অনির্বাণ ভট্টাচার্য
চুল থেকে একটা তরাস আনন্দর পায়ের আঙুল পর্যন্ত নেমে গেল। তাহলে বিপজ্জনক কিছু কি একটা আমার হবে? কিংবা হয়তো হয়েছে। সে ঘাবড়ে গিয়ে চারপাশে একবার তাকাল। প্রতিদিনের মতই লোকেরা হাঁটছে, বাস মোটর রিক্সা চলেছে, শব্দ হচ্ছে, অন্যদিনের থেকে কোনও পার্থক্য নেই। কিন্তু এখন তার চোখে পড়ল তিনতলার পাঁচিল থেকে একটি বাচ্চা মেয়ে প্রায় কোমর পর্যন্ত শরীরটা বার করে ঝুঁকে আছে, রাস্তার কল থেকে অযথা জল পড়ে যাচ্ছে, রেস্টুরেন্ট থেকে ওমলেট ভাজার গন্ধ নাকে এল, রেডিওতে কেউ আবৃত্তি করছে কবিতা। হঠাৎ যেন তার চারপাশের পৃথিবী তাকে স্পর্শ করতে শুরু করল। আনন্দ আশ্বস্ত হয়ে নিজেকে বলল, নাহ, কিছু হয়নি।
নাহ। কিছু হয়নি। কিচ্ছু হয়নি। আমি স্বপ্নের ভেতর দেখছি ছেলেগুলো ফুটবল খেলছে। মাঠ, গ্রাম, রাস্তা, ধর্মঘটের কলকাতা, বৃষ্টি, স্কুল, কাদা। আমার সিঁথি, কাঠগোলা, তোমার, তোমাদের স্পেন। কোথাও কিছু নেই। অসুখ নেই। সংক্রমণ নেই। ফুটবল। মানুষ। ভিড়। গোল। আমার পরের জন্ম। বদলা। আঃ…
মানুষের শরীর নিয়ে কী জঘন্য আমাদের ধারণা! এটাই যেন জীবনের একমাত্র জিনিস। শরীরের আড়ালেই তো আসল জিনিসটা— মন, বুদ্ধি। তবু চেহারাটাই লোকে আগে চায়। চোখ সবার আগে যা দেখে তাই দিয়ে প্রথমেই ধারণা তৈরি করে নেয়। মন দিয়ে কি প্রথমেই দেখা যায় না?
প্রিয় জোসেবা। একটু পর থেকে ডাকছি। নাম ধরে। সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায় আমার এখানে। কেউ কথা বলে না। একজন করে উঠে এসে পাশে বসে। নির্বাক। অনন্তকাল। জীবন অনন্ত। মৃত্যু অনন্ত। প্রদীপদা এসেছে। একটু আগে চুনিদাও এসে বসল। ইনসাইড লেফটের জায়গায়। হেসে বলল, ফিয়াট গাড়ি, স্পনসর, টাকা থাকবে না দেখবি। খেলাগুলো থাকবে। প্রিয় জোসেবা। শরীর না, মন। মন দিয়ে দেখা। শট। সেটপিস। ডজ। সাহিল, টুর্সুনভের সঙ্গে ওয়াল। ওয়ান টাচ। ডান দিক থেকে আশুতোষ মেহেতা। ক্রস। সামনে অরক্ষিত পাপা। বিউটিফুল গেম বাই মোহনবাগান। কমেন্ট্রি। গোল হতে পারে। হেড। কিন্তু না..। অথবা মিনার্ভা। ডান দিক থেকে বল ধরে দুটো ছোট টোকায় ঘুরে লাট্টু জীবন। ঘুড়ি লাটাই জীবন। সামনে সেই পাপা। অথবা আইজল। সেই আশি মিনিট। দুজনকে কাটিয়ে শরীরের দোলা। পাহাড়ের দুজন দীর্ঘদেহী কালো আফ্রিকান এক ঝটকায় শেষ। পাপা। শট। গোলা। ইয়েসসসসসসস…..
