সমিধ বরণ জানা
লেখক কবি, গদ্যকার
আসলে পুরো ব্যাপারটাই একটা যুদ্ধের গল্প। অনেকদিন থেকে ঘনিয়ে ওঠা একটা পুঞ্জীভূত রাগ-দ্বেষ ও ঘৃণার বিস্ফোরণ। যদিও দুটো দেশ ও তাদের নাগরিকদের বেশিরভাগেরই দেখাসাক্ষাৎ হয় না, তাদের পরস্পরের জীবন-জীবিকা এবং আদতেই বেঁচে থাকার সম্পূর্ণ জীবনবোধ, উদ্দেশ্য ও জীবনদর্শনও সম্পূর্ণই আলাদা, তবু তাদের একটা নির্দিষ্ট বলয়ে সাক্ষাৎকার ঘটেই যায়। এইটাই হয়তো নিয়তি। আর দুই দেশের নাগরিকদের যা কিছু রাগ-দ্বেষ-ঘৃণা-হিংসা তা এইমাত্র বলয়েই সীমাবদ্ধ।
মানুষ হিসেবে প্রকৃতির দেশের নিয়ম-কানুনকে আমরা বিশেষ মান্য করি না। কারণ আমাদের দেশটা শুধুমাত্র মানুষের দেশ। যেখানে প্রেমিক থেকে হত্যাকারী, শাসক থেকে শাসিত, পীড়িত থেকে পীড়নকারী, বিনোদনের বস্তু থেকে বিনোদনকারী এ-সমস্তই শুধু মানুষ আর মানুষ। এই দৃশ্যের বাইরে আমাদের চক্ষুদৃষ্টি বড় ক্ষীণ। বড়জোর শস্য, আসবাব এবং মাংস পর্যন্ত আমরা দেখতে পাই। তার বাইরে প্রকৃতির দেশের যে বিশাল অংশ ও সম্ভাবনা এবং তার নাগরিকদের সুবিস্তৃত যাপন তা আমরা দেখতে পাই না। এমনকি যা মানুষের বিজ্ঞান বলে আমরা দাবি করি, তার দ্বারাও সেই দেশের সামান্যমাত্র অংশই আমাদের ধারণায় আসে।
এখন এই অবস্থায় ওই দেশের যেটুকু বলয়ের সঙ্গে আমাদের নিত্য যোগাযোগ, যে অংশটুকু আমাদের দৃশ্যের অন্তর্ভুক্ত, সেটুকুতেও আমরা দখল করতে চাই। আর কে না জানে, দখলের রাজনীতি এবং তার জন্য যুদ্ধ আকাঙ্খা এক অলঙ্ঘ্য নিয়তি হিসেবে মানুষের সৃষ্টি থেকেই তার সঙ্গে জুড়ে আছে। এই যুদ্ধবলয়ের সাম্প্রতিকতম সংযুক্তি হল মানুষের ভাষায় ‘করোনা সঙ্কট ও লকডাউন’।
সমস্যা হল, এইরকম যুদ্ধ সঙ্কটে মানুষ নিজেদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, প্রকৃত অর্থে, বাঁচার সম্ভাবনাকে টিকিয়ে রাখতে তাকে বিচ্ছিন্ন হতেই হয়। এখন আমাদের প্রেম, হত্যা, পীড়ন ও বিনোদন সমস্তই খোপের মধ্যে ক্রমে সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। আমাদের সুবিশাল, দানবাকার বড় ভয়ঙ্কর ছায়া ক্রমে ক্রমে ছোট হয়ে আসছে। বরং তার জায়গা নিয়ে বেড়ে উঠছে নিজের জন্য ব্যাক্তিকেন্দ্রিক আতঙ্ক ও মৃত্যুভয়। আমাদের খাদ্য, হিংসা, বিনোদন ও আনন্দের মতোই আতঙ্ক ও ভয়ও, আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত দেশটির নাগরিকদের থেকে সম্পূর্ণই আলাদা। ফলত এই সামান্য যুদ্ধবলয়ের মধ্যে আমাদের ক্ষয়ক্ষতিও সবচেয়ে বেশি।
