ওডিশা দেখাচ্ছে, সঠিক দিশানির্দেশ ও সদিচ্ছায় এড়ানো যায় জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়

আত্রেয়ী কর

 



লেখক জনসংযোগ ও সমাজকর্মী

 

 

 

সাম্প্রতিক করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে ওডিশা সরকারের সাফল্য ইতিমধ্যেই খবরের কাগজের শিরোনামে। সেখানে কীভাবে সংক্রমণকে রোখা গিয়েছে, লকডাউনের প্রভাব থেকে প্রান্তবর্তী মানুষগুলিকে কীভাবে বাঁচানো গিয়েছে, তা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে বেশ কিছু ইতিবাচক ও সসম্ভ্রম আলোচনাও চোখে পড়েছে। কিন্তু, সেসব আলোচনায় জনস্বাস্থ্য-বিষয়ক প্রস্তুতি ও সমাজকল্যাণমূলক নীতির বাস্তবায়নের যে দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষাপট রয়েছে, সেই দিকটি নিয়ে প্রায় কাউকেই আলোকপাত করতে দেখিনি। অথচ, সে রাজ্যের বেশ কয়েকটি পিছিয়ে থাকা জেলায় কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে যেটুকু বুঝেছি, শুনতে খানিক বিস্ময়কর লাগলেও, আসল ঘটনা হল কোভিডের হানাদারির অনেক আগে থেকেই একাধিক সমাজ-উন্নয়নমূলক প্রকল্পের রূপায়ণের মধ্যে দিয়ে জনস্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ঘটনার মোকাবিলা করার কাজ শুরু করেছিল ওডিশা। একাধিক প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলার অভিজ্ঞতা থেকেই সম্ভবত ওডিশার মানুষ ও সরকার আগাম প্রস্তুতির ব্যাপারে অনেকটা এগিয়ে ছিলেন। সেই প্রস্তুতিটাই তাঁদের জিতিয়ে দিয়েছে। মনে রাখতে হবে, যেটাকে সংবাদমাধ্যমে ‘কেরল মডেল’ বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে, সেটাও কিন্তু কার্যত এক দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতিরই ফল।

কিন্তু, কেরলের প্রসঙ্গ আপাতত থাক। ফেরা যাক ওড্রদেশের দুই পশ্চাদ্‌বর্তী জেলা সুন্দরগড় ও বোলাঙ্গিরের প্রত্যন্ত গ্রামে। দেশের অন্যান্য পিছিয়ে থাকা জেলাগুলোর মতোই এখানেও অধিকাংশ মানুষ লোক দিনমজুরি করে খান। গ্রামের মানুষ মূলত চাষবাস, দিনমজুরি, এমজিএনআরইজিএ-র কাজ ছাড়া কার্যত আর কিছুই তেমন করেন না। বড়জোর গ্রামে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র থাকলে আশা দিদির কাজ, আর ইস্কুল থাকলে শিক্ষকতা। মাঝে মাঝে বাইরে থেকে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দিদি-দাদারা আসেন, তাতে সরকারি কিছু যোজনা সম্পর্কে  হদিশ পাওয়া যায়। সেইরকমই কয়েকটি গ্রামে কয়েকবছর আগে ওডিশা লাইভ্‌লিহুড মিশনের নির্দেশে এবং ট্রিক্‌ল আপ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহযোগিতায় অতি গরিব মহিলাদের নিয়ে কিছু স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। গোড়াতেই ঠিক করে নেওয়া হয়, ১০-১২ জনের এই দলগুলি সপ্তাহে একবার করে বৈঠকে বসবে, এবং প্রত্যেক সপ্তাহে ১০ টাকা করে জমাবেন। শুনতে মোটে ১০ টাকা হলেও, দিন-আনি-দিন-খাই এই পরিবারগুলির পক্ষে সপ্তাহে ১০টি টাকা সরিয়ে রাখা যে খুবই কষ্টকর ব্যাপার ছিল তা বলা বাহুল্য।

