অবিন সেন
পূর্ব প্রকাশিতের পর
পর্ব – দুই
চার
নান্টু তার সিডি ডিভিডির গুমটিতে বসেছিল। সিভিল ড্রেসে সেটার সামনে তন্ময় সামন্ত এসে দাঁড়াল। তখন বেলা প্রায় বারোটা। সঙ্গে প্রবাল আর একজন কনস্টেবল। সামন্তকে দেখে তার মুখে মালিন্যহীন এক হাসি খেলে গেল। বলল,
স্যার, আমাকে ডেকে পাঠাতে পারতেন।
তোমাদের ডিরেক্টর দিগন্ত দাশগুপ্তর সঙ্গে একবার দেখা করব। দেখা পাওয়া যাবে?
শনিবার উনি একটু বেলার দিকে আসেন। আর একটু পরে গেলে পাবেন। আজকাল উনি কাজ কমিয়ে দিয়েছেন। কাজ করেনই না বললেই চলে।
কেন? বাজার খারাপ?
এমনিতে নতুন ডিরেক্টর। বছর দেড়েক মাত্র কাজ করছেন। ফলে হাতে কাজ বেশি নেই। কাজে বোধহয় মনও নেই। শুনেছি অন্য কী একটা ব্যবসা করছেন।
সবার সঙ্গে দেখাটেখা করেন?
প্রশ্নটা করল প্রবাল।
নান্টু একবার সামন্তর দিকে তাকিয়ে ফের বলল,
ওঁর মত লোক এই লাইনে বেমানান। এত শান্ত ভদ্র লোক বলেই আজকাল আরও কাজ করতে পারছেন না।
নান্টু চা আনাল। বেশ সুন্দর চা। প্রবাল তারিফ করল।
নান্টু খুব খুশি হয় তাতে।
প্রবাল হ্যামিলটনের কথা জানতে চাইল।
নান্টু বলল,
হ্যামিলটন এই চত্বরে বেশিদিন আসেনি। তার ডিটেল এখনও আমাদের কাছে অজানা। লোকটা অদ্ভুত। টুকটাক দালালি করে। মেয়ের দালালি। আমাকে স্যার আর কয়েকদিন সময় দিন। আমি ওর ঠিকুজিকুষ্ঠি বার করছি।
সে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল। সিগনালে দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাড়ি দেখিয়ে বলল,
স্যার, ওই দিগন্তবাবুর গাড়ি।
আঙুল দিয়ে সে একটা গ্রে-কালারের ইনোভা দেখায়।
প্রবাল গাড়িটার দিকে তাকায়।
সামন্তকে ইশারা করে। তারা সেখান থেকে বেরিয়ে তাদের গাড়িতে উঠে পড়ে।
দিগন্ত দাশগুপ্ত ছোটখাটো ডিরেক্টর। একটা ছোট অফিস। স্টুডিওপাড়ার কাছে একটা তিনতলা বাড়ির একতলায়।
ছিমছাম সাজানো ঘর।
দিগন্ত দাশগুপ্ত বেশ লম্বা। হ্যান্ডসাম চেহারা। চাইলে সে নিজেই হয়ত সিনেমার নায়ক হতে পারত। কিন্তু তার কাছ থেকেও হ্যামিলটনের বিষয়ে তেমন কিছু পাওয়া গেল না। দিগন্ত বলল হ্যামিলটনকে সে চেনে, মানে তার এখানে মাঝে মাঝে দু একজনকে অভিনয়ে সুযোগ পাইয়ে দেওয়ার সুপারিশ করতে আসে। কিন্তু যেহেতু সে এখন তেমন কাজ করছে না, তাই কোনও কাজ সে হ্যামিলটনকে দিতে পারেনি।
প্রবাল চুপ করে বসে তার কথা শুনছিল। কী সুন্দর গুছিয়ে কথা বলে সে। তেমনি তার সুন্দর কথা বলার ভঙ্গি।
তার টেবিলে এক ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ের বাঁধানো ছবি দেখল প্রবাল। এমনি একটা মুখ যেন সে আগে কোথাও দেখেছে। দেখেছে?
প্রবালের প্রশ্নের উত্তরে দিগন্ত বলে তার একমাত্র বোনের ছবি।
তখন তার গলাটা বিষাদে ভরে ওঠে।
কিন্তু দিগন্ত আর কিছু বলে না। সে যেন এই প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যেতে চায়।
প্রবাল জানতে চেয়েছিল, বিশাখা দত্তর সঙ্গে সে কাজ করেছে কি না?
