সুমন সেনগুপ্ত
লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার, সমাজকর্মী
সারা দেশে করোনা নিয়ে লকডাউন চলছে, সারা বিশ্বে কী করে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানো যায় তা নিয়ে প্রচুর গবেষণা চলছে। কী করে প্রযুক্তির ব্যবহার করে এই করোনা সংক্রমণকে রোধ করা যায় তা নিয়েও কথা চালু হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে কিছুদিন আগে বলা হয়েছে যে নাগরিকদের একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তাঁদের ফোনে ডাউনলোড করতে হবে তাহলে নাকি বোঝা যাবে কোথায় কোথায় করোনা সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দিলেন সেখানেও তিনি বিশেষ করে উল্লেখ করলেন এই মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন সম্পর্কে যার নাম সরকারিভাবে রাখা হয়েছে— আরোগ্য সেতু। এই সেতুবন্ধনের মধ্যে দিয়ে নাকি করোনা সংক্রমণ রোখা যাবে। কিন্তু বিষয়টি কতটা সত্যি?
প্রথমে দেখে নেওয়া যাক এই ‘আরোগ্য সেতু’ মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন কীভাবে কাজ করার কথা বলা হয়েছে সেই বিষয়ে। বলা হয়েছে যে এই অ্যাপ্লিকেশন যাঁদের ফোনে থাকবে তাঁরা যদি কোনও করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসেন তাহলে সরকার বুঝতে পারবে দেশের কোন কোন জায়গায় কারা সংক্রামিত। কীভাবে বোঝা যাবে? যারা স্মার্ট ফোন ব্যবহার করেন তাঁদের মোবাইলে অনেক ধরনের মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন থাকে, দিনে কত ক্যালরি খাবার খাওয়া জরুরি, কত ক্যালরি হেঁটে বা দৌড়িয়ে পোড়ানো উচিত, কত ব্লাড প্রেশার বা কত সুগার এরকম হাজারো আছে। এগুলো ব্যবহার করলে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় কি না, তা সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও অনেকেই এইগুলো ব্যবহার করেন। বলা হয়েছে যে মোবাইলের ব্লুটুথ এবং জিপিএস চালু রাখতে হবে, তার মধ্যে দিয়ে বোঝা যাবে আশেপাশে কোনও করোনা আক্রান্ত মানুষ আছেন কিনা। সঙ্গে সঙ্গে সরকারের কাছে তথ্য পৌঁছে যাবে যে অমুক অঞ্চলে একজন বা একাধিক করোনা আক্রান্ত মানুষ আছেন। এর পাশাপাশি কী করা হল, বিভিন্ন স্কুলের মাধ্যম দিয়ে একটি নির্দেশ পাঠানো হল যে অভিভাবকেরা যেন তাঁদের মোবাইলে এই অ্যাপটি ইন্সটল করে নেন। তারপর তো বিভিন্ন সংস্থা থেকে অনবরত মেসেজ যে অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে নিন। যদিও দক্ষিণ কোরিয়া এই পদ্ধতি মেনেই কিছুটা সংক্রমণ প্রশমিত করেছে, কিন্তু ভারতের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে এই পদ্ধতি কি খুব কার্যকর হবে? নাগরিকেরা কেন এই প্রশ্নটা করছেন না, যে এই অ্যাপ্লিকেশন কি করোনা পরীক্ষার বিকল্প হতে পারে? এটা কি আসলে বিতর্কটিকে অন্য দিকে চালনা করার জন্য কোনও পদ্ধতি?