এইভাবে সমাজের একেবারে প্রান্তবর্তী মানুষগুলিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে টাকা জমানো শুরু করার পর, শুরু হল আরও একটি অত্যন্ত জরুরি কাজ— প্রত্যেক মহিলা ও তাঁর পরিবারকে একে-একে কল্যাণমূলক সরকারি  যোজনাগুলির সঙ্গে যুক্ত করা। সে কাজও শেষ হওয়ার পরে, শুরু হল মহিলাদের সঙ্গে তাঁদের জীবিকা-অর্জনের উপায়গুলি নিয়ে আলোচনা করে, তাঁদের পক্ষে উপযোগী জীবিকাগুলি বেছে নিয়ে পায়ে-পায়ে যাত্রা শুরুর কাজ। খেয়াল করে দেখবেন, এর মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে কোথাও কোভিড-এর বিরুদ্ধে প্রস্তুতি নেওয়ার ব্যাপার ছিল না— থাকার প্রশ্নও ছিল না। কিন্তু, আচমকা ধেয়ে আসা কোনও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজে সমাজের প্রতিটি প্রান্তবাসী পরিবারকে সামান্য হলেও অংশীদার করে নেওয়ার একটা সুস্পষ্ট দিশানির্দেশ ছিল। তখন কে ভেবেছিল, এটাই ওডিশার আদিবাসী ও উপজাতিভুক্ত হতদরিদ্র মানুষগুলিকে এভাবে বাঁচিয়ে দেবে!

কিন্তু, সে অনেক পরের কথা। বরং, আবার ফিরে যাওয়া যাক প্রস্তুতির সেই দিনগুলিতে। যে কথা বলছিলাম, স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি কয়েকবছরের মধ্যেই অল্প-অল্প করে বেশ কয়েক হাজার টাকা জমিয়ে ফেলেছিলেন। পরিবারের কেউ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে, বা চাষের মরশুমের শুরুতে বীজ রোপণের পয়সা না-থাকলে অল্প সুদে গোষ্ঠী থেকে টাকা ধার নিচ্ছিলেন, প্রয়োজন মিটে গেলে সময়মতো ফিরিয়েও দিচ্ছিলেন। কেউ ঘরের পিছনের একফালি জমিটুকুতে সামান্য শাকসবজি চাষ করে পরিবারের খাওয়াদাওয়ার অসুবিধেটুকু ঘুচিয়ে ফেলছিলেন, কেউ ছোট্ট একটা মুদির দোকান খুলবেন বলে ভাবছিলেন, কেউ বা বাজারে নিজের ক্ষেতের ফলন বিক্রি করছিলেন, আবার কেউ বা রাস্তার ধারে খাবারের দোকান দিচ্ছিলেন আয় বাড়াতে। আপাতদৃষ্টিতে হয়তো খুবই সামান্য উদ্যোগ— হয়তো বা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্যও— কিন্তু এভাবেই, খুব নীরবে, প্রায় চোখে পড়ে না অথচ নিশ্চিতভাবে অতি গরিব জীবনযাত্রা থেকে বেরিয়ে আসার একটা অক্লান্ত প্রচেষ্টা চলছিল। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, এই চেষ্টাটা চলছিল একেবারে নিরবচ্ছিন্নভাবে, যাকে আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলা যেতে পারে একটা ‘লো কি ইয়েট সাসটেনেব্‌ল’ অভিযাত্রা।

ভাবছেন, এখনও তো লেখার কোথাও কোভিডের কোনও নামগন্ধ নেই! একটু সবুর করুন। কোভিডের যাত্রা শুরু বিদেশে, তারপর বিমানবন্দরের হাত ধরে শহরে-শহরে, তারপর শহরতলি, শহরের কাছাকাছি গ্রামগুলি পার হয়ে এই প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছতে তার একটু সময় লাগবে বইকি!

