অসঙ্গতির সঙ্গত — ১২তম পর্ব

হিন্দোল ভট্টাচার্য

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

এমন এক অনিশ্চিত সময়ে এই পর্বটি লেখা শুরু করলাম, যখন আমরা সত্যিই একটা সুতোর উপর দিয়ে হেঁটে চলেছি। বিজ্ঞজনেরা বলবেন, আজ বুঝলে, জীবনটা একটা সুতোর উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া? আমরা যে বেঁচে থাকি, সেটাই আশ্চর্যের। কারণ অনিশ্চয়তাই আমাদের এই মহাবিশ্বের শেষ কথা। কিছুই নিশ্চিত নয়। একমাত্র নিশ্চিত কয়েকটিই ধ্রুবকের মান, কিন্তু সেগুলি কেন যে নিশ্চিত তা কেউ জানে না। মানুষ হয়তো এখনও সে কারণ আবিষ্কার করে উঠতে পারেনি বলেই সমস্যা। অথবা এমনটাও হতে পারে, আমরা যেগুলিকে ধ্রুবক  বলছি, সেগুলিও আসলে পরিবর্তনশীল। আমরা তো আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ক্ষমতার ম্যাক্সিমাম পর্যায়ে গিয়েও জগতের যে বৈচিত্র, তাকে ব্যাখ্যা করে উঠতে পারি না। মানুষ কোথায় পশুদের থেকে আলাদা, তার একটা ব্যাখ্যা হচ্ছে, কল্পনা, বিস্ময়বোধ, সৌন্দর্যবোধ এবং বোধকে বিশ্লেষণ করতে পারার ক্ষমতা। যেগুলি মানুষকে অনেক বেশি সৃজনশীল করে তুলেছে বলেই মানুষ আজ নিজেকে যতটা পারে ভালোভাবে রাখার চেষ্টা করে। আর সেই সব প্যারামিটারের প্রেক্ষিতেই বলে, আমরা সভ্য। কিন্তু এই সভ্যতায় স্বাভাবিক ভাবেই এসে থাবা মারে মানুষের মধ্যে থাকা ধ্বংসাত্মক প্রভুত্ববিস্তারের বৈশিষ্ট্য। শুরু হয় দেবতা আর শয়তানের দ্বন্দ্ব। পৃথিবীর যাবতীয় মহাকাব্য এবং পুরাণে এই দেবতা ও রাক্ষসের, শয়তান এবং ঈশ্বরের দ্বন্দ্বই প্রবল। সাহিত্যে এবং ধর্মে শয়তান এবং রাক্ষসের পরাজয় হয়, কিন্তু দেবতাও যে সেখানে অধিকার প্রতিষ্ঠার এক মানব-নির্ধারিত খেলায় মত্ত, সে বিষয়ে আর কিছু বলা থাকে না। অর্থাৎ গড বা ঈশ্বর বা ধর্মকে আর কেউ প্রশ্ন করে না, অনুসরণ করে। এই যে থেমে গেল সব দ্বন্দ্ব, এখানেই পৃথিবীর যাবতীয় মৌলবাদের শুরু।

তবে মৌলবাদ নিয়ে আলোচনা করা এ পর্বের আলোচ্য নয়। আলোচ্য হল একধরনের প্রতীক, ধরে নিই, সেই প্রতীক হলেন স্বয়ং কোভিড-১৯, তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে এলেন। মানুষের অস্তিত্বকে বিপর্যস্ত করতে শুরু করে দিলেন। লাখে লাখে মানুষ আক্রান্ত হল। হাজারে হাজারে মানুষের মৃত্যু হল। এসব কথা সবাই জানেন। কিন্তু কেন যে এই অপ্রত্যাশিত আক্রমণ হল মানুষ জানে না। নানারকম সম্ভাবনার কথা খতিয়ে দেখতে শুরু করল মানুষ। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কীভাবে মানুষ বাঁচবে তার রাস্তা বের করতে পারল না। মানুষ যতই ভাবুক সে পৃথিবীর উপর, প্রকৃতির উপর প্রভুত্ব করতে সক্ষম, আসলে যে তা নয়, এ কথা আরেকবার প্রমাণিত হল। তবু মানুষের অহঙ্কারের শেষ নেই।