প্রিয় জোসেবা। তোমার গিপুজকোয়া। গঞ্জালেজ। ‘দ্য বস’। যেন মনে পড়া ডগলাস ডি সিলভা। হাসি। স্মাইলিং কিলার। নেরোকা ম্যাচ। সেলিব্রেশন না, স্যালিউট। পুলওয়ামা। নিহত সেনাদের কোনও দেশ নেই। শ্রদ্ধা, সম্মানের কোনও দেশ হয় না। সেই গঞ্জালেস। ওর কর্ডোবা। স্পেন। স্যার কিবু। সান সেবাস্টিয়ান, চিজিকুয়েলে থাকা কিবুর বাবা মা। প্যামপ্লোনায় থাকা ভাইয়েরা। ভাল নেই। আমাদের মেদিনীপুর, মানিকতলা, হাওড়া, ধারাভি— ভাল নেই। আমাদের ক্লাব। মোর দ্যান এ ক্লাব। চুক্তি। মেরুদণ্ডহীন সদস্য। সব, সবকিছু মঞ্জুর। শেয়ারে কুড়ি-আশি। গোয়েঙ্কা গ্রুপ। ‘উই উইল রেসপেক্ট ইওর হেরিটেজ’। আয়রনি। টাকা। বড় লিগ। এশিয়া। পৃথিবী। ফুটবলবিহীন কাট আউট। হৃদয়বিহীন হোর্ডিং। ক্লাব। ভাল নেই।
সন্ধ্যার শ্বেত পাথরের মতো ঠান্ডা ছিল মায়ের মেজাজ। প্রতি সন্ধ্যায় এসে আরতি না দেখলে ছটফট করত। ঠাকুরদালানে মা বসত চোখ বন্ধ করে, দুটি হাত কোলে রেখে, গলায় আঁচল, তার প্রান্তে চাবির থোকা। লালপাড় শাড়ির ঘোমটায় ঘেরা, যেন কুমোরের হাতে গড়া মুখ। আনন্দ একদৃষ্টে তখন মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকত। হঠাৎ চোখ খুলে মা তাকাত। তারপর মুচকি হেসে আবার চোখ বন্ধ করত। ফিসফিস করে আনন্দ একদিন বলেছিল, ‘চোখ বুজে থাক কেন?’
–চোখ বন্ধ করলে যে ভাল দেখা যায়।
–কী দেখো?
–আমার আনন্দকে।
মা। বাবা। সম্পর্ক। বাবলু ভটচাজের সময়ে পারিবারিক ট্র্যাজেডির দিন প্র্যাকটিস করতে এসেছিল বাসু। শরীরে শোক, পোশাকে অশৌচ। তবু, প্র্যাকটিস মিস করা যাবে না। শ্যামনগর তরুণ সঙ্ঘ থেকে মোহনবাগান আসতে শুভ ঘোষকে গরিবি পেরোতে হয়েছে। এখনও পেরোচ্ছে। কলকাতা লিগে রেনবো এফসি ম্যাচে নামা উনিশ বছরের ছেলেটা। মিনার্ভা। সেই অষ্টআশি মিনিট। স্পিড। তিন কাঠি। পাশে আশুতোষ। প্রিয় জোসেবা, তুমি জড়িয়ে ধরলে শুভকে। ওর বাবা বিজয় তখন বিগবাজার বিরাটি ব্র্যাঞ্চের গেটে। সিকিউরিটি গার্ড। নওরেমের নর্থ ইস্ট। লড়াই। পাহাড়ি রাস্তার ধারের বস্তি। কেরল ব্লাস্টার থেকে কলকাতায়। লিয়েন। কেন? মোহনবাগান। টান। দ্যাট ক্লাব। ছেলেটা নিজে থেকেই খেলতে চেয়েছিল। নওরেম রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। পাপা। সেনেগাল। প্রিয় জোসেবা, তুমি পাখি দেখেছ? সবুজ পাখি? তোতা? জোস ব্যারেটো। আলাপ হয়েছিল প্রি-সিজন ক্যাম্পে। কোচিং লাইসেন্স পেতে আসা লেজেন্ড। পাশে কিবু। তুমি। লিগের শেষ অবধি পাপার খেলা টিভিতে দেখে থাকতে পারলেন না জোস। ‘আই সি এ বিট অফ মি ইন পাপা।’ চোখে জল। আনন্দের। এখানে, এত এত দূরে আমি একা কাঁদতে পারি না। প্রিয় জোসেবা, তুমি আমার সঙ্গে কাঁদবে, দূরত্বে?
