সবজির গোটা বাজারটাকেই আমরা বাড়িতে নিয়ে এসেছি, বলছে নাগাড়া

সবজির গোটা বাজারটাকেই আমরা বাড়িতে নিয়ে এসেছি, বলছে নাগাড়া

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

আপনার বাড়িতে বাগান আছে? যদি থাকে, এই লকডাউনের বাজারে সকালে ঘুম থেকে উঠে বাগানে বসে চা খাচ্ছেন নিশ্চয়ই? দুটো শালিখকে পোকা খুঁজতে দেখে নিশ্চয়ই ছুড়ে দিচ্ছেন বিস্কুটের ছোট্ট, ভাঙা টুকরো? কিংবা, ধরুন সন্ধে নামার আগে, বাগানে পায়চারি করতে-করতে আপনমনে নিশ্চয়ই কথা বলছেন যত্নে বড় করে তোলা গাছগুলোর সঙ্গে? এবার, যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করা যায়, নিজের হাতে তৈরি এই ছোট্ট একফালি সবুজের সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা ঠিক কেমন— আপনার উত্তরটা কী হবে? আপনার অবসরের সঙ্গী? আপনার মনের খিদে মেটানোর জায়গা? আপনার নিজের সঙ্গে একলা সময় কাটানোর একটা খোলা জানালা— যেখানে উঁকি দিয়ে এক নিমেষে আপনি পৌঁছে যেতে পারেন অন্য একটা দেশে?

বাগানকারদের সঙ্গে তাদের নিজেদের হাতে তৈরি বাগানের সম্পর্ক কত বিচিত্র রকমের হতে পারে, আসুন, শোনাই। কিন্তু সে গল্পটা শুনতে হলে, আগে আপনাদের পরিচিত হতে হবে জুয়াংদের সঙ্গে। কেতাবি পরিচিতির দিক থেকে জুয়াংরা হল একটি উপজাতি, নৃতাত্ত্বিকদের হিসেবে আদিম অস্ট্রো-এশিয়াটিক জনগোষ্ঠীর অংশ। ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে জুয়াংদের মুন্ডারি ভাষাভাষী জনজাতির অংশ বলে ধরা হয়, এবং গবেষকরা উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনেক মিলও খুঁজে পেয়েছেন। সরকারি নথি ঘাঁটলে দেখবেন, ওডিশার ১৩টি বিশেষভাবে পিছিয়ে পড়া উপজাতিগুলির মধ্যে একটি হল এই জুয়াং উপজাতি।

কিন্তু, আমরা যেহেতু সোশ্যাল অ্যানথ্রোপলজির ক্লাসে বসে নেই, অতএব পুথিগত তত্ত্ব আপাতত থাক। গল্পের খেই ধরতে অসুবিধে যাতে না-হয়, সে-কারণে স্রেফ এটুকুই জানিয়ে রাখা যাক যে, জুয়াংদের মূলত দেখতে পাওয়া যায় পড়শি রাজ্য ওডিশার কেওনঝাড়, ঢেঙ্কানল জাজপুর জেলায়। এর মধ্যে জাজপুরের নাগাড়ায় থাকেন জুয়াং উপজাতির প্রায় ৫৮২ জন মানুষ।

জাজপুর জেলার মহাগিরি পাহাড়ের ওপরে হাতে গোনা কয়েকটি ছোট গ্রাম মিলে কালিয়াপানি তহশিল। এই তহশিলেরই আওতায় একমুঠো একটি গ্রাম এই নাগাড়া। জেলা-সদর থেকে গাড়িতে প্রায় ৯৪ কিলোমিটার। দূরত্বের হিসেবে মোটেই খুব বেশি না-হলেও, নাগাড়ায় পৌছনো রীতিমত দুষ্কর। সে কারণেই বছরের পর বছর কোনওরকম উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি গ্রামগুলোয়। রাস্তা না-থাকায়, পৌঁছতে পারেনি কোনও সরকারি সুবিধা। ফলে সাংঘাতিক অপুষ্টি ও সেই-সংক্রান্ত নানা অসুখবিসুখ ছিল এই জনগোষ্ঠীর মানুষের নিত্যসঙ্গী। নাগালের মধ্যে ছিল না কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্রও, ফলে সামান্য জ্বরজারি কিংবা সাধারণ অসুখে মৃত্যুর ঘটনা ঘটত আকছার।

এককথায়, বাইরের পৃথিবীর নজর থেকে নিজেকে একরকম লুকিয়েই রেখেছিল নাগাড়া। নজরে আসে ২০১৬-র জুলাই মাসে, যখন একমাসের মধ্যে অপুষ্টিতে মৃত্যু হয় ১৯টি নবজাত শিশুর।

