অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী
রেশন
নদীর উপর দিয়ে একটি ইলিশ মাছ উড়ে যায়। জলের উপর দিয়ে একটি নৌকা লাফাতে লাফাতে চলে। নদীর ঘাটে জল লাফায়। জোয়ার আসে। জোয়ার নামে।
তখন তুমি কী করো বাবা?
ছিপ নিয়ে বসে থাকি।
একাই থাকো?
হ্যাঁ। হোটেলের ঘরে আমি তো একাই।
একা কেন?
এখন না লকডাউন।
ও।
দূরে সরে বসে থাকে আর একজন।
সেও কি ছিপ নিয়ে যায়?
না।
সেও কি তোমার মত একা একা থেকে অফিস করে, বাবা?
না মনে হয়।
সে নদীর ধারে বসে কেন তবে?
আসলে সে রেশন পায়নি।
তুলো
সকাল নয়টা। হোটেল থেকে বের হয়ে অফিসের দিকে রওনা দিলাম। লকডাউনের বাজার। আমাদের কোনও ছুটি নেই।
ভাবলাম একবার গঙ্গা নদীর তীরে ঘুরে যাই। অফিসের গায়েই কিনা।
নির্মল বাতাস। পরিষ্কার জল। কোনও নৌকা নেই। পাখিরা নির্ভয়ে উড়ে চলে।
বাতাসে ভেসে আসে শিমুলতুলো অনেক অনেক।
একটিকে মুঠোবন্দি করে অফিস আসি। ড্রয়ারের মধ্যে রেখে দিই। কাজে ডুবে গিয়ে ভুলেও যাই।
কোনও কারণে ড্রয়ার খুলতেই পাখার বাতাসে সারা ঘর সেই তুলো গুড়ো হয়ে উড়তে থাকে।
ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে।
মাস্ক
অফিস থেকে ফেরার পথে গঙ্গার ধারে বসে আছি। আজ দেখি এক অন্যতর দৃশ্য।
বৃহৎ বটের নীচে চারটি ইট দিয়ে উনুন বানিয়েছে একটি লোক। বড় আকারের একটি হাড়িতে ভাত ফুটছে। পরনে কেবল একটি বারমুডা। কোনও মাস্ক নেই। মানের আনন্দে মেতে উঠে সে গান গেয়ে, নেচে নেচে ভাত নাড়ছে।
গাছের অদূরে অবস্থিত একটি চাতাল। সেখানে চুড়িদার পরা একটি মহিলা চিত হয়ে শুয়ে। তারও কোনও মাস্ক নেই। সে চাতালে গড়াগড়ি দিচ্ছে। এখানে ওদের কোনওদিন দেখিনি।
কিছু না বলে চলে আসছি।
তখন পাড়ের বস্তির একটি বউ ইশারায় ডাকল। গেলাম। সে বললে, লোকটি শুয়োর দেখাশোনা করে।
আর ওই মহিলাটি?
জানি না।
এই বলে সে মুচকি হাসলে।
এই বউটিও মাস্ক বেঁধে নেই।
সোনা
ফেরার পথে দেখি, কয়েকটি ছেলে নদীর তীরে নদীর জল ফেলছে বালতি করে। তার পর সেই জল নেমে আসছে পুনরায় নদীতে। দাঁড়িয়ে গেলাম। কী ব্যাপার?
একটি নয়, সাত আট জন। জল নেমে গেলে পাড়ের মাটিতে ঝুঁকে পড়ে তারা কিছু খুঁজছে। খোঁজ শেষ হলে, তারা আবার নদীতে নামছে, আবার জল তুলছে।
কী খুঁজছে?
সোনা।
নদীতে নাকি সোনা মিলছে।
আচ্ছা! গঙ্গা নদীতে সোনা? কেউ পেল?
না।
তবে?
ওই দিকে একজন পেয়েছে।
বলে সে হাত তুলে সেদিকটি দেখাল। তার পর বলল, কী করব স্যার, কাজ নেই। লকডাউনে সব বন্ধ। খেতে হবে তো। যদি এককুচি সোনা মিলে যায় তো…
ডিম
কাজের মাসিকে আসতে বহুদিন আগেই বারণ করে দিয়েছিল অনুপ। অগ্রিম মাইনাও দিয়ে দিয়েছিল। এখন যখন কোভিড পজিটিভ বাড়ছে, মাসি এসে উপস্থিত। কেন? না সে পনেরোখানা দিশি মুরগির ডিম এনেছে, কিনতে হবে।
অনুপ দরজা খুলল না। জানালা দিয়ে বলল, চাল পাওনি মাসি?
পেয়েছি। সে ঘাড় নাড়ে।
গম?
তাও।
তবে?
