্কটে ভুগত। দ্বিবিধ সঙ্কটমোচনের জন্য মৌলানা ইলিয়াস তাদের মসজিদে ডেকে এনে ধর্মীয় শিক্ষা দিতে শুরু করেন এবং পরিবারগুলির আর্থিক দায়ভারও নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে নেন। দিল্লির বাঙালওয়ালি মসজিদ থেকে শুরু হয় ধর্মশিক্ষামূলক কার্যাদি।

মেওয়াতের মুসলমানদের মধ্যে তাবলিগের আদর্শ জনপ্রিয় হওয়ার দুটি কারণকে সমাজতত্ত্ববিদরা চিহ্নিত করেছেন। মেওয়া জনগোষ্ঠীর মুসলমান অবজ্ঞা ও লাঞ্ছনা থেকে মুক্তির পথ হিসাবে তাবলিগ প্রচারিত “বিশুদ্ধ ইসলামকে” আঁকড়ে ধরে বাঁচতে শেখে। অন্যটি হল সামাজিক সাম্য। তাবলিগ জামাত মেওয়াতের মুসলমানদের কাছে এমন একটি বিকল্প সমাজের বার্তা নিয়ে আসে যেখানে সবাইকে একইভাবে সম্মান করা হবে এবং সমগুরুত্ব দেওয়া হবে। তাবলিগীরা তাদের নিজ জীবনচর্চায় সবাইকে সমান গুরুত্ব ও মর্যাদা দিয়ে দেখতে চায় এবং একে অপরকে “ভাই” বলে সম্মোধন করে। সামাজিক সম্মানের আর্তি মেওয়াতের উপেক্ষিত মুসলমানদের কাছে ইতিবাচক বার্তা বয়ে নিয়ে আসে।

মৌলানা ইলিয়াস যখন তাবলিগ জামাতের প্রাথমিক কাজকর্ম শুরু করেন, তখন তিনি অনেক সহজ সরল পন্থা উদ্ভাবনের চেষ্টা করেন। যে মসজিদ থেকে তাঁর কাজ শুরু সেটিই বর্তমানে নিজামুদ্দিন মারকাজ। এই মসজিদ থেকেই তাবলিগ জামাতের বিশ্বজোড়া কর্মসূচি একটি সমন্বিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে বিগত শতক ধরে। বর্তমানে ১৬৫টিরও বেশি দেশে তাবলিগ জামাত তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। সংগঠনটির বর্ষীয়ান কিছু সদস্যকে নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়ে থাকে। এটিকে সাধারণত “শুরা কমিটি” বলা হয়। ভারতের দিল্লি ছাড়াও প্রতিটি শহরেই একটি স্থানীয় কেন্দ্র থাকে। এমনকি এলাকাভিত্তিক ও মসজিদভিত্তিক একটি ছোট্ট সাংগঠনিক কাঠামো থাকে। তাবলিগ জামাতের সংগঠক হিসাবে সক্রিয় ও প্রখর জ্ঞানসম্পন্ন একজনকে সাংগঠনিক প্রধান নির্বাচন করা হয়, যাঁকে তাবলিগ জামাতের “আমির” বলা হয়। প্রতিটি মসজিদে তাবলিগ জামাতের একজন প্রতিনিধি থাকে, যাঁকে সেই মসজিদের জিম্মাদার হিসাবে বিবেচনা করা হয়। যদিও তাবলিগ জামাতের কোনও নথিভুক্ত সদস্যপদ হয় না।

প্রতিটি দেশে আবার একটি করে প্রধান কেন্দ্র রয়েছে। এই কেন্দ্র থেকে নিজ নিজ দেশের তাবলিগের কাজকর্ম পরিচালিত হয়। ভারতে যেমন দিল্লির বাঙালওয়ালি মসজিদ, তেমনি বাংলাদেশের কাঁকরাইল মসজিদ, পাকিস্তানের রাইবাঁধ, ইউরোপের ডিউজবেরি হল প্রধান কেন্দ্র। প্রতিটি দেশের প্রধান কেন্দ্রগুলোকে “মারকাজ” বলা হয়। তাবলিগ জামাতের সাথীরা কখন, কোন সময় ও কোন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন মেয়াদের দাওয়াতের কাজ নিয়ে যাবেন সেই বিষয়গুলো তাদের প্রধান মারকাজের মাধ্যমেই ঠিক হয়। এই ধর্মবাণী প্রচারের কাজে তাবলিগীরা কোনও পারিশ্রমিক পান না। নিজের খরচায় যেতে হয়। সংগঠনের সামগ্রিক কাজকর্ম স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। একেক জন একেক রকম দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

