নীলাঞ্জন হাজরা
পূর্ব প্রকাশিতের পর
মুসাফিরি — সাত
সমুদ্রের স্বাদ!
সুড়ুৎ করে সরাসরি খোল থেকে মুখে টেনে নেওয়াই দস্তুর৷ একটানে আসবে না, কারণ গোড়াটা খোলের সঙ্গে লেগে থাকবে৷ দাঁত দিয়ে মৃদু টান৷ ব্যাপারটা মোলায়েমভাবে করে ফেলা একটা শিল্প৷ একটু অভ্যেস লাগে৷ তারপর মুখের মধ্যে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হাল্কা চিবিয়ে গিলে ফেলা৷ আর তার পরেই এক চুমুক ওয়াইন৷ হতেই হবে সাদা— আমি পছন্দ করি সোভিনিয়োঁ ব্লঁ৷ শার্ডনেও দিব্যি চলতে পারে৷ চিল্ড্৷ বোতলের গায়ে হাল্কা কুয়াশা হওয়া চিল্ড্৷ না৷ একটু ভুল হল৷ ওই চিবিয়ে গিলে ফেলা আর চুমুকের মধ্যে একটা ফাঁক থাকতেই হবে৷ ততক্ষণের ফাঁক, যতক্ষণ না সমুদ্রের একটা গভীর স্বাদ ছড়িয়ে পড়ে সারাটা অস্তিত্বে৷ ঝিনুক৷
এইভাবেই আমায় হাতে ধরে ঝিনুকের মর্ম বুঝিয়ে ছিলেন আমার একদা বস্, বর্তমান বন্ধু ডগলাস জি কেলি৷ ডাকনামে— ডাগ৷ জাত Sea-food বলতে আমি দু গোত্রের পাঁচটি জিনিস বুঝি৷ তার কারণ, আমার কাছে ‘সি-ফুড’ হল সেই খাদ্য যা স্বাদগ্রন্থি বেয়ে সমস্ত অনুভূতিতে ছড়িয়ে দেবে এমন একটা ‘ফ্লেভার’ যাকে সমুদ্রের গভীর স্বাদ ছাড়া আর কিচ্ছু বলা যায় না৷ পৃথিবীর অন্য সমস্ত খাবার— বিরিয়ানি থেকে স্টেক, হিমসাগর আম থেকে নতুন গুড়ের সন্দেশ বা অ্যাপলপাই, বিশ্বে যা কিছু সুখাদ্য আছে তার সঙ্গে এখানেই ‘সি-ফুড’-এর মৌলিক স্বাদের তফাৎ৷ সুস্বাদু বলতে যা বোঝায়, ‘সি-ফুড’ তা মোটেই নয়৷ না৷ গড়িয়ে আসা ফ্যানা ফ্যানা জলে ছপাত ছপাত করে পায়ের পাতা ভিজিয়ে যদি ‘সমুদ্রে গিয়েছি, সমুদ্রে গিয়েছি’ বলে নাচানাচি করতে ভালোবাসেন— চিংড়ি মিংড়ি খেয়ে বলে বেড়ান ‘সি ফুড’ খেয়ে এলুম৷ যদি নুলিয়ার হাত খামচে ধরে টিউবে চড়ে আরও খানিকটা এগিয়ে মর্দাঙ্গি দেখাতে চান— লবস্টার ট্রাই করুন৷ বহুত তালিয়াঁ পড়েঙ্গে৷ জাত সি-ফুড হল স্বাদের মহাসমুদ্রে সেই অ্যাডভেঞ্চার যার সঙ্গে তুলনা চলতে পারে জেলেদের ডিঙি নৌকোয় চড়ে অনন্তের বুকে ভেসে পড়ার৷ সে স্বাদ সমুদ্রের মতোই মৌলিক৷ সে গন্ধ সমুদ্রের মতো নোনা৷