দিগন্ত বলেছিল বিশাখাকে সে চিনত। আলাপ ছিল তার সঙ্গে। কিন্তু এক সঙ্গে কাজ করেনি কখনও।
দিগন্তর টেবিলে একটা খবরের কাগজ পড়েছিল। সেটার দিকে একদৃষ্টিতে কী যেন দেখছে প্রবাল।
আরও কিছু সাধারণ কথা বলে তারা বেরিয়ে এসেছিল সেখান থেকে।
প্রবাল বেরিয়ে এসে রাস্তার ধারে পার্ক করে রাখা দিগন্তর ইনোভাটা একবার দেখল। কী অবহেলা, অযত্নের গাড়ি। সারা গাড়িতে কাদা, কাদা জলের ছিটে। মনে হয় গাড়িটা সে নিজেই চালায়। পোষা, মাইনে করা ড্রাইভার থাকলে এমন দশা হত না বোধহয়।
প্রবাল বলল,
কী সামন্তবাবু, কী বুঝছেন?
সবসময় আমরা একটা ডেড এন্ডের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ছি। রুবিরও কোনও হদিশ আমরা করতে পারছি না। স্যার এর কোথায় শেষ?
গাড়িতে উঠতে উঠতে প্রবাল মৃদু হাসল। বলল,
এত অধৈর্য হয়ে পড়লে হবে?
না হয়ে কোনও উপায় নেই স্যার। আজকের পেপারে তো দেখেছেন। ফ্রন্ট পেজে হেডলাইন “কলকাতায় সিরিয়াল কিলার”। এর পরে আর অধৈর্য না হয়ে উপায় আছে!
***
সেখান থেকে বেরিয়ে প্রবাল সোজা অফিসে চলে গিয়েছে। কিন্তু কোনও কাজেই সে মন বসাতে পারছিল না। কী যেন একটা কাঁটা তার মনের ভিতরে বিঁধে আছে। সেই কাঁটাটা অনবরত তাকে খোঁচা দিয়ে চলেছে। সে যেন স্থির হয়ে কোথাও বসতে পারছে না। কোথাও মন বসাতে পারছে না। অফিসেও সে কাজ করতে পারছিল না। অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা সে ময়দানে চলে আসে। নরম বিকেলে সবুজ ঘাসের উপর সে অনেকক্ষণ পায়চারি করে। পায়চারি করতে করতে বিকেলের আলো নিভে আসা দেখে সে। দেখে দূরে গাছের মাথা থেকে আলো ক্রমশ মিলিয়ে যেতে যেতে অন্ধকারের বুকে ভুবে যাচ্ছে।
প্রবাল ঘাসের উপর বসে পড়ে এবার। দুর থেকে ঘনয়ামান অন্ধকার যেন ক্রমশ যেন তার দিকে এগিয়ে আসছে। সেই অন্ধকার এখুনি এগিয়ে এসে তাকে গিলে নেবে এই অকস্মাৎ অনুভূতিতেই সে যেন আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকায়। আকাশে কি তখন আবার মেঘ জমতে শুরু করেছে? সে যেন ঠিক বুঝতে পারে না। তখনি আকাশের বুক চিরে এক বিজলির রেখা, এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ঝলসে ওঠে। প্রবাল অবাক বিস্ময়ে সেই দিকে তাকিয়ে থাকে। তখনি কি তার মাথার ভিতরে এক বিদ্যুৎ চমকিত হয়ে যায়? সে সারা শরীরে তড়িদাহত হওয়ার মতো চমকে ওঠে। সে অনুভব করে এক অলৌকিক বিদ্যুতের রেখা তাকে সহসা এক আশ্চর্য সত্যের সন্ধান দেয়।
সে তার ফোনে বিশাখার বাড়ি থেকে পাওয়া ছোট অ্যালবামের কয়েকটি ছবি মোবাইলে স্ক্যান করে রেখেছিল। সেই ছবিগুলো সে আবার মোবাইলটা বার করে দেখতে থাকে। সেইসব ছবি দেখার যেন তার ভীষণ ত্বরা। সে দ্রুত হাতে একটার পরে একটা ছবি স্ক্রল করে চলেছিল। ময়দানে সেই সময় দারুণ হাওয়া তবু তার সারা শরীর ঘেমে নেয়ে একেবারে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। তার যেন কেমন পাগল পাগল লগছিল নিজেকে। মনে হচ্ছিল এখুনি যেন তার মাথার ভিতরে বিস্ফোরণ হয়ে যাবে। কিন্তু সে যা চাইছে তা সে যেন পাচ্ছে না। অথচ জিনিসটা সে কোথাও দেখেছে।
