সঙ্কটাপন্ন ভারতীয় কৃষি, লকডাউন এবং…

শঙ্কর সান্যাল

 

 

 

লেখক অর্থনীতির ছাত্র, পেশায় সাংবাদিক

 

 

সঙ্কট। হ্যাঁ, গভীর, গভীরতর কিংবা গভীরতম এক সঙ্কট। বৃদ্ধ চাষি সওগাত আলি যখন পাঁচ ব্যাগ তরতাজা কচি ঢ্যাঁড়শ মাত্র ৫০ টাকায় বিক্রি করে দিতে আসেন, তখন সঙ্কটটা স্পষ্ট হয়। মধ্য বৈশাখের বাজারে কিলোপ্রতি ৩০ টাকার বেশি দামে কোনও সবজি নেই। শহুরে মধ্যবিত্ত মহানন্দে। কিন্তু চাষি? চাষির কি হচ্ছে? লাভ তো দূরের কথা চাষির উৎপাদন খরচেরও ধারেকাছে নেই বাজারের দাম। সঙ্কটটা এখানেই। চাষি তার উৎপাদিত পণ্যের দাম পান না। এই ভারতে কেন গোটা পৃথিবীতেই কৃষি উৎপাদন এমন একটিমাত্র ব্যবসা, যেখনে উৎপাদক তাঁর পণ্যের দাম স্থির করেন না। যেমন সওগাত স্থির করতে পারেননি তাঁর ঢ্যাঁড়শের দাম। যে কারণে কৃষি একটি নিশ্চিত অলাভজনক কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে। ঠিক এই কারণেই প্রতিদিন এই ভারতে গড়ে ৫২ জন চাষি আত্মহত্যা করেন। বিদর্ভের তুলোচাষি থেকে শুরু করে পাঞ্জাব-হরিয়ানার গমচাষি, উত্তরপ্রদেশের আখচাষি থেকে বর্ধমানের ধানচাষি— সঙ্কটটা একই জায়গায়। নীতি আয়োগের ২০১৯ সালের কৃষি বিষয়ক রিপোর্টে এক অদ্ভুত তথ্য উঠে এসেছে। বলা হচ্ছে, ভারতীয় অর্থনীতিতৈ কৃষির অবদান মাত্র ১৪ শতাংশ। কিন্তু কৃষি ভারতের ৫৫ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান করে। এখানেই স্পষ্ট হয়ে যায় ভারতীয় কৃষকের হালহকিকৎ। সারা ভারত কৃষকসভার হিসাব অনুযাষী, ভারতে একজন চাষির গড় মাসিক আয় ৬ হাজার টাকা।[1] আগাগোড়া কৃষিক্ষেত্রে সমস্যা ছিল। এখন তা সঙ্কটে পর্যবসিত হয়েছে। সমস্যার সমাধান হয় কিন্তু সঙ্কটের কোনও সমাধান নেই।

যদি চাষি আর চাষ না করেন? তাহলে ভারতে তাবৎ অর্থনৈতিক সঙ্কট রূপান্তরিত হবে গভীরতম এবং ব্যাপকতম সঙ্কটে। খাদ্য সুরক্ষা বলে কিছু থাকবে না ১৩৭ কোটি ভারতবাসীর। স্বাধীনতার পরে গত শতকের ছয়ের দশক পর্যন্ত ভারত খাদ্যে স্বনির্ভর ছিল না। সমস্যাটা তখন ছিল ভূমি সংক্রান্ত। কৃষকের হাতে জমি নেই। বৃটিশ ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার স্থির করা বন্দোবস্ত অনুযায়ী সিংহভাগ কর্ষণযোগ্য জমি কেন্দ্রীভূত ছিল জমিদার এবং জোতদারদের মতো মধ্যসত্ত্বভোগীদের হাতে। বিশিষ্ট পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ স্বাধীনতার পরেই বলেছিলেন, সঠিক ভূমিসংস্কার হলে ভারতে ছ কোটি একর কৃষিজমি উদ্বৃত্ত হবে। ওই বিপুল পরিমাণ জমি ভূমিহীন কৃষকের হাতে এলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। প্রথম থেকে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ঘটা করে ভূমিসংস্কারের কথা লেখা হল, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হল না। প্রায় প্রতিটি রাজ্যই ভূমিসংস্কার আইন প্রণয়ন করল কিন্তু তা বলবৎ হল না। এটা ছিল কংগ্রেসের নীতির প্রশ্ন। বড়জোতের মালিকের বিরুদ্ধে কংগ্রেস নীতিগতভাবেই কখনও কোনও পদক্ষেপ নেয়নি।