আনন্দর চোখ ভারী হয়ে জড়িয়ে আসছে। রেডিওর ঘরঘর শব্দ যেন সে শুনতে পাচ্ছে। হাজার হাজার মানুষের চীৎকার আর উচ্ছ্বাস একসঙ্গে জট পাকিয়ে যাওয়ার মত শব্দটা। আনন্দর মনে হচ্ছে তাকে ঘিরেই পাক দিচ্ছে বিরাট এই উচ্ছ্বাস।
উচ্ছ্বাস। ওই আশি মিনিট। লম্বা বাঁশি। পাঁচ বছর। চলে যাওয়ার আগে শেষ আগুন। গর্জন। গ্যালারি। রং। আবির। সংক্রমণের ভয়ে খেলা বারণ। কমরোন টুর্সুনভ এক পুলিশের মুখে সবুজ মাখিয়ে দিলেন। কমরোন মানে তেইশ বছর। কমরোন মানে তেইশ পাসের শেষ স্পর্শ। কমরোন মানে তাজিকিস্তান। ভিডিও কনফারেন্সে ভ্যালেন্টাইন মুহূর্ত। দেবারা, এলিজাবেথ, আনি। পাপার কালো চকচকে আফ্রিকা। সুহের, সাহিল, শুভ, আশুতোষ, নওরেম, ধনচন্দ্র, শঙ্কর। ভারতবর্ষ। প্রিয় জোসেবা তোমাদের স্পেন, প্রেসিং, পাসিং, তিকিতাকা। ‘টে কুইরো’। তোমাদের ভাষায়। এত মুখ, এত এত মুখ। ফিরতে পারবে? স্পেন? ডেথ টল কত আজ? নাহ। মৃত্যু না। মৃত্যু বলা পাপ। বলো জীবন। নাহলে পঁচাত্তর মনে পড়বে। সেই ম্যাচটা মনে পড়বে। পাঁচ। অপমান। জ্বালা। থাকতে পারলাম না। একটা নোট….
ফুটবল খেলার মধ্যে লরি ঢুকে পড়ায় ওরা কারখানার হেড দরোয়ানকে বলেছিল, তাড়াতাড়ি মাল খালাস করে লরি সরিয়ে দিতে। লোকটা তাচ্ছিল্যভরে জবাবে বলে, এ জমি তো দত্তবাবুদের। তাদের লরি যতক্ষণ খুশি দাঁড়িয়ে থাকবে। একটি ছেলে বলেছিল, এ মাঠ তো ক্লাবের জমি। তাই শুনে দরোয়ান বলে, ক্লাব তো উঠে গেছে….
ক্লাব উঠে গেছে। বেঁচে গেছে। ভাস্কর সেনাপতি ওড়িশা থেকে এসেছিল। গঙ্গা মালির পাশে মাঠের কাজ করতে করতে এক দশকের মধ্যে ভাস্কর থেকে ভাসিয়া মালি। ভোটার কার্ডের অ্যাড্রেসে লেখা থাকত, মোহনবাগান গ্রাউন্ড। ভিক্টোরিয়ার কাছে একটা গাছে টিঙ্কু দাস ঝুলে পড়ল। বুড়ি চাঁদ। বেনোজল। দু একটা ইঁদুর। আচ্ছা, টিঙ্কুর ঘরে বউ, ছেলেমেয়ে ছিল? জানি না। তবে, ওর মরা কাঠ গায়ে সবুজ মেরুন পতাকা ছিল। জড়ানো। ২০১৭। শিলিগুড়ির ডার্বি। ফিরতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট। সৌম্য, ফুটফুটে ছেলেটা, চলে গেল। আর একটা বোকার গল্প। রামবোকা। পঁচাত্তর। সেই পাঁচ গোল। কী করে ফিরবে? একটা সুইসাইড নোট। ‘এ অপমানের জ্বালা ভুলব না। পরের জন্মে মোহনবাগান ফুটবলার হয়ে জন্মাব। এই অপমানের শোধ তুলব’। শোধ। আমাদের সেইসব দিনগুলোর শোধ ওঁরা নিয়ে নিল। ওঁরা। কারণ কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। ‘বিশেষ পরিকল্পনা’। শুনেছিলাম, ক্লাব সদস্যরা মিটিংয়ে তেমন আপত্তি করেননি। প্রাক্তনেরাও তেমন কিছু না। যারা কেঁদেছে, আড়ালে। অবিশ্বাস। প্রিয় জোসেবা, তোমাদের ড্রিম সিজন শেষ এক মরসুমেই। খুব চাইছিলাম, লিগ যেন শেষ না হয়। যেন কাশ্মির থেকে কলকাতা ফিরতে বছরখানেক লাগে। লুধিয়ানা থেকে মারগাঁও আরও এক বছর। হল না। শেষ হল। ভারতসেরা। ইতিহাসচ্যুত। পাশাপাশি। কোনটা নেব? উইম্বলডনের সেন্টার কোর্ট। দরজার উপর। জোসেবা, ওখানে গেলে কিপলিং-এর কবিতা দেখবে। ‘ইফ….’