সার্চলাইট

শান্তা মুখোপাধ্যায়

 

সন্ধের অন্ধকারটা সবে নামব নামব করছে। বাড়ির পাশের নিমগাছটার তলায় ঝুজকো আঁধার। তখনই ছোট গ্রীলের গেট ঠেলে বাড়ি ঢুকল পল্টু। নগেন পাড়ুইএর একমাত্র ছেলে পল্টু। পল্টু এখন কলকাতায় থাকে। কলেজে পড়ে। এখন লকডাউন চলছে বলে গ্রামের বাড়ি এসেছে। ছেলে বাড়ি এসেছে, কাছে আছে বলে অণিমার বড় সুখ। নইলে ছেলে আসে, যায়। থাকে বলতে ঐ একদিন। ওতে সুখ হয়! নয় নয় করে নগেন পাড়ুইএর সম্পত্তি তো কম নয়! পুকুররে, ধানী জমিরে, পাকা বাড়িরে, কি নেই নগেন পাড়ুইএর! গ্রামের মধ্যে চোখে পড়ার মত বাড়িটাই নগেনের। ঘরে দুধ, মাছ উপছে পড়ছে। ছেলে কাছে না থাকলে সেসব খেয়েও সুখ নেই। তবে অণিমা জানে এসব তো আর একদিনে হয় নি! অনেক মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়েছে। অণিমা ভাবে ভাগ্যিস ভগমান রেশনের ডিলারশিপটা জুটিয়ে দিয়েছিল! অণিমা বিয়ে হয়ে এসে দেখেছে অভাব কাকে বলে। অণিমা বড়ঘরের মেয়ে। কথায় কথায় বাপের বাড়ির লোকেদের ঠেস টিপ্পনী নগেনকে একরোখা করে তুলেছিল। সেই নগেন শ্বশুরবাড়িকে দেখিয়ে দিয়েছে পুরুষমানুষ কি করতে পারে! পুরুষ মানুষ! কি করতে পারে ভাবলেই অণিমার বুকের ভেতরটায় হু হু বাতাস বইতে থাকে। আউল বাউল।

অভাবের সঙ্গে লড়াই করেছে অণিমাও। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে খেটে শরীরটা শুকিয়ে দড়ি হয়ে গেছে। শাড়ি পরে থাকলে মনে হয় কঞ্চির গায়ে কাপড় জড়িয়ে রেখেছে। সবচেয়ে ছোট সাইজের ব্লাউজটাই আনে নগেন বাজার থেকে, তাও ঢল ঢল করতে থাকে। নিজের দিকে নজর দেবার সময় হল কই অণিমার? সংসারের সমস্ত কাজ, গরু, হাঁসদের দেখাশোনা, খেতের মুনিষদের ভাত রাঁধা, মুড়ি ভাজা… এই করতে করতেই জীবনটা যেন নদীর কিনারে এসে দাঁড়িয়ে গেল। যেন টুপ করে খসে পড়লেই হয়। সেদিন ত তেমনই মনে হয়েছিল যেদিন রাত্রে শুতে এসে নগেন বলেছিল, “শালা রসকষ শুকিয়ে দড়ি করে রেখেছে! এরপর কি বাজারে যেতে হবে নাকি?” অণিমা সিঁটিয়ে গেছিল! তীব্র অভিমান হয়েছিল অণিমার। সংসারে খাটে কি নিজের জন্য? পাই পয়সা হিসেব নগেনের। পান থেকে চুন খসলে বাড়ি মাথায় তোলে! সব দিক দেখেশুনে সামলিয়েছে কে? দিনেরপর দিন সাঁঝ গড়ালে ভাত খেয়েছে কে? এককাপড়ে গরুর জাব দিয়েছে কে? গরু দোয়ানোর জন্য কেউ ছিল কি? সেসব চোখে পড়ল না! দিনের পর দিন অনিয়মে গ্যাস অম্বলে একবেলা খেয়ে থাকা চোখে পড়ল না! অণিমার মাথায় এসেছিল পুরুষ মানুষ! নিজেরটা ছাড়া আর কি কিছু বোঝে না? কিন্তু মজুমদার জেঠুকে দেখে তো সেরকম মনে হয় নি। তবে কি তার বরটাই… তারও পরে নগেনের সন্ধ্যার ঘরে যাওয়ার খবর গ্রামে রাষ্ট্র হতে দেরি হয় নি। সেদিন অণিমা ভেবেছিল টুপ করে খসে পড়ার কথা। কিন্তু অণিমা পারে নি। পল্টুর কথা ভেবে। পল্টু মা ছাড়া চলতে পারবে না। অণিমা সংসারে থেকে গেছিল ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে। সারাদিন সংসারের সবই করেছে, কিন্তু শোয়ার জায়গা আলাদা করে নিয়েছে। নগেনও জিজ্ঞাসা করেনি।এইসব পেরিয়ে পল্টু আজ এত বড়টি হল। অণিমা ভাবেন, বড় কি আর হয়েছে, এখনও বাড়ি এলেই মার পেছন পেছন ঘুরবে। পল্টু হবার পরই নগেন বলেছিল আর ছেলেমেয়ে দরকার নেই। আজকালকার বাজারে একটাই ভালো। ভালো মানুষ করতে কম খরচা? তা ছাড়া সম্পত্তি যা রেখে যাব সে একজনের ভোগে এলেই ভাল। অণিমা আপত্তি করে নি। পল্টু তার নাড়িছেঁড়া ধন। যতটা সম্ভব আগলে রাখে পল্টুকে। একমাত্র ছেলেকে আগলে রাখার দরকারটাই বা কি? সেকথা বললে অবশ্য পল্টুর খেয়ালীপনার কথা বলতে হবে।