শেষমেশ পৌঁছল কোভিড, মহা আড়ম্বরে, এবং তার প্রায় হাত ধরেই এল লকডাউন। বন্ধ হল স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির সাপ্তাহিক বৈঠক, সাপ্তাহিক টাকা সঞ্চয়, দোকান, বাজার, দিনমজুরির কাজ। এমনকী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দিদি-দাদারা কবে আসতে পারবেন, তা নিয়েও তৈরি হল সংশয়। তবে স্থানীয় স্তরে স্বেচ্ছাসেবী ও সমাজকর্মীদের মধ্যে সেই সংশয় আসতে দেখিনি। শারীরিক দূরত্ব এবং লকডাউনের সমস্ত নিয়ম মেনে, মুখে মাস্ক পরে, তাঁরা সাইকেল অথবা বাইকে করে ঠিক পৌঁছে গেছেন গ্রামে গ্রামে।

এখানে একটু খেয়াল করবেন, ‘সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং’ বা ‘সামাজিক দূরত্ব’ শব্দবন্ধটিকে সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছি আমি। কেন, তা নিয়ে আলোচনার পরিসর এটা নয়, কিন্তু হু ও অন্যান্য সংস্থা শুরুতে এই শব্দবন্ধটি ব্যবহার করতে শুরু করলেও পরে দ্রুত মেনে নিয়েছে যে, এটি বিভ্রান্তিকর ও ফলত পরিহার্য। হু তো গত ২০ মার্চ রীতিমত প্রেস কনফারেন্স করে সব দেশকে জানিয়েছে, কেন এটি গ্রহণযোগ্য নয়, এবং কেন এটির পরিবর্তে ‘ফিজিক্যাল ডিসট্যান্সিং’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করাই বিধেয়। অথচ আশ্চর্য, এখনও আমাদের দেশে সেই ‘সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং’ শব্দবন্ধটিই যথেচ্ছ ব্যবহৃত হয়ে চলেছে!

কিন্তু, সে তর্ক থাক। যে কথা বলছিয়াম, স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী ও সমাজকর্মীরা লকডাউন ও ডিস্ট্যান্সিং-এর  যাবতীয় প্রোটকল মেনে যখনই গ্রামে গিয়েছেন, সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছেন ওডিশা সরকারের এই বার্তা যে, এই তিনমাস (জুন অবধি) কাউকে খালি পেটে থাকতে হবে না, সে দায়িত্ব সম্পূর্ণতই সরকারের। গরিব এবং অতি গরিব পরিবারগুলি তিনমাসের রেশন ও গ্যাস পাবেন বিনামূল্যে, তিনমাসের জন্য প্রতি মাসে প্রতিটি পরিবার পাবেন ৫০০ টাকা করে, এবং লেবর কার্ড বাবদ পাবেন মাথাপিছু ১৫০০ টাকা। যাঁরা বিধবা ভাতা পান, তাঁরা পাবেন মাথাপিছু ২০০০ টাকা।

সরকারি নীতি হিসেবে এই ঘোষণাগুলো তেমন যুগান্তকারী না-শোনালেও, একেবারে তৃণমূল স্তরে এর মানে দাঁড়াল এই যে, কারুয়াবহলের যশোবন্তী দিদির জীবন থমকে থাকবে না এই তিন মাস, তাঁর চারটে ছেলেমেয়ে পেট ভরে খেতে পাবে অন্তত। উনি বিধবা, বাড়ির সমস্ত দায়িত্ব তাঁর একার কাঁধে। দিনমজুরির কাজ, চাষবাসের কাজ সমস্ত বন্ধ হওয়ায়, সরকার তাঁদের খেয়েপরে বেঁচে থাকার ভার কাঁধে তুলে নিয়েছেন। দিদি তাতেই খুশি। “ছেলেমেয়েগুলো খেতে পেলেই হবে। বাড়ি থেকে বেরোব না আমি, সব নিয়ম মেনে চলব। শুধু আমার বাচ্চাগুলো সুস্থ থাকুক। তা ছাড়া আমি বাড়ি থেকে বেরোলে শুধু যে আমারই বিপদ তা তো নয়, বিপদ তো বাচ্চাগুলোরও। এ কথা তো মাথায় রাখতেই হবে।” গ্রামের যে সমস্ত মানুষকে শহরে কাজ করতে যেতেই হচ্ছে অত্যাবশ্যক পরিষেবা চালু রাখতে, শারীরিক দূরত্ব মেনে চলা তাঁদের পক্ষে সবসময় খুব সুবিধেজনক না-হলেও, ওঁরা খুব চেষ্টা করছেন সবাই মিলে।

