তিনটি অণুগল্প

পিয়ালী মজুমদার

 

দ্য ইরেজার

ভারি মিষ্টি দেখতে তো ছেলেটিকে। অনেকটা আয়ুষ্মান খুরানার মতো। প্রোফাইলটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম৷ ভালো লেখার হাত ছিল। বেশ প্রতিবাদী। নিজের শেষ পোস্টেও রাষ্ট্রকে তুলোধোনা করতে ছাড়েনি। সরকারি হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তার। মৃত্যু হয়েছে এক ভয়ঙ্কর সংক্রামক ভাইরাসজনিত অসুখে। প্রোফাইলটা মুছে ফেললাম। চিরতরে।

রাষ্ট্র নির্দেশ দিয়েছে। এক এক করে সমস্ত ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী— যারা এই অতিমারিতে প্রাণ হারিয়েছেন, সকলকে আন্তর্জাল থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। দুমড়ে- মুচড়ে যাওয়া স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে গোটা পৃথিবীর সামনে বে-আব্রু হওয়া থেকে আড়াল করতে রাষ্ট্রের কাছে অন্য কোনও উপায় ছিল না।

আমি একজন সরকারি বেতনভুক হ্যাকার। রাষ্ট্রের নির্দেশ পালন করছি অক্ষরে অক্ষরে।

বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালে। জল খেলাম একটু। তারপর হাত বাড়ালাম পরের প্রোফাইলের দিকে।

একটি মেয়ের প্রোফাইল। চেনা চেনা লাগছে। সুরঞ্জনা দাস। হ্যাঁ, আমার স্কুলের সহপাঠী সুরঞ্জনাই তো।

হাত-পা অবশ হয়ে আসছে।

খুব গরীব ছিল ওরা। মা আয়ার কাজ করত।

এখন নামী বেসরকারি হাসপাতালের নার্স সুরঞ্জনা। মানে ছিল। আজ ওর জন্মদিন!

টাইমলাইন জুড়ে অজস্র শুভেচ্ছাবার্তা..

জল খেলাম আবার।

ডিলিট বাটন ক্লিক করার মুহূর্তে একটা মেসেজ ঢুকল। এত রাতে! কে?

নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না আমি। সুরঞ্জনা! ওর নামের পাশে সবুজ আলো। চোখে লাগছে বড্ড।

–আমার প্রোফাইলটা মুছে দিস না প্লিজ।
–তুই, মানে তুই বেঁচে আছিস???
–না।
–তাহলে!
–প্রথম রোজগারের টাকায় মাকে স্মার্টফোন কিনে দিয়েছিলাম। মা জানে, আমি এখন যুদ্ধক্ষেত্রে। যুদ্ধ শেষ হলে ঠিক ফিরে যাব মায়ের কাছে। যতদিন এই প্রোফাইল থাকবে, মা বিশ্বাস করবে আমি বেঁচে আছি। মায়ের এই বিশ্বাসটুকু কেড়ে নিস না তুই।
–কিন্তু আমি যে রাষ্ট্রের কাছে দায়বদ্ধ।
–কিসের দায়? ওরা আমাদের ন্যূনতম সুরক্ষাটুকুও দেয়নি। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যু ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলেছে। আর আমরা মরব জেনেও লড়ে গেছি শেষ পর্যন্ত।

বুকের কাছে চিনচিনে ব্যথা। গলা শুকিয়ে কাঠ। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলাম কতক্ষণ। সবুজ আলোটা কখন নিভে গেছে টের পাইনি।

আদৌ জ্বলছিল কিনা মনে পড়ছে না।

সুরঞ্জনাকে কি আমি ভালবাসতাম?

তাও মনে পড়ছে না।

মুছে দিলাম ওকে। হাত কাঁপল না।

জানি, মৃত ব্যক্তিকে হত্যা করলে রক্ত লেগে থাকে না হাতে।

এবার অন্য প্রোফাইল।

 

ওজন

আজ অন্ধকার থাকতেই বেরিয়েছি। নাহলে কাজ সারতে সারতে সন্ধে হয়ে যায়। এই লাশ তোলার কাজটা শহরে নতুন। অনেক টাকা দেবে সরকার। বিমাও করে দিচ্ছে। তবু কেউ রাজি হচ্ছে না। মরার ভয় তো সবারই আছে। সংসারে পাঁচটা পেট, কদ্দিন আর ঘরে বসে চলবে? রেশনের পোকায় কাটা চাল-ডাল মুখে তোলা যায় না। এমনিও মরব, ওমনিও। তার চেয়ে এই ভালো। ছেলেমেয়েগুলো তো অন্তত খেতে পাবে দু-মুঠো।

