কুটিল আবর্তে করোনার বায়োলজি— বিশ্বরাজনীতি এবং কর্পোরেট পুঁজির ঊর্ণজাল

জয়ন্ত ভট্টাচার্য

 



লেখক চিকিৎসক, গবেষক ও জনস্বাস্থ্য কর্মী

 

 

 

এ যেন মৃত্যু মিছিল চলছে। ১৯.০৪.২০২০-র হিসেব অনুযায়ী বিশ্বে করোনা (শুদ্ধ করে বললে সার্স-কোভিড-২) আক্রান্ত ২৩ লক্ষ ৩০ হাজার। মৃতের সংখ্যা ১,৬০,০০০। শুধু আমেরিকাতে মৃতের সংখ্যা ৩৯,০০০-এর বেশি। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন (NEJM)-এ প্রকাশিত প্রবন্ধ[1] অনুযায়ী— “As the pandemic focuses medical attention on treating affected patients and protecting others form infection, how do we best care for people with non-Covid disease?” নিতান্ত বাস্তব প্রশ্ন। প্রতিটি দেশে, এমনকি আমেরিকার হাসপাতালগুলোতেও, রোগীর সংখ্যা সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। NEJM-এ লেখা হচ্ছে[2] যে আমরা এতদিন ধরে জোড়াতালি দিয়ে যেভাবে স্বাস্থ্যব্যবস্থা চালিয়ে এসেছি তাতে দ্রুত, সমন্বয়যুক্ত রাজনৈতিক অ্যাকশন নিতে হবে। হুবহু ইংরেজিতে এরকম– The patchwork way we govern and pay for health care in the United States is unravelling in this time of crisis, leaving millions of people vulnerable and requiring swift, coordinated political action to ensure access to affordable care. একই সঙ্গে CNN সংবাদসংস্থা আরেকটি সতর্কবাণী করেছে বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার ব্যাপারে— A new World Bank report warns the spread of Covid-19 could bring recession to countries in East Asia and the Pacific and push 11 million people into poverty. অস্যার্থ, পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মন্দার ফলে ১ কোটির বেশি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়বে। প্রশ্ন হল কেন এমনটা হল? এতটাই অপ্রস্তুত অবস্থায় রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশেরা? আমাদের এবার একটু পেছনে ফিরে দেখতে হবে।

 

পেছন ফিরে দেখা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও আগের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার মুখে ১৯১৭ সালে এক নতুন ধরনের দেশ তৈরি হল— রাজনৈতিক চরিত্রে, অর্থনৈতিক পরিচালনায়, সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জগতে, নারীর মানুষ হিসেবে উন্মেষে, এবং, সর্বোপরি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-জনস্বাস্থ্য-গণবন্টন ব্যবস্থায়। বিশ্বে এই নতুন জায়মান দেশের পরিচিতি ছিল সোভিয়েত সমাজতন্ত্র হিসেবে। কিন্তু আমাদের আলোচনায় শুধু এটুকু বুঝতে চাইব— Another World is Possible. হ্যাঁ, অন্য এক পৃথিবীর স্বপ্নসম্ভব জীবনের মহাকাব্য রচনা হচ্ছিল মানুষের স্বপ্নে, বুদ্ধিজৈবিক সৃষ্টিতে। এসব ইতিহাস আমরা সবাই জানি— কেউ মানি, কেউ মানি না। এরপরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে হিটলারের চূড়ান্ত পরাজয় নিশ্চিত হবার পরে আমেরিকা-ইংল্যান্ড-ফ্রান্স-জাপানের অর্থনৈতিক মডেলের বাইরে, সাংস্কৃতিক চেতনার বাইরে যে আরেকভাবে পৃথিবীকে দেখা যায়, পৃথিবীতে বিচরণ করা সম্ভব সেটা মূর্ত হয়ে উঠল। ১৯৪৯-এ আরেকটি বিশাল দেশ চিন একই ধরনের রাজনৈতিক পরিচালনা, একই ধরনের মতাদর্শগত বিশ্বাস নিয়ে মুক্ত হল। আরেকবার এক গভীর প্রত্যয় সমাজের উচ্চকোটি বুদ্ধিজীবী সমাজ থেকে মধ্যবিত্ত, গ্রামের চাষাভুষো মানুষ থেকে কারখানার মজুর সবার মাঝে উপ্ত হল, সামাজিক বাস্তব হল– Another World is Possible. অর্থাৎ, বিশ্ব তখন আজকের মতো একমেরু নয়। সেদিন পৃথিবীতে ছিল দ্বিমেরু বিশ্বের শক্তিময় উপস্থিতি। আর এর ফলে বিশ্বের দুর্বল দেশগুলোর দরকষাকষি করার ক্ষমতা বেশি ছিল।

স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে এর প্রতিফলন দেখা গেল— এক বড় সংখ্যক দেশে নীতি হিসেবে গৃহীত হল কমিউনিটি-কেন্দ্রিক বা horizontal programs। এর বিপরীতে ইন্সিউরেন্স কোম্পানি এবং কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে প্রয়োজন রোগ-কেন্দ্রিক বা vertical programs। করোনা অতিমারি আজ একমেরু বিশ্বে দানবীয় ফার্মা কোম্পানি এবং নিওলিবারাল পুঁজির বাহক রাষ্ট্রগুলোর সামনে নতুন করে রোগ-কেন্দ্রিক বা vertical programs-কে একমাত্র স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং প্রোগ্রাম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং বাস্তবায়িত করার সুবর্ণ মুহূর্ত তৈরি করেছে। মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্য চুলোয় যাক। চাই আইসিইউ আর ভেন্টিলেটর। পরবর্তীতে এই হাই-টেক চিকিৎসার ধরন আরও বেশি জনগ্রাহ্যতা অর্জন করার সম্ভাবনা রইল। স্বাস্থ্য-র সংজ্ঞা রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে (আরও বেশি করে যাবে) বহুমূল্য স্বাস্থ্যপরিষেবাতে। সাধারণ মানুষের কাছে দুটোই একরম মনে হবে— ম্যাকডোনাল্ড বা কেএফসি-র মতো।

এখানে যেটা প্রধান হয়ে এল সেটা হল আমেরিকা-ইংল্যান্ড-ফ্রান্স-জাপান এতদিন ধরে (প্রায় ২০০ বছর) সর্বজনীন শিক্ষা-স্বাস্থ্য-জনস্বাস্থ্য-কাজের অধিকার-খাদ্যের অধিকার-বাসস্থানের অধিকার নিয়ে যে পথে চলে এসেছে তার বিকল্প আরেকটা রাস্তা আছে। এ রাস্তায় কার্টেলের (কর্পোরেটদের পিতৃপুরুষ) বদলে সমবায়ের ভাবনা আছে। এ রাস্তায় ব্যক্তির লাভালাভ একমাত্র বিষয় না হয়ে সমাজ ও সমষ্টির প্রাধান্য আছে। রবীন্দ্রনাথের বলা (যদিও একুশ শতকের পৃথিবীতে তার কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্ক এবং মতদ্বৈধ প্রত্যাশিত) গ্রামসভার কথা, গ্রামের সমূহকে ব্যবহার করে গ্রামে পুকুর খোঁড়া, গ্রামকে পরিচ্ছন্ন রাখা, গ্রামের সিদ্ধান্ত প্রাথমিকভাবে গ্রামে নেওয়া (প্রসঙ্গত সমধর্মী ধারণা গান্ধিজিরও ছিলো) এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো মানুষের বোধে জারিত হতে শুরু করেছিল। অন্য একটা প্রসঙ্গও যারা ভাবনাচিন্তা করে তাদের চিন্তায় এল– জনস্বাস্থ্যের (পাবলিক হেলথ) এবং ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের (ক্লিনিক্যাল হেলথ) মধ্যেকার সম্পর্ক কী হবে? কীভাবেই বা এ দুয়ের মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক ও টানাপোড়েন মেটানো হবে? স্থানীয় উদ্যোগকে কীভাবে সংগঠিত করা হবে? রাষ্ট্রের পরিকল্পনার সঙ্গে একে সম্পর্কযুক্ত করা হবে কী পদ্ধতিতে? আমরা চিকিৎসক-চিকিৎসাকর্মী এবং চিকিৎসাপ্রার্থী সাধারণ মানুষ যদি রাষ্ট্রের শেখানো, কর্পোরেটদের বোঝানো আর পুঁজি-অনুগামী মিডিয়া উৎপাদিত তথ্যকেই (জ্ঞানও কি?) একমাত্র ও অভ্রান্ত বলে ধরে না নিই তাহলে আমাদের বড় প্রিয়, আমাদের একান্ত আশ্রয় এই পৃথিবীতে অন্য কী কী সম্ভাবনা খুলেছিল সেগুলো আমাদের আরেকবার বুঝে নেওয়া দরকার– Overton window-র বাইরে এসে।