। ‘ইফ ইউ ক্যান মিট উইথ ট্রিউম্ফ অ্যান্ড ডিজাস্টার, অ্যান্ড ট্রিট দোজ টু ইম্পস্টার্স জাস্ট দ্য সেম’। ডিজাস্টার। নিউ সিজন। জায়গা নেই। কুড়ি আশির শেয়ারে তিন চারজনের বেশি জায়গা নেই। স্যার কিবুর জায়গা নেই। তিকিতাকার জায়গা নেই। ফড়িয়াপুকুর, মোহনবাগান লেনের ওই গলিগুলো, ট্রাকের পর ট্রাকে বোঝাই আমাদের ছেলেরা, জয় মোহনবাগান চিৎকার, কান্না, অভিলাষ-হীরালাল-শিবদাস, ক্লাব, ক্লাবের উপরে আসলে একটা ইনস্টিটিউশন, ইতিহাস— জায়গা নেই। অথবা থাকলেও ওই কুড়ির ভেতর, আসলে, স্মৃতির ভেতর। বাকি আশি? নাম না জানা কাট আউট, নামের আগে ফ্র্যাঞ্চাইজি, ফুটবলের সঙ্গে বিন্দুমাত্র সম্পর্ক না থাকা প্রচারসর্বস্ব ক্রিকেট মালিক, বিজনেস টাইকুন— এই স্বপ্নের মরসুমের পর কারা, কোন ফর্ম্যাটে কাদের নিয়ে খেলাবে বহুদিন শতাব্দী পেরোনো আমাদের ক্লাবের নিয়তি? তাদের তো চিনি না!
কাল রাতে আমি ডাক্তার হয়েছিলাম। বিরাট কেউ নয় খুব অখ্যাত সার্জন। কেউ সাহস পাচ্ছে না— একটা হার্টবদল করার অপারেশন, পিজি হাসপাতালে। আমি গিয়ে বললাম, আমি করে দেব। ওরা বিশ্বাসই করতে চাইছিল না। যাই হোক, শেষকালে রাজি হল, কেননা …’
–কেননা, ছেলেটা এমনিই তো মারা যাবে।
–ছেলেটা! কে বলল?
–আমি জানি, তারপর?
–আধঘণ্টা ধরে করলাম।
–সাকসেসফুল?
–নিশ্চয়ই। এখন আবার সে নেটে প্র্যাকটিস শুরু করেছে …
শেখ সাহিল ডাক্তার হয়নি। ফুটবলার হয়েছে। মহামারিকালে ব্যারাকপুরের কাছে নোনাচাঁদপুকুরে রেশন বিলি করছে। এ সরকার, এ মহামারি সব এক। গরিবদের খেতে দেয় না। শাহিল, শাহিলেরা আলাদা। অন্য দেশ। স্যার কিবু ছাত্রের পাশে দাঁড়িয়েছেন। অর্থসাহায্য। তবে, ক্যামেরার আড়ালে। পূর্ব বর্ধমান মেরিনার্স। আকাশদীপ। সায়ন। করোনায় সারাদিনরাত করা পুলিশকর্মীদের মাস্ক, স্যানিটাইজার বিলি করছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে গ্লুকোজ, জল। নবাবহাট, তেলেপুকুর, বীরহাটা, উল্লাসমোড়। কোথায় না? বর্ধমান মেডিকেল কলেজের ব্লাড ব্ল্যাঙ্কে রক্ত। একটা ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প। এই বিভীষিকার সময়ে। পূর্ব বর্ধমান পেরেছে। মেরিনার্স পেরেছে। বাগুইআটির ঋত্বিক ঘোষের থ্যালাসেমিয়া। কতদিন? মাঝে মাঝেই রক্ত। এবার আরও ক্রিটিকাল। আবার মেরিনার্স। একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ। সবুজ মেরুন পতাকা। গ্রুপ লোগো। বাতাসে টানটান। না, কয়েকদিন খেলার খবর না। আহ্বান, রক্ত চাই। রক্ত এল। ফুটবলপাগল ঋত্বিক এখন ভাল আছে। শাহিল, সুহের, সায়ন, সৌম্য। গ্যালারির সেই টিফোটা। সেই টিফোটাই শেষ কথা, জোসেবা। ‘ডিভাইডেড বাই রিলিজিয়ন, ইউনাইটেড বাই মোহনবাগান’। স্বপ্ন!