ভ্যান চালিয়ে বড় মসজিদের পাশে এলাম। এ মহল্লায় একবার ঢুকলে হল, শয়ে শয়ে লাশ জমে পাহাড়। গন্ধে নাড়িভুঁড়ি উঠে আসতে চায়, কিন্তু কাজ তো করতেই হবে।

হারুণ চাচার বডি তুলতে গিয়ে চোখ পড়ল জানালায়। কচি বউটা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে দাঁড়িয়ে। কাঁদছে কিনা বুঝতে পারলাম না।

আজকাল আর কেউ কাঁদে না, চুপচাপ বাড়ির বাইরে রেখে দেয় বডি। আমরা তুলে নিয়ে গোডাউনে ফেলি। সেখান থেকে যায় গণকবরে, না হলে গণচিতায়। কোন হিন্দু গোর পেল, আর কোন মুসলিম চিতায় উঠল, সেসব নিয়ে কথা বলার কেউ নেই এখন।

গেল হপ্তাতেই তো, যখন একটাও লোক পাওয়া যাচ্ছিল না লাশ তোলার, পশ্চিমপাড়ার সুবোধ সাহা পাঁচ-পাঁচদিন ঘরে নিয়ে বসেছিল বাবা আর বউয়ের বডি। তারপর একদিন কেমন যেন পাগলের মতো সারা রাত ধরে মাটি কুপিয়ে বাড়ির বাগানে পুঁতে দিল লাশগুলো। শুনেছি, ওরও অবস্থা ভাল নয়। যে কোনও দিন…

যারা একা থাকে, তারা কেউ দরজা বন্ধ করে না এখন।

ঘুরতে ঘুরতে দুপুর গড়িয়ে গেল, একবার নিজের পাড়ায় চক্কর দিয়েই সোজা গোডাউনের দিকে রওনা দেব।

বাজারের কাছে আসতেই থমকে গেলাম। আমার বাড়ির পাশেই বাজার। কদিন আগেও যেখানে হাভাতের মতো ভিড় করেছে লোকজন, এখন সেটা শ্মশান।

এখানে আবার কার বডি ফেলে গেল?

সামনের পেঁপে গাছে হেলান দিয়ে একটা লোক বিড়ি ফুঁকছে। সিড়িঙ্গে মার্কা, আগে কখনও দেখিনি। এভাবে এখন কেউ রাস্তায় ঘোরেও না। বিরক্ত লাগল দেখে। মরার সাধ জেগেছে মনে হয়!

বডিটা তুলতে গেলাম। কী ভারি!

অথচ প্লাস্টিক মোড়া শরীরটা দেখে তেমন ওজনদার লোক বলে মনে হচ্ছে না।

আবারও চেষ্টা করলাম। বার বার। কিছুতেই তোলা গেল না।

লোকটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে আমি কেমন নাস্তানাবুদ হচ্ছি। আর মিটমিট করে হাসছে।

রাগ ধরে গেল। তেড়ে গেলাম এবার,

–মজা দেখছেন?

লোকটা অদ্ভুতভাবে হাসল। তারপর আমার চোখে চোখ রেখে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে উঠল,

–আরে রাগ করবেন না মশাই। ছেড়ে দিন। অন্য কেউ তুলে নেবে। নিজের ওজন বইতে পারা কি চাট্টিখানি কথা?

 

উত্তরকাল

“Never in my life before have I experienced such beauty, and fear at the same time.”
IIen MacArthur, Sailor

মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি। মন্ত্রবৎ প্রতিটি অক্ষর। মাথার ওপর বৃশ্চিকরাশি। ঘন কালো রাতের আঁচলে সলমা জরির প্রশ্নচিহ্ন। লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ দূর থেকে দ্বিধাবিভক্ত তার ছায়া এসে ডুবে যাচ্ছে ঘন নীল সমুদ্রের বুকে। আত্মহত্যাপ্রবণ? আমার ছোট্ট নৌকাটির মতো? নাকি রোমাঞ্চময়? এই অনিঃশেষ যাত্রার মতো! এক একসময় মনে হয়, ভয়ের চেয়ে প্রিয় খেলা আর কী আছে জীবনে। ভাসতে ভাসতে কতদূর এলে নিজেকে একটি বিরলতম দ্বীপের চেয়েও অকিঞ্চিৎকর মনে হয়, ডায়েরির শেষ পাতায় লিখে রেখেছি আজ। কাল থেকে ভুলে যাব কততম দিনের হিসাব। দু আঙুলে বিচ্ছিন্নতা বুনতে বুনতে মেতে উঠব আত্মরতিতে।