এ ব্যাপারে উন্নত পুঁজিবাদী তথা সাম্রাজ্যগর্বী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ইংল্যান্ড সবচেয়ে বেশি সমাজবদ্ধতা দেখিয়েছিল। আমেরিকান পরিভাষায় “সমাজতান্ত্রিক” কাঠামো চালু করেছিল। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে এড্যুইন চ্যাডুইক, জন স্নো এবং সাহিত্যিক চার্লস ডিকেন্সের সক্রিয় অংশগ্রহণে ভিকটোরীয় ইংল্যান্ডের পানীয় জলের সরবরাহের সংস্কার কলেরা প্রতিরোধ এবং সাধারণ জলবাহিত অসুখের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। এরপরের ইতিহাস এখন আমাদের বর্তমান আলোচনার জন্য খুব প্রয়োজনীয় নয়। শুধু এটুকু উল্লেখ করি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেই ইংল্যান্ডে National Health Service (NHS) তৈরি হল। উল্লেখ করার মতো হল ১৯৪৮-এর জুন মাসে প্রতিটি বাড়িতে একটি লিফলেট বিলি করা হয়েছিল। তাতে লেখা ছিল– It will provide you with all medical, dental and nursing care. Everyone- rich and poor, man, woman or child – can use it or any part of it. There are no charges, except for a few special items. There are no insurance qualifications. But it is not a “charity”. You are all paying for it, mainly as tax payers, will relieve your money worries in time of illness.

সেই সময়ে দুটি দেশে দুরকমের ঘটনা ঘটছিল। সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষে Bhore কমিটির রিপোর্ট (অনেকটা ব্রিটেনের আদলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপরে জোর দিয়ে) বাস্তবায়নের একটা আঁধখ্যাচড়া চেষ্টা চলছিল। আর সেসময়েই আমেরিকাতে শুরু হয়ে গেছে ইন্সিউরেন্সের যুগ, শুরু হয়েছে কর্পোরেট হাসপাতালের নতুন অধ্যায়। নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে সমগ্র বিশ্বকে ইন্সিউরেন্স এবং কর্পোরেট পুঁজির জালে বেঁধে ফেলার।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো যে মেডিক্যাল পরিষেবাকে মুক্ত বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার এবং একটি প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্র হিসেবে দেখার প্রথম প্রস্তাব আসে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ কেনেথ অ্যারো-র সুবিখ্যাত গবেষণাপত্র “Uncertainty and the Welfare Economics of Medical Care”-তে। এ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল The American Economic Review-এ ১৯৬৩ সালে। মজার ব্যাপার হল জনস্বাস্থ্য নিয়ে WHO-র অবস্থান সাম্রাজ্যবাদ এবং কর্পোরেট পুঁজির চাপে যখন ক্রমাগত বদলে বদলে যাচ্ছে, সঙ্কুচিত হচ্ছে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্র এবং সবার জন্য স্বাস্থ্যের প্রসঙ্গ, তখন অর্থাৎ ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে WHO-র মুখপত্র Bulletin of the WHO-তে কেনেথ অ্যারো-র লেখাটির নির্বাচিত অংশ ছাপা হল। মূল লেখাটি ৩৩ পৃষ্ঠার, WHO ছেপেছিল ৯ পৃষ্ঠা। অ্যারো তাঁর অবস্থান প্রবন্ধের গোড়াতেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন– “the subject is the medical-care, not health. The causal factors in health are many, and the provisio of medical care is only one.” এরপরে তিনি “analysis of the medical-care market”-এ প্রবেশ করেন। বলেন– “in the analysis of the medical-care market is comparison between the actual market and the competitive model…” ইন্সিউরেন্সের প্রসঙ্গ আনেন অ্যারো– “It is frequently observed that widespread medical insurance increase the demand for medical care.” এক অদ্ভুত যুক্তিজালের মধ্যে আমরা প্রবেশ করলাম– একদিকে, ইন্সিউরেন্সের প্রসঙ্গ এল স্বাস্থ্য পরিষেবার জগতে; অন্যদিকে, ইন্সিউরেন্সের বহু বিস্তৃত ব্যবহার যে স্বাস্থ্য পরিষেবার চাহিদা বাড়াবে এ প্রসঙ্গও চলে এল। কিন্তু তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি যে পণ্য দুনিয়ার অন্য ক্ষেত্রের মতো এখানে শুধু কেনাবেচার-র সম্পর্ক নয়– একজন ব্যক্তি মানুষের অন্যের স্বাস্থ্য নিয়েও চিন্তা ও উদ্বেগ থাকে যা পণ্য জগতের অন্য ক্ষেত্রে দেখা যাবে না। তাঁর অভিমত– “The economic manifestations of this taste are to be found in individual donations to hospitals and to medical education, as well as in the widely accepted responsibilities of government in this area.” KFC, Nike কিংবা অ্যাডিডাসের ক্ষেত্রে আমরা নিশ্চয়ই এ দৃশ্য দেখতে পাব না।

প্রসঙ্গত আমরা স্মরণ করব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে পারমাণবিক বিস্ফোরণের প্রয়োজনে নতুন নতুন প্রযুক্তির জন্ম হয়েছিল (যেমন নিউক্লিয়ার অ্যাক্সিলেরটর, যার ফলিত চেহারা সিটি স্ক্যানার, এমআরআই ইত্যাদি) এবং এর জন্য স্বাভাবিকভাবেই বিপুল অর্থের বিনিয়োগ হয়েছিল। যুদ্ধোত্তর সময়ে এই বিনিয়োগের পরবর্তী দীর্ঘকালীন মুনাফা ধরে রাখার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে এ সমস্ত প্রযুক্তি রফতানি নিতান্ত জরুরি হয়ে পড়ল। মেডিসিনের জগৎ এক্ষেত্রে সবচেয়ে সফল ও কার্যকরী অবস্থা তৈরি করতে পেরেছিল। কারণ সহজেই অনুমেয়। পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব মুহূর্ত থেকে সবসময়েই মানুষের স্বাস্থ্য ও অসুস্থতা একসঙ্গে সহাবস্থান করে। ফলে অসুস্থ মানুষ মেডিসিনের ও চিকিৎসকের ওপরে নির্ভর করবেই এবং এর সঙ্গে সমগ্র চিকিৎসা ব্যবস্থাকে যদি প্রযুক্তি নির্ভর করে তোলা যায় তাহলে অসুস্থতা থেকে আহরণ করা অবাধ মুনাফা নিয়ে দুশ্চিন্তা কমে যায়। এর পূর্বশর্ত দুটি– (১) চিকিৎসাকে মুক্ত বাজারের অর্থনীতির আওতায় আনতে হবে এবং সাধারণ জনসমাজকে এই অর্থনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী করে তুলতে হবে, (২) স্বাস্থ্য-র এবং “সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা”-র (comprehensive primary health care) ধারণাকে স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং “বেছে নেওয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা”-র (selective primary health care) ধারণা দিয়ে ধীরে ধীরে প্রতিস্থাপিত করতে হবে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে স্বাস্থ্য পরিষেবাকে পূর্ণত মুক্ত করে ফেলতে হবে। গবেষকেরা দেখিয়েছেন কিভাবে ১৯৭০ পরবর্তী সময়ে নয়া-উদারবাদী স্বাস্থ্যনীতি “have shifted resources from the public to the private sector, reduced benefits to recipients, and affected the lives of clients and workers alike.”[3]

