ভবিষ্যৎ নিয়ে সকলে চিন্তায়, বর্তমান নিয়ে নয়

বর্ণালী মুখার্জি

 



লেখক রাজনৈতিক ও গণআন্দোলনের কর্মী, রাজনৈতিক ভাষ্যকার

 

 

 

ইনফোসিস কর্তা নারায়ণন বলেছেন অর্থনীতি দ্রুত সচল করতে হবে। রঘুরাম রাজন বলেছেন এর পরেও যদি লকডাউনের মেয়াদ বাড়ে, জনগণের কাছে, বিশেষত অসংগঠিতদের সামনে মোদির বিশ্বাসযোগ্যতা ধ্বংস হবে। এমনই এক মালিক হলেন ট্রাম্প, কয়েকশো কোটি ডলার ব্যবসা তার। ১৮ই এপ্রিল, আমেরিকার রাস্তায় ‘লকডাউন নিপাত যাক্‌’, এই স্লোগান তুলে ইয়াঙ্কিদের একাংশকে মিছিল করতে দেখা গেছে, যাকে ট্রাম্প সোৎসাহে সমর্থন জানিয়েছেন। ভারতে মোদি, রাজ্যে মমতা ব্যানার্জী যা করছেন তাতে আশঙ্কা এখানেও প্রথমত অসংগঠিতরা, পরে এমনকি সংগঠিত শ্রমজীবীরাও ‘অর্থনীতি সচল করো’, অতিধনীদের এই দাবীতে রাস্তায় নেমে পড়বেন! IMF জানিয়েছে তাদের সংস্থা ঋণ দিতে তৈরি। তার ফলে সংস্থার অবস্থা কাহিল হবে তা সত্যি, কিন্তু সেই দুর্দশা স্বীকার না করলে অর্থনীতি তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়বে। প্রায় প্রতিটা পুঁজিবাদী দেশ ত্রাণ দিচ্ছে কোটি কোটি মুদ্রায়। একদিকে বহুজাতিকদের, অন্যদিকে ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসায়ী বা স্বনিযুক্তদের। এদেশের অসংগঠিত শ্রমিকরা যদিও তেমন ক্রেতা নন, নিজেদের গতরটি ছাড়া বিক্রিও কিছু করেন না। ফলে অর্থনীতি সচল করাই যাদের মোক্ষ, তারা বাজারের বাইরে থাকা অধিকাংশকে কতটা সাহায্য করবেন তা বহু হিসেবের ব্যাপার। পুঁজিবাদে তাই ঢালাই মেশিনে চড়ে শ্রমিকরা বাড়ি ফেরেন আর দুগ্‌গা কৈলাশ থেকে বাড়ি ফেরেন নৌকা-হাতি চেপে।