জিনিসটা সে কিছুতেই খুঁজে পায় না। খুঁজে না পেয়ে কেমন এক বেহেড মাতালের মতো টলতে টলতে সে উঠে দাঁড়ায়। উঠে দাঁড়াতেই হয় তাকে। কারণ ময়দানের মঠে তখন ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। সে যেন চিন্তাভাবনাশূন্য সম্পূর্ণ নেশাগ্রস্তের মতো হাঁটতে থাকে। এদিকে বৃষ্টির বেগ বেড়েছে সেদিকে তার কোনও খেয়াল নেই। একটা তুরীয় ভাব যেন তার মাথার ভিতরে খেলা করে ক্রমাগত। সে সেই ব্যোমভোলা মাথায় ভিজতে ভিজতে মেট্রো স্টেশনের দিকে হাঁটতে থাকে। সম্পূর্ণ ভিজে গিয়ে এক ভেজা ভূত হয়ে সে বাড়ি ঢোকে। তনুকা তো তাকে দেখেই রেগে আগুন। কিন্তু প্রবাল তার রাগের থোড়াই তোয়াক্কা করে। সে তেমনি টলতে টলতে চানের ঘরে ঢুকে যায়। তনুকা বাইরে থেকে চিৎকার করে বলল “নেশা টেশা করে এসেছ নাকি?” সে কথাটা যেন সে শুনতেই পায়নি।
বাথরুমে শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে ভিজতে ভিজতে কিছুটা যেন মাথা ঠান্ডা হয় তার। কোমরে তোয়ালে জড়িয়েই সে বুকসেলফে রাখা বিশাখার অ্যালবামটা বার করে দ্রুত পাতা ওলটাতে থাকে। একটা ছবির দিকে না, ঠিক ছবির দিকে নয়, ছবির পিছনে লেখা কয়েকটা শব্দের উপর তার চোখ আটকে যায়। নিজের মনের ভিতরে সে চিৎকার করে বলতে থাকে, “এই তো। এই তো। পেয়েছি। পেয়েছি।” তার শূন্য হয়ে যাওয়া মাথার ভিতরে চিন্তাভাবনারা যেন আবার ফিরে আসতে শুরু করে। তার সারা গা বেয়ে যেন পোকার মতো চিন্তারা তার মাথার করোটির দরজা খুলে মাথার ভিতরে সেঁদিয়ে যেতে থাকে। তনুকা তার কাণ্ডকারখানা দেখে অবাক। সে যেন ঠিক প্রবালকে বুঝে উঠতে পারছে না। তার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি। সে একবার হেঁকে বলল,
কি গো কাপড় জামা পরবে না নাকি?
প্রবাল তার কথা শুনতেই পায় না।
সে মাথার ভিতরে কিলবিল চিন্তার রাশি নিয়ে সেই অক্ষর কয়টির সামনে দাড়িয়ে থাকে।
With love
DD
8/2/8 H.R.
B.B
ছবিটিতে হেসে কুটিকুটি দুটি আবক্ষ মুখ। একটি বিশাখা। আর একটি কে?
প্রবাল নিজের মনের কাছে প্রশ্ন করে।
আর লেখাটাও নিশ্চয়ই তার। সে নিশ্চয়ই ছবিটা দিয়েছিল বিশাখাকে।
ছবিটা কার সেটা এবার তাকে খুঁজে বের করতে হবে। অথচ এমন মুখ যেন সে কোথাও দেখেছে।
তার মাথা কিছুটা শান্ত হয়। কিন্তু চিন্তাভাবনারা চলতে থাকে।
এবার সে তনুকার কথাটা খেয়াল করে।
নিজের দিকে তাকায় সে। তার মাথা থেকে সারা গা থেকে তখনও জল ঝরছে। জল ঝরে পড়ে পায়ের কাছে কার্পেটের কিছুটা ভিজিয়ে দিয়েছে। নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেই যেন সে লজ্জা পায়। সে পিছন ফিরে তনুকার দিকে তাকিয়ে কিছুটা অপ্রতিভ হয়ে যায়।
তনুকা জিজ্ঞাসা করে,
তোমার কী হয়েছে বলো তো?
