সৌভিক ঘোষাল
লেখক প্রাবন্ধিক ও গদ্যকার, পেশায় শিক্ষক
একটি প্রচলিত বাংলা প্রবাদে বলা হয় ঢেঁকি নাকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে। আমরা স্বর্গ-নরকে বিশ্বাসী নই, কিন্তু এই প্রচলিত প্রবাদের একটি প্রকাশ আমরা দেখলাম করোনাকালে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর রমরমার মধ্যে। করোনা গোটা মানবজাতির সঙ্কট, গোটা মানবজাতিকে এক হয়ে এর বিরুদ্ধে লড়তে হবে, এই সুভাষিত বাণীর বিরুদ্ধে আমরা দেখলাম আমাদের বিভাজনরেখাগুলি এই সঙ্কটের সময়েও আর একবার নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। জাতিবিদ্বেষ (চিনাদের বিরুদ্ধে ভাইরাস ছড়ানোর কাল্পনিক অভিযোগ), ধর্মপরিচিতিভিত্তিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আক্রমণ (মুসলিমদের ভাইরাস জেহাদ ছড়ানোর চেষ্টা সংক্রান্ত বিদ্বেষ-বিষে ভরা গাঁজাখুরি তত্ত্ব), শ্রেণিভিত্তিক বৈষম্যের অন্ধকার দিকগুলির নতুন নতুন চেহারায় আত্মপ্রকাশ (পরিযায়ী শ্রমিকদের লং মার্চ থেকে গরীবদের নানামাত্রিক অসহায়তা, তা দূর করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাব থেকে সময়ে সময়ে লাঠি চালানো পর্যন্ত)– সবই এই সময়ে খুব স্পষ্টভাবে আমাদের সামনে ধরা দিল।
মার্চের মাঝামাঝি সময়ে দিল্লিতে তবলিগি জামাতের একটি আন্তর্জাতিক ধর্মীয় সমাবেশকে বেছে নিয়ে যেভাবে তাকে অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর প্রচেষ্টা চলছে তা চরম নিন্দনীয়। এই অপরাধের শরিক অনেকেই। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার, বিজেপির পেটোয়া মিডিয়া বাহিনী, এমনকী এই সেদিন যাদের ওপর দিল্লির ব্যাপক সংখ্যালঘু মানুষ ভরসা করলেন সেই আম আদমি পার্টি ও তাদের পরিচালিত সরকারও। সরকার বা বড় বড় মিডিয়া হাউসের থেকে ব্যাপারটা অচিরেই ছড়িয়ে পড়ে তৃণমূল স্তরে। ফেসবুক, ট্যুইটার, হোয়াটস অ্যাপ সহ নানা ধরনের সোশ্যাল মিডিয়ায় লাগাতার চলতে থাকে মুসলিম বিরোধী ঘৃণা ও বিদ্বেষের উদগীরণ।
একথা তো জানা যে, ভাইরাস প্রতিরোধে বিদেশ থেকে ভারতে আসা বন্ধ করার এবং বড় জমায়েত নিষিদ্ধ করতে নির্দেশিকা বা সতর্কতা জারি করার দায়িত্ব ও ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারেরই ছিল; আর কেন্দ্র সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তার বদলে, মার্চ মাসের অর্ধেকটা পেরিয়ে যাওয়ার পরেও, কেন্দ্রীয় সরকার কোভিড-১৯-এর বিপদকে অস্বীকার করছিল এবং বিরোধী দলনেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করলে উল্টে তাদেরকেই “অযথা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে” বলে অভিযুক্ত করছিল। ভারতে কোভিড-১৯-এর প্রথম আক্রমণ নথিভুক্ত হয় ৩০ জানুয়ারি ২০২০। কিন্তু সমগ্র ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে কেন্দ্রীয় সরকার ভাইরাস আটকাতে ন্যূনতম পদক্ষেপ ও প্রস্তুতি নিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। তার বদলে কেন্দ্রীয় সরকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে স্বাগত জানাতে বড় বড় সমাবেশের আয়োজন করছিল যার ফলে হাজার হাজার মানুষের মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে বিজেপি সমর্থকরা দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক হানাদারদের এক জায়গায় জড়ো করছিল। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে বিরোধী নেতারা যখন কোভিড-১৯-এর আসন্ন মহামারি সম্পর্কে বারবার সতর্ক করছিল তখন কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যুত্তরে আসছিল কেবলমাত্র ব্যঙ্গবিদ্রুপ।