আমার মতে এই জাত সি-ফুড-এর প্রথম গোত্রটিতে আছে— Mussels, oyster, clam৷ ডিকশনারি খুলে দেখুন বাংলায় তিনটিকেই বলবে ‘ঝিনুক’৷ প্রাণীবিদরা চটে টং হবেন৷ হতে দিন৷ আমরা ঝিনুকই বলব৷ আর জাত সি-ফুড অভিযাত্রী সেই ঝিনুক খোল থেকে সুড়ুৎ করে টেনে নেবেন কাঁচা৷ ইয়েস, একদম কাঁচা৷ র৷ আনকুক্ড্৷ শুধু মুখে টেনে নেওয়ার আগে ছড়িয়ে নিতে হবে কয়েক ফোঁটা লেবু৷ খবরদার নুন নয় কিন্তু৷ ‘চলো তোমায় আজ খাওয়াবো খাসা র অয়েস্টার,’ এই বলে ডাগ সাহেব আমায় আর্লিংটন ভার্জিনিয়া থেকে নিজে এক ঘণ্টার ওপর গাড়ি চালিয়ে হাজির করেছিলেন বল্টিমোর মেরিল্যান্ডে৷
বল্টিমোর বন্দর৷ ইনার হার্বার৷ উত্তর অতলান্তিক মহাসমুদ্র চিজেপিক খাঁড়ি হয়ে পাটাপস্কো নদী বেয়ে হুবহু কাঁকড়া বিছের দাঁড়া দুটোর মতো ঢুকে পড়ে বল্টিমোরকে আগলে রেখেছে বা কামড়ে ধরেছে দু দিক থেকে৷ তারই ডান দিকের, অর্থাৎ উত্তরপূর্ব দিকের ডগায় গাঁথা আছে ইনার হার্বার৷ কিন্তু তা তো শুধু বন্দরই নয়৷ খিদিরপুর বন্দর বলতে আমরা যা বুঝি তা একেবারেই নয়৷ ইনার হার্বার একটি পুরোদস্তুর পর্যটন কেন্দ্র৷ পার্ক, শপিং মল, রেস্তোরাঁ, জাদুঘর, বিশাল বিশাল মাস্তুলে পাল ঘাড়ে করে দাঁড়ানো ঐতিহাসিক জাহাজ আর তার পাশ দিয়েই মসৃণ গতিতে ভেসে যাওয়া অত্যাধুনিক ক্রুজ-তরী৷ এবং আমার কাছে মহা-আকর্ষণ— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘ন্যাশনাল অ্যাকুয়ারিয়াম’৷ সারা দিন কাটিয়ে ছিলাম এই ইনার হার্বারে৷ সব কিছুই এত সাজানো গোছানো যে মনে হয় যেন ১৯৬০-এর দশকের কোনও রোমান্টিক ফিল্ম-এর সেটে ঢুকে পড়েছি৷ তারই মধ্যে অবশ্য দেখেছি ফুটপাথে বসে পটাপট ছবি এঁকে বিক্রি করছে কৃষ্ণাঙ্গ শিল্পী৷
ইনার হার্বার, বল্টিমোর
এই ছিমছাম রঙিন ইনার হার্বারে ঘুরতে ঘুরতে আমার মনে পড়ে গেল ‘মিস্টিক’ গ্রামের কথা৷ ছোট্ট বসতি৷ আমি যখন গিয়েছিলাম বড়োজোর হাজার তিনেক লোকের বাস৷ কিন্তু আরও অনেক পরে আমার দেখা সুদূর নিউ মেক্সিকো-র স্যান্টা ফে-র মতোই এ বসতিও যেন হুবহু একটা পিকচার পোস্টকার্ড (দুর্ভাগ্যবশত, অনেক খুঁজেও একটা ছবিও পেলাম না, যদিও অনেক ছবি তুলেছিলাম)৷ কিন্তু স্যান্টা ফে-র সঙ্গে রয়েছে আর একটা মিলও৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল বাসিন্দা লক্ষ লক্ষ নেটিভ আমেরিকান বা আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের খতম করে শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্য বিস্তারের নির্মম কাহিনির মিল৷ সভ্যতার আদি পর্ব থেকে হাজার হাজার বছর ধরে পূর্বে পাউকাটুক নদী থেকে পশ্চিমে কানেটিকাট