মঞ্জুল ভার্গব
ভারতীয় বংশোদ্ভূত মঞ্জুল ভার্গব একজন ক্যান্যাডিয়ান–অ্যামেরিকান গণিতজ্ঞ। অধুনা প্রিন্সটন ও লাইডন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত। ২০১৪ সালে মরিয়মের সঙ্গেই ফিল্ডস পদক লাভ করেন। খুব কাছ থেকে মরিয়মকে দেখেছেন। একসঙ্গে কাজ করেছেন।
মরিয়মের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। ও খুব অসুস্থ ছিল জানতাম, কিন্তু কোথাও একটা খুব বিশ্বাসও ছিল, ও ঠিক সামলে নেবে। ঠিক যেভাবে গত কয়েকবছরে অসুস্থ শরীর নিয়েই অঙ্কের দুর্দান্ত সব সমস্যার সমাধান করেছে, ভেবেছিলাম এবারও ঠিক খবর পাব, অসুখটাকে শেষপর্যন্ত সামলে নিয়েছে মরিয়ম-– সামলে নিয়ে ফের নতুন কোনও একটা তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো প্রোজেক্টে হাত দিয়েছে। এমন আশ্চর্য প্রাণশক্তি, এমন নাছোড় মনের অধিকারী– মাত্র চল্লিশ বছর ওর মতো বিরল এক প্রতিভার চলে যাওয়ার বয়স হতে পারে?
মরিয়মের কথা ভাবতে গিয়ে অনেকগুলো শব্দ একসঙ্গে ভীড় করে আসছে মনে। একজন মানুষ-– এত ঝকঝকে, এমন ক্ষুরধার মস্তিষ্ক, সৃষ্টিশীল, চিন্তায় অভিনব, অথচ একইসঙ্গে এত নম্র, বিনয়ী, আর তার পাশাপাশিই তুমুল ব্যক্তিগত, যত্নশীল, ঘরোয়া, পারিবারিক। আমরা প্রায় একই সময়ে হার্ভার্ড-এ আসি, আর সেটা আমাদের দু’জনেরই গবেষণার একেবারে শুরুর সময়ে। ফলে একেবারে শুরু থেকেই আমরা খুব বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম পরস্পরের। আমার এখনও খুব স্পষ্ট মনে পড়ে, একসঙ্গে কত চমৎকার সময় কাটিয়েছি আমরা। অধিকাংশ সময়ই আমাদের সঙ্গে থাকতেন আরও কয়েকজন গবেষক, সবাই কাজ করতেন গণিতেরই বিভিন্ন দিক নিয়ে… আর প্রায়দিনই কাজ করতে-করতে, মতামত বিনিময় করতে-করতে রাত গড়িয়ে মাঝরাত্তির পার হয়ে যেত। যদিও আমাদের দু’জনের গবেষণার ক্ষেত্র ছিল গণিতের ভিন্ন দুই শাখা, কিন্তু অঙ্কের প্রতি অনুরাগ আর উৎসাহের কারণে প্রায়ই একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসতাম… তেমনই একে অন্যের গবেষণার অগ্রগতি নিয়েও খবর রাখতাম। প্রায় দেড় দশক আগের সেই সব রাত্তিরে একসঙ্গে কাজ করতে-করতে আমরা ভাবতেও পারিনি, একদিন একইসঙ্গে ফিল্ড্স মেডাল সম্মান অর্জন করব আমরা। এখন বুঝি, মরিয়মের মতো বিরাট প্রতিভার সঙ্গে এক মঞ্চে সম্মান ভাগ করে নেওয়াটাই কী অসামান্য একটা গৌরবের ব্যাপার। মরিয়ম আর আমি একসঙ্গে একই বছরে ফিল্ড্স মেডাল সম্মান পেয়েছি, কেবল এইটুকু তথ্যই আমার কাছে বিরাট এক প্রাপ্তি।