আমরা গত শতাব্দীর ৬০-৭০-এর দশকের কথা ভাবি। দীর্ঘকালীন উপনিবেশিকতার পরে এশিয়া, আফ্রিকা আর লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর একটা বড় অংশ ধীরে ধীরে স্বাধীনতা অর্জন করছে। দুটি বিষয় এসব দেশের কাছে গুরুত্ব নিয়ে হাজির হল। একদিকে, নিজস্ব যা যৎসামান্য সম্পদ আছে (বিশেষ করে মানব সম্পদ) তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে; অন্যদিকে, যুদ্ধ-দারিদ্র্য-বুভুক্ষা-দীর্ণ অগণন মানুষের কাছে স্বাস্থ্যের ন্যূনতম সুযোগ পৌঁছে দিতে হবে। ১৯৬৭ সালে একটি গবেষণা দেখাল— Some developing countries have developed health care programmes at the most peripheral level to meet the health and development needs of the deprived populations. Each experience has followed a particular approach. China uses mass education programmes and “barefoot doctors” to deliver primary health services.[4] এদের আলোচনায় স্পষ্টভাবে বলা হল চিনে নগ্নপদ চিকিৎসক বা “barefoot doctors” এ সমস্যার অনেকটা সমাধান করেছে। এছাড়াও তানজানিয়া, কিউবা, ভেনেজুয়েলা এবং নাইজেরিয়াতে প্রায় একইরকম পদ্ধতিতে ফল পাওয়া যাচ্ছে। পৃথিবীতে সূচনা হল প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার ধারণার। ১৯৬০-এর দশকের শুরু থেকেই মেক্সিকোতে ডেভিড ওয়ার্নার-এর (সুবিদিত গ্রন্থ Where There Is No Doctor-এর লেখক) উদ্যোগে তৃণমূল স্তরে গ্রামের সাধারণ মানুষকে সামিল ও প্রশিক্ষিত করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকে সুরক্ষিত করার উদ্যোগ শুরু হয়েছিল। লাতিন আমেরিকার অনেকগুলো দেশেই ওয়ার্নারের প্রভাবে জনস্বাস্থ্য আন্দোলন পরিব্যাপ্ত হয়েছিল। আমাদের ভারতে শুরু হয়েছিল জামখেদ আন্দোলন যা পরে জনস্বাস্থ্য অভিযান-এর রূপ নেয়।

একেবারে হালে পৃথিবীর চিকিৎসক মহলে সবচেয়ে মান্য NEJM-এ এমন মন্তব্য করা হয়েছে যে আমেরিকা থেকে আগত একজন পর্যটকের কাছে কিউবা “অবাস্তব” এবং “মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতো মনে হয়”। হুবহু জার্নালের ভাষায় বললে— For a visitor from the United States, Cuba is disorienting… Cuban health care system also seems unreal. There are too many doctors. Everybody has a family physician. Everything is free, totally free— and not after prior approval or some copay. The whole system seems turned upside down. It is tightly organized, and the first priority is prevention. Although Cuba has limited economic resources, its health care system has solved some problems that ours has not yet managed to address. [আমেরিকা থেকে আগত একজন পর্যটকের কাছে কিউবা মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতো… কিউবার স্বাস্থ্য পরিষেবার বিষয়টি কেমন অবাস্তব বলে মনে হয়। প্রত্যেকের একজন করে পারিবারিক চিকিৎসক আছে। সমস্ত কিছু বিনামূল্যে— কোনও ইন্সিউরেন্স কোম্পানির আগাম অনুমোদন ছাড়াই। সমস্ত ব্যবস্থাটি মনে হয় আপাদ-মস্তক উল্টে আছে। সমগ্র ব্যবস্থা সুশৃঙ্খলভাবে সংগঠিত, এবং প্রাথমিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে প্রতিরোধ বা প্রিভেনশন-এর ওপরে। যদিও কিউবার অর্থনৈতিক সামর্থ্য নিতান্ত সীমিত, এর স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থা এমন কিছু সমস্যার সমাধান করেছে যা আমাদের ব্যবস্থা এখনো নজর করে উঠতে পারেনি।][5] কিউবাতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং জনস্বাস্থ্যের ওপরে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়।

মোদ্দা বিষয় হল, ১৯৭০ থেকে ১৯৭৮-এর মধ্যে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশেও জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের বিভিন্ন রূপ তৈরি হতে থাকে। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৮-এর মধ্যে চিন সোভিয়েট রাশিয়ার সহযোগিতায় এবং আফ্রিকার কয়েকটি দেশের সমর্থনে হু-কে তৃণমূল স্তরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে প্রসারিত করা এবং রোগের ক্ষেত্রে সামাজিক ভূমিকার ব্যাপারে আরও বেশি যত্নবান ও সক্রিয় হওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। এক গবেষক দেখিয়েছেন, যদিও সোভিয়েট রাশিয়া ১৯৪৯-১৯৫৭ পর্যন্ত সময়ে হু-র সদস্য ছিল না কিন্তু হু-র বাৎসরিক বাজেটের ৬ শতাংশ জোগাত এ দেশটি। ১৯৫৯ সালে সদস্য হবার পরে এর পরিমাণ বেড়ে হয় ১৩ শতাংশ।[6]

 

১৯৭৮– সকলের জন্য স্বাস্থ্য, ২০০০ সাল

একদিকে চিন থেকে কিউবা পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে অর্থপূর্ণ করে তোলার জন্য লাগাতার প্রয়াসের ফলিত চেহারা, হু-র তৎকালীন ডিরেক্টর জেনেরাল ডঃ ম্যালার-এর বিশেষ মতাদর্শগত অবস্থান, আবার অন্যদিকে মুক্ত বাজার অর্থনীতির বর্তমান সর্বগ্রাসী শক্তি ও উপস্থিতির তুলনায় দুর্বলতর অবস্থান এবং একমেরু বিশ্ব না থাকা– সবকিছুর সামগ্রিক যোগফলে ও ফলশ্রুতিতে জন্ম নিল ১৯৭৮-এর Alma-Ata সনদ– Comprehensive Primary Health Care-এর ওপরে। মোট ১০টি অনুচ্ছেদ ও উপ-অনুচ্ছেদে বিভক্ত এই ঘোষণাপত্রে স্পষ্ট ভাষায় বলা হল– “that the attainment of the highest possible level of health is a most important world-wide social goal whose realization requires the action of many other social and economic sectors in addition to the health sector”। অর্থাৎ স্বাস্থ্য-কে অর্জন করা এবং একে রক্ষা করা আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যের মধ্যে একটি এবং এ লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র স্বাস্থ্যের বাইরেও আরও অনেক সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রসঙ্গ জড়িয়ে আছে। এক কথায় বলা যায় স্বাস্থ্য একটি ব্যতিক্রমহীনভাবে রাজনৈতিক বিষয়ও বটে। আরও বলা হল– The people have the right and duty to participate individually and collectively in the planning and implementation of their health care. অর্থাৎ একজন নাগরিকের (প্রজার নয়) প্রতিচ্ছবি এল ঘোষণাতে।

সাম্প্রতিক সময়ের একটি প্রবন্ধে মন্তব্য করা হয়েছে যে আমেরিকা ইরাকে যুদ্ধের জন্য ১০০ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে প্রস্তুত, কিন্তু এইডস, যক্ষা এবং ম্যালেরিয়ার মোকাবিলার জন্য তৈরি Global Fund-এ মাত্র ১০০ মিলিয়ন ডলার দেয়।[7] এর হাতে গরম উদাহরণ হচ্ছে করোনা অতিমারির এই ভয়ঙ্কর সঙ্কটের সময়েও টাইমস অব ইন্ডিয়া-র খবরের শিরোনাম– US approves sale of missile, torpedoes worth million $155 to India. “জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি”-র মতো ব্যাপার আর কি!

১৯৭৮-এর সনদে আরও বলা হল– “A genuine policy of independence, peace, détente and disarmam ent could and should release additional resources that could well be devoted to peaceful aims and in particular to the acceleration of social and economic development of which primary health care, as an essential part, should be allotted its proper share.” এ বক্তব্য থেকে নিতান্ত পরিষ্কার হয় যে যুদ্ধখাতে ব্যয়বরাদ্দ স্বাস্থ্যকে সঙ্কুচিত করে এবং প্রথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে কার্যকরী করতে হলে শান্তির জন্য প্রচেষ্টাও একটি অর্থপূর্ণ পদক্ষেপ হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, যুদ্ধখাতে ব্যয়-বরাদ্দ কমিয়ে জনকল্যাণমূলক ক্ষেত্রে ব্যয় বাড়ানোর মতো ঘোরতর রাজনৈতিক বার্তাও ছিল এ ঘোষণাপত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

মুশকিল হচ্ছে তেলের এবং খনিজ সম্পদের বাজারের জন্য সমগ্র পশ্চিম এশিয়া ও মিশর অশান্ত হয়ে না উঠলে যুদ্ধাস্ত্র বিক্রির বিপুল মুনাফা হয় না। স্বাস্থ্য এখানে দুয়োরানিরও অধম যে! এজন্য এরকম সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সনদপত্র মুক্ত বাজারের প্রবক্তাদের পক্ষে হজম করা অসম্ভব একটি ঘটনা।

ল্যান্সেটে (২৬ মার্চ, ২০২০) প্রকাশিত একটি রিপোর্টের শিরোনাম– “COVID-19 gives the lie to global health expertise”। সে রিপোর্টে খুব তীক্ষ্ণ ভাষায় বলা হয়েছে— The US and UK Governments have provided among the world’s worst responses to the pandemic, with sheer lies and incompetence from the former, and near-criminal delays and obfuscation from the latter. শুধু এটুকু নয়, বলা হয়েছে— Neither country has widespread testing available, as strongly recommended by WHO, alongside treatment and robust contact tracing. দুটি দেশের কোনওটিতেই স্বাস্থ্যকর্মী এবং ডাক্তারদের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক পিপিই (personal protective equipment) নেই। পৃথিবীর স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং ডাক্তারির ধরন হয়তো কোভিড-১৯ পরবর্তী পৃথিবীতে চিরকালের জন্য বদলে গেল— Global health will never be the same after COVID-19— it cannot be.