নদী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ কানেটিকাট অঞ্চলে ছিল পেকো আদিবাসীদের বসবাস৷ তার পরে এল সেই ভয়ঙ্কর সপ্তদশ শতক৷ স্যান্টা ফে-তে যেমন হাজির হয়েছিল স্পেনিয়ার্ডরা, এখানে এল ডাচ এবং তার পরে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ৷ স্যান্টা ফে-তে গিয়েছিল শুধু বন্দুক-কামান আর শিকারি কুকুর, মিস্টিক-এ তার সঙ্গে এল ইউরোপিয়ানদের দুই মহামারি যা আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল— গুটি বসন্ত আর হাম৷ গ্রাম কে গ্রাম উজাড় হয়ে গেল৷ তার সঙ্গে তো ছিলই গণহত্যার পর গণহত্যা৷ ১৬৩২ সাধারণাব্দ৷ ঠিক কলকাতায় ইংরেজদের ফোর্ট উইলিয়ামের মতো একটা বাণিজ্য কুঠি হার্টফোর্ডে বানিয়ে ফেলল ডাচরা৷ সেই শুরু৷ তারপর এল ইংরেজরা৷ আর ঠিক ভারতেরই মতো ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ গোছের একটা বিভাজন করে ফেলা গিয়েছিল আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের মধ্যেও৷ তারপর সেই ভয়াবহ দিন৷ ২৬ মে, ১৬৩৭৷ মিস্টিক ম্যাসাকার৷ ক্যাপ্টেন জন মেসন এবং ক্যাপ্টেন জন আন্ডারহিল-এর নেতৃত্বে ইংরেজ বাহিনী চারপাশ থেকে ঘিরে আগুন লাগিয়ে দিল মিস্টিক গ্রামে৷ এক ঘণ্টায় ৬০০ থেকে ৭০০ পেকো আদিবাসীকে খুন করা হয়েছিল, যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল নারী এবং শিশু৷ সেই দুর্দান্ত ইংরেজ অ্যাডভেঞ্চারের খাসা বর্ণনা দিয়েছেন আন্ডারহিল নিজেই— ‘… Many were burnt in the Fort, both men, women, and children, others forced out, and came in troopes to the Indians, twentie, and thirtie at a time, which our souldiers received and entertained with the point of the sword; downe fell men, women, and children…’ (সূত্র— Nevves from America; or, a new and experimentall discoverie of New England; containing, a trve relation of their war-like proceedings these two yeares last past, with a Figure of the Indian Fort, or Palizado. By Captaine IOHN UNDERHILL, a Commander in the Warres there. LONDON, Printed by J.D. for Peter Cole. 1638৷ বানান অপরিবর্তিত৷ আর, ওয়াঃ সাহেব! ‘এন্টার্টেন্ড’ শব্দটির এমন ব্যবহার মনে রাখব৷)