এরপরেও আমরা নিজেদের গর্বিত প্রচ্ছায়াটিকে গোপালমূর্তির মতো গোপনে লালন করছি, তার খাবার জোগাচ্ছি। এইসব প্রক্রিয়ার অংশস্বরূপ, সোশ্যাল মিডিয়ায় থরে থরে ভরে উঠছে মিমস, খাদ্যাখাদ্যের ছবি, তরল রসিকতা, দানধ্যানের সুনিপুণ গরিমা দর্শন, সর্ববিশেষজ্ঞের নিদান এবং মজুতকারীর দেহভঙ্গিমা। আমরা যে-যার খুপরিতে দিবস-রজনী টেলিভিশনের পর্দায় খেয়োখেয়ির লাইভ টেলিকাস্টিং এবং পুরনো ডেইলি সোপের আবর্তনে মজে আছি। কারণ, সত্যি বলতে আমাদের শ্রেণি সাধারণ্যের বেঁচে থাকার জন্য এটুকুর থেকে খুব বেশি দরকার পড়ে না। বাকি রইল খাদ্যবস্তুর সময়কালীন জোগান। তা যা মনে হয় এখনও ব্যাক্তিগত ভাঁড়ারে এবং সরকারি ভাঁড়ারে তেমন টান পড়েনি। তবে যখন তা পড়বে, তখন প্রথমে তারাই মৃত্যু বরণ করবে, যাদের এই যুদ্ধের পিছনে দায় ছিল সবচেয়ে কম। আমরা সবাই জানি এবং সহজেই মেনে নিই যে সাধারণ সৈন্যরা অসহায়ভাবেই দেশাত্মবোধে অন্ধ এবং আগে মরে। তবে এটাও ঠিক যে, এই যুদ্ধ শেষের পরেও যদি মানুষের অস্তিত্ব থাকে, তবে কবিতা-গানে-গল্পে এই শহীদদের স্মরণ করা হবে।
আপাতত এভাবেই নিজের গণ্ডি ছোট করতে করতে যুদ্ধের দিনগুলো কেটে যাচ্ছে। তবু আমাদের মধ্যেই কেউ কেউ আছেন, যাঁদের কাছে এই যুদ্ধটা হত্যা ও প্রতি-আক্রমণের বাইরেও অন্যকিছু। তাঁরা একা একা ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ঘুম থেকে উঠে পড়েন। আধো অন্ধকারে নেমে আসেন বাড়ির উঠোনে। সেখানে কয়েকটা ঝুপসি আমের গাছ ভর্তি হয়ে ঝুঁকে পড়েছিল বউলে। জ্যোৎস্নার রাতে তীব্র গন্ধে ভিজে উঠেছিল খোড়ো চাল, ধবধবে নিকানো উঠোন। এখন গুটি একটু বড় হয়েছে। শেষ চৈত্রে, অন্যান্য বছরের মতো এখনও খুব বেশি গরম পড়েনি। সারাদিন মধুর দখিনা হাওয়া বয়। এত পাখি আছে এ তল্লাটে, কই আগে তো দেখা যায়নি! এত পুলকিত প্রজাপতি, ফড়িং বোধ হয় বহুদিন আগে এ পৃথিবীতে ছিল! আর ওই যে অবাধ্য মাধবীলতার ডাল যেগুলো প্রায়ই দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে থাকত মানুষ চলাচলের রাস্তায়, সেও আজ বাঁধনছাড়া। তরতর করে খুশিমতো বেয়ে চলেছে। তার প্রতিটি ডালে অসংখ্য গোছা গোছা সাদা ও কমলা রঙের ফুল। তারা মধু ঢেলে দিচ্ছে পরিত্যক্ত রাস্তার উপরে। দিগন্তবিস্তৃত মাঠে ধান পেকে উঠেছে। এবারে লকডাউনের জন্য ফসল কাটার লোক পাওয়া যায়নি। শান্ত-গম্ভীর এক অসীম সম্ভাবনা নিয়ে শুয়ে আছে শস্যভরা মাঠ। তার উপরে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে আসছে ওই যে শিশু সূর্য। কোথায় হত্যা, কোথায় বা যুদ্ধ!