করোনার দিনগুলিতে একা

মুয়াফাক শিশেইক

 




লেখক কেরলের বাসিন্দা, রাজস্থানের জয়পুরে চাকুরিরত। তিনি নিজের জীবন নিয়ে আর কোনওদিন কোনও অভিযোগ করবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন।




 

আমার করোনা কোয়ারান্টিনে থাকার অভিজ্ঞতা, আপনারা যখন এই লেখা পড়ছেন, তার চেয়ে অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। এ বছর ১৭ মার্চ জয়পুরের একটা হাসপাতালে আমি নিজেকে একটা আইসোলেশন ওয়ার্ডের মধ্যে খুঁজে পাই। আমরা মোট ১১ জন সেদিন ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছিলাম। এমনিতে আমরা বেশ খোশমেজাজেই ছিলাম, কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছিল, যদি আমাদের মধ্যে কেউ করোনা পজিটিভ হয়, তাহলে কী হবে? আর যদি বা আমরা নেগেটিভও হই, তাহলে এই হাসপাতালের কমন বাথরুম আর অন্যান্য সুবিধেগুলো ব্যবহার করার ফলে নতুন করে সংক্রামিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। আমার তো মনে হচ্ছিল, দেশের মধ্যে অন্য কোথাও হোক না হোক, রাজস্থানের বিভিন্ন হাসপাতালগুলিতে করোনা সংক্রমণের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এখানে ব্যবস্থাপনার ছিরি এমনই। আমাকে যখন সোয়াইন ফ্লু আউটপেশেন্টস ডিপার্টমেন্ট থেকে আইসোলেশন ওয়ার্ডের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, আমি হাসপাতালের এক কর্মীকে আমার থেকে নিরাপদ দূরত্ব রেখে হাঁটার কথা বলেছিলাম। উত্তরে সে বলেছিল, ‘করোনা সব চায়না মে হোতা হ্যায়, ইন্ডিয়া মে ইয়ে সব নেহি হোতা হ্যায়’। এই হল ১৮ মার্চ ২০২০ নাগাদ আমাদের দেশে কোভিড ১৯ সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের ধ্যানধারণা। অন্তত এই একটা দিক থেকে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে আমি একটা সদর্থক দিক পাচ্ছি, সাধারণ মানুষকে করোনার সঙ্কট সম্পর্কে অবহিত করতে অনেকখানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে সেইসব ভাষণ। 

অন্য সবার মতোই দেশব্যাপী লকডাউন আমাকেও পরীক্ষায় বসিয়েছিল। প্রথম কয়েকদিন ফুরফুরে থাকার পর ক্রমশ একঘেয়েমি আমাকে গ্রাস করল। খুব সাধারণ কিছু কাজটাজ করে সময় কাটালাম (আমার বস যদি এ লেখা পড়েন, প্লিজ জেনে রাখুন, আমি অবশ্য অফিসের কাজটাজও করেছি)। তবে এর মধ্যে কিছু কিছু জিনিস আমার কাছে ইউরেকা মুহূর্তের মতো উঠে এল। আমি আবিষ্কার করলাম, আমার ঘরে মোট ৩২.৫টি টাইলস আছে, আমার বারান্দার পায়রাগুলো সব ভূতুড়ে, সুইচ অফ করার পর আমার ঘরের পাখাটা পুরোপুরি বন্ধ হতে মোট এক মিনিট বারো সেকেন্ড সময় নেয়।  কয়েকদিন পর, এইসব মুহূর্ত বদলে গিয়ে ধীরে ধীরে দার্শনিক ও অস্তিত্ববাদী চিন্তাভাবনায় পর্যবসিত হল। হাতে বেশ কিছুটা খালি সময় পাওয়ার পর ক্রমশ বুঝতে পারলাম, আমার বন্ধু ও সহকর্মীরা ক্রমশ ফেসবুকের অর্থনীতিবিদ এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। 