“দাওয়াত” হল বিভিন্নভাবে মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকা। দাওয়াতের কাজ মসজিদভিত্তিক। একটি দল তৈরি করে নিজের এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় বিভিন্ন মেয়াদে মসজিদ থেকে মসজিদ অবস্থান করে দাওয়াতের কাজ করা হয়। একটি মসজিদে তিন দিনের বেশি থাকার নিয়ম নেই। দাওয়াতের অন্যতম প্রধান কাজ হল আসরের নামাজের (বিকালের নামাজ) পর এলাকার মধ্যে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন মানুষকে নামাজ পড়ার জন্য আহ্বান করা। মাগরিবের আজানের (সন্ধেয় নামাজের ডাক) আগে পর্যন্ত এই দাওয়াতের কাজ চলতে থাকে। একে তাবলিগ জামাতের ভাষায় “গাস্ত” বলা হয়। তবে এটা তাবলিগীদের উদ্ভাবন নয়। ইসলামের আদি পর্বে নবী মুহম্মদ (সাঃ) সাহাবিদের নিয়ে এই কাজ করতেন। তাবলিগ সেই পথেরই অনুসারী। অন্য এলাকায় গিয়ে দাওয়াতের কাজ বিভিন্ন মেয়াদে পরিচালিত হয়। মেয়াদ ৩ দিন, ৭ দিন, ৪০ দিন, ১২০ দিন, এমনকি এক বছরেরও হতে পারে। এক বছরের দাওয়াতকে তাবলিগের ভাষায় “সাল লাগানো” বলে। যদিও এক বছরের দাওয়াত এখন বন্ধ হয়ে গেছে। এদের মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত হল ৪০ দিনের দাওয়াত। একে “চিল্লা” বলা হয়। “চিল্লা” শব্দটি ফারসি “চাহাল” থেকে এসেছে যার অর্থ চল্লিশ।

“চিল্লার” ধারণাটি মৌলানা ইলিয়াস চিশতিয়া ও কাদেরিয়া সুফি ধারা থেকে গ্রহণ করেন।

পারিবারিকভাবে মৌলানা ইলিয়াস চিশতিয়া সুফি ঘরানার অনুসারী। চিশতিয়া সুফি পীরের মুরিদ ছিলেন তিনি। দারুল-উলুম-দেওবন্দের ছাত্র হলেও মৌলানা ইলিয়াসের পারিবারিক সুফি ঘরানার প্রভাব তাবলিগ জামাতেও আছে। একইসঙ্গে দেওবন্দ ও সুফি ঘরানার মিশেল তবলিগ জামাতে দেখতে পাওয়া যায়। চিশতিয়া ও কাদেরিয়া ঘরানায় পীরকে ৪০ দিন পরিবারবিচ্ছিন্ন হয়ে একটি কামরায় বদ্ধ থেকে স্রষ্টার সন্তুষ্টি লাভের আশায় নিরবিচ্ছিন্নভাবে আল্লাহর উপাসনা করতে দেখা যায়। এটি এক ধরনের ধ্যান। একটা লম্বা সময় ধরে আল্লাহর সঙ্গে আধ্যাত্মিক যোগসাধনই এ ধরনের উপাসনার উদ্দেশ্য। চিশতিয়া ধারা অনুসরণ করে মৌলানা ইলিয়াস পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতে থাকেন। শেষে তিনি এই ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হন যে চিশতিয়া সুফি ধারার মত একটি ঘরে বদ্ধ হয়ে উপাসনা না করে মসজিদে এই কাজ করলে কেমন হয়। তাঁর মতে এই সময়পর্বটিকে একজন মুসলমান দলগতভাবে ইসলাম চর্চা ও প্রসারে মনোনিবেশ করার ক্ষেত্রে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবেন। সেই ভাবনা থেকে ৪০ দিনের জন্য দাওয়াত। তবে নিজের আহরিত জ্ঞান দ্বারা তিনি তাবলিগ জামাতকে সুফি ধারা থেকে স্বতন্ত্র ধারায় বিকশিত করতে সফল হন। বর্তমানে একদম নীচুতলার তাবলিগীদের একাংশ সুফি ঘরানার প্রতি বিরূপ হলেও সেটা সার্বিক চিত্র নয়।