মৃত্যুর সামনে মানুষ যতই অসহায় হয়ে যায়, মানুষের অহঙ্কার সম্ভবত আরও বেশি বেড়ে যায়। তখন যতই মানুষ আদিম মানুষের চেয়েও বোকাবোকা কথা বলে চলুক না কেন, মানুষ স্বীকার করতেই চায় না, এবার অন্তত মানুষের একটু চুপ করে থাকার সময় এসেছে। কিন্তু কথা হল, কীকরে বাঁচবে লোকে, কেউ যদি বলে দিত! আর এই বাঁচার সূত্রেই যে অসঙ্গতির কথা মনে আসছে, তা হল, মানুষ মৃত্যুকে ভয় পায় বলেই মৃত্যুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাইছে। আর এই যুদ্ধে মানুষ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গুনে যাচ্ছে সারাবিশ্বের লাশের খতিয়ান। কতজন মারা গেল, কতজন আক্রান্ত হল। করোনার গ্রাফ এবার নিম্নমুখী হল কি? না কি সাইন গ্রাফের মতো আবার ঢেউ হয়ে উপরে উঠে যাবে?

লকডাউন হয়ে থাকাটাই একটা অস্বাভাবিক বিষয়। তার উপর করোনা শুধুমাত্র একটা মারণ ভাইরাস-ই না, একটা মানসিক অসুখ হয়েও দেখা দিচ্ছে আমাদের মধ্যে। যে আতঙ্ক, মানসিক অবসাদ এবং বিচ্ছিন্নতার মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি, তাতে আমাদের সকলের মধ্যে দূরত্ব যে ক্রমশ বাড়বে তাতে সন্দেহ নেই। মানুষ হিসেবে ভাইরাসটির কাছে এখানেই হবে চরম হেরে যাওয়া। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অর্থ তো আর নয় মানুষের সঙ্গে মানুষের চিরবিচ্ছিন্নতা। কিন্তু সেরকম দিকেই হয়তো মানবসভ্যতা এগোবে, যেখানে মানুষ মানুষের স্পর্শেও ভয় পাবে। সেই কতদিন আগে এমনই এক ভয়ংকর সময়কালে জীবনানন্দ লিখেছিলেন- সকলেই সকলকে আড়চোখে দেখে। কথা হল, এই অবস্থা থেকে আমরা মুক্তি পাব কেমন করে? মৃত্যু তো আমাদের ভয় দেখাচ্ছেই ক্রমাগত। যেন রোজ সকলের সঙ্গে দাবা খেলার বোর্ড পেতে বলছে – এসো, দেখি, কে জেতে আর কে হারে। কিন্তু আমরা চরম ভয় পেয়ে আতঙ্কে যেমন ঘরের মধ্যে বসে আছি, তেমন কেউ অতিসাহস দেখাতে বাইরেও বেরিয়ে পড়ছেন। এই অতিসাহস আসলে অতি ভয়েরই লক্ষণ। কারণ সাবধানতা অবলম্বনের যে যুক্তি তা তখন পরিণত হয়ে যায় সংস্কারে। কোনও অভ্যেস যদি সংস্কারে পরিণত হয়ে যায়, তবে স্বাস্থ্যকর অভ্যেসও কুসংস্কার হয়ে যেতে বাধ্য। কথা হল, আমরা যুক্তির সঙ্গে বোঝাপড়া করব না বিশ্বাসের সঙ্গে। তারও আগে কথা হল, আমরা মানসিক ভাবে করোনা আক্রান্ত হয়ে পড়ব না মানসিক ভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করব আর একটু। আমরা তো কেউ জানি না আমরা কে কতদিন বাঁচব! এটা হল প্রকৃত সত্য। তাহলে কেন আমরা প্রতি মুহূর্ত বাঁচব না? কেন আমরা প্রতি মুহূর্ত মরব?