স্বপ্নে তুমি যা খুশি হতে পারো। স্বপ্ন দেখে তারাই যাদের মন আছে, মন আছে। দুর্বল লোকে স্বপ্ন দেখতে পারে না, আমার অনেক ইচ্ছে আছে, জানি সেগুলো পূরণ হওয়া সম্ভব নয়, তাই স্বপ্নে পূরণ করি। ….। নিজেকে বিরাট মনে হয় সেই পৃথিবীতে, তাই সারাক্ষণ সেখানেই থাকি। ….। একটা পাঁচ বছরের বাচ্চাকেও আমি দৌড়ে হারাতে পারব না। কিন্তু আমি সাড়ে ন’ সেকেন্ডে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করে বোরজভকে হারিয়েছি মিউনিখে। বিকিলাকে হারিয়েছি ম্যারাথনে।
ঠিক যেমন এত দূর থেকে আমি কোথাও আসতে পারি না। তবে, স্বপ্নে চলে গেছি যুবভারতীর সাইডলাইনে। দেশ, পৃথিবী অসুখমুক্ত। একটা ম্যাচ। জীবনের শেষ ম্যাচ। ডিল। জিতলে দল থাকবে, ক্লাব থাকবে, ফুটবল থাকবে, ইতিহাস থাকবে। হারলে শেষ, মার্জিং, সুপার লিগ। পাশাপাশি অমলদা, প্রদীপদা, চাটুনি, বাবলু ভটচাজ, সত্যজিৎ, সঞ্জয়— কিবুর পাশে বসে। শুরুর দিকে গোল মিস করে পা চাপড়াচ্ছে বাবলু। পাশ থেকে কাঁধে হাত। ফর্ম্যাট থেকে সরে এসো না মেট। মানুষ তোমার পাশ থেকে সরবে। তুমি তোমার থেকে সোরো না। এক ম্যাচে এক, দু ম্যাচে এক, তিন ম্যাচে চার, তারপর ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে একদিন। দেবজিৎ মজুমদার বলটা ফিস্ট করে বার করে দিলে ক্লিয়ার করছে আরেক দেবজিৎ। ঘোষ। বাবলু ওকেই উত্তরসূরি বলেছিল। পেয়ে গেছে ব্যারেটো, দেখছে কাকে দেবে, যীশু লেখা সবুজ গেঞ্জি লোকটাকে চিরকালীন টিম লিডার ছাড়া আর কিছু হতে শেখায়নি। পাশ থেকে হাসতে হাসতে আসা গঞ্জালেজের সঙ্গে ওয়াল খেলে বল শেষমেশ কাৎসুমির কাছে। টিম বদলালেও আমাদের এগেইনস্টে গোল করলেও ও কোনও সেলিব্রেশন করেনি তারপর থেকে। সেই কাৎসুমি। বল এখন সনির কাছে। গ্যালারিতে বসা ফেয়ারওয়েলের দিন কাঁদতে কাঁদতে পা জড়িয়ে ধরা লোকটাকে স্যালিয়ুট জানাল হাইতিয়ান। নিজেদের মধ্যে দেওয়া নেওয়া করে খেলা। এগারো নেই। একুশ নেই। সংখ্যা নেই। আছে নাম। মুখ। চোখ। স্বপ্নে আমি যা ইচ্ছে করতে পারি। স্বপ্নে আমি এগারো থেকে বেরিয়ে একশো এগারোয় উঠতে পারি। বলতে বলতে বল পেয়ে গেছেন বাসুদেব। চোরাগোপ্তা লাথি। ঐতিহ্যকে খেলতে দিচ্ছে না বিজনেস, গ্ল্যামার। রক্তাক্ত বাসুর হাত ধরে ওঠাচ্ছেন দীপেন্দু। সাইডলাইনের