মহিলারা যাতে অংশগ্রহণ করে তার জন্য “মাস্তুরাত জামাত”-এর আয়োজন করা হয়। এটি দম্পতিদের নিয়ে হয়। এই জামাতে মহিলারাও তাবলিগ জামাতের দাওয়াতের কাজে যুক্ত থাকে। বিবাহিত মহিলারা স্বামীদের সঙ্গে জামাতে অংশগ্রহণ করে। এই জামাত হয় সাত দিনের। জামাতের সদস্যরা যখন অন্য এলাকায় যান, তখন পুরুষেরা মসজিদে ও মহিলারা কোনও এক নিবেদিত প্রাণ তাবলিগ জামাতের সাথীর বাড়িতে অবস্থান করে। এই জামাতে মহিলাদের জন্য বয়ানের সুযোগ করা হয়। মহিলারা নিজেরাও বয়ান করে থাকেন এবং তাঁদের আসরে বয়স্ক অভিজ্ঞ পুরুষ সাথীদের দিয়েও বয়ান করানো হয়।

“ফাযায়ালে আমল” হল তাবলিগ জামাত বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বই। এটি একটি নির্দেশিকা হিসাবে তাবলিগ জামাতে বিবেচিত হয়ে আসছে। এই বইটিতে কোরানশরিফ থেকে বহু “আয়াত” (ধর্মীয় বার্তা, নির্দেশনা) এবং বিবিধ হাদিস সঙ্কলিত রয়েছে। এই আয়াত ও হাদিসগুলিতে পরিষ্কারভাবে জামাত তৈরির কথা বলা হচ্ছে, যাদের কাজ হবে মানুষকে ভাল কাজে ডাকা ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকা। মুসলমানগণকে উত্তম জাতি হিসাবেও দাবি করা হয়েছে। খারাপ কাজের জন্য শাস্তি ও ভাল কাজের জন্য পুরস্কারের কথা বলা হয়েছে। বেশ কিছু সুফি ধারণা তাবলিগ জামাতে প্রয়োগ করা হলেও এটি সুফি ঘরানার দাওয়াতি প্রতিষ্ঠান নয়। মৌলানা ইলিয়াস বা তার পরবর্তীকালে মৌলানা ইউসুফ বা মৌলানা সাদকে পীর বা তার সমকক্ষ হিসাবে ধরা হয় না। সুফি ধারা থেকে স্বতন্ত্রতা আনার জন্য মৌলানা ইলিয়াস তাবলিগ জামাতের নিয়মকানুন আরও দৃঢ়ভাবে প্রণয়ন করেন।

পাঁচটি কাজের কথা বিশেষ গুরুত্ব সহকারে সম্পাদনের কথা বলা হয় তাবলিগ জামাতে। এগুলি হল সাপ্তাহিক তালিম, মাসোয়ারা, প্রতিদিন অন্ততপক্ষে আড়াই ঘণ্টা দাওয়াতের কাজ করা, সাপ্তাহিক “গাস্ত” করা এবং মাসে অন্তত একবার দাওয়াতের কাজ নিয়ে অন্য এলাকার মসজিদে সময় কাটানো। তালিম হল কোরান এবং হাদিস থেকে নির্বাচিত কিছু অংশ পাঠ করা। পরিবারের সঙ্গে ও মসজিদের মুসল্লিদের সঙ্গে এই তালিমের কাজ করতে হয়। মাসোয়ারা হল ধর্মীয় ও দাওয়াতের কাজকে আরও বেগবান করার জন্য তাবলিগের সাথীদের সঙ্গে নিয়মিত পরামর্শ করা। আড়াই ঘণ্টার দাওয়াতের ক্ষেত্রে একজন তাবলিগ সাথী যেকোনও মানুষের কাছে দাওয়াতের জন্য যেতে পারে। তাবলিগ জামাতের ভাষায় এই সময় দেওয়াকে বলে “সময় লাগানো”। সাপ্তাহিক “গাস্তের” জন্য একটি দলনেতা ঠিক করা হয় যিনি দাওয়াতের কাজ করবেন, আর একজন পথ দেখিয়ে বিভিন্ন বাড়িতে বাড়িতে নিয়ে যাবেন, যাঁকে “রাহবার” বলা হয়। বাকি সদস্যদের কাজ হচ্ছে মনে মনে “জিকির” (আল্লাহর নাম স্মরণ) করা। এরা যখন রাস্তায় হেঁটে যায় তখন মাথা নীচু করে সারিবদ্ধভাবে থাকে। আর একটি দল মসজিদে থেকে ধর্মীয় বিষয়ে আলাপ আলোচনা ও বাইরে দাওয়াতের কাজে নিয়োজিত দলটির সাফল্য কামনা করে দোয়া করতে থাকেন।