প্রবাল তনুকার কথাটা যেন কিছুটা এড়িয়ে যায়। বলে,
একটা বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম।
প্রবালের এড়িয়ে যাওয়া দেখে তনুকা আর প্রশ্ন করে না।
তারা দুজনে চুপচাপ বসে কফি খায়। তনুকা বুঝতে পারে প্রবাল আবার গভীর ভাবনার ভিতরে ডুবে গিয়েছে। কফির পেয়ালা শেষ করে তনুকা শূন্য কাপ প্লেটগুলি গুছিয়ে নিয়ে কিচেনে চলে যায়।
প্রবাল তন্ময় সামন্তকে ছবিটা হ্যোয়াটসঅ্যাপ করে পাঠিয়ে দিয়ে ফোন করে। বলে,
সামন্তবাবু বিশাখার সঙ্গের মেয়েটি কে সেটার একটু পাত্তা লাগাতে হবে। আর শুনুন, কাল একবার সময় করে আমার অফিসে চলে আসুন, কেসটা নিয়ে আলোচনা করার আছে।
আরও মামুলি কিছু কথা বলে সে ফোন রেখে দিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসে। সোস্যাল সাইটে বিশাখার প্রোফাইলের ভিতরে সে ঢুকে পড়ে। প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা ছবি, প্রতিটা কমেন্ট সামস্ত কিছু সে খুঁটিয়ে পড়তে থাকে। সেই কমেন্ট কে করেছে? তার প্রোফাইলে কী আছে সব কিছু সে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। পড়তে থাকে।
রাত দশটা নাগাদ একবার সে ডিনার করতে উঠেছিল। তার পরে সারা রাত শুধু সিগারেট পুড়েছে আর প্রবাল ল্যাপটপে বুঁদ হয়ে বসে থেকেছে। আস্তে আস্তে তার চোখের সামনে একটা সিনেমা যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশাখা আর সেই মেয়েটি আর ছবির পিছনে লেখা শব্দগুলোর মানে যেন তার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যখন রাত ভোর হয়ে গিয়েছে তখন, যখন জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে ভোরের নরম আলো ঢুকে পড়েছে ঘরের ভিতরে, তখন প্যাকেটের শেষ সিগারেটটা ধরিয়ে নিয়ে সে শূন্য প্যাকেটটা দূরে রাখা ওয়েস্ট পেপারের বালতিতে তাক করে ছুঁড়ে দিয়ে চেয়ারের পিঠে গা এলিয়ে দেয়। তার চোখে সারা রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি, কিন্তু চোখ দুটো তার এক আশ্চর্য সাফল্যের আলোয় ঝলমল করছিল। প্রবাল উঠে গিয়ে পর্দা সরিয়ে জানালার সামনে দাঁড়ায়। ফর্সা আকাশটার দিকে তাকায়। সিগারেটটা শেষ করে সে শোবার ঘরে গিয়ে দ্যাখে তনুকা তখনও ঘুমে তলিয়ে আছে। তনুকার মুখে ঘুমের পালকের মতো একটা প্রশান্তি। প্রবাল ক-মুহূর্ত সেই মায়াময় মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার বুকের ভিতরে যেন এক আহ্লাদি বেড়াল জেগে ওঠে। সে আলতো করে তনুকার পাশে শুয়ে পড়ে তাকে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে। তনুকা ঘুমের ভিতরেও যেন এমনি এক স্পর্শের অপেক্ষায় ছিল। তনুকার অলস হাত প্রবালকে জড়িয়ে ধরে। বুকে মুখ গুঁজে দেয়। ভোরের আলোয় এমনি অলস ভালোবাসায় ভরে থাকে দুজনে।
মুখোমুখি বাসে সকালের চা খেতে খেতে তনুকা বলল,