দুশ্চিন্তায় ফিরে যাই। আমি যেখানে থাকি সেই গৃহটির সামনে একটা এঁদো পুকুর, কচু গাছে ভর্তি। যেখানে এখন প্রায়ই দুই বেলা, একটু ভোরের দিকে আর সন্ধের পর মহিলা আর বাচ্চাদের দেখা যায়। দেখা যায় অল্পবয়সি ছুতোর বা কাঠের মিস্ত্রিদের। দুই সপ্তাহ আগেও যারা বন্ধ দোকানের সামনে মাচায় বসে মোদি-চিন-আমেরিকা আর কোভিডের গল্প করত, এখন আর আসছে না। খাবারে টান পড়েছে। লোকমুখে শোনা যাচ্ছে, রেশনে ডাল দিচ্ছেই না, অথচ গেলেই বলছে দেবে। অমুক পাড়াতে রেশনে ৬ কেজি চাল দিচ্ছে  অথচ এই পারাতে মাত্র ৩ কেজি! ওখানে আটা দিচ্ছে আর এখানে গম! আটাতে পোকা। রিলিফের সময় বুঝলাম, যে সব পরিবারগুলিকে বনেদি ভাবতাম তাদের বিরাট বিরাট পুরনো বাড়িগুলি দেখে, তাদের বাড়িতেও দু কেজি চাল-আলু দেওয়ার অনুরোধ করলেন পাড়ার ক্লাবের ছেলেটি। পরিবহনের ঠিকা কর্মী। মাসে ৫ হাজার রোজগার। ফলে যেদিন লকডাউন ঘোষণা হল, সেদিন তাদের অনেকেরই হাতে ছিল ১০০ থেকে ৩০০ টাকা। এরা আর কতদিন এভাবে থাকবেন? মোদির পক্ষে মধ্যপ্রদেশের ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে লকডাউন ঘোষণা করা সম্ভব ছিল না। তা আগে থেকে জানালে বিরোধী পক্ষ সচেতন হয়ে যেত। রাতের অন্ধকারে ক্ষমতা হস্তান্তর হত না। গুজরাটে ট্রাম্পের অভ্যর্থনায় স্টেডিয়ামে ১ লক্ষ লোকসমাগম করতে পারতেন না মোদি। এখন কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, মানুষ বলছেন, কোভিডের বদলে যে না খেয়ে মরব! আর সেটাই দুশ্চিন্তা, রাস্তায় নেমে পড়ার মুখে এঁরা। ওই মার্কিন মুলুকের মতোই— আমাদের রোজগার করতে দাও, লকডাউন তুলে দাও। ব্যস তাহলেই কেল্লা ফতেহ। শ্রমজীবীদের কথা অন্তত একটিবার জীবনে শোনার জন্য তারা ব্যাকুল। যেমন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী রবি টোডি, CII-এর প্রতিনিধিও বটে। তিনিও টিভির অনুষ্ঠানে ঠিকা কর্মীদের জন্য দুঃখ করছিলেন। বলছিলেন, তাদেরই জন্য সরকারের লকডাউন প্রত্যাহার করা উচিত। মোদ্দা কথা অসংগঠিত ক্ষেত্রের মেহনতি মানুষদের কাঁধে বন্দুক রেখে একচেটিয়া পুঁজি অর্থনীতিকে অবিলম্বে সচল করতে চাইছে। তাতে যদি নারায়ণনের পরিবারেরও কেউ মারা যায়, কুছ পরোয়া নেহীঁ! না হলে যে ইনফোসিসের ঠিকা কর্মীটির, ঠিকা কর্মীর বস্তিতে যে রিক্সাওয়ালা থাকেন তার, ঠিকা কর্মীর গৃহপরিচারিকা স্ত্রীর, তাদের বড় পুত্র যে বম্বেতে কাজ করে এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের মিছিলে পা মিলিয়ে ঘরে ফিরতে পারেনি এখনও, এদের বড্ড কষ্ট হবে!! মুম্বই-এর বস্তি যে কতটা অস্বাস্থ্যকর তা এতদিনে রতন টাটার চোখে পড়েছে। তিনি নাকি পরিকল্পনাকারীদের ভর্ৎসনাও করেছেন! তবে এনারা শুধু ভবিষ্যত নিয়েই দুশ্চিন্তায় আছেন। কারণ বর্তমানে পরিযায়ী শ্রমিকদের বিশেষ ট্রেন-বাস এমনকি হেলিকপ্টারের সাহায্যে কেন বাড়ি ফেরানো হল না, তা নিয়ে ওনারা প্রশ্ন তুলেছেন জানা যায়নি। ভারতের মিলিটারিকে পরিযায়ীদের ফেরানোর জন্য হেলিকপ্টার-ট্রাক-জিপ নিয়ে আসতে দেখা গেল না। রবি টোডির নির্মাণ শিল্পে যে সব শ্রমিক কাজ করেন যাদের বেশিরভাগের BOCW কার্ড যে নেই, তা উনি ভাল করেই জানেন। যেমন জানেন যে বেশিরভাগ ঠিকাদারের লাইসেন্স নেই, অথবা নিয়োগপত্র পান না এনারা। ঠিকা শ্রমিকরা বেশিরভাগই ভূতুড়ে। সুতরাং এই বিশেষ অবস্থায় রবি টোডির স্বাক্ষর সম্বলিত কোনও আপৎকালীন কার্ডের ব্যবস্থা করে তাদের প্রাপ্য সেসের অংশ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলতে শোনা গেল না। অথবা যে রেশনের প্রতিশ্রুতি আছে তা কেন বহু বহু পরিযায়ী শ্রমিক পাচ্ছেন না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠল না। রবিবাবুরা জানে যে দেশে ৫ কোটিরও বেশি নির্মাণ শ্রমিক আছেন, অথচ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করার তালিকা এসেছে ২ কোটিরও কম, তাও সরকারি ‘চুরি সেন্টার’-গুলি কত নয়ছয় করছে তা স্পষ্ট করে জানাও অসম্ভব এখন।

