অপরাজিতা ভট্টাচার্য
‘কই রে দুলু, হল তোর?’
রোজ এই ডাকটার অপেক্ষা করে লতা। লতার বর দুলালকে কাজে যাওয়ার জন্য ডাকতে আসে কেষ্টদা। কেষ্টদাই ধরে বেঁধে দুলালকে রোজ কাজে নিয়ে যায়। দুলাল গড়িমসি করে বেরোলে বছর তিনেকের ছেলে রাজাকে ঘুম থেকে তুলে দুধ খাওয়াতে বসে লতা।
দুলালের বাবা পঞ্চাননের তেজারতি কারবারে রোজগার ছিল দোহাত্তা। লতা বিয়ে হয়ে এসে সংসারে দেখেছে সে রোজগারের ছাপ। মাটির দাওয়া ঘিরে পরপর ছটা ঘর। দাওয়া থেকে ছোট তিনটে ধাপ নামলে বেশ বড় উঠোন, তুলসি মঞ্চ। উঠোন ঢালু হয়ে নেমে গেছে পুকুরে। ওদের নিজস্ব বড় পুকুর। ভারি বৃষ্টিতে পুকুর উপচে জল ঢোকে উঠোনে। লতা ভাবে তার বুঝি নদীর ধারে শ্বশুরঘর।
গাঁঘর হলেও উঠোন ঝাঁটানো, দালান নিকানোর জন্য বাগদি মেয়ে ছিল। এক বুড়ি মাসি এসে রান্না করে দিয়ে যেত। হতদরিদ্র বাপের তিন নম্বর মেয়ে লতা। বাপের ঘরে কলমিশাক সেদ্ধ আর ভাতই জুটত। সেখানে শ্বশুর ঘরের দুবেলা মাছ ভাতে লাবণ্য ঠিকরাত লতার মুখে।
বাড়িময় সন্ধের ধূপ দীপ দেখিয়ে, দাওয়ার কুলুঙ্গিতে জাগ প্রদীপ জ্বালাই ছিল লতার একমাত্র ধরাবাঁধা কাজ। শাশুড়িও কোন্দল জানেন না। দুলাল রোজগেরে না হলেও শ্বশুরবাড়ির সুখ ছিল লতার। পালাপার্বণে মেলা থেকে পছন্দের জিনিস কেনার পয়সা দিতেন পঞ্চানন। চাঁদ মেখে ঘুটঘুটে রাত যখন নারকেল পাতার মিহি সরসর শব্দে ভাসত, নিজের ঘরে তখন চাপা অহং বুকে ঘুমোত লতা। পাড়ার অন্যান্য বউদের তুলনায় সে ভাগ্যবতী।
দুলালের মায়ের মৃত্যুতে ছবিখানা বদলে গেল। চিকিৎসায় মেলা খরচ হল। পঞ্চানন সঙ্গীহারা, একলাটি বসে থাকতে লাগলেন মাটির দাওয়ায়। অকালে থুত্থুরে হয়ে গেলেন মানুষটা। দুলাল অলস। কাজে তেমন মন নেই। পুকুরপারে, গাছের ছায়ায়, চায়ের দোকানে কেটে যায় দিন। নেশাভাঙ করে না এই যা। তেজারতি কারবার লাটে উঠল। মাস মাইনের কাজের লোকেরা বিদেয় হল। সংসারের জোয়াল লতার কাঁধে। লতা তখন অন্তঃসত্তা। পঞ্চাননের জমানো টাকায় চলছে সংসার। ঘটির জল ঢালতে ঢালতে ফুরোয় একসময়। দুলালের কোনও তাপ-উত্তাপ নেই।
লতার ছেলে হতে বুড়ো মানুষটা ধীরে ধীরে খানিক স্বাভাবিক কথাবার্তা শুরু করলেন। আদরের নাতির নাম দিলেন রাজা। হামা টানা থেকে গুটগুট করে হাঁটতে শেখা, সব নজরে রাখতেন পঞ্চানন। জিওন কাঠি নাতির পিছনে পিছনে ধর ধর করতে করতে দাদু সর্বদা।
‘আরেকটু বড় হতে দাও বৌমা, চৌকস বানাব রাজাকে। ওর বাপটার মত ম্যাদামারা নয়। বাঁখারি দিয়ে ধনুক বানিয়ে দেব, গাছের ডাল কেটে গুলতি। পঞ্চানন হাট থেকে কাঠের ঘোড়া কিনে আনেন। চড়বে, দুলবে নাতি।’ শ্বশুর আবার বলভরসা হয়, লতাও আবার চোরা অহং টের পায়।