এই পাঁচটি কাজের সঙ্গে তাবলিগ জামাতের সাথীদের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনুসরণ করতে হয়, সেটি হল তাবলিগ জামাতের ৬টি মৌলিক নীতি। যাকে প্রচলিতভাবে “ছয় নম্বর” বা “ছয় উসুল” বলা হয়। তাবলিগের ভাষায় বলা হয়ে থাকে, “দ্বীনের উপর চলাই হচ্ছে মানব জীবনের আসল উদ্দেশ্য। সাহাবী আজমাইনগন হুজুর পাক (সাঃ) এর সাথে থাকার কারণে অনেক গুণে গুণান্বিত ছিলেন। তার মধ্যে কয়েকটি গুণের ওপর মেহনত করে আমল করতে পারলে দ্বীনের ওপর চলা সহজ”। এগুলো হল, ১) কালেমা ২) নামাজ ৩) এলেম বা জিকির ৪) ইকরামুল মুসলেমিন ৫) তাহসিহে নিয়্যত ও ৬) দাওয়াত ও তাবলিগ। কালেমা, নামাজ, জ্ঞানার্জন, ধর্মাচরণ, পারস্পরিক ভালবাসা, সম্মান, শ্রদ্ধা, সাহায্য-সহযোগিতা, আল্লাহপাকের নির্দেশ পালন, ধর্মবাণী প্রচার এগুলোই ছয় উসুলের উপজীব্য। সর্বোপরি একজন ভাল মানুষ হিসাবে নিজেকে গড়ে তোলার গুণাবলি অর্জন করা। তাবলিগের সাথীদের দাবি যে এই ছয় উসুল কারও মাথায় আসেনি বরং এগুলো কোরান-হাদিস অনুসারেই গঠিত হয়েছে।

তাবলিগ জামাতের তিন দিনব্যাপী বার্ষিক সম্মেলনকে “বিশ্ব ইজতেমা” বলে চিহ্নিত করা হয়। প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ এই ইজতেমায় অংশগ্রহন করেন। অংশগ্রহণকারীর সংখ্যার বিবেচনায় হজের পরেই বাংলাদেশের টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমাকে বলা হয় বৃহত্তম মুসলিম সম্মেলন। বিশ্ব ইজতেমার মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীরা জাগতিক বিষয়াবলি ও কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। প্রতীকীভাবে এক মানসিক অবস্থা থেকে আর এক মানসিক অবস্থায় রূপান্তর ঘটে। এর ফলে স্রষ্টার সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ ও আত্মশুদ্ধির পথ প্রশস্ত হয় বলে তাদের দাবি। ইজতেমায় নিয়মিত কাজগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে বয়ান করা। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত আলেম ও উলেমারা ইজতেমায় বয়ান করে থাকেন। এই বয়ান শুনতে পারা ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীদের কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণস্বরূপ। ইদানিং ইজতেমায় আর একটি কাজ চোখে পড়ে সেটি হল সুন্নত আদায় করে অনাড়ম্বরে বিবাহ কার্যাদি সম্পন্ন করা হয়। তাবলিগের অন্যতম আদর্শ হল আড়ম্বরহীন মিতব্যয়িতা। তিন দিন ব্যাপী ইজতেমা শুরু হওয়ার আগে তাঁরা সবসময় আরেকটি ছোট সম্মেলন করে থাকেন এই একই ইজতেমা মাঠে। একে “জোড়” বলা হয়। নিজ নিজ এলাকায় গত এক বছরের অভিজ্ঞতা, সাফল্য, ব্যার্থতা ও কাজের কষ্টকর দিনগুলি নিয়ে আলোচনা হয়।