এবার আসি আসল প্রশ্নে। লকডাউনের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কে? আম্বানির বাড়িতে যিনি গৃহপরিচারিকা তিনি, নাকি আম্বানি নিজে? আমার যে ভাই cognizant-এর বড় মাইনের কর্মী সে, নাকি তাদের অফিসের সামনের চায়ের দোকনদার, বা যাঁর রিক্সা চেপে সে বাড়ি থেকে শপিং মলে যায় তিনি? ১৬ বিঘা বস্তির যে মানুষটি কুঁয়ো খোঁড়েন বা মেটিয়াবুরুজের কোনও দর্জির দোকানে সুতো ছাড়ান যিনি, নাকি যে সরকারি চাকুরিজীবী বাবুর বাড়িতে কুঁয়ো খোড়া হয় তিনি বা কাপড়ের আড়তদার, তার? যে ডাক্তারবাবু প্রাইভেট হাসপাতালে চাকরি করেন তাঁর, নাকি তাঁর গাড়ির ড্রাইভারের? যে পরিযায়ী শ্রমিক তার সন্তানকে কাঁধে চাপিয়ে আনল তার, নাকি যে রিয়েল এস্টেটের নির্মাণ সাইটে সে শ্রম ঝরাত তার? সন্দেহ নেই, নীতা আম্বানিকে কচু শাক কাটতে হয় না, জয় আদানিকেও ত্রাণের লাইনে দাঁড়াতে হয় না। কিন্তু তারা যে ভিক্ষাবৃত্তি করতে উঠে পড়ে লেগেছেন, ভারতের ব্যাঙ্কের টাকা পাওয়ার জন্য বায়না জুড়েছেন ত্রাহি রবে, তাতে টের পাওয়া যায়, যারা অতিধনী, যারা ধনী, যারা সংগঠিত ক্ষেত্রের আধিকারিক বা সাধারণ স্থায়ী কর্মী, তাদের বিপদ-ক্ষতি অনেক, অনেক, অনেক বেশি। যে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি আম্বানিদের হচ্ছে, (জিও-তে ক্ষতি হবে না বরং লাভই হবে) যে বিপুল অনিশ্চয়তার মধ্যে টাটা-রা নিমজ্জিত হচ্ছেন তার তুলনায় পরিযায়ী শ্রমিকদের বিপদ (তাদের মৃত্যু সহ) তুচ্ছ। ওদের সাম্রাজ্য ভেঙে পড়েছে। কে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কেউ জানে না। সবচেয়ে বড় বিপদ হল, যে সব রাষ্ট্রগুলি ওদের এতকাল ধরে বাঁচিয়ে রেখেছে, তারা নিজেরাই ধ্বসের মুখে। ডলারের সাম্রাজ্য আর কতটা থাকবে জানা যাচ্ছে না। ফলে নিজেদের দৈন্যকে আড়াল করতে অসংগঠিতদের দুরবস্থার কথা সামনে আনছে। আসলে এতকালের এই ফেরেব্বাজ ক্ষীরননীভোগীরা নিজেদের বিপদের ও সঙ্কটের বোঝা কীভাবে জনগণের উপর চাপাবে তা নিয়ে ফন্দি আঁটছে। কোভিড নামক মহামারির মোকাবিলা ওদের কছে অপ্রয়োজনীয়।