ছোটবেলা থেকেই পল্টু একটু আলাদা। মাস্টার মশাইরা বলতেন লেখাপড়ায় ভালো মাথা। তার সঙ্গে সঙ্গে সকলকে ভালো রাখার আপ্রাণ চেষ্টা। একবার একটা কুকুর গাড়ি চাপা পড়েছিল গ্রামের রাস্তায়। তাকে বাড়ি এনে কি সেবা! নগেন দেখেই চেঁচিয়েছিল, “এই ছেলে দান খয়রাতি করে সব সম্পত্তি ওড়াবে ,এই আমি বলে রাখলুম! আর হবে নাই বা কেন! সব ধিঙ্গীপনার আস্কারা তো বাড়িতে! গর্ভধারিনী কেমন দেখতে হবে না!” অণিমা ভাবে, একটা কুকুরকে খাওয়াতেও বেশি পয়সা খরচা হচ্ছে নগেনের! সেবারে খুব ঠান্ডার সময় যখন গেনীবুড়িকে নিজের শীতের র‍্যাপারটা খুলে দিয়ে এসেছিল, সেদিন নগেন চ্যালাকাঠ দিয়ে পিটিয়েছিল পল্টুকে। বাঁচাতে গিয়ে ঘা কতক নিজেও খেয়েছিল অণিমা। রাত্রে ছেলেটার ব্যাথায় তেল মালিশ করতে করতে অস্ফূটে বলেছিল, “যে যাই বলুক বাবা, ভালো কাজ করলে ভগমান ভালোবাসেন।“ পল্টু মাকে জড়িয়ে ধরেছিল। তারপর থেকে প্রত্যেকবার পল্টু ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ালে নগেন যত ক্ষিপ্ত হয়েছে, অণিমা মনে মনে কেমন যেন যুদ্ধজয়ের চাপা উল্লাসে ফেটে পড়েছে! গ্রামের লোকেরা আড়ালে বলাবলি করতে শুরু করেছে, পল্টু নগেনের নাম ডুবিয়ে ছাড়ছে! ততদিনে নগেন রেশনের ডিলারশিপটাও পেয়ে গেছে। জমি বাড়িয়েছে। টিউকল বসিয়েছে। পাকা বাড়ি আদ্ধেক উঠে গেছে।

পাকা বাড়ি শেষ হতে হতেই পলটু মাধ্যমিক দিল। ভজনও দিল। কিন্তু ভজন পাস দিতে পারল না। ভজন আর পল্টু হরিহর আত্মা ছিল। এবার পথ আলাদা হল। ভজনের বাবা ভজনকে মুদির দোকানে কাজে লাগিয়ে দিলেন। ভজন কেমন ম্লান হেসে বলেছিল, “তোদের মুদির মালটা আমাদের দোকান থেকেই নিস!! তাহলে অন্তত দেখা হবে! নইলে মুদির দোকানের ছেলের সঙ্গে তোর মত মাথাওলা ছেলে কি দেখা করতে আসবে!” পল্টু বলেছিল, “দূর পাগলা! বন্ধুত্বের মধ্যে আবার ব্রেনী আর মুদির দোকানী! তুই ছাড় তো!” সত্যিই পল্টু ভজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব রেখেই চলছিল। ভজনের খুব সাধ ছিল পয়সা জমিয়ে নিজেই একটা মুদিখানা দোকান দেবে। ভজনের বাবা ততদিনে অসুস্থ হয়ে গেছেন। শয্যাশায়ী। ভজনের উপর সংসার। পয়সা জমানোর কোন উপায়ই ভজনের জানা ছিল না। পল্টু আবার ভাবত, বড় হয়ে চাকরী করে ভজনের মুদির দোকানের পয়সা যোগান দেবে। নিতে না চাইলে বলবে, “ধার দিচ্ছি! এতে তোর আঁতে লাগার কি আছে?” ততদিনে ভজনেরও বিয়ে হয়ে যাবে। সুমনা আর বেশি দিন কি অপেক্ষা করবে? সুমনা ওদের স্কুলেই পড়ত।

উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে পল্টু কলেজে পড়তে এল। ভজনের বাবা মারা গেলেন। অসুস্থ মানুষ, চলে গেলে মেনে নিতেই হয়। কিন্তু যেদিন দেবাংশু ফোনে জানাল ভজন নেই, পল্টু ভয়ে নীল হয়ে গেছিল। তাহলে কি ভজন জানতে পেরেছিল সুমনা কলকাতা এসেছিল! সুমনা পরীক্ষা দেবার নাম করে এসেছিল, কিন্তু আসল কারণ তো শুধু সে আর সুমনাই জানত! দেবাংশু ফোনে বলেছিল, “মাসীমার দিকে তাকানো যাচ্ছে না! তুই একবার আসবি না?” বাড়ি এসে ভজনদের বাড়ি গিয়েছিল। ভজনের মা থানপরে ভাঙা দাওয়ায় বসে ছিলে। মোটা কাচের চশমা ভেদ করে চোখদুটো দেখা যাচ্ছিল না। পল্টুকে দেখেই ভজনের হাবাগোবা ভাইটা বলে উঠেছিল, “দাদা ঐ গাছে ঝুলছিল!” ভজন কাকীমার কোলে মুখ গুঁজে হাউ হাউ করে কেঁদেছিল পল্টু। অপরাধবোধ ধুয়ে ফেলতে? অনেকক্ষণ পর জিজ্ঞাসা করেছিল, “কেন এমন হল?” কাকীমা মাথা নেড়েছিল। জানে না। পল্টু দেবাংশুর থেকে শুনেছিল সুমনা নিজেই নাকি বলেছিল মুদির দোকানের ছেলেকে বিয়ে করতে পারবে না।

দিন আপন নিয়মেই কেটে যায়। তারপরও বছর ঘুরে গেছে। ভজনের মা লোকের বাড়ি বাসন মেজে, মুড়ি ভেজে চালাত খবর পেয়েছে। পল্টু নিজেই সামান্য হাতখরচ পায়। টিউশনি করতে পারত, করতে ইচ্ছা হয় না। তাই ভজনের মাকে অর্থ সাহায্য পল্টু কোনওদিনই করতে পারে নি। বাড়ি এলে এটা ওটা মার কাছ থেকে নিয়ে দিয়েছে। লকডাউনে গ্রামে ফিরে পল্টু অবাক হয়ে যাচ্ছে। একে ভাইরাসের ব্যাপার যতটা না বুঝছে মানুষ, ভয় তার চেয়ে বেশি। কেউ কারো বাড়ি যাচ্ছে না। মাঠে খেলা বন্ধ, রাস্তা যেন গিলে খেতে আসছে… দমবন্ধ লাগে পল্টুর! সবাই মুখে গামছা বাঁধা! মাস্ক কোথায় পাবে গ্রামের মানুষ! দেখে চেনাও যাচ্ছে না। পল্টুও কদিন বাড়িতেই ছিল। তারপর অসহ্য হওয়ায় বেরিয়েছিল। প্রথমেই ভজনদের বাড়ি গেছিল। ভজনের মা দাওয়ায় বসে ছিল। বেলাশেষের ক্লান্ত রোদ মুখে পড়ছিল। কোনো উত্তাপ নেই কারোরই। না রোদের, না ভজনের মার। পল্টু বলল “আজ তোমার বাড়ি ভাত খাবো কাকীমা।“ ভজনের হাবাগোবা ভাইটা বলল, “খাবে কি করে? ঘরে চাল নাই।“ পল্টু জানে রেশন ঢুকেছিল। বাড়িতেই গোছগাছ হতে দেখেছিল।

