সমর (বদ্রু) ব্যানার্জি
লেখক স্বনামধন্য ফুটবলার। ১৯৫৬-র সিডনি অলিম্পিকে ভারতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক
এর চেয়ে শোকাচ্ছন্ন মুহূর্ত আর কিছু হতে পারে না। কত স্মৃতি মনে ভিড় করে আসছে। চুনির পাশে দাঁড়িয়ে আমি দীর্ঘদিন খেলেছি। মোহনবাগানে আমি, চুনি আর কেষ্ট পাল, এই তিনজনের মধ্যে একটা দারুণ বোঝাপড়া ছিল, একটা দুর্দান্ত বন্ডিং ছিল। মোহনবাগানে থাকাকালীন অসামান্য দলগত ফুটবল খেলেছি আমরা। প্রত্যেক বছর একটা করে রেকর্ড হয়েছে। তার কারণ সেসময় মোহনবাগানে অনেক গুণী খেলোয়াড়ের সমাবেশ ঘটেছিল। আমরা সেই সময় উচ্চমানের ফুটবল খেলতাম, টোটাল ফুটবল খেলতাম। আমাদের টিমে চুনির মতো একাধিক খেলোয়াড় ছিল, যারা প্রত্যেকেই ক্রাউডপুলার। তাই আজও মানুষ আমাদের ভুলতে পারেননি।
চুনির সঙ্গে আমার সম্পর্ক বাহান্ন থেকে। তখনও চুনি মোহনবাগানে আসেনি। তিপ্পান্নতে আমরা ডুরান্ড পেলাম। সেটা ছিল মোহনবাগানের প্রথম ডুরান্ড জয়। চুয়ান্নয় চুনি মোহনবাগানে আসে। আমরা একসঙ্গে আইএফএ শিল্ড ফাইনাল খেলেছি ইস্টবেঙ্গল মাঠে। আমাদের অর্থাৎ মোহনবাগানের বিরুদ্ধে খেলছে হায়দরাবাদ পুলিস। মাঠে লোক ভেঙ্গে পডেছে। ইনসাইড লেফটে রুনু গুহঠাকুরতা ডামি প্লে করল। রাইট থেকে আমি গোল করলাম। বল নেট ছিঁড়ে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল, শটে এত জোর ছিল। চুয়ান্নয় ঘরে আইএফএ শিল্ড এল। পঞ্চান্নয় আমরা রোভার্স চ্যাম্পিয়ন। ছাপ্পান্নতে এরিয়ান্স বনাম মোহনবাগানের ফাইনাল খেলা চলছে। এরিয়ান্স তখন দাপুটে টিম। মেওয়ালাল এরিয়ান্সের সেন্টার ফরোয়ার্ড। থ্রি অল রেজাল্ট চলছে। চুনি চিৎকার করছে, “বদ্রুদা, কী করব?” আমি বলছি, “চুপ করে খেল। মাথা ঠান্ডা করে খেল।” কেষ্টকে বললাম, “বলটা যখন উঠবে কর্নার কিকে, তখন তোরা পজিশন নিয়ে গোলকিপারকে ডিসটার্ব করবি। তারপরে আমার কাজ।” ওরা ঠিক তাই করল। আর আমিও বলটা গ্রিপ করে শেষ গোলটা করলাম। ম্যাচের রেজাল্ট মোহনবাগানের পক্ষে ৪-৩। এরিয়ান্সের হয়ে মেওয়ালাল দুখানা গোল করেছিল। আর এদিকে আমি দুটো গোল করেছিলাম, চুনি একটা, কেষ্ট পাল একটা। অসাধারণ ম্যাচ হয়েছিল সেটা। আজ পুরনো কথাগুলো মনে পড়ছে। কেষ্ট ২০০৯-এ চলে গেছে। চুনিও চলে গেল।
চুনি, কেষ্ট পাল, পিকে এদেরকে আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে স্যালুট করি। এরা আমাকে অ্যাসিস্ট করেছে, বল তৈরি করে দিয়েছে, আমি গোল করেছি। তেমনিভাবে আমিও ওদের জন্য বল তৈরি করে দিয়েছি। আমরা যারা একসঙ্গে খেলতাম সবাই যেন একটা ভালোবাসার বাঁধনের মধ্যে ছিলাম৷ এই ভালোবাসা আসলে ফুটবলকে ভালোবাসা, মোহনবাগানকে মন্দিরের মতো ভালোবাসা! খেলা ছাড়ার পরেও আমার সঙ্গে কারও যোগাযোগ বিন্দুমাত্র কমেনি। বাষট্টিতে আমি বাংলার কোচ হয়ে এলাম। চুনি, বলরাম তখন টিমে। আমরা সন্তোষ ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হলাম।
চুনির সঙ্গে আমার শেষ দেখা কিছুদিন আগে ভেটারেন্স ক্লাবের একটা অনুষ্ঠানে। আমি ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ছিলাম, তারপর ও জয়েন করল। অবশ্য আমি ছেড়ে দেওয়ার কিছুদিন পরে ও-ও ক্লাব ছেড়ে দেয়।
চুনি অসাধারণ স্কোয়ার ড্রিবল করত। আউটসাইড অফ দ্য রাইট ফুট, আউটসাইড অফ দ্য লেফট ফুট— চুনি দুটো সাইডেই বলটাকে এত সুন্দর ওয়াইডে নিয়ে যেত আর তারপর বলটা ছাড়ত, একটু লেট-এ, সে এক দেখবার মতো জিনিস ছিল। চুনি এত ভালো ড্রিবল করত, অবশ্য তাতে পেনিট্রেশন একটু কম হত। কারণ স্বাভাবিকভাবেই যারা ড্রিবল করে, তাদের পেনিট্রেশন একটু কম হয়। গতি আর পায়ের কাজ দুটোকে সচরাচর একসঙ্গে আনা যায় না।
চুনির খবরটা পাওয়ার পর টিভি চালিয়েছি আর চোখে জল এসে যাচ্ছে। আর এমন সময় ঘটনাটা ঘটল, আমরা সবাই ঘরে বন্দি, ওকে শেষবার দেখতে যাওয়ার উপায় নেই। পিকে, চুনি— দুটো প্রাণের লোক চলে গেল আর আমি আমার শেষ কর্তব্যটুকু করতে পারলাম না। চুনির সঙ্গে আমার দেখা তো হবেই। তবে ও চলে যাওয়ার আগে শেষ দেখাটা দেখতে পেলাম না।