শ্রমিকরা মালিকদের স্বার্থের সামনে মাথা নুইয়েছেন অনেকবার, ইতিহাস সাক্ষী। তাদেরই হাতে রক্তে ভাসে মুসলমান বা ইহুদি। পাশের দেশের শ্রমজীবীকে হত্যা-লুঠ করার যে বিশ্বযুদ্ধ তাকে সমর্থন জানিয়েছেন শ্রমজীবীরাই। যখন অন্য সব রোজগার বন্ধ তখন যুদ্ধ দাঙ্গার অর্থনীতি চালু থাকে, তার মধ্য দিয়েই চাকরি বাঁচে, অথবা নতুন চাকরিও হয়। তাই আজ যখন করোনা মোকাবিলায় সরকার মাত্র দেড় লক্ষ কোটি ঘোষণা করে, যা জাতীয় আয়ের মাত্র ১%, সকলকে ন্যূনতম ৬ মাস বসিয়ে খাওয়ানোর ঘোষণা করে না, প্রত্যেকের ব্যাঙ্কে ৫-৭ হাজার টাকা ৬ মাস ধরে জমা করার সিদ্ধান্ত নেয় না, প্রতিটি বস্তিবাসীকে খালি ফ্ল্যাট বা হোটেলগুলিতে স্থানান্তরিত করে না, দেশে প্রতিটি জেলা সদরের কম্যুনিটি হলে একটি করে অস্থায়ী হলেও কোভিড হাসপাতাল বানায় না, দেশে প্রয়োজনীয় ডাক্তার–নার্স ও তৃতীয় শ্রেণির স্বাস্থ্য কর্মচারী (ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস ১৪ই এপ্রিল, ২০১৯ সালে যে সংখ্যাটা ৬ লাখ ডাক্তার আর ২০ লাখ নার্স বলে জানিয়েছে) নিয়োগ করে না, প্রতিটি বেসরকারি সংস্থার পরিচালকমণ্ডলীকে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি উৎপাদনের নির্দেশ দেয় না, যথেষ্ট গবেষণার ব্যবস্থা করে না, এমনকি চিকিৎসা করার ভয়ে পরীক্ষাও করে না, শুধু লকডাউন ঘোষণা করেই হাত গুটিয়ে বসে থাকে, তখন শ্রমজীবীরা ক্রমেই অস্থির হয়ে নারায়ণনদের স্বরে স্বর না মিলিয়ে বসেন! গ্রামীণ অসংগঠিত জনতা, মানে কৃষকরাও দেখছে মাঠে তাদের ফসল নষ্ট হতে পারে, দাম সামান্যই। এই পর্যায়ে শুধু পাঞ্জাবে যেভাবে এফসিআই-রেল মাঠ থেকেই সরাসরি গম কিনেছে, রেল তা পৌঁছে দিয়েছে দূরদূরান্তে, তা সর্বত্রই করা যেত। মাঠে আনাজ নষ্ট হত না গ্রামীণ অসংগঠিতদের। আর মার্কেটিং-এর জন্য ভিখিরি বহুজাতিকদের ডাকতে হত না। আর এগুলির মধ্য দিয়ে আগামী দিনের জন্য একটি পাকা পরিকাঠামোরও হাতমক্সো হয়ে যেত। তা যখন হচ্ছে না তখন শহরের মতোই গ্রামেও যদি আওয়াজ ওঠে যে লকডাউন তোলো, কৃষিকাজ দিয়ে যে আর সংসার চলে না, তার চেয়ে মানবজাতির পক্ষে মর্মান্তিক আর কিছুই হতে পারে না!