যারা এই অ্যাপটি নিজেদের মোবাইলে স্থাপন করবেন, তাঁদের নাম, বয়স, লিঙ্গ এবং ফোন নম্বর দিয়ে নিজেকে নথিভুক্ত করতে হবে। সেই মানুষটির যদি কোনও শারীরিক অসুবিধা থাকে, ধরা যাক তিনি হার্টের রুগী বা ডায়াবেটিক বা অন্য কোনও সমস্যা আছে, সেগুলোও জানাতে হবে। তারপর বলা হবে যে তাঁর ফোনকে চালু রাখতে হবে সারাক্ষণ, যাতে এটা বোঝা সম্ভব হয় যে সেই মানুষটি কোথায় কোথায় যাতায়াত করছেন। এছাড়াও আরও একটি বিশেষ প্রযুক্তি এর মধ্যে অন্তর্নিহিত থাকবে যা কিনা সেই মানুষটিকেও এই করোনা বিষয়ে সচেতন করবে। যেই সব দেশে স্মার্ট ফোনের ব্যবহার খুব বেশি সেই সব দেশে তাও এই পদ্ধতি চলতে পারলেও ভারতের মতো দেশে যেখানে এর ব্যবহার ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশের মধ্যে সেখানে কি এই আরোগ্য সেতু কাজ করবে? এখন প্রাথমিক ভাবে বলা হচ্ছে যে এটি স্বেচ্ছামূলক, কিন্তু অচিরেই এটিকে বাধ্যতামূলক করা হবে, ঠিক যেভাবে আধারকে করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর এবং নীতি আয়োগ থেকে এটা করার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে তাতে অন্য কিছু কি মনে হতে পারে? যেহেতু জিপিএস এবং ব্লুটুথ লাগে, তাই সাধারণ ফোনে এই অ্যাপ কাজ করবে না, তাই এরপরেই হয়তো শোনা যাবে সাধারণ ফোনের জন্যেও নতুন কোনও প্রযুক্তি আনা হবে, ঠিক যেভাবে ইউপিআই বা পেমেন্ট সিস্টেমের জন্য ওটিপি আসবে, ইত্যাদি প্রভৃতি। দেশের অন্তত ৫০ শতাংশ মানুষ যদি এই আরোগ্য সেতু নিজেদের মোবাইলে না নেন, তাহলে এই প্রযুক্তি কতটা কাজ করবে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। বলা হয়েছে যে আপাতত প্রত্যেকটি মানুষের তথ্য সেই মোবাইলেই জমা থাকবে, যদি কোনও মানুষ করোনা আক্রান্ত হন তখন সেই তথ্য সরকারের কাছে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু শোনা যাচ্ছে যে এই তথ্য একটি বেসরকারি সংস্থা ‘আমাজন ওয়েব সার্ভিসেস’-এর কাছে রাখা থাকবে, যারা যেকোনও কারও কাছে এই তথ্য বিক্রি করতে পারবে। ঘটনাচক্রে এই সংস্থার কাছেই ভারতের বহু নাগরিকের আধারের তথ্য রাখা আছে এবং বিভিন্ন সময়ে যা আরও অন্যান্য সংস্থার কাছে বিক্রি করা হয়েছে।
প্যারিসের একটি সাইবার সুরক্ষা সংস্থা এই বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছেন যে এই অ্যাপ্লিকেশনটি ব্যবহারকারীর পরিচয় থেকে শুরু করে, যে কোনও সময়ে ব্যবহারকারী কোথায় যাচ্ছেন, কার সঙ্গে দেখা করছেন এবং অন্যান্য আশেপাশের মানুষজনের মোবাইলে এটি আছে কিনা সেটা অবধি বুঝতে পারে। তার মানে কি দাঁড়াল? একজন ব্যবহারকারীর যদি সামাজিক চলাফেরাকে নজরে রাখা যায় তাহলে খুব সুনির্দিষ্ট একটি রেখাচিত্র আঁকা খুব কি কঠিন কাজ যে মানুষটি কোথায় কোথায় যাতায়াত করছেন, কার সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা হচ্ছে, ইত্যাদি। আরও একটি কথা বলা আছে এই আরোগ্য সেতুর শর্তাবলিতে যা হয়তো অনেকেরই নজর এড়িয়ে গেছে যে ভবিষ্যতে শুধু করোনা নয়, যদি সরকার মনে করে তাহলে এই তথ্য তারা অন্য কোনও কারণেও ব্যবহার করতে পারেন।