আন্ডারহিল অবশ্য জানতেনই যে, প্রয়োজনে নিরস্ত্র নারী এবং শিশু খুন করায় সম্পূর্ণ সায় আছে ভগবানের৷ তাঁর নিজের ভাষায়— ‘… Sometimes the Scripture declareth women and children must perish with their parents… We had sufficient light from the Word of God for our proceedings.’ সাবাশ৷ কিন্তু এখন কোত্থাও নেই আর সেই রক্তের ছাপ৷ ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়-এর সেই অমোঘ কবিতা— নহি, কহিঁ ভি নহি হ্যায় লহু কা সুরাঘ…৷ এখন সব ফুরফুরে৷ সব ছিমছাম৷ সব যেন ছবির মতো৷
সি অ্যানিমোন
স্টিং রে
ইনার হার্বারে ঘুরতে ঘুরতে মিস্টিক গ্রামের কথা মনে পড়েছিল আর একটা কারণে৷ বল্টিমোরের ন্যাশনাল অ্যাকুয়ারিয়ামকে রীতিমতো টক্কর দিতে পারে এমন অ্যাকুয়ারিয়াম রয়েছে মিস্টিকেই৷ সত্যি বলতে কী জীবনে প্রথমবার এমন একটা অ্যাকুয়ারিয়াম দেখতে দেখতে আমার মনে হচ্ছিল গ্রামটার থেকে অ্যাকুয়ারিয়ামটা বড়৷ কত কী যে দেখেছিলাম— তার মধ্যে তিনটে জিনিস বিশেষ করে মনে আছে৷ বেলুগা তিমি৷ লম্বায় প্রায় ২০ ফুট৷ ওজন ১৫০০ কিলোগ্রাম৷ সি লায়ন বা এক ধরনের কানওয়ালা সিলমাছ৷ আর তাক লেগে গিয়েছিল দেখে — একটা ইঞ্চি ছয়েক গভীর ওপর খোলা কাচের বিরাট চৌকো পাত্রে সামুদ্রিক বাগান৷ কী রংয়ের ফুল নেই তাতে, নীল, লাল, খয়েরি, সাদা৷ আর ফুলগুলো সব আসলে এক একটা প্রাণী, উদ্ভিদ নয়— সি অ্যানিমোন! এখন এমন কিছু কিছু কলকাতাতেও দেখা যায় বটে কিন্তু প্রায় ২০ বছর আগে আমি সত্যিই হাঁ হয়ে গিয়েছিলাম৷ আর বল্টিমোর ন্যাশনাল অ্যাকুয়ারিয়ামেও এই সি-অ্যানিমোনের বাগান তো দেখলামই, সঙ্গে দেখলাম জীবন্ত প্রবালের প্রাচীর— কোরাল রিফ৷ এ ছাড়া বল্টিমোরে বিশাল বিশাল হাঙর, স্টিং রে, পিরহানার ঝাঁক, নীল জ্বলন্ত রেখার মতো এক ধরনের মাছ (যার নাম আর আজ মনে নেই) এ সবের সঙ্গে দেখেছিলাম আশ্চর্য ফ্লুরোসেন্ট উজ্জ্বল নীল রঙের ব্যাং, যেমন ব্যাং আর আমি জীবনে দেখিনি৷ তবে মিস্টিকেও নয়, বল্টিমোরেও নয়, জীবনে অ্যাকুয়ারিয়ামের মধ্যে সব থেকে রুদ্ধশ্বাস দৃশ্য আমি দেখে ছিলাম ভুবনেশ্বরের নন্দনকাননে— জেলি ফিশের বাচ্চা হচ্ছে৷ শত শত প্রায় স্বচ্ছ পুটকি পুটকি জেলিফিশ বিরাট কাচের ট্যাঙ্ক জুড়ে ওপর থেকে ভাসতে ভাসতে নীচের দিকে নেমে আসছে খুদি খুদি প্যারাশুটের মতো৷