এ ধরনের বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন তাবলিগ জামাতের সাথীদের ভ্রাতৃত্ববোধ ও বৈশ্বিক পরিচিতি নির্মাণে সহায়ক। ধর্মীয় পরিচয় যে পরিচিতি নির্মাণ করে সেটি এভাবে ভৌগোলিক জাতিসত্তাকে ছাপিয়ে বিশ্বজোড়া প্যানইসলামিক ভ্রাতৃত্ববোধের ধারণা তৈরি হয় ইজতেমায়। এই বৈশ্বিক ভ্রাতৃত্ববোধ বা উম্মাহর ধারণা বহুজাতিক ইসলামের (Transnational Islam) ধারণাকে ছুঁয়ে যায়। সাম্প্রতিক বিশ্বে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ও বহুসংস্কৃতিবাদ সারা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে ভৌগোলিক গণ্ডি ছাড়িয়ে একটি সমজাতীয় অনুভূতির ধারণা তৈরি করে, ঠিক তেমনি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের মানুষজনও আজকের বিশ্বে একাধিক সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেকে সম্পর্কিত বা সংশ্লিষ্ট ভাবে। রাজনৈতিকভাবে না হলেও সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে একই জীবনশৈলীর অনুশীলনের মাধ্যমে তাবলিগ জামাত বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব ও বহুজাতিক ইসলামের পরাকাষ্ঠা তৈরি করে।

তাবলিগ জামাত গত একশো বছরের ইতিহাসে ১৬৫টি দেশে পৌঁছতে পেরেছে। আনুমানিক প্রায় ৮০ মিলিয়ন মানুষ জামাতের কাজে যুক্ত আছে। তাবলিগ জামাতের উদ্ভব ভারতে হলেও দেশভাগের পর থেকেই তাবলিগ জামাত ইউরোপে পাড়ি দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বহু মানুষ দক্ষিণ এশিয়া থেকে রিভার্স মাইগ্রেশন করে ঔপনিবেশিক যোগাযোগের মাধ্যমে পাকাপাকিভাবে যুক্তরাজ্যে বাস করতে শুরু করে। ফলে পঞ্চাশের দশকে একটা বড় ধরনের অভিবাসন প্রক্রিয়া আমরা লক্ষ করি। এদের একটি বড় অংশ মুসলিম জনগোষ্ঠী। ফলত যুক্তরাজ্যে মুসলিমদের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। মূলত এদের হাত ধরেই যুক্তরাজ্যে তাবলিগ জামাতের প্রবেশ ঘটে। যুক্তরাজ্যের ডিউজবেরিতে তাবলিগ জামাতের হেডকোয়ার্টার অবস্থিত। জার্মানির ২০ থেকে ২৫টি শহরে তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম চলছে। তবে জার্মানিতে তাবলিগ জামাত যুক্তরাজ্যের মত বিকশিত না হওয়ার কারণ হল জার্মানির মুসলিমরা বেশিরভাগই তুর্কি। তুর্কি মুসলমানরা তাবলিগ জামাত পছন্দ করে না। ফ্রান্সে তাবলিগ জামাতের হেডকোয়ার্টার হল প্যারিসের আব-রহমান মসজিদ। ফ্রান্সে তাবলিগ জামাতের অনুসারীরা বেশিরভাগই শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষ। এঁরা প্রধানত উত্তর আফ্রিকার মাগরের এলাকা থেকে এসেছেন। এই এলাকাটি আলজেরিয়া, লিবিয়া, মৌরিতানিয়া, মরক্কো, তিউনেশিয়া ও সাহারার কিছু অঞ্চলকে নির্দেশ করে। ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় ফ্রান্সেই সবথেকে বেশি তাবলিগ জামাতের সাথী রয়েছে। বিশেষ গবেষণা থেকে দেখা যায় সংখ্যাটি লক্ষাধিক। উত্তর আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১৫ হাজার তাবলিগ সাথী রয়েছেন বলে জানা যায়। কানাডার দক্ষিণ-পশ্চিম ওন্টারিওতে তাবলিগ জামাতের কানাডীয় কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে।