জীবনে মাত্র একবারই গণিতের একটা জটিল সমস্যা সত্যি-সত্যিই একসঙ্গে সমাধান করেছিলাম আমরা। সেটা ২০১৪-য় দক্ষিণ কোরিয়া-র সোল-এ, আন্তর্জাতিক গণিত কংগ্রেসে। সেখানে ভারী মজার এক ঘটনা ঘটেছিল। ফিল্ড্স মেডাল সম্মান যাঁরা দেন, সেই উদ্যোক্তাদের তরফে যিনি সেদিনের অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করছিলেন তিনি সম্ভবত খেয়াল করেননি যে, প্রতিটি মেডালের গায়ে প্রাপকদের নাম খোদাই করা আছে। মঞ্চ থেকে যখন প্রাপকদের নাম ঘোষণা করা হল, আমরা চারজনই একসঙ্গে উঠলাম। এবং যথারীতি আমাদের প্রত্যেকের গলায় মেডাল পরিয়ে দেওয়া হল। এবং, এমনই বিচিত্র সমাপতন, আমরা চারজনের কেউই নিজেদের মেডালগুলো পেলাম না। মানে এ পেল বি-র মেডাল, বি পেল সি-এরটা… এইরকম আর কী! কিন্তু ব্যাপারটা ভাবুন, দু’জনের মধ্যে মেডাল অদলবদল হয়ে যাওয়াটা যদিও বা সম্ভব হতে পারে, চারজনের সকলেই নিজেরটা না-পেয়ে অন্য কারও পদকটা পাচ্ছেন, সম্ভাব্যতার নিরিখে সেও তো একটা বিচিত্র জটিল অঙ্ক। এবং বলা বাহুল্য, আমাদের কেউই মঞ্চ থেকে নেমে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়ার আগে সেটা খেয়ালও করিনি। যখন খেয়াল হল তখন দেখি আমি পেয়েছি মার্টিনেরটা, মার্টিন পেয়েছে মরিয়মেরটা, মরিয়ম পেয়েছে আর্থারেরটা, আর আর্থার পেয়েছে… ঠিক ধরেছেন, আমার পদকটা। অনুষ্ঠানের শেষে তুমুল ব্যস্ততা… সাংবাদিক সম্মেলন, ফোটো-সেশন, এসবের মধ্যে সকলের এক জায়গায় দেখা হওয়ার সম্ভাবনাও খুব কম। কিন্তু প্রত্যেকেরই নিজেদের পদকটা চাই। এবং সেটা চাই ফোটো-সেশনের আগেই। কিন্তু কীভাবে সেটা সম্ভব? আমার সঙ্গে মরিয়মের হয়তো ভীড়ের মধ্যে একবার একঝলক দেখা হল, কিন্তু তাতে তো লাভ নেই, কারণ আমার পদকটা তো আর ওর কাছে নেই, বা ওরটাও নেই আমার কাছে। আমার পদক ফেরত পেতে হলে আমার সঙ্গে দেখা হওয়া চাই আর্থারের। কিন্তু আর্থার যদি ওর নিজের পদকটা ফেরত পেতে চায়, তা হলে আমার সঙ্গে দেখা হয়ে ওর লাভ নেই, ওর চাই মরিয়মকে। আপাতদৃষ্টিতে খুবই হাস্যকর একটা পরিস্থিতি, কিন্তু আসলে তার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে সম্ভাব্যতার একাধিক পারমিউটেশন-কম্বিনেশন। রীতিমত জটিল একটা অঙ্কের সমস্যা। কীভাবে এটার সমাধান করা যায় ভাবতে-ভাবতে সত্যি-সত্যিই মরিয়মের সঙ্গে একবার দেখা হয়ে গেল ভীড়ের মধ্যে। এবং, কী আশ্চর্য মাথা মরিয়মের, ও কয়েক সেকন্ডের মধ্যে সমাধানও করে ফেলল ধাঁধাটার। প্রথমে ও আর আমি আমাদের কাছে থাকা পদকগুলো পালটাপালটি করে নিলাম। তারপর ও মার্টিনকে খুঁজে বের করে ওর সঙ্গে পদক পালটাপালটি করল, আর আমি আর্থারকে খুঁজে বের করে একই কাজ করলাম। ব্যস! হয়ে গেল। প্রত্যেকটা পদক ফিরে এল তাদের মালিকের গলায়। সমাধানটা আপাতদৃষ্টিতে অভিনব রকমের সহজ, এবং এই পুরো ঘটনাটা বললাম কেবল এটা বোঝাতে যে, কত সহজে ও কত জটিল বিষয় ভেবে ফেলতে পারত! এই ছিল মরিয়ম। অসম্ভব জটিল সমস্যার আশ্চর্য সৃষ্টিশীল সন সমাধান যেন ওর জন্যই অপেক্ষা করে থাকত!