গত শতকের ছয়ের দশকে ইন্দিরা গান্ধি ভারতকে খাদ্যে স্বনির্ভর করার জন্য সবুজ বিপ্লবের পরিকল্পনা করলেন। এই পরিকল্পনার মূল অংশীদার ছিলেন ধনী এবং বড় কৃষক। বিদেশ থেকে অতিফলনশীল বীজ আমদানি থেকে শুরু করে, সদ্য রাষ্ট্রায়ত্ত হওয়া ব্যাঙ্কগুলি থেকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কৃষিঋণ প্রদান, সরকারি উদ্যোগে সেচব্যবস্থা গড়ে তোলা, সারে এবং বিদ্যুতে ব্যাপক ভর্তুকি ইত্যাদি পদক্ষেপ নেওয়া হল। উৎপাদিত ফসল সরকারি সংগ্রহের মধ্যে দিয়ে গণবণ্টন ব্যবস্থায় নিয়ে আসা হল। এর ফল যে ফলল না তা নয়। অন্ততপক্ষে খাদ্যে ভারতের আমদানিনির্ভরতা কমে গেল।

কিন্তু গত শতকের সাতের দশকের শেষে বিশ্বব্যাঙ্ক ফরমান জারি করল ‘স্ট্রাকচারাল চেঞ্জ’ অর্থাৎ কাঠামোগত পরিবর্তন করতে হবে। ভারত সরকারও আটের দশকের শেষ থেকে নয়ের দশকের শুরুর মধ্যে বিশ্বব্যাঙ্কর ফরমান কার্যকরী করে ফেলল। ফলত সবুজ বিপ্লবের শরীর থেকে সবুজ জামাটা খুলে গিয়ে একটা হাড়জিরজিরে চেহারা বেরিয়ে পড়ল। এরপরেই ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের চুক্তি ভারতীয় কৃষির কফিনে শেষ পেরেকটা মেরে দিল। সেই চুক্তি মোতাবেক ভারত সরকার ১৪৫৩টি কৃষিপণ্য আমদানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হল। চুক্তি অনুযায়ী ভারত সরকারের ধাপে ধাপে কৃষি থেকে সমস্ত ভর্তুকি তুলে নেওয়ার কথা ছিল। ধাপে ধাপে কৃষিতে ভর্তুকি তুলে নেওয়ার ফল হিসাবে এক ভয়ঙ্কর চিত্র সামনে চলে এল ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে। ভারত এই সময়ে মোট সাড়ে ৩৮০০ কোটি ডলারের কৃষিপণ্য এবং কৃষিজাত পণ্য রফতানি করেছে। এর মধ্যে প্রায় পুরোটাই মোষের মাংস এবং বাসমতি চাল।[2] বাসমতি ছাড়া অন্য কোনও চাল এবং ভারতীয় গম একদানাও রফতানি হয়নি। কেননা এর চেয়ে ঢের কম দামে চাল এবং গম বিশ্ববাজারে এনে দিয়েছিল রাশিয়া ব্রাজিল এবং চিন। ভর্তুকি তুলে দেওয়ায় ভারতের দুই মূল কৃষিপণ্য ধান এবং গমের উৎপাদন খরচ এতই বেশি হয়ে যায় যে তা বিশ্ববাজারে কোনও প্রতিযোগিতাতেই দাঁড়াতে পারছে না। আন্তর্জাতিক বাজারে কৃষিপণ্যের দাম স্থির হয় ফাটকার মাধ্যমে। এই ফাটকা হল ফিউচার ট্রেডিং। অর্থাৎ তিনবছর পরে বিশ্ববাজারে গম, চাল কিংবা তুলোর দাম কী হবে, তা আজকে বসে স্থির করে দিচ্ছে ফাটকা ব্যবসায়ীরা। যাদেরকে একটু গালভরা নামে স্পেকুলেটর বলা হয়। বিশ্বায়িত দুনিয়ায় নয়া উদারনীতিতে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের দাম স্থির করে না। বাজারের স্থির করা দামেই তাকে কৃষিপণ্য বিক্রি করতে হয়, তা তার উৎপাদন খরচ যাই হোক না কেন। উন্নত দেশগুলি কৃষি উৎপাদনে ভর্তুকি দিয়ে উৎপাদন খরচকে বাজারের দামের নিচে রাখে। কেবল আন্তর্জতিক বাজারেই নয়, কৃষিপণ্যের দাম আভ্যন্তরীণ বাজারেও স্থির করে বাজারই, উৎপাদক নয়। এমনকী সরকার যে নূন্যতম সহায়ক মূল্যে কৃষিপণ্য সংগ্রহ করে, সেটাও উৎপাদন খরচের নিরিখে অনেকটাই কম। সুব্রহ্মনিয়ম কমিটির সুপারিশ কেন্দ্রীয় সরকার মেনে নেয়নি। মেনে নিলে হয়তো কৃষকের আত্মহননের সংখ্যাটা কিছুটা হলেও কমত। মজার ব্যাপার হল, কৃষিঋণ বলে সরকারি কোষাগার থেকে যে টাকাটা মঞ্জুর করা হয়, তার বেশিরভাগ অংশই আইনের ফাঁক গলে চলে যায় শিল্পপতিদের ঘরে, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে ঋণ হিসাবে। মাঠে যাঁরা ফসল ফলান, তাঁদের তখন অনিবার্যভাবেই হাত পাততে হয় মহাজনের কাছে। চড়া সুদের পাকে জড়িয়ে পড়া কৃষকের আত্মহনন আরও ত্বরান্বিত হয়। আসলে এক সময়ে কৃষকের কাছে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল জমি। কিন্তু আজকে ফসলের দম পাওয়াটাই সমস্যা। বস্তুতপক্ষে এটা আর সমস্যার পর্যায়ে নেই সঙ্কটে পরিণত হয়েছে।