একচেটিয়াদের স্বার্থে বেশ কিছু সরকার বহুজাতিকদের শ্রমিক-কর্মচারীদের মাইনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। মানে এভাবে অপদার্থ একচেটিয়াদের কিছুটা ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। ভারতেও তেমনটাই চাইছে মালিকরা, তাদের প্রতিনিধি ASOCHEM বা CII। আপাতত মিউচুয়াল ফান্ডে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ৫০ হাজার কোটি ঢেলেছে। যদিও এটুকুতেই তারা সন্তুষ্ট নয়। তারা চাইছে ব্যাঙ্কের যাবতীয় টাকা তাদের জন্যই খরচ হোক, যেমনটা আমেরিকাতে হয়েছে, তাদের বড় ভাইদের ন্যাতানো বন্ড কিনেছে সরকার, বন্ড বাজারের জাতীয়করণ করে। এই ভিক্ষাবৃত্তির (সাধু ভাষায় যাকে বলে bail out) ক্ষেত্রেও একচেটিয়াদের তুরুপের তাস ওই অসংগঠিত ক্ষেত্রের মেহনতি মানুষ। যদি ব্যাঙ্ক তাদের জন্য এই ব্যয় না করে তবে তাদের প্রচ্ছন্ন হুমকি হল, তারা বাধ্য হবে ছাঁটাই করতে। ট্রাম্পের মতোই মোদিজি যে মানবিকতা দেখাতে বলেছেন তা আর রাখা সম্ভব হবে না তাদের। ঠিকা শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার জন্য যে ন্যূনতম ব্যয় হত বা তাদের করতে হত তা থেকে তারা হাত গুটিয়ে নেবে। যেমন প্রভিডেন্ট ফান্ডে তাদের দেয় টাকাটা আর তারা দিতে পারবে না। এবং এই যে তারা হাত গুটিয়ে নেবে তা যাতে বেআইনি না হয় তাই শ্রম আইন বদলে দেওয়া হবে, এই যে কথায় কথায়, পান থেকে চুন খসা মাত্র শ্রমিকরা, এমনকি অসংগঠিত শ্রমিকরাও ইউনিয়নের উস্কানিতে আদালতের যাওয়ার স্পর্ধা দেখান, তা বন্ধ করা হবে। তাছাড়া সরাসরি ব্যাঙ্ক যদি সাহায্য না করে তবে এলআইসি, প্রভিডেন্ট ফান্ড দপ্তর, সরকারি বিদ্যুৎ ক্ষেত্র, ওএনজিসি-র মত সরকারি সংস্থাদেরই ক্ষতি হবে, তারাই রুগ্ন হবে। কারণ বিমার টাকা, বিদ্যুতের টাকা কিছুই তারা আর দিতে পারবে না। ফলে আরও বহু মানুষ অসংগঠিত তালিকায় যুক্ত হয়ে যাবেন। তাই আজই ব্যাঙ্ক উপুড় করে তাদের টাকা দিতে হবে, এটুকুই মাত্র তাদের চাহিদা। শোনা যাচ্ছে মহামারিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখিয়ে ২০১৯ সালের একটি আইন অনুযায়ী শ্রমিক-কর্মচারীদের মাইনে দেবেন না, এমনই পরিকল্পনা তাদের।