এবার গল্পটা বলো আমাকে।
প্রবাল মৃদু হেসে বলল,
একটু ধৈর্য ধরো ম্যাডাম।
তনুকা মুখ ঘুরিয়ে একটু রাগ দেখিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। সে এখন রান্নার মাসির সঙ্গে বকরবকর করবে।
প্রবাল চা শেষ করে বসে বসে আর একটা সিগারেট শেষ করল। খবরের কাগজের পাতা ওলটাতে ওলটাতে দেখল বাংলার বহুল প্রচারিত খবরের কাগজে “সিরিয়াল কিলার” নিয়ে একটা বড় খবর বের হয়েছে। প্রবাল বুঝতে পারছে অর্কর উপরে আবার চাপ বাড়বে। তা বাড়ুক। প্রবাল মনে মনে বলে ‘এবার সে শেষ দান দেবে’। মনে মনে একটা নাম সে উচ্চারণ করে। সে স্নানে ঢুকে পড়ে। একটু পরেই তন্ময় সামন্ত আসবে। তন্ময় সামন্তকে নিয়ে একটু বের হবে সে।
***
তন্ময় সামন্ত এল প্রায় নটা নাগাদ। প্রবালের স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট সারা হয়ে গিয়েছিল। তন্ময় আসতেই তারা বেরিয়ে পড়ল। তন্ময়ও জানে না তারা কোথায় চলেছে। প্রবাল তাকে কিছুই জানায়নি। রিপন স্ট্রিটের গলি তস্য গলি পেরিয়ে একটা জীর্ণ তিনতলা বাড়ির সামনে তারা এসে দাঁড়াল। সামনে একটা ময়লা কাপড়-জামা পরা লোক ফুটপাথের ধারে বসে দাঁত মাজছিল। প্রবালের যেন কেমন মনে হল লোকটি এই বাড়িরই। প্রবাল জিজ্ঞাসা করল,
দাদা এগারো নম্বর ঘরটা কোন তলায় হবে?
লোকটি মুখ তুলে তাকায়। তার দুই ঠোঁটের কস বেয়ে শাদা মাজনের ফেনা ঝরছিল। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে এক মুহূর্ত। তার পরে হাত তুলে দুটো আঙুল দেখায়।
সদর দরজাটা খোলাই ছিল। দরজার পাশেই সিঁড়ি। দরজা দিয়ে ঢুকে তারা দেখল সিঁড়িটা অন্ধকার। ময়লা নোংরা দেওয়ালের থেকে প্লাস্টার খসে গিয়েছে। সিঁড়ির অবস্থাও তথৈবচ। প্লাস্টার খসে গিয়ে ইট বেরিয়ে গিয়েছে। অপরিচিতরা অন্ধকারে হাঁটলে নিশ্চিত হোঁচট খাবে। হুমড়ি খেয়ে পড়বে। সামন্ত পকেট থেকে মোবাইল বের করে মোবাইলের টর্চ জ্বালল। সাবধানে তারা দোতলায় উঠে যায়। সামন্ত একবার বলল,
স্যার, এ কোথায় চলেছি আমরা?
প্রবাল অস্ফূটে কিছু বলল। সামন্তবাবু তা ঠিক শুনতে পায় না।
দোতলায় টানা বারান্দা। বারান্দার দুপাশে সারি দেওয়া ঘর। বারান্দার মাথায় কোনও ছাদ নেই। বারান্দায় অনেক লোকজন। কেউ বালতিতে জল নিয়ে কাপড় কাচছে। কেউ কয়লার উনুনে আঁচ দিয়েছে। দু-একটা ন্যাংটো বাচ্চা খেলা করছে। মোটকথা বারান্দায় সকালের চরম ব্যস্ততা। এগারো নাম্বার ঘরটা খুঁজে বার করতে কষ্ট হল না তাদের। একেবারে সিঁড়ির কাছেই। নীল রঙ করা কাঠের পলকা দরজা। দরজাটা ভেজানো ছিল। প্রবাল একটা লোহার বালা ধরে একবার নাড়া দেয়। ভিতর থেকে বাচ্চার গলার অস্ফুট আওয়াজ আসছিল। কেউ সাড়া দিল না দেখে সে আবার কড়া নাড়ে। এবার দরজা খুলে মুখ বাড়ায় একটি বাচ্চা মুখ।
প্রবাল জিজ্ঞাসা করে,
ডরোথি গোমস আছেন খোকা?