এতদিনে আমরা সবাই জেনে গেছি চারপাশে সূর্যের ছটার মতো প্রোটিনের গঠন থাকার জন্য এর নাম করোনাভাইরাস। খুবই সাদামাটা এর গঠন। একটি আরএনএ স্ট্রিং থাকে তার একটি জেনোমের দৈর্ঘ্য ৩০,০০০ “letters”-এর চেয়ে কম।

করোনাভাইরাস চারপাশে সূর্যের ছটার মতো এজন্য এই নাম

এর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল ভাইরাসের শরীরের ওপরে এক বিশেষ ধরনের “স্পাইক প্রোটিন” থাকে। এই প্রোটিনের সাহায্যে মানুষের কোষের রিসেপ্টরের ওপরে ভালোভাবে গেঁথে গুছিয়ে বসতে পারে। এবং ভাইরাসটি এর নিজের ইচ্ছেমতো কোষের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে যার ফলে যে যে উপসর্গ মানুষের শরীরে দেখা যায় (জ্বর, শুকনো কাশি, গলা এবং শরীরে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি) সেগুলো তৈরি হয়।

স্পাইক প্রোটিনের চেহারা

নেচার মেডিসিনের মতো গ্রাহ্য পত্রিকায় (১৭.০৩.২০২০) একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপ্রসূত চিঠি প্রকাশিত হয় “The proximal origin of SARS-CoV-2” শিরোনামে। সে চিঠিতে স্পষ্ট করে জানানো হয়— Our analyses clearly show that SARS-CoV-2 is not a laboratory construct or a purposefully manipulated virus. মূল কথা, এ ভাইরাসটি কোন ল্যাবরেটরিতে তৈরি হয়নি। তার কারণও নিহিত আছে স্পাইক প্রোটিনের বৈশিষ্ট্যের মাঝে। গবেষকদের বক্তব্য— the high-affinity binding of the SARS-CoV-2 spike protein to human ACE2 is most likely the result of natural selection on a human or human-like ACE2 that permits another optimal binding solution to arise. This is strong evidence that SARS-CoV-2 is not the product of purposeful manipulation. এর বাংলা করা প্রায় দুঃসাধ্য। সংক্ষেপে সহজভাবে বললে এটুকু বলা যায় স্পাইক প্রোটিন যে পদ্ধতিতে প্রবল আসক্তি নিয়ে কোষের রিসেপ্টরের সঙ্গে লেগে যায় (ACE2 রিসেপ্টর যা আমাদের কিডনি, ফুসুফুস ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে থাকে, সেসব অঙ্গের কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং কিছু উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ এই রিসেপ্টরগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তৈরি করা হয়) তাতে দৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হয় এটা ভাইরাসের বিবর্তনের ফলে তৈরি হয়েছে। কোনও জিন প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে নয়। ফলে মহাশক্তিধর ট্রাম্পের বলা “Chinese virus”-কে কেন্দ্র করে যেসব কন্সপিরেসি থিওরি বাজারে গুজব হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে এ ভাইরাস সেরকম কল্পবিজ্ঞানের মতো ল্যাবরেটরিতে তৈরি একেবারেই নয়। প্রাকৃতিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া একটি অসীম শক্তিশালী, ক্ষতিকর ভাইরাস যে এখন প্রাণীদের শরীরের বদলে মানুষের শরীর পেয়ে গেছে নিজের অসম্ভব সব কাণ্ড ঘটানোর জন্য।

প্রশ্ন হচ্ছে এতদিন বাদুড়ের দেহে বাস করা ভাইরাস (সম্ভবত মধ্যবর্তী আরেকটি প্রাণী প্যাঙ্গোলিনকে পেয়েছিল নিজের জিনের চরিত্র বদলের জন্য) মানুষের শরীরে এল কী করে? এর কোনও সরল, একরৈখিক, একমাত্রিক উত্তর নেই। এখানেই আমাদের ভাবতে হবে নিওলিবারাল অর্থনীতি, পুঁজির সর্বময় অস্তিত্ব এবং কর্পোরেট পুঁজির প্রয়োজনে কীভাবে বছরের পর বছর ধরে প্রাকৃতিক অঞ্চলগুলো মুনাফার লীলাক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এবং তার ফলে বাস্তুতন্ত্রের স্বাভাবিক ভারসাম্য ভেঙেচুরে গেছে, প্রকৃতির নিজস্ব বাসিন্দারা মানুষের দেহে এদের নতুন বাসস্থান খুঁজে নিয়েছে। আমরা নিত্যনতুন মারণ রোগে আক্রান্ত হচ্ছি। এ বিষয়ে পরে আরেকটু বিস্তৃত আলোচনা করব।

 

বিজ্ঞানী যখন সত্যান্বেষী বোমকেশ

নিউ ইয়র্কার পত্রিকায় (২৭.০৩.২০২০) ক্যারোলিন করম্যান একটি সুদীর্ঘ, তথ্যবহুল প্রবন্ধ লিখলেন “From Bats to Human Lungs, the Evolution of a Coronavirus”। লেখাটি শুরু হচ্ছে এভাবে— For thousands of years, a parasite with no name lived happily among horseshoe bats in southern China. The bats had evolved to the point that they did not notice; they went about their nightly flights unbothered. One day, the parasite—an ancestor of the coronavirus, SARS-CoV-2—had an opportunity to expand its realm. Perhaps it was a pangolin, the scaly anteater, an endangered species that is a victim of incessant wildlife trafficking and sold, often secretly, in live-animal markets throughout Southeast Asia and China. হাজার হাজার বছরে ধরে দক্ষিণ চিনের ঘোড়ার খুরের মতো দেখতে বাদুড়ের মধ্যে এই ভাইরাসেরা সুখে বাস করছিল। বাদুড়েরা রাতে মহানন্দে উড়ে বেড়াত। (এখানে উল্লেখযোগ্য, বিজ্ঞানীরা দেখেছেন স্তন্যপায়ীদের মধ্যে একমাত্র বাদুড় জোরে উড়তে পারে বলে সম্ভবত বিভিন্ন ভাইরাসের বিরুদ্ধে শক্তিশালী ইমিউনিটি গড়ে তুলতে পারে, যেটা আমাদের নেই।) তারপরে বাজারের নিয়ম মেনে এরা অ্যানিম্যাল মার্কেটে চলে এল মানুষের সর্বগ্রাসী খিধে মেটানোর জন্য। এবং ভাইরাস বাসা বাঁধল আমাদের শরীরে– তার এক নতুন আশ্রয় মিলল।

২০০৩-এ সার্স-কোভ-১ আবিষ্কার হয়েছিল। অন্যতম আবিষ্কারক ছিলেন জোনাথান এপস্টাইন। সে এক রূদ্ধশ্বাস কাহিনী। চিনের গুয়াঙ্গডনের বাজারে যে বাদুড় খাদ্য হিসেবে বিক্রি হত তাতে এপস্টাইনের সন্দেহ হয় বাদুড় থেকে সার্স-কোভ-১ উৎস। এপস্টাইন ঐ অঞ্চলের চুনাপাথরের গুহায় ক্যাম্প করে থেকেছিলেন। আর রাত্রিবেলা ডজন ডজন বাদুড়ের লালারস সংগ্রহ করতেন। এভাবে বাদুড়ের চারটি প্রজাতিকে খুঁজে পান যাদের জিনের সঙ্গে সার্স-কোভ-১-এর জিনের ৯০%-এরও বেশি মিল আছে। ২০১৩ সালে এপস্টাইন এবং সহ-গবেষিকা শি ঝেং-লি বাদুড় থেকে পাওয়া জিনের সিকোয়েন্সিং করে সার্স-কোভ-২-র জিনের সঙ্গে ৯৬% জিনগত সাদৃশ্য পান। কিন্তু যেহেতু দুটির মধ্যে ১০০% সাদৃশ্য পাননি সেজন্য তাঁদের ধারণা মাঝে এই ভাইরাসের আরেকটি মিউটেশন হয়েছে অন্য কোনও প্রাণীর দেহে (সম্ভবত প্যাঙ্গোলিন)।