সরকার, বলা বাহুল্য, সঙ্গে-সঙ্গে পদক্ষেপ করে। শুধু অপুষ্টির মোকাবিলা নয়, অগ্রাধিকারের তালিকায় ছিল অনেককিছুই। স্থানীয় মানুষের জীবিকার সংস্থান, তাদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির বন্দোবস্ত, শিশুদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা— এবং সকলের আগে দরকার উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরি। অতএব, প্রথমে পরিকাঠামো গড়ে তোলার ওপরেই জোর দেওয়া হল। তৈরি হল রাজ্য সড়ক থেকে গ্রামে ঢোকার পাকা রাস্তা, কাটা হল পুকুর, গ্রামে পৌঁছল বিজলি। একশো দিনের কাজের প্রকল্পের আওতায় রাস্তা ও পুকুর-কাটার কাজে যোগ দিলেন স্থানীয়রাই— কাজেই সেটা তাঁদের জীবিকারও একটা সংস্থান হয়ে দাঁড়াল।

তার পরের পর্যায়ে অগ্রাধিকার পেল জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি। গ্রামে বসল স্বাস্থ্যকেন্দ্র, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র খোলা হল শিশু ও আসন্নপ্রসবা মায়েদের জন্য, ইন্দিরা আবাস যোজনার আওতায় পাকা বাড়ি পেলেন গ্রামের মানুষ। একইসঙ্গে সরকার নাগাড়ার মানুষের জীবন ও জীবিকার দিকেও নজর দিল— চর্চা শুরু হল খাদ্য সুরক্ষার বিষয়টি নিয়েও। স্থানীয় উদ্যোগে অপুষ্টি ও অপুষ্টিজনিত ব্যাধির স্থায়ী মোকাবিলার দিশানির্দেশ নিয়েও আলোচনা শুরু হল।

জীবিকার উপায় নিয়ে চর্চা শুরুর পরপরই রাজ্য সরকারের তরফে ওডিশা লাইভলিহুড মিশন নাগাড়ার দায়িত্ব নেয়। সংস্থার অধিকর্তাদের মনে হয়, জুয়াং উপজাতির মানুষকে উন্নয়নের দিশা দেখাতে তাঁদের সঙ্গে মিলেমিশে এবং তাঁদের সামাজিক রীতিনীতি কাছ থেকে বুঝে তবেই কাজে এগোতে হবে। এ-ক্ষেত্রে শুধু তাঁদের জীবিকার কথা ভাবলেই চলবে না, ভাবতে হবে তাঁদের সামগ্রিক উন্নতির কথাও। সেই ভাবনা থেকেই সূত্রপাত ওড়িশা লাইভলিহুড মিশন ও ট্রিক্‌ল আপ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অংশীদারির।

নাগাড়ায় কাজ শুরু হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই ট্রিক্‌ল আপ-এর কর্মীরা বুঝতে পারেন, শুধুমাত্র সরকার অনুমোদিত মাসিক রেশন পৌঁছে দিলেই গ্রামের মানুষের অপুষ্টির সমস্যার সমাধান হবে না। সার্বিক পুষ্টির জন্য শরীর ও মনের সম্পূর্ণ বিকাশ সুনিশ্চিত করতে হবে। এবং তার জন্য অতি অবশ্য প্রয়োজন খাদ্যবৈচিত্র সুনিশ্চিত করা। সন্তানসম্ভবা এবং সদ্যোজাত সন্তানদের মায়েদের জন্য, এবং এক থেকে ছ বছর বয়সি শিশুদের জন্য এটা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ, প্রজন্মান্তরে বাহিত হয়ে চলা অপুষ্টিচক্র ভাঙার আর কোনও উপায় নাগালের মধ্যে ছিল না।

এই সমস্যার সমাধান অবশেষে খুঁজে পাওয়া যায় ২০১১ সালের একটি সমীক্ষা থেকে। ইউনাইটেড নেশন্‌স-এর খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা ‘ফাও’-এর (ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানআইজেশন) সেই সমীক্ষায় জানা যায়, আপনার বাড়ির বাড়ির উঠোন বা নিতান্ত অবহেলায় পড়ে থাকা বাড়ির পিছনের খালি জমিটুকুই হয়ে উঠতে পারে আপনার ‘ফ্যামিলি হেল্‌থ স্পেস’— পরিবারের পুষ্টি সুনিশ্চিত করার যোগ্য জায়গা। একেবারে কম পুঁজিতে গড়ে তোলা এই ছোট্ট শাকসবজির বাগানের মধ্যেই আপনি পেয়ে যেতে পারেন পরিবারের পুষ্টি-সংক্রান্ত যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর।