পঞ্চাননের সঙ্গে মিলে দক্ষ হাতে সংসার সামলাচ্ছিল লতা। হঠাৎ এক ফাল্গুনের রাতে ঘুমের মধ্যে বেঘোরে মারা গেলেন দুলালের বাবা পঞ্চানন।
দুলাল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল আর আতান্তরে পড়ল লতা। ভাবে ভোলা দুলালকে সে সাংসারিক ব্যাপারে ভরসাই করে না সেরকম। বাবা বেঁচে থাকতে অনটনের মধ্যেও দুলাল কোনদিন রোজগারের চিন্তা করেনি। ছোট্ট ছেলেটাকে নিয়ে কী করবে ভেবে পায় না লতা।
দাদুর ঘরে রাজা কাঠের ঘোড়ায় দুলতে দুলতে দাদুকে এদিক ওদিক খোঁজে। রাজাকে চোখে হারাতেন মানুষটা। স্নান করানো আর খাওয়ানো ছাড়া ছেলেকে নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাত না লতা। পঞ্চানন থাকতেই বিকেলের দিকে শাড়িতে জরি, চুমকি বসানোর কাজ শুরু করেছিল। রাজাকে বিকেলে দুধ খাইয়ে শ্বশুরের জিম্মায় দিয়ে, অর্ডারের শাড়ি নিয়ে বসত।
বাবা মারা যাওয়ার পরেও দুলাল রোজগারের দিকে ঘাড় পাতত না যদি না কেষ্টদা পিছনে লেগে থাকত। গ্রামের গরীব পুরুতের ছেলে এই কেষ্টদা। যজমানির দিন আর নেই। যে কম্পানিতে নিজে কাজ করে সেখানেই লাগিয়েছে দুলালকে। রোজ কাজে নিয়ে যাওয়ার দায় যেন কেষ্টদার। দুলাল সকালে কাজে চলে যায়। আর এদিকে হেঁসেল ঠেলে, সেলাই সামলে রাজাকে নিয়ে সারাদিন হিমসিম খেতে থাকে লতা।
সকালে রওয়ানা হওয়ার সময় দুলালকে পৈপৈ করে লতা বলে দিয়েছে ফেরার সময় চুনোমাছ আর আম আনার কথা। নিজে বাড়তি দুধ নিয়েছে গয়লার থেকে। অম্বুবাচি লেগেছে আজ। লতার শাশুড়ি বলতেন বছরের এই তিনটে দিন নাকি ঠাকুরের, পৃথিবীর শরীর খারাপ হয়। ফসলে ভরভরন্ত হয় ঋতুমতী পৃথিবী মা। এসময় মাছভাতের সঙ্গে দুধ আম খেতেই হয়। বিয়ে হয়ে এসে থেকে এই সময় মাছভাতের পর আম দুধ খায় লতা।
সবে আষাঢ়ের এক সপ্তাহ কেটেছে। গত দুদিন ধরে নাগাড়ে বৃষ্টি হয়েই চলেছে। ভারি বৃষ্টি, মাঝে মাঝে ঝিরঝির, ধরেনি মোটে। আলো ফোটেনি সেভাবে, ঘোলাটে দিন। দলা দলা কালো মেঘে ঢাকা আকাশ। কেষ্টদা না এলে কোনওমতেই আজ কাজে যেত না দুলাল। সপ্তাহের টাকা দেবে বলে ধরে বেঁধে নিয়ে গেছে কেষ্টদা। গত রাত্তির থেকেই শরীরটা ভাল নেই লতার। মাথা, কোমর যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে। বেশ বুঝতে পারছে ভেতরে ঘুসঘুসে জ্বর।
দুলালকে বললে এই অছিলায় হয়ত কাজেই যাবে না। বড় বদ অভ্যাস দুলালের। একদিন কামাই করলে পরের দিনও যেতে চায় না। এইসব চিন্তা করেই দুলালকে কিচ্ছুটি বলেনি লতা। লতাদের পুকুর উপচে জল প্রায় উঠোন সমান হয়েছে।
দুলাল যেতে না যেতেই আজ রাজাও উঠে পড়েছে। রাজাকে আজ চোখে চোখে রাখতে হবে, ছোট থেকে ঠান্ডার ধাত। উঠোনের জলে নামলেই জ্বর কাশি হবে। খিচুড়ি চাপিয়ে সদ্য কেনা সেকেন্ড হ্যান্ড টিভিটা চালিয়ে দেয় লতা। টিভি চললে রাজার নড়াচড়া নেই, নিচু চৌকিতে বসে থাকবে চুপটি করে।
