নীলিম
এতদিন দুর্ভিক্ষ সম্মন্ধে জানতাম ‘নবান্ন’ নাটক পড়ে, ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’, ‘খাদ্য আন্দোলন’ এর সময়কার লেখাপত্র পড়ে। সেগুলো পড়তে পড়তে দুর্ভিক্ষ, খাদ্য সংকট নিয়ে একটা ছবি গড়ে উঠেছিল মনে। আজ যখন ‘লকডাউন’ এর ২৫ দিন চলছে তখন বিমূর্ত থেকে মূর্ত হয়ে উঠছে ছবিটা। ‘লকডাউন’ এর এই সময়টাকে আমি দুর্ভিক্ষ বা খাদ্য সংকটই বলবো। জানি সরকারি রেশন চালু থাকা বা বাজার-মুদির দোকানে সবকিছুর সরবরাহ দেখিয়ে অনেকেই আমাকে বিরোধিতা করবেন। তাদের কে আমার ঐ ‘বিমূর্ত ছবির মূর্ত হয়ে ওঠা’র বিষটিকেই জানতে বলবো।
যা পড়েই দুর্ভিক্ষ সম্মন্ধে আমরা জানি না কেন, তাতে হাহাকারের যে ছবিটা আঁকা হয় সেটা দেশের শ্রমজীবী জনতার হাহাকার। ক্যানভাসের বেশিটা জুড়ে সেটাই থাকে। আর সেটাই থাকা উচিত। আমার লেখাতেও তাই থাকবে। কিন্তু অনেকটা জুড়ে শ্রমজীবী জনতার কথা থাকলেও সেই লেখাগুলোতে অন্য শ্রেণীগুলির উল্লেখ যে একদম নেই তা কিন্তু নয়। দুর্ভিক্ষের মাঝেও বিয়েবাড়ির খাওয়াদাওয়া-বিলাস বৈভবের কথাও সেখানে পাওয়া যায় অল্প হলেও। তা যখন পাওয়া যায় তখন নিশ্চয় খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ ছিল বলেই পাওয়া যায়। এইবারেও সেটাই বাস্তবতা। সব্জিবাজার খোলা, সব্জি আছেও। মুদির দোকানও খোলা, সেখানেও সরবরাহ রয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য মাছ-মাংসের দোকান নিয়ে। তার ওপরে আবার দুবেলা করে খোলা থাকছে রেশন দোকান। তাহলে খাদ্য সংকটটা কিসের?
একটা ছোট্ট ছবি তুলে ধরি। রেশন দোকানে দুবেলাই ইঁট পেতে, ব্যাগ রেখে লাইন পড়ছে দোকান খোলার অনেক আগে থেকে। আর লাইন থাকছে দোকান বন্ধ হওয়া অবধি! এই ছবি কি ‘লকডাউন’ এর আগে দেখা যেত? কেন দেখা যাচ্ছে এখন? আরেকটি ছবির দিকে তাকানো যাক, ‘লকডাউন’ ঘোষণা হওয়ার পর পর সব্জীবাজার-মুদির দোকান-রেশন দোকানে যে ভিড়টা হতো সেটা এখন হাল্কা হয়ে গেছে। কেন? উত্তর দুটো একই সুত্রে বাঁধা। দ্বিতীয়টার সাথে প্রথমটার উত্তর পাওয়া যাবে। ‘লকডাউন’ শুরু হওয়ার সময় শ্রমজীবী জনতার হাতে যেটুকু টাকা ছিল তা শেষ হয়ে গেছে। তাই তাদের ভিড় কমে গেছে সব্জীবাজার-মুদির দোকান-মাছ বা মাংসের দোকানে। একই কারণে লাইন বেড়েছে রেশন দোকানে। রাষ্ট্রীয় ‘দয়া’ য় বেঁচে থাকা বাদে রাস্তা বন্ধ করা হচ্ছে। যে পরিমানেই দেওয়া হোক, শুধুমাত্র রেশনের চাল-আটা/গম-চিনি খেয়ে থাকা সম্ভব নয় কারুর পক্ষেই। সেটা যেমন শ্রমজীবী জনতা জানেন, তার চেয়েও বেশি জানে রাষ্ট্র। তাও দেশের রেশন ব্যবস্থার দৌড় ঐটুকুই। সচেতনভাবেই তা করা হয়েছে। একই সাথে রাষ্ট্রের দয়া দেখানোর পাইপলাইন ওটি, এবং ‘ত্রান’ নামক অসম্মানে শ্রমিক-কৃষকদের অভ্যস্ত করানোর এক রাজনীতি এটি। ‘অধিকার’ এর প্রশ্নকে ক্রমশই পিছনে ঠেলে দিয়ে দয়া আর নির্ভরশীলতায় ঠেলার