আর মিস্টিক এবং বল্টিমোর দুই অ্যাকুয়ারিয়ামেই চেয়ারের হাতল খামচে ধরে দেখেছিলাম ফোর-ডি শো৷ বিশাল একটা হাঙর যখন দুরন্ত গতিতে দর্শকদের দিকে তেড়ে এসে পর্দা থেকে হঠাৎ মুখ বার করে প্রত্যেককে জলের ছিটেতে ভিজিয়ে দিল, হলের সম্মিলিত তারস্বরে আর্তনাদ শুনে মনে হল পালে বাঘ পড়েছে৷ আমিও বাদ যাইনি৷
মিস্টিক এবং বল্টিমোর দুই অ্যাকুয়ারিয়ামেই সব শেষে দেখেছিলাম এমন একটা শো, যা চোখ বন্ধ করে মনে করলেই আজও মনটা খুশিতে ভরে ওঠে৷ ডলফিন শো৷ পেল্লায় পেল্লায় ডলফিনের ট্রেনারদের সঙ্গে ঘণ্টা খানেক ধরে সে কী খেলা৷ গড়িয়ে, শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে, হাতে ধরা রিংয়ের মধ্যে দিয়ে লাফ মেরে, বল খেলে, চুমু খেয়ে, আদিখ্যেতার আর শেষ নেই৷ মুখ দেখলেই মনে হয়, সারাক্ষণ যেন হাসছে৷
আর সে খেলার শেষে যখন উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়েই চলেছি, জামার হাতা ধরে টান৷ ডাগ৷ ‘চলো, চলো৷ এবার বড্ড ভিড় হয়ে যাবে৷ র অয়েস্টার!’ রেস্তোরাঁটার নাম ঠিক মনে নেই, সম্ভবত ‘মাসেল্স্ বার’৷ মনে আছে ইনার হার্বারের বেশ কাছেই৷ ছোট রেস্তোরাঁ৷ কিন্তু সে কী ভিড়৷ বুঝলাম ডাগ আমাকে জাত সি-ফুড অভিযাত্রীদের ডেরায় এনে ফেলেছে৷
ডজন দুয়েক অয়েস্টার সাবড়ে দিয়েছিলাম একাই৷ আর পাক্কা এক বোতল সোভোনিয়ঁ ব্লঁ ওয়াইন৷ ডাগ শিখিয়ে দিয়েছিল৷ সুড়ুৎ করে লেবু চেপা সবজেটে কাঁচা, মানে ‘র’ অয়েস্টার টেনে নিয়ে হাল্কা চিবিয়ে গিলে ফেলার পরে একটু অপেক্ষা করে সমুদ্রের গভীর স্বাদটাকে ছড়িয়ে যেতে দিয়ে যখন ওয়াইনে চুমুক দেবে, মেক শিওর যে মুখের মধ্যে ওয়াইনটা যেন ‘রোল’ করে, মানে জিভের ওপর দিয়ে তলায় এনে আবার ওপরে নিয়ে আসা৷ তার পর গেলা৷ কেন? কারণ, তাতে সমুদ্রের সেই স্বাদ সম্পূর্ণ মুছে যাবে, যাতে পরের ঝিনুকের সাথে আছড়ে পড়তে পারে সমুদ্রের গভীর স্বাদের নতুন ঢেউ৷ এ শিল্পেরই নাম ‘র অ্যান্ড রোল’!
কোনও দিন ভুলব না সেই অভিজ্ঞতা৷ তবে ঝিনুক খাওয়ার আরও একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতাও আমার হয়েছিল৷ কোনও রেস্তোরাঁয় নয়৷ এক্কেবারে জাহাজ ঘাটায় দাঁড়িয়ে৷ ইস্তানবুলে৷ ইস্তানবুলের জাহাজঘাটায়৷ অন্য কেতায়৷ সিরকেচি জাহাজঘাটায় নেমেই চোখ আটকে গেল৷ তখন মাঝ সকাল৷ রেস্তোরাঁ-টেস্তোরাঁ নয়, হুবহু আমাদের ফুচকাওয়ালার মতো ঝিনুকের স্তূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন এক ভদ্রলোক৷ সঙ্গে সঙ্গে হাকানকে হাত টেনে থামাই৷