২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০-তে NEJM-এ প্রকাশিত হল “Escaping Pandora’s Box — Another Novel Coronavirus”। প্রবন্ধে স্পষ্ট ভাষায় বলা হল— We must realize that in our crowded world of 7.8 billion people, a combination of altered human behaviors, environmental changes, and inadequate global public health mechanisms now easily turn obscure animal viruses into existential human threats. আমরা এমন এক জীবনবোধ এবং অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা লালন পালন করেছি যেখানে মানুষ প্রকৃতিকে নিয়ে যা খুশি করতে পারে। কর্পোরেট পুঁজি দুনিয়ার প্রতিটি মানুষ, বনাঞ্চল, জীবজগৎ এবং সম্ভাব্য সমস্ত অস্তিত্বকে পণ্য করে তুলেছে। ফলে একটি স্টাডি অনুযায়ী ১০,০০০-এর বেশি নতুন ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া এবং অণুজীব মানুষের শরীরে আশ্রয় নিচ্ছে। তার একটি হল আজকের করোনা ভাইরাস। উদাহরণ হিসেবে ২০১৪ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রের উল্লেখ করি- Anthropogenic Land Use Change and Infectious Diseases: A Review of the Evidence।

 

ভাইরাসের বায়োলোজি

একেবারে অজানা এই মারণান্তক ভাইরাসকে বোঝার জন্য শ্রেষ্ঠ মেধার বিজ্ঞানী, চিকিৎসক-চিকিৎসাকর্মী, এপিডেমিওলজিস্ট সহ বিভিন্ন পেশার মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জানুয়ারি (২০২০) থেকে প্রায় হাজারখানেক প্রকাশিত, প্রাক-প্রকাশিত, অপ্রকাশিত গবেষণাপত্র লেখা হয়েছে এবং BIOxiv-তে (একটি প্রাক-প্রকাশনা গবেষণাপত্রের পোর্টাল) পোস্টেড হয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে ১০০০-এর বেশি করোনাভাইরাস জিনোম সিকোয়েন্স public darabase-এ পারস্পরিক লেনদেন করার জন্য তুলে দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞানীদের কথায়— SARS-CoV-2 behaves like a monstrous mutant hybrid of all the human coronaviruses that came before it. It can infect and replicate throughout our airways. এর আগে যে ACE-2 receptor-এর কথা বলেছিলাম বর্তমানের করোনাভাইরাস ২০০২-০৩-এর সার্স ভাইরাসের ১০ গুণ বেশি কার্যকরীভাবে এই রিসেপ্টরগুলোর সঙ্গে বেঁধে যেতে পারে। এজন্য শ্বাসকষ্টের প্রাবল্য এত বেশি হয়। আরও কথা হল যে এদের অতি দ্রুত এবং ঘন ঘন মিউটেশন হতে থাকে। শ্বাসনালীতে পৌঁছনোর পরে আরও বেশি ঘটে এটা।

বর্তমানে Real-time quantitative fluorescence polymerase chain reaction (RT-qPCR) testing of respiratory specimens for SARS–CoV-2 RNA ব্যবহার করা হয় সংক্রামিত কে তাকে চিহ্নিত করা এবং কতদিন হাসপাতালে থাকা প্রয়োজন সেটা নির্ধারণ করার জন্য। অ্যানালস অফ ইন্টার্নাল মেডিসিন-এ প্রকাশিত একেবারে সাম্প্রতিক গবেষণাপত্র (৩০.০৩.২০২০) “ARS-CoV-2–Positive Sputum and Feces After Conversion of Pharyngeal Samples in Patients With COVID-19”-এ ১৩৩ জন রোগীর ওপরে পরীক্ষা করে বলা হয়েছে যে ২২ জন রোগীর ক্ষেত্রে “who had positive RT-qPCR results for SARS–CoV-2 in the sputum or feces after pharyngeal swabs became negative.” ভাইরাস বায়োলজির এ হল আরেক গভীরতর সমস্যার কথা। থুতু কিংবা মলে কোন ভাইরাস পাওয়া যাচ্ছে না, অথচ যে এনজাইমের সাহায্যে পরীক্ষা করা হচ্ছে তার খোঁজ মিলছে ভাইরাসমুক্ত রোগীর রক্তে। এবার একে কি সংক্রমণমুক্ত বলা যাবে? এরকম নিত্যনতুন গবেষণালব্ধ তথ্য উঠে আসছে। ফলে ভাইরাস বায়োলজি আমাদের কাছে এখনও অধরা।

জার্মান গবেষকেরা দেখিয়েছেন যে সংক্রামিত রোগীরা উপসর্গ পরিস্ফুট হওয়ার আগে প্রচুর পরিমাণে ভাইরাস চারপাশে ছড়ায়। এমনকি ৩৭ দিন পর্যন্ত এরকম ভাইরাস ছড়ানো চলতে পারে। এবার ভাইরাস যে ছড়িয়ে পড়বে তার দুটো মাধ্যম– (১) এরোসল বা কফ, থুতু, কাশি, হাঁচি ইত্যাদি এবং (২) fomite বা কোনও শক্ত বস্তু যেমন পিচবোর্ড, ধাতব বস্তু, কাঁচ, প্লাস্টিক ইত্যাদি। প্রথম ক্ষেত্রে ৩ ঘণ্টা মতো সংক্রামক অবস্থায় থাকতে পারে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তামার ওপরে ৪ ঘণ্টা, পিচবোর্ডে ২৪ ঘণ্টা, প্লাস্টিকে ৩ দিন পর্যন্ত সক্রিয় থাকতে পারে। যদিও প্রথম ১০ মিনিটে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ হয়। তারপরে ধীরে ধীরে কমতে থাকে।

সমাজের যে অংশের মানুষেরা বেশি বিপজ্জনক অবস্থায় আছে তারা হল– (১) ৬০ বা এর চেয়ে বেশি বয়সী, (২) ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা নিউমোনিয়ার মতো অন্য কোনও রোগে আক্রান্ত, (৩) যারা ইমিউনোসাপ্রেসিভ ওষুধ খাচ্ছে ইত্যাদি। যদিও সাম্প্রতিক সময়ের গবেষণা দেখাচ্ছে ৩০ দিনের শিশু এবং মা থেকে শিশুতে সংক্রমণের ঘটনাও ঘটছে। কমবয়সীরা তুলনায় নিরাপদ। তবে বিপন্মুক্ত নয়। করোনাভাইরাসে যাদের মৃত্যু ঘটে তাদের মৃত্যুর প্রধান কারণ দুটি– (১) ডাক্তারি পরিভাষায় বললে “cytokine storm syndrome” যখন অত্যন্ত মাত্রাছাড়াভাবে শরীরের আভ্যন্তরীণ ইমিউন রেস্পন্স তৈরি হয় যার ফলে আক্রান্তের ফুসফুস চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক গবেষকের কথায়– “It is almost like an autoimmune disease; the immune system is attacking parts of the body that it should not.” এবং (২) “fulminant myocarditis” যার ফলে অতি দ্রুত এবং মারাত্মক হার্ট ফেইলিউর হয় যাকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসাধ্য। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ ACE2 inhibitor নিয়ে বিতর্ক। কিন্তু ১৭ মার্চ, ২০২০-তে প্রকাশিত জার্নাল অব আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন-এর একটি গবেষণাপত্রের শিরোনাম “Patients taking ACE-i and ARBs who contract COVID-19 should continue treatment, unless otherwise advised by their physician”। ব্যথা কমানোর ওষুধ ইবিউপ্রোফেন নিয়েও একই কথা। একমাত্র তাড়াহুড়ো করে লেখা ফ্রান্সের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর একটি চিঠি ছাড়া আর কোথাও একে নিষিদ্ধ করা হয়নি। এ নিয়ে ১৭ মার্চ, ২০২০-তে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ একটি প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে।

আমেরিকান জার্নাল অব হেমাটোলজি-তে ৪ মার্চ, ২০২০ তারিখে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রের শিরোনাম – Hematologic parameters in patients with COVID-19 infection। সেখানে গবেষকরা দেখেছেন রক্তে শ্বেতকণিকা, লিম্ফোসাইট, এমনকি অণুচক্রিকার পরিমাণও কমে যাচ্ছে। এর পরিণতিতে থ্রম্বোসিস, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এবং ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলে ডিসেমিনেটেড ইন্ট্রাভাস্ক্যুলার কোয়াগুলেশনের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

বিখ্যাত জার্নাল সায়ান্স-এ (২৭.০৩-২০২০) একটি গবেষণাপত্রের শিরোনাম— How sick will the coronavirus make you? The answer may be in your genes। ঐ প্রবন্ধে বলা হয়েছে– “Variations in the ACE2 gene that alter the receptor could make it easier or harder for the virus to get into cells.” আরও অনুমান করা হচ্ছে (চিনা গবেষকদের একটি প্রাক-প্রকাশ গবেষণাপত্রে) যে যাদের ব্লাড গ্রুপ O (+ বা – বলা হয়নি) তাদের ভাইরাস সংক্রমণের প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। এখানে সর্বশেষ মন্তব্য– “The catastrophic spread of the coronavirus should soon increase the number of COVID-19 patients available to these gene hunts.”