রাষ্ট্রীয় চক্রান্ত এক শাসকশ্রেণীর এক রাজনৈতিক হাতিয়ার। অনুদান বা ত্রানের চেয়ে শ্রমিক-কৃষকদের অধিকার মেনে নেওয়া খুব সমস্যাজনক রাষ্ট্রের কাছে। তাই কোম্পানি আর ঠিকেদারদের মজুরি না আটকানোর উপদেশ দিয়ে দায় সারে রাষ্ট্র। নির্দেশ জারি করে না, কোনো ‘অর্ডিন্যান্স’ আসে না। কৃষকদের কাছ থেকে সরকার সরাসরি ফসল কিনে নেয় না। যখন গণ পরিবহন বন্ধ তখন এক শ্রেণীর পয়সাওয়ালা লোক নিজেদের গাড়িতে করে ফসল কেনে। না বিক্রি করলে ফসল নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা, কারণ ফসল বিক্রি করার বিকল্প রাস্তা বন্ধ! তখন অভাবী বিক্রি করে লোকসানে ডুবতে বাধ্য হয় কৃষক! না শ্রমিক না কৃষক, কারুর হাতেই টাকা থাকে না। ফলে সেই, ভরসা হয়ে দাঁড়ায় রেশন দোকান, ত্রান আর অনুদান।
ত্রান আর অনুদান নিয়ে দূর্নীতি আসলে এই ত্রান এবং অনুদানের রাজনীতির এক অন্যতম নীতি। ফলে অধিকাংশ শ্রমজীবী জনতার কাছে চুঁইয়েও পৌছয় না ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের অবিছিন্ন সরবরাহ’। হাতে টাকা না থাকায় সংকট আজ এই জায়গায় গেছে যে রেশনের চাল বা গম/আটা বিক্রি করে দেড় বছরের বাচ্ছার জন্য দুধ কেনার টাকা জোগাড় করে মা-বাবা! পাইকারি সব্জির দাম বেঁধে দেওয়াটাকে এক বিশাল সাফল্য বলে দাবী করে রাষ্ট্র। কিন্তু সেই বেঁধে দেওয়ার মাত্রাটি সে ঠিক করে না শ্রমজীবী জনতার ক্রয় ক্ষমতার নিরিখে। তাই সব্জীর সরবরাহ জারি রাখা আসলে কোনো কাজেই আসে না দিন আনা দিন খাওয়া জনতার জন্য। মাছ-মাংসের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা প্রযোয্য। ESI তে যাওয়ার সুযোগ না থাকায় ওষুধপত্র কিনতেও যখন টাকা থাকে না হাতে তখন সব্জী-মাছ-মাংসের কতটা পৌছয় এদের রান্নাঘরে?
রেশনের চাল, আটা/গম, চিনি আর ত্রান-অনুদানের ওপর দাঁড়িয়েই হয়তো এই খাদ্য সংকটকেও পেরিয়ে যাবে ভবিষ্যতের ‘সুপার পাওয়ার’ ভারত। তার মধ্যে কিছু মা তার ক্ষিদের চোটে সন্তানদের কান্না সহ্য না করতে পেরে হয়তো তাদের নদীতে ছুঁড়ে ফেলবে। কিছু আত্মহত্যাও ঘটবে। তারপরেও দেশের মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের কারখানাগুলোতে কাজ করার মতো যথেষ্ট শ্রমিক কোনো ভাবে নিজেদের জীবনটাকে ধরেই রাখবে। অন্তত কচু পুড়িয়ে খেয়েও কৃষকরাও বেঁচে থাকবেন মহাজনি ঋণ শোধ দিতে থাকার জন্য। এদেশের বেশিরভাগ শ্রমজীবী জনতাই পেরিয়ে যাবে এই দুর্ভিক্ষ, বা খাদ্য সংকট।
জানি এই পরিস্থিতিকে দুর্ভিক্ষ বা খাদ্য সংকট বলে স্বীকার করতে চাইবেন না অনেকে। বইতে পড়া মজুতদারি-কালোবাজারির সাথে মিল খুঁজে হয়তো পান নি তিনি বা তারা। যে যে বড় মুদির দোকানে খাতা চলতো সবার সেগুলো এখন বন্ধ। এটা মজুতদারির নামান্তর ছাড়া কি? কম দামের মাল চেপে দেওয়া হচ্ছে সচেতনবভাবে। জনগণকে বেশি দামের মাল কিনতে বাধ্য করাটাও কি একধরনের কালোবাজারি নয়?