এই তরিতরকারির বাগানগুলো, বলাই বাহুল্য, গড়ে ওঠে বাড়ির সামনের ও পেছনের জায়গাটাকে যথাযথ ব্যবহার করে। এর দৌলতে, শুধু যে পরিবারের সদস্যরা শাকসবজি ফলিয়ে খিদে মেটাতে পারেন তা-ই নয়, পরিবারের জন্য ব্যবস্থা করতে পারেন একটি সুষম আহার বা ‘ব্যালান্স্‌ড মিল’-এরও। মরসুমি শাকসবজি খেলে শরীর-স্বাস্থ্য ভাল থাকে, এবং পুষ্টির অভাবও মিটে যায়। আশেপাশে যা জৈববর্জ্য পাওয়া যায়, তা থেকেই তৈরি হয়ে যায় জৈব সার। একবার এই বাগান তৈরি হয়ে গেলে, অনেকদিন ধরে একটি পরিবার লাভবান হতে পারে। ইদানীং পুষ্টিবিজ্ঞানে ‘লোকাল ফুডপ্ল্যাটার’ বলে একটি বিষয় নিয়ে খুব আলোচনা হচ্ছে। বিষয়টি হল, দেখা গিয়েছে কোনও বিশেষ অঞ্চলের মানুষদের পুষ্টির চাহিদা মেটানোর বন্দোবস্ত প্রকৃতিই করে রাখে— স্থানীয় শাকসবজির মধ্যে দিয়ে। যেমন, ওডিশাতেই দেখা গিয়েছে, বিভিন্ন জায়গায় প্রচুর সজনেগাছ (স্থানীয় মানুষরা বলেন, ‘মোরিঙ্গা’) গজিয়ে ওঠে, জঙ্গলের মধ্যে, কোনও আদরযত্ন ছাড়াই। সজনেডাঁটা অসম্ভব পুষ্টিকর একটি খাবার, স্থানীয়ভাবে অত্যন্ত সুলভও। খুব কম জায়গাতেই সজনেগাছ তরতরিয়ে বেড়ে ওঠে। ফলে, বাড়ির পেছনের ফাঁকা জায়গায় একটা সজনেগাছ লাগানো কোনও সমস্যাই নয়, যেমন সমস্যা নয় অন্যান্য তরিতরকারির চাষও।

আজ, নাগাড়ার ১২৪টির মধ্যে প্রায় ৬০টি পরিবারেই খরিফ মরসুমের শাকসবজির এই বাগান রয়েছে, ৩৪টি বাড়িতে রয়েছে রবি মরসুমের তরকারিবাগান। আজিম প্রেমজি ফিলানথ্রপিক ইনিশিয়েটিভ-এর (এপিপিআই) সাহায্যে নাগাড়ার বাসিন্দাদের দেওয়া হয়েছে বাগান তৈরির প্রশিক্ষণ। তাঁদের সাহায্যেই জোগাড় হয়েছে বীজ।

শুধু তা-ই নয়, গ্রামবাসীর খাদ্যাভ্যাস পালটাতে, এখন খাদ্যউৎসব পালিত হয় নাগাড়ায়। এই উৎসবের একটাই লক্ষ্য, স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য পেঁপে ও রাঙা আলু যেন তাঁরা খাবার হিসেবে নিয়মিত গ্রহণ করতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। ট্রিক্‌ল আপ-এর কর্মীরা এই উৎসবের মধ্যে দিয়ে গ্রামের মানুষকে এই দুটি সবজির উপকারিতা বুঝিয়ে দেন, রান্নার প্রক্রিয়াও শিখিয়ে দেন। এতে তাঁদের খাদ্যাভাস পালটানোর সঙ্গে-সঙ্গে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার অভ্যেসও গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়।

নিঃসন্দেহে এই শাকসবজির বাগান অপুষ্টির সঙ্গে লড়াই করার একটি বড় এবং সহজলভ্য অস্ত্র। দুর্গম জায়গায় এটি জীবিকার্জনের উপায়ও বটে। আবার সাম্প্রতিক কালের লকডাউনের বাজারে, এই শাকসবজির বাগান নাগাড়ায় মৃত্যুমিছিল থামিয়ে রাখার কাজটাও করে দিতে পারে নিঃসন্দেহে।

তা হলে, আপনার বাড়ির হাতায় ছোট্ট বাগানটির সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী দাঁড়াল? নাগাড়ার মানুষকে জিজ্ঞেস করুন, একগাল হেসে ওঁরা বলবেন, “আপনারা সবজি কিনতে বাজারে যান তো? আমরা সবজির বাজারটাকেই আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছি।” চমৎকার উত্তর, না?

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...