আরও একটি বিষয় বলা খুব জরুরি যা নিয়ে অনেকেই কথা বলেননি, তা হল এই অ্যাপটি একটি সন্দেহ ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রযুক্তি। আমাদের মতো দেশে যেখানে শুধু করোনা আক্রান্ত এই সন্দেহে একেকজন মানুষকে গ্রামছাড়া করা হয়, বা অবসাদে কোনও কোনও মানুষ আত্মহত্যাও করছেন এরকম খবরও পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে এই ‘আরোগ্য সেতু’ অ্যাপটি কি মানুষে মানুষে আরও দূরত্ব বাড়াবে না? একজন মানুষ যদি জানতে পারেন তাঁর পাশের মানুষটি করোনা-আক্রান্ত তাহলে কি মব লিঞ্চিং বা গণপিটুনির ঘটনা ঘটবে না সেই নিশ্চয়তা দেওয়া যায়? যে দেশে শুধু খাদ্যাভ্যাসের কারণে একের পর এক গণহত্যা ঘটে, সেখানে কে করোনায় আক্রান্ত, কে সংখ্যালঘুদের কোন সমাবেশে হাজির ছিল সেটাও যদি বোঝা যায় তাহলে একজন নাগরিকের জীবন কি অসুবিধায় পড়তে পারে না? আসলে রাষ্ট্র চাইছে প্রতিটি নাগরিক যাতে রাষ্ট্রের চোখ হয়ে ওঠে, প্রতিটি নাগরিক যাতে তাঁর সহনাগরিককে সন্দেহের চোখে দেখে, এটা করতে পারলেই রাষ্ট্র জিতে যায়, তাহলেই দুজন সহনাগরিক একজোট হয়ে আর প্রশ্ন করতে পারবেন না, যে করোনার লকডাউনে কেন সাধারণ নাগরিকেরা, পরিযায়ী শ্রমিকেরা না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছেন? কেন সঠিক এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে করোনার পরীক্ষা হচ্ছে না? কিংবা যাঁদের জন্য প্রধানমন্ত্রী কুম্ভীরাশ্রু ফেলেই চলেছেন সেই স্বাস্থ্যকর্মীদের কেন পর্যাপ্ত পিপিই নেই?
গত ৬ই এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী একটি টুইট করে বিজেপি কর্মীদের এই অ্যাপ্লিকেশনটি ডাউনলোড করতে বলেছেন, তাহলে তার উদ্দেশ্য কী? অঞ্চলে অঞ্চলে বিজেপি কর্মীরা এই আরোগ্য সেতু অ্যাপ্লিকেশনটি মোবাইলে নিয়ে যদি বলেন কোনও নাগরিককে যে আপনি করোনা আক্রান্ত, আপনার কি প্রমাণ করবার কোনও সুযোগ থাকবে যে আপনি আক্রান্ত নন, এটা কি আর একধরনের চাপ সৃষ্টি করার কৌশল নয়?
পরিশেষে কিছু কথা যা পাঠকেরা ভেবে দেখতে পারেন।
১। কোনও নাগরিক মনে করতেই পারেন যে রাষ্ট্র তো এমনিতেই সব জানে, তাহলে আর নতুন কী অসুবিধা হবে? হবে, কারণ এর পরে বলা হবে যে এই অ্যাপ্লিকেশনটি ছাড়া ই-পাস পাওয়া যাবে না, সুতরাং দেশের মধ্যেও কোথাও যেতে হলেও এটি লাগবে। এই মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনটি কখনওই বাধ্যতামূলক হতে পারে না।
২। নজরদারি শব্দটি যদিও কেউ মনে করতে পারেন ভালো, কিন্তু কোনও কোনও মানুষ তো এটিকে শৃঙ্খলও মনে করতে পারেন।
৩। সরকারকে এখন অনেকেই কিছু প্রশ্ন করছেন যাতে সরকারের ব্যর্থতাই চোখে পড়ছে, এই অ্যাপ্লিকেশনটি নিয়ে এত মাতামাতি করার অর্থ কি এই প্রশ্নগুলো থেকে দৃষ্টি সরানো?
৪। স্বাস্থ্য একটি রাজ্যের আওতাভুক্ত বিষয়, কিন্তু এই আরোগ্য সেতু বন্ধনে কি এই স্বাস্থ্যকেও রাজ্য থেকে কেন্দ্রীয় আওতায় নিয়ে যাওয়া হবে?
৫। একজন নাগরিক কি চাইবে তাঁর সমস্ত গতিবিধি সরকার নজর রাখুক? সুস্থ গণতন্ত্রে কি এটা কখনওই কাম্য?
এই কথাগুলো না ভেবে যদি গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়া হয় তাহলে হয়তো কোনও নাগরিকের মনে হতে পারে যে তিনি সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করলেন, কিন্তু আসলে কি তিনি ব্যক্তি হিসেবেই গণতন্ত্রকে স্বৈরতন্ত্র বানানোর দিকে এগিয়ে দিচ্ছেন না? সরকারকে সহযোগিতা করার অর্থ কি সরকারকে প্রশ্ন না করা?