এই সঙ্কটকেই তীব্রতম, ব্যাপ্ততম এবং গভীরতম করে দিল করোনা দুর্বিপাক। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে করোনা মহামারিকে কেন্দ্র করে বলবৎ হওয়া চরম অপরিণামদর্শী এবং অপরিকল্পিত লকডাউন। গত ২৪ মার্চ গোটা দেশব্যাপী লকডাউন শুরু করার আগে পরিকল্পনা করার যথেষ্ট সময় পেয়েছিল নরেন্দ্র মোদি সরকার। কিন্তু একবারও ভেবে দেখা হল না যে সময়ে লকডাউন বলবৎ করার ফরমান জারি করা হচ্ছে, সেই সময়টা ভারতের কৃষি অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। রবিশস্য মাঠ থেকে ওঠার এবং সেটা বাজারজাত করার সময়। বোরো ধান রোয়ার সময়। এই এপ্রিল থেকে বর্ষার শুরু অর্থাৎ জুন মাস পর্যন্ত ভারতে যাকে এক কথায় বলে ‘ফার্ম অ্যাক্টিভিটি’ তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। লকডাউনের ফলে কৃষিশ্রমিক অপ্রতুল হয়ে যাওয়ায় রবিশস্যের বেশিরভাগ অংশই পড়ে রইল মাঠে। বিপুল পরিমাণ ফসল নষ্ট হয়ে গেল এক অপরিণামদর্শী লকডাউনে। প্রতিটি মান্ডি বন্ধ থাকায় চাষি যেটুকু ফসল গোলাজাত করতে পেরেছিল, সেটাও বাজারজাত করতে পারল না। ফলে চাষির হাতে এক কপর্দকও নগদ থাকল না। সঙ্কটের মাত্রা আরও তীব্রতর হয়ে উঠল।