আমরা জিন হান্ট বা জিন শিকার শব্দটিতে নজর করি একবার। আমরা আমাদের নিজেদের দেহের অভ্যন্তর থেকে শুরু করে প্রকৃতি এবং আমাদের চারপাশের জীবজগৎ সবার ওপরে শুধু প্রভুত্ব করে যাবার উদগ্র আকাঙ্খা পোষণ করি। সবার সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ। আমরা জিনকে শিকার করি। আমাদের ঘিরে রাখা সহনশীল বাস্তুজগৎ বা ম্যাক্রোকজম (macrocosm)-কে আমরা যতদিন মমতার সঙ্গে, ভালোবাসার সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে গ্রহণ করতে না পারব ততদিন আরও মহামারির (এর চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়তো) জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। শিল্পবিপ্লব-উত্তর পৃথিবীতে প্রকৃতিকে পুঁজির দাস এবং ক্রয়যোগ্য পণ্য হিসেবে দেখার যে মানসিকতা ৩০০ বছর ধরে বিশ্বব্যাপী মানসিকতায় সঞ্চারিত হয়েছে– যার চূড়ান্ত রূপ কর্পোরেট পুঁজির যুগে এসে আরও গভীর এবং সর্বব্যাপী হয়েছে– তার গোড়া ধরে টান না মারলে আমাদের মুক্তি ও পরিত্রাণের কোনও সম্ভাবনা নেই। এ লড়াই করোনার সঙ্গে লড়াইয়ের চেয়েও শক্ত, দীর্ঘস্থায়ী।

 

করোনার চিকিৎসা

২০ মার্চ, ২০২০-র নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টের শিরোনাম– Covert coronavirus infections could be seeding new outbreaks। আমাদের বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়, একজন আপাত-উপসর্গহীন মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে অথচ এই বিপজ্জনক ভাইরাস তার শরীর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সমাজে। কী অসম্ভব এক পরিস্থিতি! নেচার-এর মন্তব্য— As coronavirus outbreaks surge worldwide, research teams are racing to understand a crucial epidemiological puzzle — what proportion of infected people have mild or no symptoms and might be passing the virus on to others. Some of the first detailed estimates of these covert cases suggest that they could represent some 60% of all infections. অর্থাৎ, প্রাথমিক যে হিসেব পাওয়া যাচ্ছে তাতে অনুমান করা যায় জনসমাজের ৬০ শতাংশ সংক্রমণ এভাবে ঘটতে পারে। জাপানের এক জাহাজ থেকে উদ্ধার করা টেস্ট-পজিটিভ ১৩ জনের মধ্যে ৪ জনের অর্থাৎ ৩১ শতাংশের কোনও উপসর্গ ছিল না।

ভাইরাসের প্রজনন সংখ্যা (রিপ্রোডাকশন নাম্বার) দিয়ে এর গতিপ্রকৃতি এবং সংক্রামিত করার ক্ষমতা মাপা হয়। একে বলা হয় R0– যা দিয়ে বোঝা যায় একজন সংক্রামিত মানুষ কজনের মাঝে এই ভাইরাসকে পৌঁছে দিতে পারে। সংক্রমণের সময় সাধারণভাবে এ সংখ্যা ২-২.৫। চিনের য়ুহানে একসময়ে এটা ৪ অব্দি পৌঁছেছিল। এখন এ সংখ্যা ০.৩২-এ এসে পৌঁছেছে। এপিডেমিওলোজির ভাষায় সংখ্যাটি ১-এর নীচে গেলে সংক্রমণমুক্ত বলা যেতে পারে।

এখনও অবধি করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কোনও ধাপেই কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি। অতি মারাত্মক ক্ষেত্রে কিছু ক্ষেত্রে শোনা যাচ্ছে সার্স, এইচআইভি-তে ব্যবহৃত অ্যান্টি-ভাইরাল ড্রাগ এবং ক্লোরোকুইন বা ক্লোরামফেনিকলের মতো অ্যান্টিবায়োটিকের সম্মিলিত প্রয়োগ ফল দিচ্ছে। কিন্তু ১৮ মার্চ, ২০২০-তে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এ প্রকাশিত ট্রায়াল রিপোর্ট (র‍্যান্ডমাইজড, কন্ট্রোলড, ওপেন লেবেল ট্রায়াল) “A Trial of Lopinavir-Ritonavir in Adults Hospitalized with Severe Covid-19” জানাচ্ছে— In hospitalized adult patients with severe Covid-19, no benefit was observed with lopinavir–ritonavir treatment beyond standard care. ১৯ মার্চ, ২০২০-তে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এ প্রকাশিত সম্পাদকীয় হল– Covid-19 – The Search for Effective Therapy. এ লেখায় খানিকটা বেদনার স্বরেই বলা হয়েছে— What we lack is a specific antiviral agent to treat the infected and, optimally, decrease viral shedding and subsequent transmission. যদিও চরম আতঙ্কের সময়, পরম আর্ততার মুহূর্তে মানুষ যেকোনও অবলম্বনকে আঁকড়ে ধরে– এমনকি গোমূত্রও!

নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল-এর (২৬.০৩.২০২০) সম্পাদকীয়র শিরোনাম– Covid-19 Navigating the Uncharted. শিরোনামেই স্পষ্ট যে আমরা অজানা পথে হাঁটছি, খুঁজে বেড়াচ্ছি। সম্পাদকীয়তে লেখা হচ্ছে– “A robust research effort is currently under way to develop a vaccine against Covid-19. We anticipate that the first candidates will enter phase 1 trials by early spring. Therapy currently consists of supportive care while a variety of investigational approaches are being explored. Among these are the antiviral medication lopinavir–ritonavir, interferon-1β, the RNA polymerase inhibitor remdesivir, chloroquine, and a variety of traditional Chinese medicine products. Once available, intravenous hyperimmune globulin from recovered persons and monoclonal antibodies may be attractive candidates to study in early intervention.” অর্থাৎ, সম্ভাব্য যতরকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায় চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মানুষকে সুস্থ করে তোলার জন্য। কিন্তু এর সঙ্গে বিজ্ঞানের কঠোর পরীক্ষাকে (open label, randomized controlled trial) যুক্ত করতে হবে, যুক্ত করতে হবে নৈতিকতাকে। সম্পাদকীয়র মন্তব্য– “Critical to moving the field forward, even in the context of an outbreak, is ensuring that investigational products are evaluated in scientifically and ethically sound studies.”

