কোভিডসম্ভব ১৯

বল্লরী সেন

 




লেখক কবি ও গদ্যকার 

 

 

 

ফ্লোরিডা নদীগাত্র, ২০১৮

নিশ্ সমুদ্র সৈকতে বিহান হলে টফির ডানা খুলে দেয় হান্স, স্কুইড আর লাল কর্ড মাছের পেছন ধরে এবার তার পান্নারং কাফতানের মধ্যে তরঙ্গময়ী জলস্রোত উথালিপাথালি করতে করতে আলো ঠেলে আনে অজানা দ্বীপের কানা উঁচু হাঁগুলো থেকে। নিতম্বে জেগে থাকে শেষ ঘুমতলানি, পাশ ফেরা পাখনায় অবাক রাত্রির চাঁদ চুপটি করে অপেক্ষারত, তার ছায়া নিজের গলার কাকুতিতে গার্গল করলেই ঝুপ্ করে পাদানিতে গড়িয়ে নামে পাংশু পেখমের নতুন একটা দিন। আর টফির দু কানে সামান্য ছুঁয়ে গতরাত্রের নিক্ষেপ করা শর একটু খেলাচ্ছলে রগড় করে দেখা, একটু অজান্তেই এটার ধড় ছুঁয়ে থাকা পৌরুষ চেখে দেখলে ইচ্ছে করে আবার কোলে নিতে ওকে। ইচ্ছে করে গ্রীবাসুখে পাগলামি করতে, আবার। আবার জল ঘেরা ভূমধ্যসাগরের পশ্চিমে ডলফিনের গ্রামে সেঁতলা পাথরের খাঁজে জেগে আছে যে পরমাণুকাঁকড়ার ডিম, তার বাঁ হাতের শেষে বটলনেক ডলফিনের শামিয়ানা। ওদিকটায় সোফিয়ারা বহুযুগ ধরে ওদের বন্ধু হবার আশায় তাঁবু বিছিয়ে রয়েছে। বেলা হলে বোট ক্যামেরা নিয়ে হাজির হবে নিশ্চিত, কিন্তু তার আগেই যে উপায়ে হোক টফিকে দাপনায় বেঁধে ফেলতে হবে, নইলে বিপদ। পিঙ্কমুনের জোয়ার এলে পালঙ্কির ধারে পৌঁছবে সার দিয়ে অববাহিকার পিঁপড়েরা, যাদের মুখে সাদা ডিম। তারা বসন্তের দূত, তারা এলে নীলাভ গুল্মের সুবাস বেরোয়, কামার্ত মেয়ে ডলফিন প্রায় ৬৩০ দিন পর সম্মতি দেয় সঙ্গমে। সব বাধা দূরীভূত হলে হান্স, টফিকে নিজের দুই ডানায়, নিজের তুলতুলে আঘ্রাণের চিৎকার ঢুকিয়ে আবার সেতু বাঁধবে। শিশ্নমুখের লাভা ছিটকে যাবে জরায়ুর দীর্ঘ সুড়ঙ্গ, দিগন্তের মূর্ধায় কম্পমান সমুদ্রঘোটকেরা ছুটে যাবে দ্যাবা পৃথিবীর এফোঁড় ওফোঁড়। হঠাৎ জলের রং বদলে কুয়াশার দানা যেন ছেড়ে দিচ্ছে কেউ। কে? কোনও অজানা আতঙ্ক কি তবে এল?

আলো ফুটছে নাকি? সাড়া দেয় না কেউ। কেবল চশমা ফেটে একটা মট্ মট্ শব্দ হল, আর জাহাজটা নোঙর নিল গা ঘেঁষে। গলা দিয়ে কুঁই করে ডাক ছাড়াও বেকার, কে ওরা, কারা যেন মানুষের মতো।

কিন্তু সোফিয়া নয়, আর কোনও জন্তু। জলের শত্রু। মা নেলি মরে যাবার আগের দিন তাকে বলেছিল, পৃথিবীতে এমন কিছু স্পন্দন তৈরি হয়, যা বিপদের সঙ্কেত দেয়। এই শব্দ চেনার ক্লাসে প্রথম তাদের আলাপ, টফি তখন এক চিলতে মাদী, বেপরোয়া ও হার্দিক। তার ত্বক ঈষৎ গোলাপি, তখন তার জিভ কাঁকড়ার গায়ের মতো হত।

 

২য় মাস, কোয়ারেনটাইন বর্ষ ২০১৯

বরাদ্দ ছিল রোজ দুটো করে বিরাটাকার চাঁদামাছ। সে সময়ে প্রথম একটা আনকা রোগ এসেছে সাগরে।