পল্টু ভজনের মাকে জিজ্ঞাসা করল, “রেশন পাও নি?” ভজনের মা বলল, “পেয়েছিলাম তো, মাথাপিছু দুকিলো করে চাল। কিন্তু কি রাক্ষসের পেট হয়েছে আজকাল! দুদিনেই শেষ! এখন তো লকডাউন না কি হয়েছে তাতে লোকে ঘরের কাজও করাচ্ছে না। মুড়িও নিচ্ছে না……” ম্লান হাসে সুধাবালা। ভজন বলে “চারকিলো চাল দুদিনে শেষ! তোমরা তো কতটা খাও জানি! কি হচ্ছে বলত?” সুধাবালা জানে না। দিনের আলো অগস্ত্য যাত্রায় চললে পল্টু ফিরতে লাগল। রাস্তা ফাঁকা। পথে দেখা অধীর জেঠুর সঙ্গে। অন্যসময় হলে পল্টু প্রণাম করত, এখন সেসব করা যাবে না। পল্টু বলল, “জেঠা কেমন আছো?” জেঠার দাঁত অনেকগুলোই নেই। তায় আবার মুখে গামছা বাঁধা। বলল, “ভালই ঠো। ভালই। শুঢূ পেঠ ভরে না!” পল্টু বলল, “রেশন থেকে সরকারি রিলিফ পাও নি?” জেঠা বোধকরি হাসে। বলে, “হ, ঠা পেয়েঠি। ঠবে কুলায় না ঠো!” পল্টু ভাবতে ভাবতে হাঁটা দেয়। সরকারি রিলিফ আগে যা রেশন দেওয়া হত তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই তো দেওয়া হচ্ছে। তবে কি লকডাউনে লোকের খিদে বেড়ে গেল? প্রদীপ স্যারের বাড়ি যাবার ইচ্ছা ছিল, ঢুকত না, দূর থেকে দেখাকরে চলে আসত। কিন্তু এখন সন্ধে গড়িয়ে গেছে। আর যাওয়া যাবে না। কাল বরং যাবে। রেশনের ব্যাপারটা বুঝতে হবে। সুমনারও খবর নিতে হবে।

গ্রীলের গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে দেখল বাড়ির পিছনের গোডাউনে কাজ হচ্ছে। দুজন কর্মচারী মুখে রুমাল বেঁধে মাপামাপি ঢালাঢালি করছে। আন্দাজে পল্টু বুঝল রিলিফ প্যাকেটিং হচ্ছে। কিন্তু প্যাকেট তো হয়েই আসার কথা! নেত্রীর ছবি দেওয়া প্যাকেট… পল্টু দাঁড়িয়ে গেল। ততক্ষণে নগেন পাড়ুই চা চাইতে অণিমার কাছে এল। সন্ধেবেলার চা পাটকাঠি জ্বেলে হয়। প্রথমে নগেনের নির্দেশ ছিল, এখন অণিমার অভ্যেস হয়ে গেছে। নগেন বলে, “সে লাটের ব্যাটা বাড়ি ফেরে নি এখনও?” অণিমা ঘাড় নাড়ে। নগেন বলে, “যাই হোক দুট খুদকুঁড়োর ব্যবস্থা যে করে রেখে যাচ্ছি, সে তো ওর জন্যেই। তা বাবু বুঝলে হয়! গোদাম থেকে কাকে দানছত্র করে বসবে এই বাজারে…” বলে সশব্দে চা খায়। বলে, “রও তোমারে আর চা নিয়ে গোদামে যেতে হবে না। মিস্তিরিদের চা আমিই নিয়ে যাচ্ছি। এই চাটুক খেয়ে নিই।“