হাজারটা অভিযোগ করলাম এই একঘেয়েমি নিয়ে, নিজের রান্না করা নিয়ে, সিগারেট না পাওয়া নিয়ে, ট্রাম্প বা কিম কেন এখনও উহানে পারমাণবিক আক্রমণ করছে না, এইসব টুকটাক। তেইশে মার্চ রাত থেকে আমার চারপাশটা একটু বদলাতে শুরু করল। সে এক চমৎকার রাত ছিল। বাইরে অল্প ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছিল আর সঙ্গে ঝিরঝির বৃষ্টি। এক গ্লাস সুলেইমানি কফি (কালো কফির উত্তর মালাবার সংস্করণ) নিয়ে বারান্দায় গেলাম, তারপর জগজিৎ সিং-এর গজল চালিয়ে মুহূর্তটাকে উপভোগ করতে শুরু করেছিলাম। নিচের আলোঝলমলে রাস্তাটা দারুণ লাগছিল, যেন কোনও বিদেশের টুরিজম বিজ্ঞাপনের ছবি থেকে উঠে এসেছে। 

এভাবেই বারান্দায় বসে ঠান্ডা হাওয়া উপভোগ করছি, হঠাৎ দেখতে পেলাম রাস্তায় এক এক করে অনেকগুলি হতভাগ্য মানুষের ভিড় বাড়ছে, তারা হাঁটছে, হাতে ব্যাগপত্তর, কাঁধে শিশু। সেদিনই কাগজে পড়েছিলাম কয়েকশ কিলোমিটার পথ হেঁটে পরিযায়ী শ্রমিকদের দল বাড়ি ফেরার জন্য রওনা দিয়েছে। হাতে টাকা নেই, বাড়িওলা লকডাউনের মধ্যেই বকেয়া ভাড়া মিটিয়ে দিতে বলছে, এই অবস্থায় হেঁটে বাড়ি ফেরা ছাড়া ওদের কাছে আর কোনও রাস্তা খোলা নেই।

এইসব দেখছিলাম, একসময় ঝিরঝিরে বৃষ্টি ক্রমে মুষলধারায় পরিণত হল। ওদের মধ্যে অনেকে আমার বারান্দার সামনেই একটা দোকানের শেডের নিচে আশ্রয় নিল। কিছুক্ষণ পরেই, পুলিশের টহলদারি জিপ এসে ওদের ওখান থেকে সরিয়ে দিল। ওরা তখন বাধ্য হয়ে ওই বৃষ্টিতেই হাঁটা শুরু করল। আমি ওদের বাচ্চাগুলোর কথা ভাবছিলাম। তখন প্রায় মাঝরাত, বাচ্চাগুলো বৃষ্টি উপেক্ষা করেই এতটা রাস্তা হেঁটে যাচ্ছে, আর ওই একই বৃষ্টিতে আমি গরম সুলেইমানি কফি আর জগজিৎ সিং-এর গজল দিয়ে উপভোগ করছি। ওরা কাঁদছে না, অভিযোগ করছে না, শুধু অসম্ভব এক প্রতিজ্ঞা নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আমি গোটা জীবনে আর কারও চোখেমুখে এমন বেদনা আর অসহায়তা দেখিনি। 

ঠিক সেই মুহূর্তে আমি বুঝতে পারলাম একঘেয়েমি নিয়ে আমার যাবতীয় অভিযোগ আমার সুবিধেজনক আর্থসামাজিক অবস্থান থেকে এসেছে। আরও অন্যান্য রাত আটটার বিস্ময়ের মতো, এই লকডাউনও অসংখ্য দরিদ্র ভারতবাসীর কাছে এক চরম বিপর্যয় ডেকে এনেছে। 

আশায় থাকলাম, মাঝরাতে এই বৃষ্টির মধ্যে বাচ্চাগুলোকে যেন আর হাঁটতে না হয়। এই প্রচণ্ড বৃষ্টির কথা ভেবে পুলিশ জিপ যেন ওদের প্রতি কিছুটা সহানুভূতি দেখায়। আশায় থাকলাম, যেন দেশের সরকার হঠাৎ করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দেশের গরিব মানুষগুলোর কথা একবার ভাবেন। আশায় থাকলাম, ঘরভাড়া না পেলেও ওদের হৃদয়হীন বাড়িওলারাও যেন ওদের থাকতে দেন। যারা পিছনে পড়ে আছে, আমরা সবাই যেন তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিই। আশায় থাকলাম …. কেউ কি শুনতে পাচ্ছেন আমার এই কথাগুলো?

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4649 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...