কৃষিক্ষেত্রও অসংগঠিত। জিডিপির ১৫ শতাংশ দায়ভার বহন করে। তাদের নিয়ে মোদিজি তাঁর দুশ্চিন্তা ব্যক্ত করে দিয়েছেন। মার্কেটিং-এর কাজটি যাতে বেসরকারি সংস্থা আরও সুবিধা মতো করতে পারে, তার ব্যবস্থা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন মোদিজি, ২রা মে। কৃষি মাণ্ডি হবে বেসরকারি। রবি টোডি সেদিনই বলছিলেন, ধনী কৃষকদের থেকে কর আদায় করার চেষ্টা করতে হবে সরকারকে। না হলে সরকার টাকা পাবে কোথা থেকে আর টাকা না পেলে তারা রবিবাবুদের ত্রাণ দেবেই বা কী করে। সেই ত্রাণ না পেলে রবিবাবুরা অসংগঠিত শ্রমিকদের সুখ সুবিধা দেখবেই বা কী করে!! ফলে কৃষিক্ষেত্রে মার্কেটিং যদি ঠিক করে হয়, তবে সরকার আয়কর বসিয়ে টাকা যোগাড় করুক আর সেই টাকা টোডিবাবুদের জন্য খরচ করুক। আর সেই ঋণমুক্ত হতে সরকার তার পর টাকা ছাপাক, বা যা খুশি করুক। যখন মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যবৃদ্ধি হবে, ততদিনে যদি টোডিবাবুরা স্বাস্থোদ্ধার করতে পারেন তবে অস্ত্রব্যবসা করে, যুদ্ধ করে পাশের দেশ লুট করে কিছু ব্যবস্থা করা যাবে। কিন্তু অত দূরে ভাবার উপায় তাদের নেই। দূরবর্তী পরিকল্পনা করার সাধ বা সাধ্য কোনওটাই যদি তাদের থাকত তবে কি আর প্ল্যানিং কমিশন বাতিল করতে হত তাদের? সবই তাদের আশু। নিজেদের বেলায় বর্তমান, আর জনগণের বেলায় ভবিষ্যৎ!

বিকল্প টাকার সন্ধান ভবিষ্যতের জন্য নয়, প্রাথমিকভাবে দরকার বর্তমানের জন্যই। পেনশন ফান্ড, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, বিদেশি ঋণদায়ী সংস্থা, দেশি ঋণদায়ী ব্যক্তিমালিকানাধীন সংস্থা, এগুলির মধ্যে এখন ভরসা একমাত্র রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। কারণ সরকারি বন্ডের উপর ভরসা রাখতে পারবে না কেউই। এখন চাই কাঁচা টাকা। সেই কাঁচা টাকা বহুজাতিকদেরও নেই, জনগণের নেই। সরকারকে বেছে নিতে হবে সে কাকে দেবে সেই টাকা। কারণ দুই অংশকেই একসঙ্গে দেওয়া অসম্ভব। যারা অর্থনীতি চালু করার কাঁদুনি গাইছে সেই একচেটিয়া পুঁজি কি চাকরির নিশ্চয়তা দেবে? বলাই বাহুল্য, না। তারা কি বহুগুণ উৎপাদনের নিশ্চয়তা দেবে? না। তারা কি রপ্তানিতে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে? না। তবে কেন তাদের টাকার জোগান দেওয়ার জন্য সরকারকে আকাশকুসুম কল্পনা করতে হবে? বরং ব্যাঙ্কে যেটুকু টাকা আছে তা সুরক্ষিত রেখে, স্টক মার্কেটের সাহায্যে কেউ যাতে টেম্পেলটনের মত পালাতে না পারে তা খেয়াল রেখে, অবিলম্বে কম্পানিগুলির ম্যানেজমেন্টকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করা যেত এই লকডাউন পর্যায়ে। যদি তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজের কাজ কিছু করতে না পারে তবে অবিলম্বে তাদের সোনা-স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করে কম্পানি অধিগ্রহণ করে নেওয়া যেত। যদিও এখন তাদের থেকে এক কণা টাকাও বেরোবে না। আপাতত ব্যাঙ্কের জমা টাকা দিয়েই কাজ চালানো যেত আর আশু ভবিষ্যতে রাজস্ব দপ্তরের আধিকারিকদের পথ অবলম্বন করা যেত। উত্তরাধিকার করের কথাও বলেছেন তারা। আগামী ২০ বছরের মধ্যে ভারতের প্রথম সারির সব শিল্পপতিরা মারা যাবেন। তখন উত্তরাধিকার কর বাবদ যা হাতে আসবে তাতে সরকারগুলির অবস্থা ফিরে যাবে। রাজস্ব বিভাগের আধিকারিকদের অভিনন্দন। তবে যে করব্যবস্থা এখনই আছে সেটুকুও যদি আদায় হত, তাহলেও প্রতি বছর ৩৩ লক্ষ কোটি টাকা সরকারের আয় হত।