তাবলিগ জামাত এই মুহূর্ত সবথেকে বড় ইসলামিক ধর্মীয় সংগঠন। তবুও সংগঠনটি সমালোচনার ঊর্ধ্বে আছে সেটা বলা যাবে না। সবথেকে বেশি সমালোচিত হয়েছে বেরেলিপন্থীদের দ্বারা। তাদের অভিযোগ সাংসারিক দায় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ধর্মপ্রচার অনৈস্লামিক। সাংসারিক মানুষ হিসাবে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে দেখভালের দায়ভার বহন না করে লম্বা সময় ঘরছাড়া থাকা কাজের কথা নয়। ঘরে থেকেই যাবতীয় ইসলামি আকিদা মেনে চলা সম্ভব বলে তাদের অভিমত। তাদের বিরুদ্ধে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ যে অভিযোগটি আনা হয় সেটি হল যে এরা বংশানুক্রমিক পীরতন্ত্রের বিরোধী হলেও তাবলিগ জামাতের বৈশ্বিক আমিরের পদটি মৌলানা ইলিয়াসের বংশধরেরা দখল করে বসে আছে। আজকের মৌলানা সাদ মৌলানা ইলিয়াসেরই বংশধর। এই পরিবারতান্ত্রিকতার জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় বর্তমানে তাবলিগ জামাত দুই শিবিরে ভাগ হয়ে গেছে। স্থানীয়ভাবে ঐতিহ্যবাহী লৌকিক ইসলামের বিবিধ ধারাও তাবলিগ জামাতের বিশুদ্ধবাদী ইসলামের চাপে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন মারফতি মাজহাবের অনুসারীগণ। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি থেকে শুরু করে সালাফিপন্থীরাও একাধিক বিষয়ে তাবলিগ জামাতের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন। ধর্মনিরপেক্ষ ও অধার্মিক মানুষেরা অভিযোগ করছেন তাবলিগ জামাতের রক্ষণশীল মনোভাব প্রগতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। যদিও তাবলিগ জামাতের আমিরেরা আধুনিক শিক্ষার বিরোধী নয় বলে নিজেদের অবস্থান পরিস্কার করার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের আরও অভিমত ইসলাম নিত্যনতুন জ্ঞানার্জনের কথা বলে, তাই আধুনিক শিক্ষার পথে তাবলিগ জামাত কখনওই বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।

তাবলিগ জামাতের জনপ্রিয়তা দিনদিন বাড়ছে এটা অনস্বীকার্য। তার কারণ হল অরাজনৈতিক অবস্থান ও সমিল স্মৃতিচারণা (Shared memory, Smith, 1990)। তাবলিগ জামাতের অরাজনৈতিক কাজকর্ম পরিচালনা করার যে দাবি সেটি সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি তাৎপর্যপূর্ণ আগ্রহ তৈরি করে। কেননা অধিকাংশ মানুষ ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে মেলাতে চান না এবং দুটি বিষয় আলাদা রাখতেই পছন্দ করেন। সমিল স্মৃতির ধারণা পরিচিতি নির্মাণের একটি প্রভাবশালী উপাদান। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের মধ্যে এই স্মৃতি খোঁজার একটি প্রয়াস থাকে। তাবলিগ জামাতের ক্ষেত্রে বিষয়টি দাঁড়ায় যে তাদের কাজের প্রেক্ষাপটই হল হজরত মুহম্মদ (সাঃ) এর জীবন অনুসরণ এবং তাঁর সাহাবিদের কাজের স্মৃতিচারণ করা। এর পিছনে যে কারণটি কাজ করে তা হল এর মধ্যে দিয়ে তারা এক ধরনের সামষ্টিক চৈতন্য তৈরি করতে পারে। তাদের মধ্যে এক ধরনের নস্টালজিক মনোভাব দেখা যায়। যেখানে তারা মনে করে যে তাদের ইসলামের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করতে হবে। এই বিষয়টিই তাদের এমন পরিচিতি এনে দিচ্ছে যেখানে ইসলামের অতীত ঐতিহ্যের সঙ্গে সব সদস্য একাত্ম বোধ করে এবং একই রকম স্মৃতি নিয়ে একই ধরনের স্বপ্ন নিয়ে বিশেষ মূল্যবোধের সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রয়াস তারা চালিয়ে যায়।

 

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...