এপ্রিলের শেষ থেকে বোরো ধান রোয়ার কথা। বোরো চাষের ওপরেই নির্ভর করে ভারতে ধানের ফলন। নাবি রোয়া হলে সেই ফসল কি পর্যাপ্ত ফলন দেবে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেবে না। প্রতিটি ফসলেরই একটি নির্দিষ্ট ঘড়ি থাকে। সেই ঘড়ি অনুযায়ী চাষ না করলে ফসল আশানুরূপ পরিমাণে পাওয়া সম্ভব নয়। আমরা এখনও জানি না, হিসাব এখনও পাওয়া যায়নি, কত জমিতে গম, মুগ, আখ, তৈলবীজ নষ্ট হয়ে গিয়েছে কেবল ফসল ঘরে তোলার শ্রমিকের অভাবে। গত ১ এপ্রিল কেন্দ্রীয় সরকার জানাচ্ছে, ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার গুদামে মজুত রয়েছে ৫ কোটি ৮৪ লক্ষ ৯০ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য। এর মধ্যে চাল রয়েছে ৩ কোটি ৯ লক্ষ ৭০ হাজার মেট্রিক টন এবং গম রয়েছে ২ কোটি ৭৫ লক্ষ ২০ হাজার মেট্রিক টন।[3] এই পরিমাণ খাদ্যশস্য সরকারের তথ্য অনুযায়ী দেড় বছরের জোগান। এই হিসাবটা করা হচ্ছে কেবলমাত্র রেশন কার্ডধারী নাগরিকদের ভিত্তিতে। ভারতে দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী ৬০.৪ শতাংশ মানুষের কোনও কার্ডই নেই।[4] অর্দাৎ খাদ্যমন্ত্রকের এই হিসাবের বাইরে রয়ে গিয়েছেন সিংহভাগ দারিদ্রসীমার নিচে থাকা মানুষও। অতঃপর আগামী দিনে খাদ্যসঙ্কটের মোকাবিলা হবে কী করে? রাষ্ট্রসঙ্ঘের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের শীর্ষ অর্থনীতিবিদ আরিফ হুসেইন জানাচ্ছেন, করোনা দুর্বিপাক বিশ্বের সাড়ে ২৬ কোটি মানুষকে চরম খাদ্য সঙ্কটের মুখে ফেলতে চলেছে। এর মধ্যে ভারতে কত? অত্যন্ত বিনীত ভাবে হুসেইন জানাচ্ছেন, এর এক তৃতীয়াংশ জনসংখ্যাই হবে ভারতে।[5] অর্থাৎ ভারতের ৯ কোটি মানুষ পড়তে চলেছেন চূড়ান্ত খাদ্য সঙ্কটের মুখে।

কৃষি উৎপাদন মানে তো কেবল দানাশস্য, ডাল, তৈলবীজ, আখ এবং তুলো নয়, গোটা ভারতে বিপুল পরিমাণ জমিতে সবজি চাষ হয়। সেই সবজি মাঠ থেকে তুলে তৎক্ষণাৎ বাজারজাত করতে হয়। একই কথা প্রযোজ্য পান এবং ফুলের ক্ষেত্রেও। পান এবং ফুল দেশের আভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি হয়। কৃষক সংগঠনগুলির হিসাব বলছে, লকডাউনের ফলে পরিবহনের সুযোগ নেই। প্রায় ৪০ শতাংশ সবজি মাঠেই পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পান এবং ফুলের অবস্থা আরও করুণ। প্রতিদিন গড়ে সাড়ে তিন কোটি লিটার দুধ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।[6] কেননা ক্রেতা নেই এবং ক্রেতার কাছে পৌঁছনোর পরিবহণ নেই। খাবারের দোকান, হোটেল, এমনকী রাস্তার ধারের ধাবা পর্যন্ত বন্ধ। সবজির চাহিদা তলানিতে। তারপরে পরিবহন নেই। ট্রেন বন্ধ, লরিও অপ্রতুল। চাষিকে ফসল বিক্রি করতে হচ্ছে উৎপাদন খরচের থেকে অনেক কম দামে। পাড়ায় পাড়ায় ভ্যানগাড়ি ভর্তি সবজি নিয়ে খুচরো বিক্রেতা হাঁক দিচ্ছেন, যা নেবে তাই ২০ টাকা। কমপক্ষে তিনস্তর মধ্যসত্ত্বভোগীর হাত পেরিয়ে সবজির দাম খুচরো বাজারে গড়ে ২০ থেকে ৩০ টাকা। তাহলে চাষি কিলোপ্রতি সবজির দাম কত পাচ্ছে? আসলে বিপদটা যেখানে ঘনীভূত হচ্ছে তা হল, চাষির পুঁজি ভেঙে যাচ্ছে। অর্থাৎ চাষি আগামীদিনে চাষ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। এর প্রভাব কেবলমাত্র জিডিপির হিসাবে সীমাবদ্ধ থাকবে না, প্রবল নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের খাদ্য সুরক্ষাতেও।