একটা ছোট হিসেব দেওয়া যাক। ধরে নেওয়া হল, ৫ জনের পরিবারে প্রতিদিন মাথাপিছু আয় ৪০ টাকা। তাহলে পরিবারের মাসিক আয় হয় ৬০০০ টাকা, বছরে ৭২,০০০ টাকা। অর্থাৎ ২০ কোটি পরিবারের মোট রোজগার হয় প্রায় ১৫ লক্ষ কোটি টাকা। এদিকে মোট জাতীয় আয় হল ১৩৫ লক্ষ কোটি টাকা। ২৫ কোটি পরিবারের বাস এই দেশে। অতএব বাকি ৫ কোটি পরিবার আয় করে বছরে ১২০ লক্ষ কোটি। এবার এই ৫ কোটির মধ্যে মোটামুটি হিসেবে মাত্র ১ কোটি পরিবার কর দিতে পারেন। বাকি ৪ কোটি পরিবারের বার্ষিক রোজগার যদি ৩ লক্ষও ধরা হয় তবে এই ৪ কোটি পরিবারের মোট রোজগার দাঁড়ায় ১২ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১ কোটি পরিবারের আয় দাঁড়াল ১০৮ লক্ষ কোটি টাকা। বা পরিবার পিছু বার্ষিক আয় ১ কোটি ৮ লক্ষ টাকা। এই ১ কোটি পরিবারকেও দুই ভাগে বিভক্ত করলে সরকারি চাকুরিজীবীরা যারা প্রত্যক্ষ করের আওতাভুক্ত, তাদের সংখ্যা ৮০ লক্ষ ধরা যেতে পারে। এরা ১০ লক্ষ টাকা রোজগারের ট্যাক্স স্ল্যাবের অধীন। ২০ শতাংশ হারে ধরলে এদের কর হয় দেড় লক্ষ কোটি টাকার কাছাকাছি। তাহলে বাকি ১০০ লক্ষ কোটি টাকা রোজগার করছে মাত্র ২০ লক্ষ পরিবার। সুতরাং ৩০ শতাংশ হারে কর ধরলে এদের মোট কর হয় ৩০ লক্ষ কোটি টাকা। ফলে প্রত্যক্ষ কর বাবদ সরকারের আদায় হওয়ার কথা বছরে ৩০ লক্ষ কোটি টাকার বেশি। ২০২০-২১ সালের বাজেটে সাড়ে ৭ লক্ষ কোটি টাকার বাজেট ঘাটতি, আর তার সঙ্গে রঘুরাম রাজনের হিসেবে ৭০ হাজার কোটি ত্রাণ। এই কর উঠলে সব দেনাই মুক্ত হওয়া যেত।

বর্তমান যদি অসুরক্ষিত থাকে তবে ভবিষ্যতে শ্রমিক শ্রেণি, তা সংগঠিত হোক বা অসংগঠিত কী বিপজ্জনক ভূমিকা নেয় তার সাক্ষী ইতিহাস। সামন্ততন্ত্রের পতনে প্লেগের ভূমিকা নিয়ে আজ সকলেই কথা বলছেন। করোনার প্রভাবে পুঁজিবাদের ভবিষ্যত কী হবে তা আমরা কেউই জানি না। কিন্তু এটুকু জানি আমাদের কাছে বর্তমান আছে। লকডাউন কালে যদি দেশের প্রথম ৬০টি পরজীবী পরিবারের বেআইনি সম্পত্তিতে হাত দেওয়া যেত, তবে অসংগঠিতদের প্রথমে বর্তমান ও পরে ভবিষ্যত দুটোই নিশ্চিত হত। সংগঠিত বনাম অসংগঠিত লড়াই বাধিয়ে দিতে চায় সরকার। এভাবেই দেশে একমাত্র যারা নিয়মিত কর দেন, সেই সরকারি কর্মচারীদের ঘাড়ে কোপ বসালেন। আর সেই ফাঁক গলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক খালি হতে থাকে মুমূর্ষু পরজীবী বহুজাতিকদের স্বার্থে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...