শুধু কি তাই? বিপদ যখন সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে, যখন লকডাউন ঘোষণা হয়ে গেছে, তখনও বিজেপি নেতা ও সমর্থকেরা বড় বড় জমায়েতে নেতৃত্ব দিয়েছে। ৭০০ সাংসদ সংসদ অধিবেশনে উপস্থিত থেকেছে এবং মধ্যপ্রদেশ বিধানসভা দখল করতে বিজেপি ষড়যন্ত্র করেছে ও শেষে ২৪ মার্চ এক বিশাল জমায়েত করে বিজয়োৎসব করছে।
এসব দায়কে অস্বীকার করে অমিত শাহর হাতে থাকা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক তবলিগি জামাতকে অপরাধী সাব্যস্ত করার রাস্তাই বেছে নিল। দিল্লির রাজ্য সরকারও তবলিগি জামাতের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করল! অথচ সেই জমায়েতটি কোনও অর্থেই বেআইনি ছিল না। বাস্তবে দিল্লি পুলিশের (যা কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক পরিচালিত) এবং সংশ্লিষ্ট এসডিএম (দিল্লি রাজ্য সরকারের অধীন)-এর অনুমতি ও সহযোগিতা নিয়েই সেই জমায়েত সংগঠিত হয়েছিল। যদি সেই সমাবেশ বেআইনিই হবে তাহলে দিল্লি রাজ্য সরকার সঠিক সময়ে তা বন্ধ করার নোটিস দেয়নি কেন?
কিছু কোভিড-১৯ রোগীর ও মৃত্যুর সংযোগ সেই জমায়েত সংশ্লিষ্ট বলে নির্ণীত হয়েছে। ওই সময়েই অন্যান্য যে সব বড় বড় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জমায়েতগুলি হয়েছিল সেই সংযোগে কতজনের সংক্রমণ হয়ে থাকতে পারে তা জানা অবশ্য খুব কঠিন। কারণ ভারতে করোনা পরীক্ষার হার খুবই ধীর। অন্যান্য ধর্মীয় জমায়েতগুলির মধ্যে আছে শিরডি সাইবাবা মন্দির, এক শিখ প্রচারকের জমায়েত, এবং বৈষ্ণোদেবী তীর্থের যাত্রীরা, যারা লকডাউনের ফলে সেখানেই আটকে পড়েছে (এবং এঁরা প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারী জনসম্প্রদায়ের মধ্যেও ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা)। এইসব জমায়েতগুলিকে বা তবলিগি জামাতের জমায়েতটিকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত নয়। তার চেয়েও বড় কথা এই সব জমায়েতের সংগঠকদের বিবেচনাবোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ থাকলেও সমগ্র সম্প্রদায়কে দোষারোপ খুবই অন্যায়। এটা কিছুতেই আড়াল করা যায় না যে দায়টা প্রথমত কেন্দ্রীয় সরকারের ওপরই বর্তায়। প্রথম থেকেই সরকার বিভ্রান্তিকর বার্তা দিয়েছে, সুস্পষ্ট নির্দেশিকা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, জমায়েত করা না করার সিদ্ধান্ত ছেড়ে রেখেছে ব্যক্তি ও সংগঠনগুলির নিজস্ব বিচার বিবেচনার ওপর। এইসব জমায়েতের সংগঠকেরাও সুবিবেচনাবোধের পরিচয় রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই নিয়ে আক্ষেপের জায়গা এক জিনিস, আর তাকে অপরাধীকরণ করা সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। আর সবার মধ্যে থেকে আলাদাভাবে তবলিগি জামাতকে বেছে নিয়ে অপরাধী হিসেবে শণাক্ত করা তো একেবারেই উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