পল্টু ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছে। খুদকুঁড়ো যখন ওর জন্যই রাখা, তখন তা নিয়ে কি করা উচিত সেটা ভাবার ওর অধিকার আছে। গোদামে গিয়ে মিস্তিরিদের বলে “চারজনের রেশন দাও তো! বাবা চেয়ে পাঠাল।“ মালিকের ছেলে। ওরা বিনাবাক্যব্যয়ে দিয়ে দেয়। ফেরার জন্য ঘুরতেই সামনে পড়ে যায় নগেন পাড়ুই। বলে, “রিলিফ পেকেট নিয়েছিস কেন?” পল্টু বলে, “একজনকে দেব।“ মিস্তিরিদের উপস্থিতি ভুলে চেঁচায় নগেন পাড়ুই, “হারামজাদা! তুই বাপের গোদাম থেকে মাল সরাচ্ছিস? কারে দিবি? কে তোর এত পীরিতের?” পল্টু এবার সোজা দাঁড়িয়ে বলে, “সে খোঁজে তোমার কি দরকার?” নগেন পাড়ুই হুঙ্কার দেয়, “এই গেরামের কেউ রিলিফ পায় নাই, হয়েছে?” পল্টু বলে, “তবে পেট ভরে না কেন? তোমার মিস্তিরিরা রাতের আঁধারে গোদামে কি করছে?” নগেন চিৎকার দেয়, “সেই কৈফিয়ত আমি তোরে দেব? শালা! যার জন্য এত করি, সেই বলে চোর! নে, নে এই প্যাকেট গুলো নে আর ফুটে যা! বেরিয়ে যা বাড়ি থেকে! পীরিতের নাঙ!”

পল্টু সোজা তাকায় নগেনের চোখের দিকে। নগেন একটু পিছু হটে যায়। নগেন পড়তে পারে কি লেখা আছে ওর চোখে। পল্টু বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়। অণিমা ঘুনিয়ে ঘুনিয়ে কাঁদে। বলে, “ভর সন্ধেবেলা ছেলেটাকে বাড়ির বার করে দিলে…” কথাটা নগেনেরও মনে বিঁধছে। নিজের মনকে প্রবোধ দিতেই অণিমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, “যাবে কোথায় বাছাধন! রাত বাড়লেই ঠিক ফিরে আসবে…”

চাঁদ যখন মাঝ আকাশে, তখনো ফেরে না পল্টু। অণিমা ডুকরে ডুকরে কাঁদে। মোবাইলে ফ্ল্যাশ লাইট জ্বেলে নগেন খুঁজতে বেরোয়। এ রাস্তা, ও রাস্তা, এ পাড়া, ও পাড়ার কোথাও খুঁজে পায় না। এবার ডাকতে থাকে নগেন, “পল্টু…” বাড়ির ভেতর থেকে অণিমা উৎকর্ণ হয়ে থাকে উত্তরের অপেক্ষায়। ক্ষয়া জ্যোৎস্নায় চরাচর পাণ্ডুর হয়ে ওঠে। উত্তর আসে না। প্রায় হাল ছেড়ে দেবার অবস্থায় বাড়ির পুকুরের ঘাটলাটায় যায় নগেন। গ্রীষ্ম কাল। জল নেমে গেছে অনেক নিচে। সিঁড়ি নেমে থমকে দাঁড়িয়ে এবড়খেবড়ো মাটিকে সুযোগ করে দিয়েছে জলের অনেক নিচে নেমে যাবার। নগেন দেখে পল্টুর আনা রিলিফের প্যাকেট জীবনবিমুখ উদাসীনতায় জ্যোৎস্না দগ্ধ হচ্ছে। নগেন আতঙ্কিত হয়ে ভাবতে থাকে ঘাটলার সিঁড়ি বেয়ে, এবড়োখেবড়ো জমি বেয়ে জীবন নিচে নেমে যাচ্ছে জ্বালা জুড়াতে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। মনে মনে ভাবনা আর প্রতিভাবনার বিতন্ডায় জড়িয়ে পড়ে। তারপর একসময় ভাঙাগলায় চিৎকার দেয়, “পল্টু…”

তখনই উত্তর আসে, “এই যে, এখানে…” নগেন পাড়ুই দেখে পল্টু সামনে, পিছনে পিছনে গ্রামের মানুষ… যাদের মোবাইল আছে, মোবাইলের সার্চ লাইট জ্বেলে নিজেদের মধ্যে নিয়মরক্ষার দূরত্ব বজায় রেখে হেঁটে আসছে… নগেন আতঙ্কিত গলায় বলে, “এরা কারা?” নির্বিকার গলায় পল্টু বলে, “এরা তোমার রেশন দোকানের খদ্দের। রিলিফের রেশন নিয়েও কেন পেট কেন ভরছে না তারই খোঁজ করতে বেরিয়েছে…” মোবাইলের সার্চলাইটগুলো নগেন পাড়ুইএর মুখের উপর পড়তেই হাত দিয়ে আলো আটকাতে আটকাতে নগেন চেঁচিয়ে ওঠে, “উফ! আলোটা বন্ধ কর!”

Be the first to comment

আপনার মতামত...