নুন, তেল, মশলা কিনতে হবে একটু। পনেরোটা ডিম, পঞ্চাশ টাকা দিও।
নেব না পিসি। তোমাদের গ্রামে বাইরের লোক এসে আছে। কার ভেতর করোনা আছে নেই, কে জানে! ও ডিম তুমি তোমার নাতিদের জন্য নিয়ে যাও।
বুড়িটি আবার ঘাড় হেলাল। তার পর নতমুখে হাঁটা দিল।
একলা চড়ুই
আমাদের অফিসের উল্টোদিকে একটি ছোট খাটাল আছে। তার পাশ দিয়ে একটি সরু রাস্তা গেছে। সেখান দিয়ে গঙ্গা নদীর বাঁকে যাওয়া যায়। সেদিকে যাবার পথে চড়ুইটিকে দেখি। ফুরুত ফুরুত ওড়ে আর মহিষের গায়ে বসে, খাবারে বসে, গোবরের পাশে ঘোরে।
কদিন তার দেখা পাইনি।
ভাবলুম সেও হয়ত লকডাউনে আছে।
কিন্তু না।
একদিন তাকে দেখলুম।
খাটাল ছেড়ে গঙ্গার দিকে উড়ে যেতে।
আগে সে মহিষের ডাবার পাশে পড়ে থাকা জল পান করত।
এখন চলল গঙ্গার শুদ্ধ জল পান করতে।
শুশুক
গঙ্গার বুকে এক শুশুক দেখেছিলাম বছর আট আগে, উত্তরপাড়ার এক ঘাটে। একটি বিশেষ কাজে গেছি, এক ঘণ্টা পর তিনি দেখা দেবেন। তারপর আমার কাজ হবে। তাই ঘাটটিতে বসি। তখন দেখি শুশুক ডুব দিয়ে আবার ভেসে ওঠে।
এক বয়স্ক পুরুষ সেখানে স্নান করে সূর্যপ্রণাম সারলেন। আমার কাছে এসে তিনি বললেন, দেখলেন?
হা।
রোজ আসে। আমি যখন স্নান সারি।
খুব ভালো। আপনার পাপও ধুয়ে যাচ্ছে রোজ।
এই তো, উপরে উঠে আবার পাপ করব।
লকডাউনের জন্য আবার ফিরে আসছে শুশুক। আজকের খবর।
অফিস থেকে বেরিয়ে ঘাটে বসি। যদি দেখা যায় আবার।
অন্য ঘাট। অন্য মানুষ। তারা স্নান করে, সূর্যপ্রণাম করে না।
তাদের স্নানের সময় শুশুক আসে না।
ইলিশ
লকডাউন চলছে। তেমন একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে গঙ্গানদীর তীরে গেলাম। বিকেল শেষ হয়ে আসছে। একটি জেলেনৌকা জাল গুটিয়ে ফিরছে। এরা মাছ বেচত ধোবিঘাটে। সন্ধ্যাবেলা অফিসবাবুরা মাছ কিনে বাড়ি ফিরত। এখন ধোবিঘাট বন্ধ।
নৌকাটা ঘাটের গা দিয়েই যাচ্ছিল। ডাকলাম। আছে নাকি কিছু? মাঝিদুই মুখে কিছু বললে না। ঘাটে এসে নৌকা লাগল। গলুইয়ের মধ্যে একটি গামলা। সেখান থেকে একটি মাছ তুলে ধরল। ইলিশ। জ্যান্ত। খাবি কাটছে। বলল, সারাদিন ধরে খেটে এই একটিই।
কত?
দুশো।
কম নেই?
মাঝিদুই মাছটাকে গঙ্গাতে ফেলে দিল।
একটি দোয়েল
হোটেলের নাম মহারাজা। লকডাউনের বাজারে এখানেই আছি। খরচ অফিসের।
ইট কাঠ পাথরের শহর। হোটেলের ভেতর যখন ঢুকি, এর অন্যথা হয়নি। কিন্তু রুমে ঢুকে উত্তরের জানালা খুলে দিযেই অবাক হয়ে গেলাম।
বাইরে বাগান! নিম, আম, জাম। শুকনো পাতা পড়ে আছে রাজ্যের।
পাখির ডাক ভেসে এল। কাক, শালিক, চড়ুই, দোয়েল। কেমন যেন। করুণ!
তবু শহরের মধ্যে এই গ্রাম। বেশ লাগল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, জানালায় জাল দেওয়া। বাইরে খাবার ফেলার কোনও উপায় নেই।
মনে পড়ল, বাড়ি থেকে ব্যাগ গুছিয়ে অফিসের গাড়িতে এখানে চলে আসার আগের দিন আমার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল একটি দোয়েল।
পাখিটা খাবার পাচ্ছিল না।
গার্ড
ছেলেটির নাম রাজু। বয়স ছাব্বিশ। নদীর ধারে তার বাড়ি । ওর বাবা, মা নেই। দাদু কাকা আছে। দাদা আছে। ওর কাছে আমি গঙ্গানদীর গল্প শুনি। এই হোটেলে সে নাইট গার্ড।
স্থায়ী কোনও কাজ ওর নেই। যখন যা জোটে করে। যেমন এখন নাইট গার্ড। তবে দিনেও কাজ করতে হয়। থাকা খাওয়া এখানেই। নইলে গঙ্গার ধারে কোনও চালাতে ও শোয়। তবে চায়ের নেশা আছে। ধোবিঘাটে একটি চা দোকান গোপনে গোপনে খুলে রাখে। সেখানে চা খেতে যায়।
একদিন বললে, স্যার, এই লকডাউন আর কতদিন ধরে চলবে?
জানা নেই। তবে উঠে যাবে হয়ত একটু একটু করে। কেন?
আসলে এই কাজটি পেয়েছিলাম প্রথম লকডাউনের সময়। আবার লকডাউন বাড়ল। আমার কাজ থাকল। আবার যদি বাড়ে তো আমার কাজ থেকে যাবে, তাই না?
রেশন, তুলো, মাস্ক, গার্ড– এই চারটি গল্প খুব ভাল লাগলো। বাকি গল্পগুলি কি খারাপ? তা নয়, তবে ওই চারটি খুবই ছুঁয়ে গেল।
অনেক ধন্যবাদ