কাছে ছটফট করা চিমা। কালো চিতার হাসি। এই বয়সেও নামবেন? অমলদা? বাসুদেবের ছোট্ট শরীরে একা মাঝমাঠ। দুপাশ থেকে জেমস, দুলাল বিশ্বাস। লোলেন্দ্র, রেনেডি ওয়ার্ম আপ করছে। অপেক্ষায় জেজে, সুরকুমার, ধরমজিত। সেই সময়। যখন পাহাড় মানে মোহনবাগান। মণিপুর মানে মোহনবাগান। কে নামবে? কখন? রেফারি ঘড়ি দেখছে। যেকোনও মুহূর্তে শেষ বাঁশি। গোল হচ্ছে না। বল দখলে রেখেও গোল হচ্ছে না। আর এক মিনিট। কিবু হাসছেন। পাসিং, তিকিতাকা। আসবেই কিছু একটা। বাসুর থেকে বল প্রিয় জোসেবা বেইতিয়া, তোমার পায়ে। চকিত টার্ন। শরীর নেই। একটা ফর্সা টুকটুকে ছেলের মাথা। গ্যালারি বিশ্বাস করছে না এই ফুটবল। তুলে তুলে খেলা গোল বাঁচানোর ‘বেশ করেছি আবার করব’ ফুটবল ছেড়ে এ কোন ফর্ম্যাট! পাস, পাস, পাস। ময়দানি ফুটবল ভাষা পাল্টে ফেলেছে। স্ল্যাং নেই, অধৈর্য অশ্লীলতা নেই, ভরসা আছে, গোল আসবেই। বারাসাত লেডি মেরিনার্সের আশি বছরের শান্তি চক্রবর্তীর কাঁপা কাঁপা গলায় গান। আমাদের সূর্য মেরুন। তিরিশ সেকেন্ড। আকাশবাণী থেকে কমল ভটচাজ, পুষ্পেন সরকার থম মেরে বসে। মাথায় হাত দিয়ে সুকুমার সমাজপতি। অজয় বসু তখনও বলে যাচ্ছেন, ফুল কাঁটা কিছুই মিথ্যে নয়। এ দল হারতে পারে না। তিরানব্বই মিনিটে জোসেবা, তোমার ডিফেন্স চেরা পাস পাপার কাছে। গ্যালারি দাঁড়িয়ে পড়েছে। পাপা শট নেবে? গোলার মতো? কালো আফ্রিকা থেকে এসেছে মার্কোস, সেরিকি, কর্নেল গ্লেন। কালো আফ্রিকায় রোজ অসুখ, কষ্ট, শ্রম, স্লেভারির ইতিহাস। ওখানে মহামারি পারবে না কিছু করতে। সেনেগাল। পাপা। শটের আগের মুহূর্ত। নাঃ। বল তো জালে গেল না। তাহলে কি…? আবার চোখ খুলল গ্যালারি। পাপার ছোট্ট টোকায় শুভ। বাংলার ইতিহাস। বাঙালি। শুভর চোরা স্পিড। সিকিউরিটি গার্ড বাবা গ্যালারিতে, চোখ ঝাপসা। সেই মিনার্ভা ম্যাচ। শট। গ্যালারি। গোল হতে পারে। এবং …….
আমার চোখদুটো জলে ভরে গেল। তার ওপরই ঝলমল করে উঠল নরম আভা নিয়ে বুকের মধ্য থেকে ফুটে ওঠা মিষ্টি রোদ।
মনে মনে বললাম, এত খেলা, চারদিকে এত খেলা!
ইতি, উমাকান্ত পালোধি…
কৃতজ্ঞতা : মতি নন্দী
অনেক দিন পর খেলা নিয়ে ভাল লেখা পড়লাম একটি। কৃতজ্ঞতা স্বীকারে মতি নন্দীর নাম — লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়াল।