অভিষেক ঝা
লেখক গদ্যকার ও অনুবাদক, পেশায় শিক্ষক
নিও-লিবারেলিজমের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপনটি হল গোষ্ঠীর চেয়ে ব্যক্তিকে বেশি গুরুত্ব আরোপ করা। নিও-লিবারেল সমাজ আপাতভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে মর্যাদা দানের কথা বলতে থাকে বারবার। কমিউনিজমকে একটি ভয়ঙ্কর দমচাপা অবস্থা হিসেবে দেখানোর জন্য তাই নিও-লিবারেলিজমের বহু ব্যবহৃত কিন্তু তারপরেও কার্যকরী অস্ত্রটি হল ব্যক্তি ও ব্যক্তিগতকে চূড়ান্ত মর্যাদা দান করা এবং সেটিকে নিজের ভিত হিসেবে তুলে ধরা। সুস্থির ও আপাত সুখী সময়ে মাল্টিপ্লেক্সে গিয়ে একই পরিবারের তিনজনের রুচি অনুযায়ী তিনটে আলাদা সিনেমা দেখা, ফুড কোর্টে বসে তিনজনের তিনটি আলাদা ঘরানার খাবার খেয়ে বাড়ি ফিরে আসার ভিতর দিয়ে এই ভিত পোক্ত হতে থাকে। ক্রমাগত ইন্ডিভিজুয়ালিজমকে প্রোপাগান্ডা করতে করতে নিও-লিবারেল ব্যবস্থা মনের কোনও কোণে এই বিশ্বাস তৈরি করতে থাকে যে এই ব্যবস্থায় ব্যক্তিকেন্দ্রিকতাকে অবহেলা করা হবে না যা কমিউনিস্ট ব্যবস্থা বরাবর করে এসেছে বলে অভিযোগ। এবং করোনা আসে পৃথিবীতে। নিও-লিবারেল ভারত রাষ্ট্র লকডাউন শুরু করে।
ভারতের বিভিন্ন কোণায় ছড়িয়ে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকরা আটকে পড়েন। কেউ কেউ পাঁচ ছয়শো কিলোমিটার হাঁটা দেন বাড়ি ফেরার জন্য। কেউ কেউ ওই ঝুঁকি নিতে সাহস পান না। তিন সপ্তাহের লকডাউনের শেষের অপেক্ষা করেন। ১৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী জানান যে লকডাউন আরও তিন সপ্তাহ বেড়ে ৩ মে অবধি থাকবে। ১৪ এপ্রিলই মুম্বইয়ের বান্দ্রাতে বিশাল সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিকরা বিক্ষোভ শুরু করেন। পুলিশ লাঠিচার্জ করে। প্রাথমিকভাবে জানা যায় যে ১৫ এপ্রিল থেকে ট্রেন চলার খবর ছড়িয়ে পড়েছিল এবং শ্রমিকরা বাড়ি ফিরতে চেয়ে ট্রেনের দাবি নিয়েই বিক্ষোভ করেছেন। ‘স্বাভাবিক’ভাবেই একদল মধ্যবিত্ত শ্রমিকদের আচরণকে মহামারির সময়ে সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক মনে করেছেন। আরেকদল মধ্যবিত্ত ‘স্বাভাবিক’ভাবেই শ্রমিকদের ক্ষোভকে যুক্তিসঙ্গত মনে করে শ্রমিকদের প্রতি রাষ্ট্র দায়িত্ব পালন করছে না এই অভিযোগে সরব হয়েছেন। ‘স্বাভাবিক’ভাবেই দুইদলের কাছেই শ্রমিকদের গোষ্ঠী পরিচিতিই প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁরা এটা সচেতনভাবে বা অবেচতনে ভুলে গেছেন যে তথাকথিত নিও-লিবারেল ব্যবস্থায় আমাদের শিখিয়ে এসেছে যে ‘শ্রমিক’ যখন কোনও শ্রম-মেশিনারিতে জড়িয়ে থাকেন না, তার ব্যক্তিপরিচয় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই শ্রমিক স্বার্থের মত শব্দ নিও-লিবারেল ব্যবস্থায় অপ্রাসঙ্গিক। নিও-লিবারেল সমাজ কমিউনিস্ট সমাজের মত ব্যক্তির মৌলিক প্রয়োজনের মাপকাঠি ঠিক করার সময় শুধু দৈনিক ‘পুষ্টি’তে জোর দেয় না, তার সঙ্গে ‘পছন্দের খাবার’ ব্যাপারটিও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। ১৪ এপ্রিলের বান্দ্রার ঘটনা নিয়ে ‘ইন্ডিয়া টুডে’তে দিব্যেশ সিং-এর একটি রিপোর্ট[1] জানাচ্ছে যে ১৫ এপ্রিল থেকে ট্রেনে চালাতে হবে এটিই একমাত্র এবং মুখ্য দাবি শ্রমিকদের ছিল না। তাঁদের প্রাপ্ত খাদ্যের পরিমাণ, খাদ্যের গুণমান নিয়েও তাঁদের অভিযোগ ছিল না। তাঁদের অভিযোগ ছিল এই যে সরকার থেকে বা বিবিধ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা থেকে তাঁদের জন্য রোজ যে খাবার আসছে তা তাঁদের পছন্দের খাবার নয়। বান্দ্রার ওই অংশে যাঁরা খাদ্য সরবরাহ করছেন, তাঁরা প্রত্যেকদিন হয় ভেজ পোলাও কিংবা খিচুড়ি পরিবেশন করছেন কারণ পুরো মুম্বই জুড়ে সমস্ত আটকে পড়া শ্রমিকদের জন্য এই দুটি খাদ্যই তৈরি করা হয়। বান্দ্রার ওই অংশের শ্রমিকদের বেশিরভাগ বিহার এবং উত্তর প্রদেশের বাসিন্দা। তাদের দাবি চাপাটি বা রুটি। কিন্তু চাপাটি বা রুটি ব্যাপক হারে তৈরি করা অপেক্ষাকৃত কঠিন। অতিমারির সময়ে একজন ব্যক্তি তাঁর পছন্দের সমস্ত কিছু পাবেন না, এটি ধরেই নেওয়া হয়। কিন্তু পছন্দের সমস্ত কিছু বলতে নিশ্চয় দিনের মূল খাদ্যকে বোঝানো হয় না। এই সমস্ত শ্রমিক নিও-লিবারেল সমাজের প্রত্যেকটি ইট গাঁথতে ভূমিকা নিয়েছেন। সেই নিও-লিবারেল সমাজ যা তাত্ত্বিকভাবে ব্যক্তিকে গোষ্ঠীর চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলে।