হু-র তরফে Solidarity Trial বলে একটি আলাদা সাইট খুলেছে যেখানে পৃথিবী জুড়ে যে সমস্ত ট্রায়াল হচ্ছে— সে ৫ জন রোগীকে নিয়েই হোক বা বড় কন্ট্রোলড ট্রায়ালই হোক– সমস্ত ট্রায়ালকে আপলোড করা যাবে। পৃথিবীর এবং হু-র বিজ্ঞানীরা সেগুলো খতিয়ে দেখবেন। “পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন”– বাস্তবিকই এরকম ভয়ঙ্কর এক অজানা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যার যা অভিজ্ঞতা আছে সব দুনিয়ার মানুষের সামনে আসা দরকার। কিন্তু গুজব এবং ভ্রান্তি যেন তৈরি না হয়। হু-র সাইটে আমেরিকা এবং বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত যেসব ওষুধগুলোর নাম উল্লেখ করা আছে সেগুলো হল– Remdesivir, Mavrilimumab, Convalescent plasma, Hydroxychloroquine (Plaquenil) and chloroquine (Aralen), Lopinavir-ritonavir (Kaletra), Tocilizumab, Sarilumab, Favilavir। এর মধ্যে Convalescent plasma বা করোনা সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠা রোগীর রক্তের প্লাজমা ছাড়া বাকি সবগুলো ওষুধ নিয়েই নিউ ইংল্যান্ড জার্নালে মতামত দেওয়া হয়েছে।

JAMA (Journal of American Medical Association – ২৭.০৩.২০২০)-তে একটি “Preliminary Communication”-এর শিরোনাম– “Treatment of 5 Critically Ill Patients With COVID-19 With Convalescent Plasma”। করোনা সংক্রমণমুক্ত রোগীর রক্তের অ্যান্টিবডি প্রবল শ্বাসকষ্টের রোগীকে দেবার পরে তারা সেরে উঠেছে— In this preliminary uncontrolled case series of 5 critically ill patients with COVID-19 and ARDS, administration of convalescent plasma containing neutralizing antibody was followed by improvement in their clinical status. কিন্তু সতর্ক করা হচ্ছে— The limited sample size and study design preclude a definitive statement about the potential effectiveness of this treatment, and these observations require evaluation in clinical trials. অর্থাৎ, এত কম স্যাম্পেল এবং দুর্বল ট্রায়াল ডিজাইনের জন্য এ চিকিৎসার পরবর্তী এবং উপযুক্ত মূল্যায়ন দরকার। যেকোনও চিকিৎসার কথা যে কেউ বললেই সেটাকে ধর্মবিশ্বাসের মতো সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ করার প্রশ্ন নয়। নানারকম উপকথা, অতিকথার বাইরে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিধি, পদচারণা।

 

করোনাভাইরাস এবং কর্পোরেট পুঁজির রাজনীতি – ২০২০-র পৃথিবী

করোনা আমাদের সচকিত করে এ কঠোর সত্যের সামনেও দাঁড় করিয়ে দিল– তথাকথিত গণতান্ত্রিক এবং এক-পার্টি ব্যবস্থার দেশের মধ্যে সত্যিই কি কার্যত কোনও ফারাক আছে? ধরে নিচ্ছি চিন করোনার তথ্য গোপন করেছে। স্পষ্টতই আমি য়ুহান ভাইরাসের মতো অবান্তর বিষয় নিয়ে কিছু বলছি না। নেচার মেডিসিনের মতো পত্রিকায় প্রকাশিত “The proximal origin of SARS-CoV-2” প্রবন্ধটি দেখে নিতে অনুরোধ করছি। আরেকদিকে পৃথিবীর “গণতান্ত্রিক” বড়দা আমেরিকার অধীশ্বর ট্রাম্প সাহেব ১৯ মার্চ ঘোষণা করে দিলেন হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন হল ‘game changer’– খেলা ঘুরিয়ে দেবার মতো ওষুধ। কি সব্বোনাশ! পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন Anthony Fauci-র মতো আন্তর্জাতিকভাবে মান্য চিকিৎসক– যিনি নিউ ইংল্যান্ড জার্নালে আমন্ত্রিত সম্পাদকীয় লেখেন, হ্যারিসনের টেক্সট বুকের অন্যতম সম্পাদক এবং ৪০ বছরের বেশি সংক্রামক ব্যাধি নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। তাঁকে সর্বসমক্ষে দম্ভভরে স্রেফ চুপ করিয়ে দিলেন। কোনও কথাই ফসি বলতে পারলেন না। এমনটা তো হিটলারের বা অন্য কোনও একনায়কের আমলে হয়ে থাকে। ভারতেও বোধহয় একথা ভাবা যায় না।

ট্রাম্পের হঠাৎ করে এরকম হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন প্রীতির কারণ কী? জার্মানির চ্যান্সেলর মর্কেল একজন ট্রেইনড বিজ্ঞানী। ট্রাম্প একজন অতি বিত্তশালী ধুরন্ধর ব্যবসায়ী। তিনি ওষুধ নিয়ে এত জানলেন কি করে? ২১ মার্চ টুইট অব্দি করে ফেললেন— HYDROXYCHLOROQUINE & AZITHROMYCIN, taken together, have a real chance to be one of the biggest game changers in the history of medicine. The FDA has moved mountains – Thank You! Hopefully they will BOTH (H works better with A, International Journal of Antimicrobial Agents)। এর পেছনে কাজ করছে অতি সরল বাণিজ্যিক লাভের প্রশ্ন। এবং ট্রাম্পের টুইটের পরে আমেরিকার স্বশাসিত মান্য সংস্থা এফডিএ ব্যতিক্রমীভাবে Emergency Use Authorization (EUA)-এ ওষুধগুলোর সীমাবদ্ধ ব্যবহারকে অনুমোদন দিল। আমেরিকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথ ট্রায়াল শুরু করে দিল। এগুলোকে ঠিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বলা যাবে কি? নাকি একটি একদলীয় শাসনের আরেকটি রকমফের? Vox News-এর সংবাদ অনুযায়ী (৭.০৪.২০২০)— Trump appears to have been convinced of the drug’s effectiveness by its advocates in his inner circle, including trade adviser Peter Navarro and his personal lawyer Rudy Giuliani, as well as by a French study that indicated the drug is effective against the virus — but that, as Vox’s Umair Irfan has explained, came with a number of caveats the president may have missed, and that has been retracted. শুধু তাই নয়, “the report of Trumpworld’s connections to the pharmaceutical industry caused many to believe something more sinister was afoot — namely, that Trump hoped to use the coronavirus pandemic to enrich himself and his allies.”

একইসঙ্গে আমেরিকায় জাতিবৈরিতা, বিশেষ করে এশিয়ান এবং আফ্রো-আমেরিকানদের ক্ষেত্রে, বেড়ে চলেছে। নেচার পত্রিকায় (৭.০৪.২০২০) সম্পাদকীয় লেখা হচ্ছে– Stop the coronavirus stigma now। বলা হচ্ছে— It’s clear that since the outbreak was first reported, people of Asian descent around the world have been subjected to racist attacks, with untold human costs — for example, on their health and livelihoods. Law-enforcement agencies say they are making investigation of hate crimes a high priority, but such inquiries might come too late for some, including many of the more than 700,000 Many have returned home while their institutions are closed owing to lockdowns, and many might not return.

১৬ মার্চ, ২০২০-র খবর হচ্ছে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউটস অব হেলথ-এর তরফে করোনাভাইরাসের প্রথম ভ্যাক্সিন সফলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে mRNA-1273। এবার ওষুধটি ফেজ-১, ২ এবং ৩ হিউম্যান ট্রায়ালের মধ্য দিয়ে যাবে। ফেজ-১ ট্রায়াল শুরু হয়েছে।

একটি খবরের শিরোনাম হচ্ছে– Trump reportedly offered $1 B to poach coronavirus vax for US use only। জার্মান ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি CureVac জানুয়ারি মাস থেকে ভ্যাক্সিন তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছিল। এই CureVac-এর ভ্যাক্সিন কেনার জন্য ট্রম্পের এই প্রলোভন দেখানো। আমেরিকায় বিতর্ক শুরু হয়েছে– জনসাধারণের ট্যাক্সের টাকায় যে রিসার্চ হয় সে রিসার্চের ফল কেন বাণিজ্যিকভাবে বিপুল মুনাফার জন্য কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া হবে? রয়টার্স-এর খবর (১৫ মার্চ, ২০২০) অনুযায়ী– Germany tries to halt U.S. interest in firm working on coronavirus vaccine। সে খবরেই বলা হয়েছে যে CureVac-এর প্রধান লগ্নিকারী Horst Seehofer জানাচ্ছেন যে তিনি ভ্যাক্সিন বিক্রি করবেন না এবং এই ভ্যাক্সিনের লক্ষ্য হবে “help people not just regionally but in solidarity across the world”।

আমেরিকার আরেকজন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বার্নি স্যান্ডার্স বলেছেন তিনি নির্বাচিত হলে এই ভ্যাক্সিনকে সম্পূর্ণত বিনামূল্যে মানুষের কাছে পৌঁছে দেবেন। ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২০-তে ৪৬ জন ডেমোক্র্যাটের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি চিঠি ট্রাম্পকে দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে— We write to ask you to ensure that any vaccine or treatment developed with U.S. taxpayer dollars be accessible, available, and affordable. That goal cannot be met if pharmaceutical corporations are given authority to set prices and determine distribution, putting profit-making interests ahead of public health priorities. Americans deserve to know that they will benefit from the fruits of their public investments.