ছেলেটি হাঁ-করে তাকিয়ে থাকে।
প্রবাল কথাটা রিপিট করে।
এবার দরজা খুলে দাঁড়ায় এক মহিলা। মহিলার পরণে শাদা শাড়ি নীল পাড়। বেশ লম্বা। গায়ের রং মাজা বাদামী। মাথার চুল টান টান করে খোঁপা করে বাঁধা। মহিলার গলার স্বর ধরা ধরা। বললেন,
আমি ডরোথি গোমস।
প্রবাল দু হাত তুলে নমস্কার করল। বলল,
আমরা পুলিশ থেকে আসছি। আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল।
প্রবাল ডরোথির চোখে একটা ভয়ের ছায়া দেখতে পায়। সে কী বলবে যেন ভেবে পায় না। দরজা আগলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে যেন নিজের ভিতরে খানিকটা শক্তি সঞ্চয় করে। শেষে যেন খুব কষ্ট করে বলে,
ভিতরে আসুন।
একটাই ঘর। ঘরের একদিকে একটা বিছানা। আর একদিকে রান্নার স্টোভ। বাসনপত্র, নানা দরকারি জিনিসে বোঝাই। মাঝে এক চিলতে জায়গা। সেই তিন হাত বাই তিন হাত চতুষ্কোণ পরিমাণ জায়গায় একটা সতরঞ্চি বিছিয়ে বাচ্চা ছেলেটি পড়তে বসেছিল।
ডরোথি ছেলেটিকে বলল,
টিম যাও তো বুল্টির সঙ্গে খেলা করে এসো তো। আমি এই কাকুদের সঙ্গে কথা বলে নিই।
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি এক ছুটে বেরিয়ে গেল। যাবার আগে দরজাটা আবার ভেজিয়ে দিয়ে গেল।
ঘরে একটা মাত্র জানালা। লম্বা বারান্দার দিকে। সেই লোহার লম্বা লম্বা গরাদ দেওয়া ছোট জানালা দিয়ে একট চিলতে রোদ তেরছাভাবে ঢুকে এসে একটা জলের বালতিতে পড়েছে। ঘরে বসার জন্য চেয়ার নেই কোনও। ডরোথি ইশারায় বসতে বলতে তারা দুজন সেই এক চিলতে বিছানায় বসল। বিছানার চাদরটা ময়লা। দু জনে বসতেই বিছানাটা ক্যাঁচ করে আর্তনাদ করে উঠল। একদিকে একটা নিচু কাঠের টুলের উপর একটা ঝুড়ি রাখা ছিল। সেই ঝুড়িটা মেঝেয় নামিয়ে রেখে, টুলটা টেনে নিয়ে সেটার উপরে বসল ডরোথি। সে যেন এখনও বুঝে উঠতে পারছে না তার বাড়িতে পুলিশ কেন! জ্ঞানত সে তো কোনও অপরাধ বিষয়ের সঙ্গে জড়িত নয়! তবে? সমস্ত মুখে একটা জিজ্ঞাসার ভাব নিয়ে সে প্রবাল আর সামন্তর দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রবাল তার মুখের দিকে তাকিয়ে যেন তার অবস্থাটা বুঝতে পারছে। সে কোনও ভণিতা না করে সরাসরি প্রশ্ন করে,
হ্যামিলটন কে?
আমার হাজবেন্ড।
প্রবাল যেন এমন উত্তর আশা করেনি। সে পুনরায় যেন তার উত্তরের পিঠে পিঠে বলে,
আপনার হাজবেন্ড!
ডরোথি সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়,
হ্যাঁ। ছিলেন।
প্রবাল আরও অবাক হয়ে যায়।
ছিলেন?
হ্যাঁ। ছিলেন। এক-বছর আগে মারা গেছেন। একটা অ্যাক্সিডেন্টে।
কথাটা শুনে প্রবাল আর তন্ময় সামন্ত দু-জনেই অবাক হয়ে যায়। এমনটা তো তারা আশা করেনি। তা হলে টালিগঞ্জ পাড়ায় যে হ্যামিলটনকে দেখা যাচ্ছে সে কে?
প্রবাল যেন আমতা আমতা করে যেন সেই প্রশ্নটাই করে।
তা হলে টালিগঞ্জের স্টুডিওপাড়ায় যে হ্যামিলটনকে দেখা যায় সে কে?