হাকান গুলস্বেন (উচ্চারণ গুলসেওয়েন)৷ কমরেড হাকান গুলস্বেন৷ ইস্তানবুলের ট্রটস্কাইট কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম নেতা৷ তাঁর বাড়িতেই আমার থাকার ব্যবস্থা৷ আমরা একই বয়সী৷ কাজেই বন্ধু৷ আজ আমায় ইস্তানবুল ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে হাকান৷
‘কী হল?’ জানতে চায় সে৷
‘ঝিনুক,’ আমি চেঁচিয়ে উঠি৷
‘হ্যাঁ, মিদিয়ে৷ তো?’ হাকান অবাক৷
একটু আগেই হাকান আর তার বউ (তখনকার বউ, আমার মন ভেঙে দিয়ে সে বিয়ে ভেঙে গেছে) আয়েজা, আয়েজা ইলমাজ আমায় পেট পুরে ব্রেকফাস্ট খাইয়েছে৷ এনজিনার— অলিভ অয়েলে পদ্ম ফুলের গোড়া (ডাঁটা, যেটাকে কাশ্মিরীরা বলবে নদরু, সেটা নয়, এটা ঠিক পাপড়ির তলাটা) হাল্কা ভেজে সিদ্ধ করা৷ তবু লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেলি, ‘খাব৷’
‘ও! বেশ তো৷ চলো৷’
এইখানে একটু থামতে হবে৷ যে ঝিনুক খেয়েছি বল্টিমোর মেরিল্যান্ডে এ ঝিনুক কিন্তু সে ঝিনুক নয়৷ সে ছিল অয়েস্টার৷ চওড়া৷ খোলার বাইরেটা কিরিকিরি করা সূক্ষ্ম ভাজ৷ নোনতা গন্ধ৷ সে ঝিনুকও মিলবে এখানে৷ তুর্কি ভাষায় বলবে— ইস্তিরিদিয়ে৷ আর এ ঝিনুকওয়ালার ঝিনুক মাসেল— মিদিয়ে৷ কালচে৷ লম্বা৷ একটু চিউয়ি, মানে চিবোতে হয়৷ মিষ্টির আভাস, কিন্তু সমুদ্রের গভীর স্বাদ৷ আসলে এ ঝিনুক মিষ্টি জলেও মেলে, নোনা জলেও৷ এ ঝিনুক বসফরাসের গাঢ় নীল জলের৷
মিদিয়ে বা মাসেল, কাঁচাও খাওয়া যায়৷ কিন্তু সাধারণত তা কেউ খায় না৷ মার্কিন বা ব্রিটিশরা এটা খাবে রসুন আর হোয়াইট ওয়াইন দিয়ে হাল্কা ফুটিয়ে৷ সহজ রেসিপি৷ টাটকা মাসেল নিন৷ শুঁকে নিন৷ সমুদ্রের গন্ধে বুক ভরে যাবে৷ সামান্য খারাপ হলেই মারাত্মক পচা গন্ধ ছাড়বে৷ ভালো করে ধুয়ে নিন৷ অল্পক্ষণ ভিনিগারে চুবিয়েও রাখা যায়৷ মিহি করে রসুন বেটে নিন৷ অলিভ অয়েল গরম করুন৷ রসুন ছেড়েই ভালো করে নাড়তে থাকুন৷ না হলেই ধরে যাবে৷ মিনিট দুয়েকের মধ্যে খুশবু ছড়াতে শুরু করবে রসুন৷ রং নেবে হালকা সোনালি৷ মাসেলগুলো খোলা শুদ্ধু দিয়ে দিন৷ বার চারেক এপিঠ-ওপিঠ করুন৷ ছ্যাঁক-ছ্যাঁক করা বন্ধ হলেই হোয়াইট ওয়াইন ঢালুন৷ বেশ খানিকটা, যাতে মাসেলগুলো ডুবে যায়৷ একটু পরেই সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ফুলে উঠতে থাকবে হোয়াই ওয়াইন৷ নামিয়ে ফেলুন৷ মাসেলগুলো ঠান্ডা হলে চাড় দিয়ে খুলে কাঁটা চামচ দিয়ে খুঁচিয়ে তুলে সটান মুখে৷ আর খোলাটা ফেলে দেবেন না সঙ্গে সঙ্গে৷ লক্ষ করুন অল্প ঝোল জমে আছে ভিতরে৷ সুড়ুৎ করে মুখে টেনে নিন৷ সেই রসের সঙ্গে মাসেল চেবাতে থাকুন৷ আপনি ডিঙি নৌকোতে না হলেও, লঞ্চে চড়ে গভীর সমুদ্রে ভেসে পড়েছেন৷