মানুষের বাঁচার জীয়ন কাঠিও কর্পোরেট পুঁজির আবর্তে পড়ে গেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, বর্তমান অর্থনীতির এই ধ্বসের মাঝেও আমেরিকান বহুজাতিক ফার্মা কোম্পানি ইলি লিলি-র শেয়ার লাভের মুখ দেখেছে কারণ এরা সর্বসাধারণ্যে বিবৃতি দিয়েছে যে করোনাভাইরাসের নতুন চিকিৎসা নিয়ে আসছে।

১৯ মার্চ, ২০২০– নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ খবরের শিরোনাম “Search for Coronavirus Vaccine Becomes a Global Competition”। প্রবন্ধটিতে মন্তব্য করা হয়েছে- What began as a question of who would get the scientific accolades, the patents and ultimately the revenues from a successful vaccine is suddenly a broader issue of urgent national security. বিশ্ব কি ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে? না কি জাতীয়তাবাদ এবং মুনাফার উদগ্র বাসনা প্রধান বিষয় হয়ে উঠছে?

এই মুহূর্তে ৩৫টির বেশি ওষুধ কোম্পানি এবং অ্যাকাডেমিক প্রতিষ্ঠান ভ্যাক্সিন তৈরির লড়াইয়ে রয়েছে। গার্ডিয়ান পত্রিকার (২৭ মার্চ, ২০২০) রিপোর্ট “Coronavirus vaccine: when it will be ready?” বলছে— About 35 companies and academic institutions are racing to create such a vaccine, at least four of which already have candidates they have been testing in animals. The first of these – produced by Boston-based biotech firm Moderna – will enter human trials imminently. এরপরেই যোগ করছে— This unprecedented speed is thanks in large part to early Chinese efforts to sequence the genetic material of Sars-CoV-2, the virus that causes Covid-19. China shared that sequence in early January, allowing research groups around the world to grow the live virus and study how it invades human cells and makes people sick. অর্থাৎ, এই অসম্ভব দ্রুত গতির আবিষ্কারের পেছনে রয়েছে চিনের উদ্যোগ। তাদের তরফে প্রথম থেকেই জেনেটিক উপাদান বিশ্ববাসীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।

উল্লেখযোগ্য খবর হল, ভারতের ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে অগ্রগতি- Researchers from the King George’s Medical University in Lucknow have discovered that the novel coronavirus (2019-nCoV) has new sites in the proteins in its outer layer. (Nature India, ২৮.০৩.২০২০)।

মান্থলি রিভিউ পত্রিকায় (২৭ মার্চ, ২০২০) সুবিখ্যাত জীববিজ্ঞানী রব ওয়ালেস এবং অন্যান্যরা একটি গবেষণাপত্র লিখেছেন— COVID-19 and Circuits of Capital। এঁদের বক্তব্য পুঁজির জন্মলগ্ন থেকে সর্বোচ্চ মুনাফার জন্য প্রকৃতির ওপরে প্রভুত্ব করার যে উদগ্র বাসনা তার থেকে বিভিন্ন মহামারির জন্ম— কোভিড-১৯-ও ব্যতিক্রম নয়। এঁদের বিনীত পরামর্শ— Can we fundamentally adjust the modes by which we appropriate nature and arrive at more of a truce with these infections?

পূর্বোল্লিখিত “Escaping Pandora’s Box – Another Novel Coronavirus”-এ বলা হয়েছিল— We have created a global, human-dominated ecosystem that serves as a playground for the emergence and host-switching of animal viruses, especially genetically error-prone RNA viruses, whose high mutation rates have, for millions of years, provided opportunities to switch to new hosts in new ecosystems. It took the genome of the human species 8 million years to evolve by 1%. Many animal RNA viruses can evolve by more than 1% in a matter of days. It is not difficult to understand why we increasingly see the emergence of zoonotic viruses. ভাইরাসের লক্ষ লক্ষ বছরের জীবনযাত্রা আমাদের লোভের এবং মুনাফার তাড়নায় ভেঙে দিয়েছি।

আগ্রহীরা মাইক ডেভিসের “The Monster is Finally at the Door” কিংবা সারা ক্লিফ এবং বব ওপেনহেইমার-এর “What the Coronavirus Means for the UN, IMF, and World Bank” দেখতে পারেন। দেখতে পারেন ইয়ুভাল নোয়া হারারির দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ– “The World After Coronavirus” (Financial Times, 20.03.2020) এবং “In the Battle Against Coronavirus, Humanity Lacks Leadership” (Time, 15.03.2020)। যদিও রাষ্ট্রপন্থী হারারির প্রতিপাদ্য ভিন্ন, কিন্তু অনেক চিন্তার খোরাক জোগায়।

একই সঙ্গে ভাবতে হবে আইএমএফ এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের চাপে প্রতিটি দেশের, বিশেষ করে গরীব দুর্বল ও ছোট দেশগুলোতে, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে গেছে। এর জায়গা নিয়েছে কর্পোরেট হেলথ সেক্টর যেখানে স্বাস্থ্য নেই, রয়েছে বহুমূল্যে কেনা স্বাস্থ্য পরিষেবা। এ কারণে আফ্রিকার দেশগুলোতে এবোলা মহামারির চেহারা নিয়েছিল যখন তখন স্বাস্থাকর্মীদের বেশিরভাগের কাছে একটি গ্লাভস কিংবা মাস্কও ছিল না। এখনও ইতালি, স্পেন, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, আমেরিকার মতো দেশে জনস্বাস্থ্য উপেক্ষিত হবার বিষময় ফল ২০২০-র পৃথিবী দেখছে। বিবিসি নিউজ-এর ৩০.০৩.২০২০-র খবর হল “Coronavirus: India’s pandemic lockdown turns into a human tragedy”। প্রবন্ধটিতে মন্তব্য করা হয়েছে– “The next few days will determine whether the states are able to transport the workers home or keep them in the cities and provide them with food and money.” নিওলিবারাল অর্থনীতির নামমাত্র মূল্যে উৎপাদন এবং মুনাফা সচল রাখার বড় হাতিয়ার হল এই পরিযায়ী লক্ষ কোটি মানুষ। কিন্তু বর্তমান রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় এদের অবস্থান কোথায়? গণবণ্টন ব্যবস্থায় এদের অবস্থান কোথায়? অথচ এদের অনিবার্য অবস্থানের জন্যই এরা জনস্বাস্থ্যের দিক থেকে ভাইরাসের জতুগৃহও বটে।

আমরা এই সময়ের সাক্ষী। প্রায় সবকিছুকেই আমরা রাষ্ট্রের নির্ধারিত বিধি অনুযায়ী বুঝতে এবং জানতে শিখেছি। অন্য পথে ভাবার অভ্যেস আমরা হারিয়ে ফেলছি। কাম্যুর বিখ্যাত উপন্যাসে প্লেগের ডাক্তার রু (Rieux) কাল্পনিক ওরান শহরে প্লেগের মহামারির পরে বলেছিলেন– I have no idea what’s awaiting me, or what will happen when this ends. বলেছিলেন– For the moment, I know this: they are sick people and they need curing.

হ্যাঁ, আমাদের এই কাজটি করতে হবে। কিন্তু কী ঘটতে পারে সেটা তিনি না জানলেও এই কুটিল এবং ভয়াল সময়ে আমাদের জেনে নেওয়া জরুরি। তাই এত কথা বলা।


[1] The Untold Toll; ১৭.০৪.২০২০
[2] Covid-19 and the Need for Health Care Reform; ১৭.০৪.২০২০
[3] Double Jeopardy: The Impact of Neoliberalism on Care Workers in the United States and South Africa; Mimi Abramovitz, Jennifer Zelnick; International Journal of Health Services 2010, 40 (1): 97-117
[4] Health care in developing countries; Amor Benyoussef, Barbara Christian; Social Science and Medicine 1967, 11 (6-7): 399-408
[5] A Different Model – Medical Care in Cuba; Edward Campion and Stephen Morrissey, New England Journal of Medicine 2013, 368(4): 297-299
[6] The stages of international (global) health: Histories of success or successes of history?; Anne-Emmanuel Birn, Global Public Health 2009, 4(1): 50-68
[7] Health for all beyond 2000: the demise of of the Alma-Ata Declaration and primary health care in developing countries; John H Hall, Richard Taylor, Medical Journal of Australia 178 (2003): 17-20

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...