এরই মধ্যে একদিন খবর আসে, সুন্দরগড়ে কিছু পরিবারের কাছে রেশন কার্ড না-থাকায়, প্রায় ৬৫ জন গ্রামবাসী রেশন পাচ্ছেন না। এতদিন কোনওক্রমে চলে গেলেও, এই দুঃসময়ে তাঁদের অবস্থা খুবই খারাপ। উপরন্তু, সরকারি নির্দেশে তাঁদের যে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে ৫ কেজি বেশি চাল, ১ কেজি ডাল ও তিনমাসের রেশন আগাম পাওয়ার কথা, তা-ও তাঁরা পাচ্ছেন না। এ বিষয়ে জেলা স্তরের প্রশাসনের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করলে, মাত্র চারদিনের মধ্যে তাঁদের রেশন কার্ড ও রেশনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। সহযোগিতা করেন ওডিশার বিশেষ ত্রাণ আধিকারিক এবং ফুড ওডিশার কার্যকর্তারা। আবারও মনে করিয়ে দিই, যে দেশে সরকারি ফাইল নড়তে শতাব্দী পেরিয়ে যায়, সেখানে চারদিনের মধ্যে এমন ঘটনা যুগান্তকারী বইকি। সর্বোচ্চ পর্যায়ের অগ্রাধিকার এবং সদিচ্ছা ছাড়া এ ঘটনা ঘটতে পারত না।

শুধু যে সরকার বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলিই সেই সদিচ্ছা দেখিয়েছেন, তা কিন্তু নয়। গ্রামের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারাও বিপদের দিনে পাশে দাঁড়িয়েছেন গ্রামের মানুষের। যেদিনই জানা গিয়েছে যে, মাস্ক ছাড়া বাইরে যাওয়া বিপজ্জনক, সেদিন থেকেই তাঁরা বুঝেছেন, গ্রামের লোকের পক্ষে মাস্ক কিনে নিয়মিত ব্যবহার করা কঠিন। একে দাম বেশি, তায় আবার কালোবাজারির বিপদ। তা হলে উপায়? বোলাঙ্গিরে বারবাঁধ গ্রাম এবং সুন্দরগড়ে পি-কারুয়াবহল পঞ্চায়েতের দিদিরা সেদিনই ঠিক করেন, দায়িত্বটা তাঁরাই নেবেন। গোষ্ঠীর তহবিল থেকে যথাক্রমে চার হাজার ও ছ হাজার টাকা ধার নিয়ে, কাপড়ের মাস্ক বানিয়ে তাঁরা গ্রামবাসীদের সেগুলি ২০ টাকা দামে বিক্রির কাজ শুরু করে দেন।

বারবারই আমরা দেখেছি, দুর্যোগ মোকাবিলায় সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার কাজটা কতটা জরুরি। বলা বাহুল্য, নেতার দিকে নজর থাকে সবার। তাঁর মাথা ঠান্ডা থাকলে, তিনি সঠিক দিশা দেখাতে পারলে, এবং সঠিক পথে সকলকে নিয়ে চলার বিশ্বাসযোগ্যতা দেখাতে পারলে অনেক বড় বিপদ কাটিয়ে ওঠা যায় খুব সহজেই। মনে আরখতে হবে, কোভিড-১৯ এর একটিও পজিটিভ কেস ধরা পড়ার আগেই, সর্বপ্রথম ওডিশা সরকারই এর মোকাবিলায় ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করে। টাকাটা যথেষ্ট কি না, আরও বেশি হলে আরও ভাল হত কি না, সে তর্কে যাচ্ছি না। কিন্তু সেই ঘোষণা একটা সুনির্দিষ্ট বার্তা রাজ্যবাসীর কাছে সুস্পষ্টভাবে পৌঁছে দিতে পেরেছিল। যে বার্তার মর্মার্থ, ‘আমরা তৈরি’।

এমন ইতিবাচক একটা বার্তা পেলে সাধারণ মানুষ কতটা ভরসা পান, কতদূর নিরাপদ ও উজ্জীবিত বোধ করেন, ওডিশার প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে কাজ করতে গিয়ে আমরা বারবার তার প্রমাণ পাচ্ছি।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

2 Trackbacks / Pingbacks

  1. Leadership at All Levels - Trickle Up
  2. Leadership at All Levels | Trickle Up

আপনার মতামত...