লকডাউন তো ঘোষণা হল কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য ঠিক কী পদক্ষেপ নিল? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণার ঠিক ৩৬ ঘণ্টা পরে দেশের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন দিল্লিতে সাংবাদিক বৈঠক করে দেশের মানুষের জন্য ১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকার একটি প্যাকেজ ঘোষণা করলেন। বললেন, দেশের ৮ কোটি ৬৯ লক্ষ কৃষককে মাথাপিছু ৬ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। তার প্রথম কিস্তি দু হাজার টাকা আপাতত দেওয়া হচ্ছে। প্রথম প্রশ্ন হল, ভারতে কি কৃষিজীবী মানুষের সংখ্যা এই ৮ কোটি ৬৯ লক্ষ? না তা নয়, এর থেকে অনেক বেশি। তাহলে এদের বেছে নেওয়া হল কিসের ভিত্তিতে? দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, যেখানে মাঠভরা ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সেখানে মাথাপিছু দু হাজার টাকা! লকডাউনের কর্মহীন দিনে চাষিকে কি বিড়ি খাওয়ার ভাতা দিচ্ছে সরকার? বলা হল, ১০০ দিনের কাজের টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। অতি উত্তম। কিন্তু প্রশ্ন হল, লকডাউনের মধ্যে বিধি ভেঙে কে কাজ করবে আর কে-ই বা তাদের কাজ দেবে? আগাগোড়া একটি ভাঁওতার প্যাকেজ দিয়ে সরে পড়লেন অর্থমন্ত্রী। এমনকী এই টাকার উৎস কী এবং এর ফলে আগামীদিনে যে বাজেট ঘাটতি হবে, তা সামাল দেওয়া হবে কী করে— এই দুটি প্রশ্নের জবাব না দিয়েই সাংবাদিক বৈঠক থেকে প্রস্থান করেন নির্মলা সীতারামন।

একটা ভারত এখনও আধপেটা খেয়ে বাড়ি থেকে কয়েকশো মাইল দূরে আধমরা হয়ে বেঁচে রয়েছে। আরেকটা ভারত পায়ে হেঁটে ঘরে ফিরছে। রাস্তায় মরছে, মরতে মরতে হাঁটছে। এঁরা পরিযায়ী শ্রমিক। ভারতের কর্ষণ প্রক্রিয়ার অন্যতম স্তম্ভ। ইংরেজি সংবাদপত্র দি হিন্দু-র সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, ৯৬ শতাংশ পরিযায়ী শ্রমিকর কোনও রেশন কার্ড নেই। তাঁরা সরকারের কাছ থেকে কোনও রেশন পান না। আর ৯০ শতাংশ পরিযায়ী শ্রমিক লকডাউনের আগে কোনও মজুরি পাননি।[7] তাঁদের পকেটে গড়ে ২০০ টাকা করে রয়েছে। এই ভারতটার কথা লকডাউনের আগে ভাবেননি, ভাবতেই চাননি নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু তিনি জানেন, উহান শহরে করোনা ভাইরাস দৌরাত্ম শুরু করার পরে কেবলমাত্র হুবোই প্রদেশেই লকডাউন করেছিল চিনা সরকার, গোটা দেশে নয়।


[1] হান্নান মোল্লার সাক্ষাৎকার, যুগশঙ্খ, ১৯ মার্চ ২০১৭
[2] Economic Times; 19th April, 2020
[3] দিল্লিতে কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ানের সাক্ষাৎকার; ১ এপ্রিল ২০২০
[4] নীতি আয়োগের রিপোর্ট, ২০১৯
[5] BBC World News; 19th March 2020
[6] The Hindu; 22nd April 2020
[7]

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...