এই প্রশ্নগুলোর কোনও মোকাবিলা গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে যাদের মনে করা হয়, সেই মিডিয়া হাউসের শিরোমণিকুল, অন্তত তাদের অধিকাংশই করতে চাননি। বরং নিজেরা বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন, তৃণমূল স্তরের বিদ্বেষ প্রচারকারীদের উশকে দিয়েছেন। আমরা দেখলাম যে সময়টা করোনা পরিস্থিতির সময়ে একজোট হয়ে কাজ করার দরকার ছিল, সেই সময়ে কতভাবে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো যায়, তা তারা হাতেকলমে করে দেখালেন। তবলিগি জামাতের জমায়েতকে মুসলিম সমাজের বড় অংশ যে বিবেচনাপ্রসূত কাজ বলে মনে করেননি, এটা আমরা সেই সমাজের ভেতর থেকে আসা নানা প্রতিক্রিয়া থেকে দেখেছি। পাশাপাশি সঙ্গত কারণেই এই জমায়েতকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করার বিরোধিতা তারা সহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ করেছেন। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করে তবলিগি জমাতের কিছু সংগঠকের বিবেচনাবোধের অভাব ও ভুলভ্রান্তিকে ইচ্ছাকৃতভাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রায় গোটা মুসলিম সমাজকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর অপচেষ্টা চলল। বস্তুত এটাই ভারতে ইসলামোফোবিয়ার সবচেয়ে বড় দিক, যেখানে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কোনও দায়কে সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীর দায় হিসেবে দেখানো হয় ও গোটা জনগোষ্ঠীর দিকে আঙুল তোলা হয়, প্রায় সমগ্র মুসলিম সমাজকে ঘৃণা বিদ্বেষের লক্ষ্যবস্তু করে তোলা হয়।
আমরা দেখলাম তবলিগি জামাতের সমাবেশকে অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করেই বিদ্বেষ প্রচার থেমে গেল না। নানা জায়গায় উন্মত্ত মুসলিম জনতা আর্তের সেবায় এগিয়ে আসা চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের আক্রমণ করছেন, এই রকম একটা মিথ্যেকে খবর হিসেবে পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হল। সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলি চ্যানেলে চ্যানেলে তাদের সান্ধ্য আড্ডার আসলগুলি থেকে “আক্রমণকারী মুসলিমদের বিরুদ্ধে” প্রায় যুদ্ধঘোষণার ডাক দিয়ে ফেললেন। পরে ধীরে ধীরে আমরা একে একে দেখলাম এই খবরগুলি কতটা নির্জলা মিথ্যা বা অতিশয় অতিরঞ্জিত ও বিকৃত। কিন্তু দুর্ভাগ্য এটাই যে বিদ্বেষ ছড়ানো মিথ্যে রটনাগুলি যতটা উচ্চগ্রামে প্রচারিত হল, যত মানুষের কাছে পৌঁছল, সেগুলি যে ফেক বা মিথ্যা তা তার এক শতাংশ মানুষের কাছেও সেভাবে পৌঁছাল না। এভাবে একটি পরিকল্পিত মিথ্যা দিয়ে জনমানসকে প্রভাবিত করে রাখা হল।
সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে কোভিড-১৯ কে মুসলমান ও চিনা জনতার সাথে জুড়ে দিয়ে যে বিষাক্ত ইসলামবিদ্বেষী ও জাতিবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক অপপ্রচার শুরু হয়েছে তাকে আটকাতে জোরালো উদ্যোগের দরকার। মুসলিমদের পাশাপাশি তাদের চেহারায় চিনা বা মোঙ্গলীয় ছাপের জন্য উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষেরাও ইতিমধ্যেই জাতিবিদ্বেষী বৈষম্য তথা কোভিড-১৯ এর নামে ঘৃণামূলক হিংসা ও আক্রমণের শিকার হয়েছেন। চিন এই ভাইরাস ছড়িয়েছে জৈব অস্ত্র হিসেবে, একথাও হোয়াটসঅ্যাপ ফেসবুক ট্যুইটার মাধ্যমে এত ছড়ানো হয়েছে, যে অনেক মানুষ তাকে পুরোটা বা কিছুটা বিশ্বাস করে বসে আছেন।
করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময়ে এভাবে সামাজিক বিভাজনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নতুন নতুন ফ্রন্টও খুলে যাচ্ছে। অনুভূত হচ্ছে আধিবিদ্যক (মেটাফিজিক্যাল) নানা প্রবণতার বাড়বাড়ন্তের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানমনস্কতাকে ছড়িয়ে দেওয়ার লড়াইয়ের একটি দিকও। সচেতন মানুষ ও বিবেকী চিন্তাবিদদের দল এতে হস্তক্ষেপ করতে শুরুও করেছেন। তাকে আরও সংঘবদ্ধ করা ও গতি দেওয়া দরকার।