টফিকে শেখানো হল মানুষের কণ্ঠের সুরগ্রাম চেনার, তা থেকে চল্লিশরকম স্বর তাকে নকল করানোর চেষ্টায় তাকে ঘুষ দিচ্ছে চিনা সিপাই। সেই সময়ে ফ্লোরিডা থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল ওরা।

জাহাজের বয়াতে উঠে বসে ১৩ রাত্রি নির্বাসন দণ্ডে দুজনে কাটালেন মধুচন্দ্রিমা, নিবিষ্ট বিপরীতবিহার হলে একদিন টফির গ্রীবার তলায় কিসের গন্ধ পেল হান্স।

—দেহ বুঝি এজমালি করলি? কেমন একটা ওষুধ লাগানো তোর নাকে। সম্বিত নেই মাগীর!

—নে, ভালো করে খুঁড়ে দ্যাখ, বলে মাংসল পিচ্ছিল লেজ তুলে দিল আমার কাঁধে। সন্দেহাতীত প্রলোভন ওর পিঠে, পুচ্ছে, যবনভাঁজে। আমি দাঁত বসালাম, আর সেই সুযোগে আমাদের দুজনার শরীরে ব্লুটুথ অন্ হয়ে গেল। সোফিয়ার রোজ আবৃত্তি করা মন্ত্র, মুহূর্তে পৌঁছে গেল টফির গ্রন্থিতে। তারপর সে আর আমায় চিনতে পারত না, ঘ্রাণ ফিরে যেত মুগ্ধতার শঙ্খ লাগা যামে, আমি আবেগের ভ্রান্তপথ দিয়ে তার মিলনে চৌচির হচ্ছি আর সে এক দেশের গোপন তথ্য পৌঁছে দিল চিন সরকারের কসমিক এজেন্সিকে। মঙ্গলগ্রহের অনাবিষ্কৃত গূঢ় লিপি তার মস্তিষ্কের স্ক্যানারে চলে গেল, আমি নীরবে বুঝলাম, তাকে হারিয়েছি। সে জানে, আমি তার কেউ নই। তাহলে আমার জারজ স্থাবর অস্থাবর, আমার জিজীবিষা, কত যুগের ভয়ের গোঙানি— আমি যে দিয়েছিলাম ওকে, সে তাহলে দেহের অস্থিনিলয়ে গেঁথে তুলেছিল তার চিনা মনিবের হাতের আবিলতা। তুমি সেই লাল জেলি চেটে চেটে খেয়ে আহ্লাদে গদগদ হয়ে লবণাক্ত জলের ভেতরে গোপনে শিখেছ কিভাবে গলায় কুস্বর করে, পেট টম্বুর হলে আর্তি বোঝায়, কোনটা চিড়িক, কোনটা পোআ, কোনটা থৌ তৌ ময়া। কোন্ নাদ কোন্ জিনোম থেকে প্রান্তীয় একরকম কচি জীবের কারখানায় তার শব্দরশ্মি পৌঁছতে পারবে ঠিক ৪৬০ দিনের মাথায়। চিনের উহান থেকে নিয়মিত মঙ্গলে যাবার নব্যপুষ্পকের ছক তৈরিতে ঐ জানোয়ার সোফিয়া ও তার চার চারটে লুম্পেন এ সর্বনাশ করছিল, না। কিছুতেই না। নেলির শিক্ষায় এত বছরের জলতরঙ্গের লিপি সে জানে, তাকে হারানো সহজ নয়। চোয়ালের লালায় আমিও শেষ চেষ্টা করব। বুঝতে পারি, ঋ-কারে ই-কারে দামামা লেগেছে, ভুল কালপুরুষ ভুল সপ্তর্ষিকে জব্দ করতে নেমেছে, কিন্তু দরকার হলে সন্ধ্যা ভাষার ঈ হরমোন আমি প্রিয়তমার মাংসকুঁজ রসকুম্ভে পৌঁছে দেব… উহানের বন্দরে বিক্রি হবে চৌষট্টি যোগিনীচক্র, দু মাসে ধ্বংস নামবে ওর প্রজাতির শত্রু মানুষের। নিশ্চিহ্ন হবে দলা দলা মানুষ রক্ত, মানুষকোষী জীব কোটি কোটি কোটি।

 