নিজের অসুস্থতা নিয়ে ও পারতপক্ষে কথা বলত না, এতটাই চাপা ছিল নিজের ব্যাপারে। ফলে ওকে জিগ্যেস করে বিব্রত করতেও মন চাইত না। কিন্তু যেভাবে ও সামলে রাখত নিজের অসুস্থতাকে, এবং তার মধ্যেও যেভাবে মেতে থাকত অঙ্কের দুরূহ নানা সমস্যা নিয়ে, নিজের পরিবারকে নিয়ে, বিশেষত ওর মেয়ে অনাহিতাকে নিয়ে… সত্যি শ্রদ্ধা করার মতো। আমি এমন অনেককে জানি যারা দিনের পর দিন প্রায় ওর পাশে বসে কাজ করেছে, কিন্তু মরিয়ম ঘূণাক্ষরেও তাদের কাউকে জানতে দেয়নি যে, ও আদৌ অসুস্থ।
সত্যি, ক্যানসারের মতো মারণ অসুখকে সঙ্গে নিয়ে ও শেষ কয়েক বছরে এমন কিছু কাজ করেছে, অনেকে যা ধরতেই সাহস পেত না। মরিয়ম ছিল, যাকে বলে মাস্টার অফ কার্ভ্ড স্পেস। সবাই জানেন, সমতলে দুটি বিন্দুর মধ্যে ন্যূনতম দূরত্ব হল তাদের মধ্যে সংযোগকারী সরলরেখা। কিন্তু এই সহজ বিষয়টাই ভ্যংকর জটিল হয়ে ওঠে যখন সমতলটা আর সমতল না থেকে হয়ে ওঠে উঁচুনিচু-– ঢেউ-খেলানো। ধরা যাক, একটা বলের ওপর দিয়ে, কিংবা একটা ডোনাটের ওপর দিয়ে একটা পিঁপড়ে হাঁটছে… এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে পৌঁছতে তার সবচেয়ে শর্টকাট রাস্তাটা কী নিয়ম মেনে আঁকা হবে? বা একটা ঢালু করুগেটেড শিট বেয়ে যদি একটা জলের ধারা গড়িয়ে নামে, কেমন দেখতে হবে সেই জলের দাগটা? শুনতে সহজ হলেও ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই সহজ নয়। আর যদি একটা বিশাল গামলার উলটো পিঠের ওপর দিয়ে একটা রাগবি বলকে গড়িয়ে দেওয়া যায়? সেখানে দুটো কার্ভ্ড সারফেসের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কটা কী নিয়ম মেনে এগোবে? এই ধরনের সমস্যা নিয়ে জ্যামিতির যে শাখা কাজ করে, তাকে বলে জিওডেসিকস। মরিয়ম ছিল এই জিওডেসিকস-এর মাস্টার। এবং ত্রিমাত্রিক ফলিত জ্যামিতি নিয়ে ও যা কাজ করে গিয়েছে, তার মূল্য বিজ্ঞান ভবিষ্যতে বহু বছর ধরে বুঝবে।
মরিয়মের একটা আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল-– ও জ্যামিতির সমস্যার সমাধান যেন চোখের সামনে দেখতে পেত। এবং সেগুলো সমাধান করার ওর নিজস্ব পদ্ধতিও ছিল বিচিত্র। মেঝের ওপর প্রমাণ সাইজের কাগজে উপুড় হয়ে ঝুঁকে পড়ে ও একের পর এক ডায়াগ্রাম এঁকে চলত, আর তা থেকেই, কোন ঈশ্বরদত্ত প্রতিভায় কে জানে, বের করে আনতে পারত সমাধান। ওর সেই বিচিত্র ডুড্ল দেখে ওর ছ’বছরের ছোট্ট মেয়ে অনাহিতা হাততালি দিয়ে বলত, ওই দ্যাখো, মা আবার ছবি আঁকছে…
সত্যি, ছবিই আঁকত মরিয়ম। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে যে সব মাস্টারপিস ও ‘এঁকে’ গেল, তার কোনও তুলনা নেই। ওর অভাব আমরা বহু বছর ধরে টের পাব।
অসাধারণ। যেমন লেখা তেমনি ঝরঝরে অনুবাদ। সমৃদ্ধ হলাম।