আলো ফুটলই না। কিন্তু ঘড়ি বলছে বেলা বাড়ছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাঁপিয়ে জ্বর আসছে লতার। দুলালকে জ্বরের বড়ি আনতে বলারও জো নেই। রাজাকে দুবার দুধ খাওয়ানো, চালে ডালে ফোটানো আর দাওয়া নিকোতেই বেজায় বেলা গড়াল। হাড়ে আগুন কাঁপন তখন, চোখ জ্বালা করছে বেদম জ্বরে। মায়েপোয়ে চান পর্যন্ত করল না। কয়েক গাল খিচুড়ি রাজার মুখে কোনওরকমে দিল লতা। নিজে খেল না এক দলাও। একে তো জ্বরের অরুচি, তার ওপর দুলালকেও আজ কিছু টিফিন করে দেয়নি। বাইরে আজকাল কিছু কিনে খায় না মানুষটা। বিকেলে ফিরলে একসঙ্গেই কিছু খাবে। তারপর চুনোমাছ ভাজবে রাতে, সঙ্গে আম দুধ।
রাজার হাত মুখ ধুইয়ে দিয়ে চৌকিতে গিয়ে শুয়ে পড়ে লতা। রাজাও মায়ের দুধের নেশায় লতার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। এই শরীরে সেলাই ফোঁড়াই আর হবে না বিকেলে। ফলে ঘুম থেকে ওঠার কোনও তাড়া নেই।
‘কই গো? মা ব্যাটায় ঘুমোচ্ছ নাকি এখনও? লতাআআআ ও লতাআআআ …’
দাওয়াতে ভেজা ছাতাটা মেলে দিয়ে গোটানো প্যান্টটা খুলতে খুলতে হাঁক দেয় দুলাল।
‘রোদ ফোটেনি সারাদিন। আর এখন তো ধূপ দীপ দেওয়ার সময়। উঠে এসে দেখো আম এনেছি। এই বাদলায় মাছ পাইনি গো। ছেলেকেও তোলো। অবেলার ঘুমে গা ভারি হবে যে। রাজা…’
উঠোনে গোড়ালিডোবা জল। আর ঘণ্টা খানেক ভারি বৃষ্টি হলেই জল দাওয়া ছোঁবে। নিকষ কালো মেঘেদের ফোঁকর গলে বেরিয়েছে আধফালি চাঁদ। ধীরে ধীরে উঠে এসে দুলালের পাশে বসে লতা। জ্বর আর অসময়ের ঘুমে শরীর ভারি হয়ে আছে, ফোলা চোখ।
‘চোখ খুললেই তো ঐ কাঠের ঘোড়ায় বসা চাই। দেখো গে বাবার ঘরেই ঘোড়ায় দুলছে…’ হাই তুলতে তুলতে কথাটা শেষ করতে পারে না লতা।
‘আরে আরে, দেখো, দেখো মাছ যে!’ দুলাল ফিসফিসিয়ে বলে। বাদলা সন্ধের ক্ষীণ আলোতে লতাও দেখতে পেল। উঠছে, নামছে, উঠছে, নামছে। ওজনদার মাছ।
‘জাল তো নেই। বাবার বর্শাটা আনো তো। দেখি চেষ্টা করে। গাঁথতে পারলে আজ রাতের খাওয়াটা জমবে গো। কতদিন পাকা মাছের ঝাল খাইনি।’
লতা পা টিপে গিয়ে বাড়ির সদর দরজার পাশে রাখা বর্শাটা এনে দেয়।
‘পারবে তুমি?’ দুলালের কানের কাছে এসে বলে লতা।
নিজের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে লতাকে ইশারায় চুপ করতে বলে দুলাল। ঘন হয়ে আসা অন্ধকারে কপাল ঠুকে তাক করে বর্শা ছোঁড়ে। অব্যর্থ নিশানা। গেঁথে যায় বর্শা। বর্শাটা গাঁথতে পারবে দুলাল, আশাই করেনি লতা।
বৃষ্টি তখন উপর্ঝরণ নয়, টিপটিপ। ছাতা না নিয়েই বর্শা টেনে তুলতে উঠোনের জল পেরিয়ে যায় দুলাল, পিছনে লতা। ধীর পায়ে সন্তর্পণে যেতে সময় লাগে খানিক। মাছটা সত্যি ওজনদার। প্রথমটায় তুলতে পারে না দুলাল।