ডরোথি মুখ তুলে তাকায়। সে যেন অবাক হয়। এই প্রশ্নের উত্তর কি তার জানার কথা? তবু সে বিস্ময়-বিপন্ন হয়ে বলে,
আমি স্যার কী করে তা জানব?
বিভিন্ন সোর্সদের কাছ থেকে হ্যামিলটনের যে ছবিটা পাওয়া গিয়েছিল সেটা সে ডরোথিকে দেখায়।
ডরোথি অনেকক্ষণ ধরে ছবিটা দেখে। তারপরে সেটা ফেরত দিতে দিতে বলে,
না। এ আমার হাজবেন্ড না। তবে অনেকটা এমনই দেখতে ছিল। কিন্তু এই ছবিটা যেন আমার চেনা চেনা লাগছে।
একটু থেমে সে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করে,
কোথায় দেখেছি?
প্রবাল একটু ঝুঁকে একটু উত্তেজিত হয়ে বলে,
হ্যাঁ হ্যাঁ একটু ভাবুন। ভেবে বলুন কোথায় দেখেছেন এই মুখ।
ডরোথি যেন গুম হয়ে বসে একটু ভাবল। ঘাড় নাড়ল নিজের মনে। তার পরে বলল,
ঠিক মনে পড়ছে না স্যার। মনে হচ্ছে কোনও ছবিতে দেখেছি। স্যারের ওখানে। পরে যদি ভালো করে মনে পড়ে তবে আপনাদের জানাব।
সে থামতে প্রবাল আবার প্রশ্ন করে,
আপনি তো ডিরেকটর দিগন্ত দাশগুপ্তর ওখানে কাজ করেন?
হ্যাঁ।
ছোট্ট উত্তর দেয় ডরোথি।
আপনাকে কী কাজ করতে হয়?
আমি ওঁর সেক্রেটারির কাজ করি। চিঠিপত্র লেখা। ফাইল গোছানো। বছর খানেক কি তার একটু বেশি শুটিং-এর ডেট টেট-এর ব্যাপারগুলো দেখি। সেই সঙ্গে ওঁর বাড়ির হাউসকিপিং-এর কাজও করি।
বছর খানেক বলছেন আপনি শুটিং-এর কাজ দেখেন। আগে কে দেখত?
প্রথম থেকেই আমি দেখি। ওঁর ফিল্ম ডিরেকশানের কোর্স করা ছিল। কিন্তু অন্য ব্যবসা করতেন। হয়ত তিতলির মৃত্যুর জন্য উনি সিনেমার লাইন থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন।
তিতলি কে?
স্যারের এক মাত্র বোন। তিতলির খুব অভিনয় করার শখ ছিল। কিন্তু দালালদের অন্ধকার চক্করে পড়ে ওর সঙ্গে খুব বাজে ব্যাপার ঘটে যায়। সিনেমা লাইনে যেমন শোনা যায় আর কী! কিন্তু তিতলি খুব সফট মেয়ে ছিল। সে এই ব্যাপারটা ভালো করে মেনে নিতে পারেনি। একদিন গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করল সে। বছর দুই আগে।
তার গলার স্বর মেদুর হয়ে আসে। একটু থেমে গলাটা পরিস্কার করে নিয়ে বলে,
এই আঘাতে স্যার পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। ব্যবসাপত্র কিচ্ছু দেখতেন না। স্যারের এখনকার বাড়িতে তিতলির জন্য আলাদা একটা ঘর রাখা ছিল। স্যার সারাদিন সেই ঘরে বসে থাকতেন। নিজের মনে মনে কথা বলতেন। যেন তিতলির সঙ্গে কথা বলছেন।
আপনার স্যারের কী ধরনের ব্যবসা ছিল?
এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের।
সামন্ত তার ফোন হাতে নিয়ে উঠে একবার বাইরে গেল। হয়ত কারও সঙ্গে কথা বলবে।
প্রবাল আবার প্রশ্ন করল।
তা হলে এই সময়ে ব্যবসা কে দেখত?
হ্যামিলটন আর আমি। বদ্রিও ছিল। এখনও আছে।
বদ্রি কে?
বদ্রিনারায়ণ। স্যারের ব্যাবসার ডানহাত।
তিতলির কোনও বন্ধুকে আপনি জানেন?