চিনচর্চিত নীলকলেবর

চিনের সাগর পাড়ি দেবে বলে সে তার ঘামগ্রন্থিকে সবল করেছিল। খোসা ছাড়িয়ে মধ্যরাতে আমি জলের আড়াইশত বছর পুরনো ওর গলার সাইবার হোলে যখন আমার ইচ্ছেগহ্বর নিষিক্ত গাঢ় আদর জেলির মতো মুখিয়ে তুলেছি, আমার দু বাজুতে শব্দজ্ঞান দিনান্তের কর্কটরেখা ধরে পার হচ্ছে কালোসাগর, আমার তৃষাগ্র পুচ্ছ ঝিকিয়ে উঠছে কেমন এক অবলীলায়, যেন আমি আর ও, যেন আমি আর ও বাণভট্টের ভারত মহাসাগরের গুপ্তরেশম পথে বাইছি আমাদের অসমাপ্ত যৌনপীঠ, কখনও মাসের পর মাস কেবল অধরে অধরে ছানবিন চলল। আমার মাছের মতো বিরাট লেজের তলা থেকে যেদিন স্ফটিক বেরুত, সেদিন টানা চলল রসনার বাটপারি। একবার ওর স্তম্ভন ভাঙিয়ে ঠায় ৩০০ ঘণ্টা আমরা অপরিচিতদের বেলেল্লা করে চলেছি, রোদ্দুরের রাগি ঠাট, মীড় তুলছে জলবুদ্বুদ। দেখলাম ফিনকি দিয়ে সাদা ফেনা গল্ গল্ করে বেরোচ্ছে টফির গলা থেকে। এত ফেনায় পিছিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু ক্রমশ আরও দূরে যেতে যেতে হঠাৎ কানবরাবর একটা ব্যাপক পুরুষ ডলফিন ওকে জোরে ধাক্কা দিয়ে পার করে নিল। রাতের বুক ফালা ফালা করে কপ্টারের গর্জন, বিকট দানবিক তার জলে নাশকগুঁড়ো ফেলে আমাদের পিপাসায় মেরে ফেলার অঙ্ক, যাতে গুপ্তচর পাঠানো দেশটার কথা কেউ না টের পায়। বুঝতে পারলাম পথ হারিয়েছি, বুঝলাম কতটা বিপজ্জনক এই শব্দকোড শেখানোর উদ্দেশ্য। হিম জলে তখন কোরাল প্রাচীরময় তুষারের পলি। সাঁতার দিচ্ছি আর জলের বরফ শীতল আবর্ত আমাকে পাকিয়ে ধরছে, মনে হল সেন্ট লরেন্স কোস্ট পেরিয়ে হয়ত আদিম কোনও বিষাদ সাগরে ভাসছি। কত দিন এভাবে পানীয়হীন আছি, জানি না; এক প্রকার হলদে বিষ্ঠা ও শ্যাওলার জরায়ুতে মা যেন আমায় জঠরে তুলে নিয়েছেন, প্রায় অন্ধ পাতালে একা তবে কি মহাকাশের কোনও অদৃশ্য চিরাগের জন্য এই লালসা!

মনে রেখো, মগজ নেই।
কার্তুজহারা, শরীরপিণ্ড নয়
দেহকোষ আদি সুর তাল লয়
জন্তুর চেয়েও আলোকপ্রাপ্ত হলে
দস্তানা শুধু তোমার বন্ধু, নাকোশ পরোনি বলে
অথবা কেবল অসুখের মতো তোমায় পেয়েছি, জবাই
করেছে ওরা। অসুখের বীজ চাষ করে আজ পৃথিবীকে একা
ওরা, বিনা খরচায় পাঠিয়ে দিয়েছে হত্যার পরোয়ানা

 

সাউথ চাইনা সী ২০২০

আমাকে এখন আর চেনা যায় না, এত গ্যালন স্ফীত আমার প্রদাহগুলি যে তা পর পর টানা এই মারি আগুনের মতো ফুসফুস জ্বালিয়ে দিতে পারে, টফি নিখোঁজ। কিন্তু সোফিয়ারা মরবে না। ওরা বিজ্ঞ, তাই হত্যা ওদের হাতে। এই সমুদ্র সবুজ রঙের, জল তেমন সতেজ নয়, নাকি এরা জ্যান্ত দেখলেই আবির ছুঁড়ে দেয়, মারিপতঙ্গের! তারপর প্রাণ ও অপ্রাণে আমার শরীরে টফির মননকীট বাসা করবে, কোটি বিরহ পেরোলে সেদিন এ পরবাস ফুরোবে, আমাদের দুজনের যুগল নাচের তরঙ্গে ঈশাবাস্যলোক জলে জলে প্রাণ রোপণ করে দেবে, আসবে গৃহহীনের নতুন দ্বীপ, দ্বিতীয় ভারতবর্ষ।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...