‘তাড়াতাড়ি করো। রাজাকে দুধ খাওয়াব, চা করব।’
দুলালকে তাড়া দিয়ে বর্শায় গাঁথা মাছ তুলতে হাত লাগায় লতা। বর্শা সামান্য ওপরে তুলতেই জলের রং বদলে যায়। মেঘের ছোপ লাগা চাঁদের আলো ম্রিয়মাণ। তাও ঠাহর করা যায় সে রং রক্তের।
‘তোমার মা বলতেন অম্বুবাচির সময় মাটির মাসিক হয় জানো। মাটি আরও উর্বর হয়, ফসল হয়। দেখো আজ কেমন লাল জলে ভাসছে মাছ। রাজা বড় ভালবাসে। ঠাকুর পাঠালেন।’ কথা বলতে বলতেই লতা আবার টের পায় সে ভাগ্যবতী।
দুজনের আরও একটু বল প্রয়োগে বর্শার তীক্ষ্ণ ফলায় উঠে আসে রাজা। রাজার পিঠে গাঁথা বর্শা।
ওদের দুজনের হাতে ধরা বর্শায় গাঁথা রাজার ভেজা নিথর দেহ। লতা, দুলালের পায়ের কাছে ছলাৎ ছলাৎ করছে অন্য রঙের জল, তাজা রক্তের আঁশটে গন্ধ গলা টিপে ধরছে। পরস্পরের মুখে চেয়ে ওরা বোঝার চেষ্টা করছে সম্যক। পড়শি বাড়িগুলোতে ধূপ দীপ জ্বালা হচ্ছে, শাঁখ বাজছে। লতা এসময় কুলুঙ্গিতে জাগ প্রদীপ জ্বালিয়ে নিজেকে অন্য বউদের চেয়ে ভাগ্যবতী মনে করে। কিছুক্ষণ আগেও ভেবেছে।
আজ এ বাড়ি জুড়ে এক অপ্রাকৃত প্রেতসন্ধ্যা।
বর্শার আগায় ছেলের শরীর নিয়ে উঠোনে ওরা কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল! কতক্ষণ? যতক্ষণে বুঝেছিল এ তাদেরই ছেলে, মরা ছেলে, জলে ডুবে ফুলে ওঠা রাজা, পিঠে বর্শা গাঁথা রাজা।
‘বর্শাটা পিঠ থেকে টেনে বের কোরো না গো। আরও রক্ত বেরোবে। দাওয়া, উঠোন সব ভেসে যাবে। কাল থেকে এমনিতেই অম্বুবাচি লেগেছে। তার ওপর আবার আমাদের ছেলের রক্ত। সইবে না গো। মুখ সাদা হয়ে গেছে ছেলের আমার। যেমন আছে থাক।’ পাষাণ মুখে বলে লতা। ভাবে ভোলা দুলাল দাওয়ার বাঁশে হেলান দিয়ে বসে থাকে জগদ্দল।
রাজাকে ওরা দাওয়াতে উপুড় করে শুইয়ে দেয়। বর্শা গাঁথাই থাকে পিঠে। তিন বছরের ছোট্ট রাজা যেন উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে, ডাকলেই উঠে পড়বে। নিথর স্তব্ধতায় কঁকিয়ে উঠছে ভিত।
‘কই রে দুলু, হল তোর?’ কাজে যাওয়ার জন্য কেষ্টদা ডাকে।
সাড়া পায় না। আবার ডাকে।
‘আজ রোদ উঠেছে দ্যাখ, বৃষ্টি নেই। চল না রে ভাই। কাজে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে।‘
অধৈর্য হয়ে উঠোনে এসে ঢোকে কেষ্টদা। আরেকবার ডাকার আগেই শিউরে ওঠে বর্শা গাঁথা রাজাকে দেখে। দাওয়া থেকে উঠোনে চুঁইয়ে নেমেছে ভেজা ভেজা রক্তের রেখা।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় কেষ্টদা এবার গগনবিদারী ডাক দেয় ‘দুলাল ও দুলাল… কোথায় গেলি রে… কোথায় তোরা…’
দুলালের ঘরে ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে বৃষ্টি শেষের আয়না রোদ ঢুকেছে। দু জোড়া ঝুলন্ত পা…