অনির্বাণ ভট্টাচার্য
লেখক গদ্যকার, কবি
মহামারি। আটকে থাকা হাজারের উপর শ্রমিক। অর্থনৈতিক মন্দা। স্ট্র্যাটেজি। টেস্টিং। দুর্যোগকালীন প্যাকেজ। কোভিড ১৯-এর মতো বিশ্বব্যাপী সঙ্কটে একটা দেশের সরকারের অভিধানে থাকা শব্দগুলো এমনই হওয়া উচিত। অবশ্য যদি না সেই প্রাধান্য একটু হলেও পাল্টে যায়। যদি না সেখানে চিরকালীন দমনমূলক সংস্কৃতি চলতে থাকে। সোশ্যাল নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণের নামে সরকারি শৈথিল্যের বিন্দুমাত্র সমালোচনা সহ্য করতে না পারা তেমনই এক অসুখের নমুনা। যেখানে সঙ্গত দেয় স্তাবককুল, স্থানীয় পুলিশ।
প্রশান্ত ভূষণ। প্রাক্তন আইএএস অফিসার কান্নান গোপীনাথন। সাংবাদিক আসলিন ম্যাথিউ। সরকারি সুনজরে না থাকা বেশ কিছু ব্যক্তিত্ব। মাঝে মাঝেই চোরাগোপ্তা ধরপাকড়, শাসানি, নাগরিক নকশাল এইসব। মহামারিজনিত সঙ্কটেও অবস্থার বদল নেই। প্রেক্ষিত একটি সরকারি নির্দেশিকা। যেখানে গোপীনাথনকে আইএএস অফিসারের পদে পুনরায় যোগ দিতে বলা হচ্ছে সঙ্কট পরিস্থিতিতে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কান্নানের প্রতিবাদ। টুইট। বক্তব্য, মহামারির বিরুদ্ধে সরকারের পাশে সবরকমভাবেই আছেন তিনি, কিন্তু সেটা মুক্ত এবং দায়িত্বপূর্ণ এক নাগরিক হওয়ার অধিকারে। সরকারি অনুগ্রহ পাওয়া চাকুরিরত হিসেবে না। এখানেই আপত্তি। গুজরাটের এক অবসরপ্রাপ্ত সেনা আধিকারিকের। এই টুইট নাকি আইনবিরোধী। এফআইআর।
ঠিক এমনটিই প্রশান্ত ভূষণ ও ন্যাশনাল হেরাল্ড পত্রিকার নিউজ এডিটর সাংবাদিক আসলিন ম্যাথিউ-এর ক্ষেত্রে। ম্যাথিউ কান্নানের নির্দেশিকাটিই শেয়ার করেছিলেন।
আর প্রশান্ত? এখানে অবশ্য চিরকালীন রিলিজিয়াস টাচ। তাতেই নাকি সরকারের লেগেছে যথেষ্ট। সরকারি চ্যানেলে মহামারিজনিত নাগরিক ডিপ্রেশন কাটাতে রামায়ণ মহাভারত। অথচ আটকে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকদের উদ্দেশে কোনও প্যাকেজ নেই, ভাবনাচিন্তা নেই। মহামারি রোধে মহাকাব্যিক একঘেয়েমি এবং তাকে নিয়ে আবেগী ছলছলে সরকারি চোখ। এখানেই প্রশ্ন প্রশান্তের। যখন কোটি কোটি মানুষ আকস্মিক লকডাউনে ঘরে ফিরতে না পেরে জর্জরিত, তখন রামায়ণ মহাভারতের আফিম নিয়ে সরকার পড়ে আছে হাস্যকরভাবে। আফিম। অপিয়াম। অভিযোগে বলা হল, ধর্মীয় ভাবাবেগ ক্ষুণ্ণ হতে পারে এই শব্দ নির্বাচনে।
ঠিক কী কী ধারায় এফআইআর? অভিযোগের ভিত্তিতে প্রশান্ত, কান্নান ও ম্যাথিউ-এর বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৪ (একাধিক ব্যাক্তি কর্তৃক অপরাধ সংগঠিত হলে), ২৯৫-এ (ধর্মীয় কারণে কোনও বিশেষ ব্যক্তি বা তাঁর সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত আঘাত হানলে), ৫০৫(১) (মানুষের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করতে পারে এমন খবর বা মতামত ছড়ালে) এবং ১২০-বি (অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র সাধিত হলে)।
রাজকোটে অবসরপ্রাপ্ত সেই সেনা আধিকারিক জয়দেব যোশীর করা এফআইআরে থানার পক্ষ থেকে ইন্সপেকশন এবং পরবর্তী উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের ব্যবস্থা হয়েছে। নিযুক্ত হয়েছে স্পেশাল অপারেশন গ্রুপ। তাও যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। এই মহামারি, এই সঙ্কট সরকারকে এতটা সময় দিচ্ছে কখন, কীভাবে? কান্নানের প্রশ্ন।
কান্নান অবশ্য হাল ছাড়েননি। পুলিশি ব্যবস্থা, সরকারি অঙ্গুলিহেলন তাঁকে হেলাতে পারে না। বলছেন, সরকারি নির্দেশিকা, ব্যবস্থা পছন্দ না হলে বলবেনই তিনি। এবং তাও সর্বসমক্ষে। কারণ কান্নান জানেন, তিনি অসাংবিধানিক কিছু করছেন না। এছাড়াও, প্রশান্ত ভূষণের টুইট রিটুইট করার জন্যেও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা আছে। কান্নানের বক্তব্য, তিনি কোনও রিটুইট করেননি। আর যদি করেও থাকেন, রিটুইট অন্যায় নয়।
আপাতত যুদ্ধের চেহারা, পরিস্থিতি এমনই। মহামারি কিন্তু রাষ্ট্রকে সব ভুলে সঙ্কট মোকাবিলায় ব্যস্ত রাখে না। রাষ্ট্র ভেতরে ভেতরে রাষ্ট্রই থাকে। বৃহত্তর সঙ্কট একটা মুখোশ তৈরি করে মাত্র। মুখ বদলায় না …