স্বগতোক্তিপ্রায়

স্বগতোক্তিপ্রায় । সৈয়দ কওসর জামাল

সৈয়দ কওসর জামাল

 

৩৮

যেকোনও ওষধির ভিতর লুকিয়ে থাকে নশ্বরতার ছায়া
ছায়ার ভিতর অজস্র অন্ধ গলিপথ যা স্বপ্ন দেখানোর ছলে
ঘুরিয়ে মারছে আমাকে, গুপ্তহননের আড়কাঠি ঘোলাটে চোখ
অজানা ভাষাসঙ্কেত দূর ঘন্টাধ্বনির মতো না-লেখা কবিতা
দিন শেষ হলে অন্ধ বালকের লাঠি হয়ে নিভৃতে বাস করি
বসবাস অতি সরলরৈখিক, যতিচিহ্নহীন ডায়েরির পাতা
সেখানে ওড়ে না নিঃসঙ্গ পাখিদের ডাক, শুধু খেয়াঘাট
একই পথে আসাযাওয়া, মাঝিদের দীর্ঘশ্বাস কখনও শোনেনি
আমি কি এখানে লিখেছি ভূতগ্রস্ত জলস্রোতের ক্রন্দন
নির্জন তীরে কুড়িয়ে পেয়েছি কখনও নিজের প্রতিরূপ
কে আজ গুপ্তলিপি খোদাই করে রেখে গেল গাছের ছায়ায়
এই যে ভূমিকাহীন শিরোনামহীন গ্রন্থের জীবন
আমি কি প্রচ্ছদ তার, অন্তর্লিপির সঙ্গে যার চিরশত্রুতা
জ্যা-মুক্ত করা বা না-করায় কিছু কি এসে যায়, স্থবিরতা!

 

৩৯

বিষণ্ণতা লিখে দিয়েছিল কেউ পরিদের দুধসাদা ডানায়
সেই থেকে ঘুম নেই তাদের চোখে, স্তব্ধ উড়ান
এই যে নিস্তব্ধ গ্রহ তার সঙ্গে পরিচয় ছিল না তাদের
সময়ের ধাঁধায় জড়িয়েছে আমাদেরও পা, যত খুলি
ততই জড়ায়, বিষণ্ণতা থেকে ঝরে পড়া ধুলোবালি
আমাদের বিস্ময়ের ওপর পড়ে, স্বপ্নছুট আমি কবচহীন
আত্মবিস্মরণের কাল অচেনা পথিকের মতো পাশে হাঁটে
এ সময় চাঁদ জ্যোৎস্নার সঙ্গে গলে যেতে যেতে ক্ষীণ
কে এখন উড়ান শেখাবে নতুন করে পাখিদের, পরীদের
অসমাপ্ত সব গান আকাশে আকাশে ওড়ে, দমকা বাতাস
কখনও কখনও বধির কানে ঝাপটা মেরে চলে যায়
হাতে মায়ামুকুরের জাদু একান্ত সম্বল এই তাঁবুর জীবনে
ইন্দ্রিয়নির্ভর ভাষার সন্ধানে ফিরি, দর্শন ও স্পর্শ দিয়ে
পড়ে নিতে চাই লুপ্ত উড়ানলিপি, ডানা খুলে পড়ার আগে…

 

৪০

নির্জনতা একক পাখির ব্যর্থ উড়ান নিরক্ষরেখার দিকে
উদ্ভ্রান্ত হাওয়া ছিন্নভিন্ন করেছে যূথচারী জীবনের মুঠি
এক একটি ছিন্ন শাখা নতুন বৃক্ষের জন্ম দেবে বলে
পরিক্রমা করে নক্ষত্র ও আকাশের সম্মোহিত ছায়া
যতই দাঁড়াতে যাই বৃক্ষের নীচে, ছায়া সরে সরে যায়
কোথায় হোরি নামের গোপন অভিসার বসন্তের গানে
সমস্ত রাগসঙ্গীত আজ অশ্রুত বেদনার কাছে ঋণী
কোনও উৎসবই আর সূচিত হবে না সঙ্গীত মূর্ছনায়
পাখির বিষাদঘন চোখ থেকে আমি চেয়েছি আকাশে
তাকে বলি, বরং তুমিই নেমে এসো মাথার ওপরে
ছুঁয়ে দেখি মেঘ, কতদিন আর এই আত্মঘাতী আর্তনাদ
বয়ে বেড়াবে হাওয়া, অসময়ে বৃষ্টিকে পারি না ফেরাতে
স্মৃতিহারানোর এই এক মুগ্ধবোধ সরল প্রকরণ
আত্মবিস্মরণের এই কাল খুব কি মৃত্যুর কাছাকাছি…

 

৪১

সময়ের এই শূন্য পরিসরে আগুন জ্বলেনি কতদিন
সব শূন্যতা হাওয়ার দখলে, যদি একে অন্তরীক্ষ ভাবি
নক্ষত্রমণ্ডলীর নীচে পোড়া দেশ, যেখানে পেতেছি সংসার
অক্ষরেখা বরাবর অনাত্মীয় পৃথগন্ন ক্ষুদ্র তাঁবুর প্রহরা
এত প্রশস্ত শূন্যতা তার চারপাশে, তবু উল্লম্ফন রীতি
শেখা হয়ে উঠল না এ জীবনে আর, এত যে অনন্ত রাত
তবু পৌছোনো গেল না কোনো নিজস্ব নক্ষত্রের কাছে
প্রতিটি পথের বাঁকে কেউ পুঁতে রেখেছিল ভ্রমণবিভ্রম
মৃতদের চিঠি পাই, তাদের সুষুপ্তির মধ্যে রাখি স্বপ্ননির্মাণ
আমাকে ঘিরে রাখে মৌনের আকাঙ্ক্ষাহীন গুচ্ছসঙ্কেত
যে কোনও সঙ্কেতই রহস্যের বোধিবৃক্ষ, অমৃত তৈজস
যে কোনও রহস্যই আজ মানুষের কাছে কৌতূহলহীন
দূরে আকাশের গায়ে জেগে উঠেছে স্যানেটোরিয়াম
শুশ্রূষাহীন এ জীবনে তার হাতছানিটুকু শুধু থেকে গেল…

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

4 Comments

  1. আত্মগত কথন, তাতে পাঠককে সামিল করতে পারেন যাঁরা তারাই যথার্থ কবি। খুবই বড় মাপের লেখা।

  2. সব কবিতাগুলোই দারুণ! খুব ভালো লাগলো।

আপনার মতামত...