আসলে করোনার অজুহাতে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে দেশের শ্রমজীবী জনতার বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধ তাকে বিপর্যস্ত করে তোলার জন্য। আরও নির্ভরশীল করে তোলার জন্য। এই যুদ্ধের আরও অনেক উদ্যেশ্য আছে। তবে অন্যতম উদ্যেশ্য এইটাও। যুদ্ধ আসলে রাজনীতিরই সর্বোচ্চ রূপ। এই যুদ্ধেরও রাজনীতি আছে। রাজনীতি না করার ডঙ্কা বাজিয়ে সেটাই করা হচ্ছে। আজ জনতাকেও যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে। খাদ্য সংকট প্রতিরোধের আওয়াজ এই মুহুর্তে গণ আন্দোলনের প্রধান দাবী হওয়া উচিত। সেখানেও রাষ্ট্র চতুরভাবে তার মুখপত্র মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মাধ্যমে তুলে দিয়েছে আরো করোনা প্রতিরোধ আর টেস্টিং এর দাবী। খাদ্য সংকট প্রতিরোধের যে দাবী, তাই এই মুহুর্তে শ্রমজীবী জনতার রাজনীতি। যার কিছু প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে সুরাটে, তামিলনাড়ুতে, বান্দ্রায়, শোলাপুরে বা চেঙ্গাইল প্রেমচাঁদ জুট মিলে শ্রমিক বিক্ষোভে।
সুরাটের কাপড় কলের শ্রমিকেরা প্রথম ‘লকডাউন’ অমান্য করে ‘লকডাউন’ এর দিনগুলির মজুরি ও খাদ্য দাবী করে বিক্ষোভ দেখান। তারপরেই তামিলনাড়ুতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। ‘লকডাউন’ ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথেই যে দৃশ্য দেখা গেছিল দিল্লির আনন্দ বিহার বাস টার্মিনাসে তারই পুনরাবৃত্তি ঘটে মুম্বাইয়ের বান্দ্রায়। এবার তার সাথে যুক্ত হয় পুলিশের লাঠিচার্জ! আনন্দ বিহার আর বান্দ্রার ঘটনায় রাষ্ট্রের অবহেলা আর শ্রমিকদের অসহায়তার ছবি ফুটে উঠেছিল। কিন্তু শ্রমিক শ্রেণীর আরেক চরিত্র আমরা দেখেছি তামিলনাড়ুতে এবং গুজরাটের সুরাটে। যেখানে শ্রমিকদের অসহায়তা নয় বরং ফুটে ওঠে তাদের লড়াকু চেহারা। খাবারের অভাব, মজুরিহীন অবস্থায় থেকেও শ্রমিকেরা বিক্ষোভে সামিল হন। সুরাটে যে বিক্ষোভ রীতিমতো জঙ্গি চেহারা নিয়েছিল। গুজরাটের সুরাটের ঘটনার পরেই মহারাষ্ট্রের শোলাপুরে একটি নির্মাণ সংস্থায় শ্রমিকেরা ভাঙচুর চালান সংস্থার থেকে মজুরির দাবীতে। পুলিশ ৭ জনকে গ্রেপ্তার করে সেখান থেকে। এই গ্রেপ্তারির ঘটনা পরিষ্কার করে দেয় ‘লকডাউন’ এর শ্রেণী চরিত্র। যেখানে মজুরি না দেওয়ার পরেও কোনো আইনি পদক্ষেপ হয় না কোম্পানি-ঠিকাদারের বিরুদ্ধে! কিন্তু মজুরির দাবী জানালে গ্রেপ্তার হতে হয় শ্রমিকদের। প্রেমচাঁদ জুট মিলেও মজুরির দাবীতে শ্রমিকদের বিক্ষোভ চলাকালীন পুলিশি হুমকির সম্মুখীন হতে হয় শ্রমিকদের। খাদ্য সংকট প্রতিরোধই যে শ্রমজীবী জনতার দাবী তা বুঝতে গেলে খুব কষ্ট হওয়া উচিত না আমাদের। কিন্তু আমরা এখনো রাষ্ট্রীয় এবং কর্পোরেট দয়া দাক্ষিণ্যের বিকল্প হিসেবে প্রগতিশীল ত্রান বা বড়জোর সংহতি আন্দোলনেই আটকে আছি। সেই ত্রান দিয়ে যদি এই সমস্যা থেকে উতরে যাওয়ার রাস্তা থাকতো তাহলে বোধহয় আমাদের সংগঠন, ইউনিয়ন, পার্টি নামক আধারগুলি গড়ে তোলার প্রয়োজন হতো না। NGO করলেই চলতো। কিন্তু সেটা চলে না। যে রোগের কোনো ওষুধ না থাকতেও তাতে মারা যাওয়ার চেয়ে সেরে ওঠে অনেক বেশি সেই রোগে মরার ভয়ে আমরা ঘরে বসে ‘লকডাউন’ এবং ‘সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং’ উদযাপন করবো নাকি শ্রমজীবী জনতার দাবী উচ্চারণ করবো সেটা আমাদেরই ঠিক করতে হবে। পক্ষ নিতে হবে আমাদের।