নিও-লিবারেল ব্যবস্থা কমিউনিজমকে নিয়ে ভয় দেখাতে গিয়ে বারবার বলে এসেছে যে কমিউনিজম এতটাই ‘প্রয়োজন’কেন্দ্রিক ব্যবস্থা যে তা মানুষের ব্যক্তিগত পরিসর কতটুকু হবে তাও ঠিক করে দেয়। ফলে ব্যক্তির যাপন এতটাই নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে যে ব্যক্তি কেবল টিকে থাকে, মন খুলে বাঁচতে পারে না। ঘটনাক্রমে ১৪ এপ্রিল ইতালীয় দার্শনিক আগাম্বেন নিজের ব্লগে করোনা অতিমারির পৃথিবী নিয়ে ‘একটি প্রশ্ন’ শিরোনামের একটি ছোট লেখা আপলোড করেছেন[2]। বেশ কিছু প্রশ্ন অগাম্বেন রেখেছেন নিও-লিবারেল রাষ্ট্রব্যবস্থার কাছে। তার মধ্যে একটি প্রশ্ন হল এই যে করোনা অতিমারিতে ‘ঝুঁকি’কে কিছুতেই নির্দিষ্ট করা যাচ্ছে না, বা রাষ্ট্র ‘ঝুঁকি’ নির্দিষ্ট করতে যথেষ্ট ব্যবস্থা নিচ্ছে না। শুধুমাত্র সেই ‘ঝুঁকি’র উপর ভিত্তি করে একজন ব্যক্তির স্বাধীন চলাচলই শুধু কেড়ে নেওয়া হচ্ছে না, সেই ব্যক্তির কাছ থেকে কাড়া হচ্ছে জীবনের সান্নিধ্য, তার বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ, তার পারিবারিক উষ্ণতা। একজন ব্যক্তি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ কিনা তা নির্দিষ্ট না করে, সেটি নির্দিষ্ট করার জন্য পরিকাঠামো না গ্রহণ করে সমস্ত ব্যক্তিকে পর্যবাসিত করা হচ্ছে শুধুমাত্র একটি ‘জৈব অস্তিত্বে’। এই অস্তিত্বের কাছে জীবন মানে শুধুই টিকে থাকা, বাঁচা নয়। নিও-লিবারেল রাষ্ট্র বেঁচে থাকাকে শুধুমাত্র ‘জৈব’ অস্তিত্বে টিকে থাকায় নামিয়ে আনছে। এই সেই অভিযোগ যা নিও-লিবারেলরা কমিউনিজমের বিরুদ্ধে বারবার এনেছেন।
বান্দ্রার ঘটনার তদন্তে থাকা এক অফিসার জানাচ্ছেন যে বাড়ির লোকের সঙ্গে গোটা দিনে অনেকটা সময় কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন শ্রমিকরা যা তারা লকডাউনের আগের দিনগুলোয় পেতেন না। সেই অফিসার মনে করছেন যে বাড়ির লোকের সঙ্গে এত কথা বলা বাড়ি ফেরার ইচ্ছাকে শুধু চাগাড় দেবে তাই নয়, তাদের ভিতর ব্যক্তিগত অসন্তোষ বাড়াবে। এই ব্যক্তিগত অসন্তোষের পরিসর বাড়লে তারা একত্রিত হয়ে বারবার ঝামেলা করবেন ব্যক্তিগত পরিসরের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য[3]। নিও-লিবারেল রাষ্ট্রব্যবস্থার অংশ হিসেবে এই অফিসারের কথায় স্পষ্ট প্রতিফলন রয়েছে যে শ্রমিক ‘ব্যক্তি’ নয়। শ্রমিকের ‘ব্যক্তিগত পরিসর’ থাকলে তিনি নিও-লিবারেল ব্যবস্থার পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারেন। শ্রমিক নিজের শুধুই ‘শ্রমিক’ অস্তিত্ব মেনে নিয়ে নির্দিষ্ট পুষ্টি নিয়ে খুশি থাকবে। সাম্প্রতিক কালে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টও শ্রমিকদের শুধুমাত্র রেশন নিয়েই মাথা ঘামিয়েছেন, আর কিছু নিয়ে নয়। তাই এই নিও-লিবারেল ভারত শ্রমিকের ব্যক্তি হিসেবে পছন্দের খাবার দাবি করা, ব্যক্তিগত পরিসরের মানুষদের সঙ্গে ফোনালাপও তাঁকে সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করবে।
[1] “Bandra Migrant Crisis: Crowd gathered from nearby slums, unhappy over meals provided”, ১৬/০৪/২০২০
[2] ‘Quodlibet’ ব্লগে, মূল ইতালীয় শিরোনাম: ‘Una domanda’
[3] “Bandra Migrant Crisis: Crowd gathered from nearby slums, unhappy over meals provided”