ইস্তানবুলের পশ্চিমি রেস্তোরাঁতেও পাওয়া যেতে পারে এ ধরনের ঝিনুক৷ কিন্তু জাত তুর্কিরা জাহাজঘাটার ঝিনুকওয়ালার কাছ থেকে, মানে মিদিয়ে সাতিচিসি-র কাছ থেকে যে ঝিনুক কিনে খাবে তা এক্কেবারে আলাদা৷ এর নাম মিদিয়ে দোলমা৷ বাংলায় ঝিনুক ভাত৷ করা একটু ঝামেলার, কিন্তু ততটাও নয়৷ ঝিনুকগুলো পরিষ্কার করে হাল্কা ফুটিয়ে তুলে নিন৷ ভিতরের থকথকে মাংসটা একটু শক্ত হয়ে যাবে— মানে ‘টাফ’ নয়, ‘ফার্ম’৷ সরিয়ে রাখুন৷ সরু চালের ভাত নিন৷ তাতে মিশান ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুচি করা পিঁয়াজ, পাইন নাট (অপূর্ব খেতে, নিউ মার্কেটে পেয়ে যাবেন), সামান্য কিশমিশ, একটুখানি পুদিনা পাতা, সামান্য অলিভ অয়েল৷ সব কিন্তু কুচিকুচি হবে, অলিভ অয়েলে মাখা৷ ঝিনুকের খোলের ভিতরের মাংসটা একটা ধারালো ছুরি দিয়ে দু ভাগ করুন৷ তার মধ্যে সবে তৈরি স্টাফিং-এর ছোট্ট একটা নাড়ু ঢুকিয়ে দিন৷ ঝিনুকের খোল বন্ধ করে একটা সুতো দিয়ে বেঁধে ফেলুন৷ মিনিট দশেক কয়েক ফোঁটা অলিভ অয়েল দেওয়া জলে ফুটিয়ে নিন৷ ব্যস৷
ঝিনুকওয়ালার মিদিয়া দোলমা তৈরি৷ জাহাজ ঘাটায় দাঁড়িয়ে খোল খুলে অল্প লেবু চিপে মুখে নিয়ে চিবোতে থাকুন৷ নীল-নীল বসফরাস চলকে চলকে এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাবে সারাটা অস্তিত্ব৷
‘কত হল?’
‘সর্বনাশ৷ আপনার কাছ থেকে দাম নেব? ছিঃ! আপনি কমরেড হাকানের কমরেড৷ আমাদেরও কমরেড৷’ ঝিনুকওয়ালা পাত্তাই দেন না আমার জেদাজেদির৷
‘কিন্তু হাভাইত্যার মতো হামলে পড়ে এতগুলো ঝিনুক খেলাম যে? ওঁর তো লোকসান হয়ে যাবে?’
‘দাও না, পারো তো৷ আমি কি একবারও বারণ করেছি?’ হাকান হাহা করে হাসে৷
সত্যিই, একটি লিরাও নেন না কমরেড ঝিনুকওয়ালা৷ কিছুতেই না৷ মুক্তো কে চায়, মিদিয়া দোলমা-র ঝিনুকে যে স্বাদ আছে তার আবেশ লাখ মুক্তোতেও মিলবে না৷ কোন স্টুপিড গায়, এমন একটা মানুষ খুঁজে পেলাম না, যার মন আছে? ইস্তানবুলের জাহাজঘাটায় মুসলমান কমরেড ঝিনুকওয়ালার খোঁজ করুন৷
(ক্রমশ)