তবে কি আমরা  অবসাদকে, ট্রমাকে ভালোবাসি? আমরা যে এই আগুনের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, এই হেঁটে যাওয়াকে নরকের সঙ্গে তুলনা করছি? না কি ভাবছি আমার জীবনে তো এই অপ্রত্যাশিতর আগমন প্রয়োজন ছিল না। আমার জীবন তো হতে পারত নির্মল স্বচ্ছ নির্জন অথবা আলোড়নে ভরা। কিন্তু ভাই, আপনার জীবন আসলে অনেকগুলি দুর্ঘটনার সমষ্টি। দুর্ঘটনা বললাম এই কারণে, যে, কোনও মুহূর্তে কী ঘটবে তা আপনার নিয়ন্ত্রণে নেই। ফলে, আপনার নিয়ন্ত্রণে আছে, এ কথা মনে করাটাও আপনার কাছে একটা নির্বুদ্ধিতার মতো ব্যাপার। আপাত ভাবে যে সত্যটিকে আপনার সত্য বলে মনে হয়, তা যে সত্য নয়, যে নিশ্চয়তাকে আপনার নিশ্চয়তা বলে মনে হয়, তা যে নিশ্চয়তা নয়, সে সম্পর্কে আবার ভাবার প্রয়োজনীয়তা আছে। কী কারণে আপনি এত সঞ্চয়ী হবেন তা জানি না। জানি না, কী কারণে ছোটখাটো ব্যাপার নিয়েও আপনাদের মধ্যে মারামারি হবে। কী কারণে অকারণ কে কবি আর কে কবি নয় এ নিয়ে আপনাদের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব হবে, তাও আমার অজানা। এ কথাই আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়, যে এই আমাদের ভালো বা খারাপ বলা বা চিহ্নিত করা, এর মধ্যেও রয়েছে একধরনের নিশ্চয়তার বোধ, যে এই মনে হওয়ার উপর খুব কিছু নির্ভর করে আদৌ। আদৌ নির্ভর করে না। সময় নিজের কষ্টিপাথরে বেছে নেবেই। আপনি শুধু আপনার কাজ করে যেতে পারেন। আমি ভালো বা খারাপ বলার মধ্যে খুঁজে পাই এক অভ্যস্ত মিডিওক্রিটি। কারণ বলতে পারি যা তা হল, এই লেখাটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কিনা, আমি এই লেখাটির থেকে কিছু ভাবার, আমার ভাবনাচিন্তাকে কাটাছেঁড়া করার মতো কিছু পেলাম কিনা। এই লেখাটি আমার সৌন্দর্যবোধ আমার মৃত্যুবোধ বা আমার জীবনবোধকে আক্রমণ করল কিনা, অথবা এলোমেলো করে দিল কিনা। অথবা আমি আশ্রয় খুঁজে পেলাম কিনা লেখাটির ভিতর। তাহলে লেখাটিকে সঙ্গে নিয়ে আমি থাকব। লেখাটির সঙ্গে সহবাস করব। আগামী সময়ের দিকেও বাড়িয়ে দিয়ে যাব। খুব সুন্দর ভাবে লেখা, কিন্তু ভিতরে বলার কিছুই নেই, এমন লেখা হল মস্তিষ্কহীন সুন্দরের মতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঝরে পড়ে যাবে।

এমন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি, যেখানে কেউ কারো হাতে হাত রাখতে পারছি না। কেউ কাউকে চুমু খেতেও পারছি না। আলিঙ্গন করতে পারছি না। পিঠে হাত পর্যন্ত রাখতে পারছি না। এই সময়ে আসুন না আমরা একটা রূপকথা লিখি। আমরা এক ভিন্ন সুন্দরের কথা লিখি। লিখি এক অন্য প্রেমের কবিতা। যা এতকাল লিখিত হয়নি। নরকেও তো সূর্যোদয় হয়। কবরের উপরেও ফুল ফোটে। বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখুন পৃথিবী কত সুন্দর হয়ে আছে। প্রকৃতি কিন্তু আমাদের পথ দেখাচ্ছে। আমরা আবার ঘরের সব জানলা বন্ধ রেখে প্রকৃতিকে দেখতে পাচ্ছি না।

আমাদের সামগ্রিকভাবে সেরে ওঠার খুব প্রয়োজন আজ।

 

(ক্রমশ)

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...