যান্ত্রিক মাধ্যমগুলি তখনও পড়ে থাকবে পাশে। নির্বিকার। যোগাযোগবিহীন।

ভাবতে ভাবতে বিনিদ্র রাত কাটল। এখানে সূর্যের রং মখমলি। বাতাসে সবুজের গন্ধ।

চঞ্চল হয়ে উঠল মন। দ্বিশতাধিক দিন পেরিয়ে আমি কি মাটির কাছাকাছি ফিরে এলাম তবে? দূরবীন ধরলাম চোখে। পাথুরে দ্বীপপুঞ্জ। বিস্তীর্ণ তটভূমি।

ধীরে ধীরে এগোচ্ছি। সারি সারি ডাব ভেসে যাচ্ছে স্রোতের অভিমুখে। অর্থাৎ উপকূলরেখা বরাবরই চলেছি। গন্তব্য অদূরে।

জঙ্গল ঘেরা ধূসর সৈকত। ইতিউতি ছড়ানো ব্যাসল্ট শিলার ভঙ্গুর কাঠামো। এমনই এক কাঠামোর গায়ে ক্লান্তিতে ঢলে পড়েছে অত্যাধুনিক নৌকাটি!

তার মানে আমি ছাড়াও কেউ এসেছে এখানে। সেও কি আমারই মতো? জলপথে ভূ-ভ্রমণে বেরিয়ে কোনও অজ্ঞাত কারণে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে দিশাহীন পৌঁছেছে এই নির্জন দ্বীপে?

“প্রাণ হাতে করে পালিয়েছি দেশ থেকে। শহরে আর একজন লোকও জীবিত নেই। জানি না আমরাও বেঁচে থাকব কিনা। আদৌ পৃথিবীতে কেউ বেঁচে থাকবে কিনা। এই ভাইরাস কারোকে রেয়াত করে না, শুধু শিশুদের ছাড়া। ঈশ্বর তেমনটাই চেয়েছেন হয়তো। ওরাই গড়বে নতুন পৃথিবী। প্রকৃত মানুষের সভ্যতা।”

মাত্র তিনমাস আগে, পুরুষালি হস্তাক্ষরে লেখা শব্দগুলি বারবার পড়তে লাগলাম। চোখের সামনে ভেসে উঠল যাত্রা শুরুর দিন। ঝলমলে, প্রাণোচ্ছল মেক্সিকো শহর। কোথাও মৃত্যুর চিহ্নমাত্র নেই। তাহলে এসব কী লেখা এই ডায়েরিতে?

বার্তা পেয়েছিলাম অস্পষ্ট। কে যেন বলেছিল মারি লেগেছে পৃথিবী জুড়ে। দূরে আছি, টের পাইনি তার ব্যাপ্তি। তাহলে কি…

যোগাযোগ করার মতো কেউ বেঁচে নেই বলেই মাঝসমুদ্রে আমি ভেসে বেড়াচ্ছি একা!

পাগলের মতো খুঁজছি ওদের। খুঁজতে খুঁজতে কখন যেন চলে এসেছি জঙ্গলের গভীরতম প্রান্তে।

হঠাৎ কানে এল শিশুর খিলখিল হাসি।

বিশাল নাম না জানা গাছের নিচে বসে এক রমণী। তাকে ঘিরে গোল হয়ে বসেছে কয়েকজন পুরুষ। অরণ্যচারী আদিম উপজাতি। রমণী পরম যত্নে স্তন্যপান করাচ্ছে ফুটফুটে শিশুটিকে। তাকে চিনে নিতে অসুবিধা হল না আমার। ততক্ষণে ওরা দেখতে পেয়েছে আমাকে। কী বুঝল কে জানে। একটি পুরুষ আঙুল তুলে দেখাল দূরে।

দৃষ্টি অনুসরণ করে এগিয়ে গেলাম।

পাশাপাশি দুটি কবর।

ফুল-পাতায় ছাওয়া, আধুনিক পৃথিবীর শেষ প্রজন্ম।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...