হ্যাঁ। ওই তো বিশাখা দত্ত। উধাও হয়ে গেল না! কিছুদিন হল! ওর পাল্লায় পড়েই তো তিতলির মাথায় সিনেমার ভূত চাপে। অবশ্যা দাদার জন্যেও তার এই লাইনে উৎসাহ বেড়েছিল।
প্রবালের চোখ চকচক করে ওঠে। কিছু যেন সে আবিষ্কার করে। সে মোবাইল বার করে বিশাখা আর সেই মেয়েটির ছবিটা দেখায় ডরোথিকে।
ডরোথি ছবিটা হাতে নিয়ে বলে,
হ্যাঁ। এই ছবিটা স্যারের বাড়িতেই তোলা।
তার পরে সে যেন নিজের মনেই কথা বলছে এমনিভাবে বলে,
কী যে ভালো মেয়ে ছিল সে। বিশাখাই ওর সর্বনাশ করল।
প্রবাল বলল,
তিতলির ভালো নাম কী?
দিগঙ্গনা।
প্রবাল নিজের মনে মনে বলল,
ঠিক ঠিক ডি. ডি.।
তখন মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে সামন্ত ঘরে ঢুকল।
প্রবাল অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। বলল,
আপনার স্যার মানুষটা কেমন?
ডরোথি মুখ নিচু করে ছোট্ট জবাব দিল,
ভালো।
প্রবাল বুঝল সে আর কিছু বলতে চায় না।
সে বলল,
কিন্তু আপনার এইরকম একটা বাড়িতে থাকাটা যেন মেলাতে পারছি না।
আমরা আগে অন্য একটা ভাড়াবাড়িতে থাকতাম। হ্যামিলটন মারা যাবার পরে এখানে উঠে এসেছি। পাশের ঘরটাতেই আমার মা থাকে, ভাই থাকে। তা ছাড়া আমার মাইনে বেশি না।
ডরোথি মুখ নমিয়ে নেয়।
প্রবাল কিছু বলে না আর। সে যেন বুঝতে পারে।
আপনার স্যারের কোনও লাভার আছে?
ডরোথি কী লজ্জা পেয়ে গেল! সেই ভাব লুকাতে সে মুখ নিচু করে। কিন্তু প্রবালের চোখকে সে ফাঁকি দিতে পারে না। প্রবাল যেন কিছুতেই বুঝতে পারছে না, ডরোথি লজ্জা পায় কেন!
ডরোথি মুখ নিচু করেই বলে,
আমি ঠিক জানি না। তবে এক সময় বিশাখার প্রতি একটু টান ছিল বলে মনে হত।
প্রবাল মাথা নাড়ে।
আই সি।
সে আবার জিজ্ঞাসা করে,
বদ্রিকে কোথায় পাব?
আমি সঠিক ঠিকানাটা জানি না। তবে হাওড়ার ওদিকে কোথাও থাকে। লঞ্চে করে আসে শুনেছি।
আপনার স্যারের বাড়িতে আর কজন কাজের লোক আছে?
একজন রান্নার লোক। আর একজন ঠিকে ঝি।
আচ্ছা আপনার স্যারের আদি বাড়ির ঠিকানা জানেন?
৮/২/৮ হরিশচন্দ্র রোড। বকুল বাগান।
প্রবাল হাসতে হাসতে উঠে পড়ে। তার যেন খুব হাসি পেয়ে গিয়েছে। তার মাথাটা ভীষণ হালকা হয়ে গিয়েছে।
সে দুম করে ডরোথিকে প্রশ্ন করে,
আপনি স্যারকে খুব ভালোবাসেন? তাই না?
ডরোথি মুখ নিচু করে নেয়। কোনও উত্তর দেয় না।
প্রবাল তার ঘর থেকে বের হতে হতে যেন নিজের মনে মনে কথা বলছে এমনভাবে বলে,
ভালোবাসটা তো কোনও অপরাধ নয়। তবে আপনার স্যার কি আপনাকে ভালোবাসে?
কথাটা বলেই সে হাঁটা দেয়। পিছনে লজ্জায় ন্যুব্জ হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে সে ফিরেও তাকায় না।
হাঁটতে হাঁটতে তন্ময় বলল,
স্যার, আমিও যেন কিছু অনুমান করতে পারছি।
প্রবাল বলল,
কোনও প্রমাণ আছে আপনার হাতে?
তন্ময় বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়ল।
আবার আগামী সংখ্যায়