অম্লানকুসুম চক্রবর্তী
লেখক প্রাবন্ধিক, গল্পকার
শহরের অমুক হাইটস কিংবা তমুক গ্রিনস-এর মতো বাহারি কমপ্লেক্সগুলোতে যাঁরা থাকেন, তাঁরা তাঁদের কমপ্লেক্সে নিত্যদিনের কর্মসহায়িকা অর্থাৎ কাজের লোকদের ঢোকার অনুমতি দেবেন, না দেবেন না, এই নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই বক্তব্য রাখছেন। আরডব্লুএ অর্থাৎ রেসিডেন্টস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিরা সোনালি ফ্রেমের চশমাটা নাকের উপরে ঠেলে দিয়ে, ভুরু কুঁচকে বলছেন, কার শরীরে কী আছে তা তো বলা যায় না। বাহাত্তর পয়েন্টের বিশাল ফন্টে একটা সন্দেহ মেশানো প্রশ্নচিহ্ন রাখছেন। মিডিয়ার সামনে বলছেন, এরা বস্তি-ঝুপড়ি থেকে এসে হয়তো রোগ বাধাবে। বলছেন, লোকগুলো তো আমাদের মতো পরিষ্কার, সাফসুতরো নয়। কয়েকজন আবার নিদান দিয়েছেন, যাঁরা কাজে আসবেন তাঁদের এই কমপ্লেক্সেই থাকতে হবে। একই কমপ্লেক্সের বিভিন্ন ফ্ল্যাটে যদি তাঁরা কাজ করেন তা নিয়ে কারও আপত্তি নেই। কিন্তু কাজের লোকেরা কাজ শেষে নিজের বাড়িতে ফিরে গেলেই দোষ। হাতিবাগানের পৈতৃক বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে দক্ষিণ কলকাতার এক বিখ্যাত কমপ্লেক্সে বাসস্থান বদল করে যাওয়া এক পরিচিত মানুষের সঙ্গে কথা হচ্ছিল কাল। ভদ্রমহিলা ফোনে প্রায় চিৎকার করছিলেন। কোনও কারণে ভয়ঙ্কর দুঃখ কিংবা আঘাত পেয়েছেন বলে মনে হল। কারণটা নিজেই খোলসা করলেন। তাঁদের বাড়িতে যিনি কাজ করেন, তিনি নাকি ফোনে বলেছেন, ‘দেড় মাস পরে হঠাৎ মনে পড়ল? কাজে আসতে পারব না মাসিমা। কার শরীরে কী আছে তা তো বলা যায় না।’
যে কথাটা এক উচ্চবিত্তের নিম্নবিত্তকে বলা মানায়, এক হুজুরের গোলামকে বলা মানায়, সামাজিক সিঁড়ির উপর থেকে নীচে বলা মানায়, সেখানে চরিত্র বদল হলে আমাদের বদহজম হয়। সোজা কথায় আঁতে লাগে। ষাট লাখি ফ্ল্যাটে থাকি, আমাদেরকে সন্দেহ করা! তোমাদের মতো রেশন দোকানের সামনে ব্যাগ পেতে লাইন রাখতে হয় না। পাড়ার কাউন্সিলারের দয়ায় মোড়ের মাথায় টোটো থেকে বাটি-গামলা ভর্তি করে ভাত-ডাল-তরকারি আনতে যেতে হয় না ফি সন্ধেবেলায়। এভাবে চললে কী হবে-র চিন্তাটাও করতে হয় না, অন্তত আপাতত। হোম ডেলিভারি, ওটিটি আর হবি নারচার-এর তুলসীমঞ্চে জল ঢেলে এই দিব্যি বেঁচে থাকার মধ্যে যখন কেউ এমন আনস্ক্রিপ্টেড সংলাপ বলে, তখন প্রবল জোরে ‘কাট’ বলার সময় গলাটা চিরে যায়। কাজের লোক, কাজের লোকের মতো না থাকলেই তো দোষ। নিউজ ক্যাপসুলগুলোতে তো মাঝেমধ্যেই দেখাচ্ছে কর্মসহায়িকাদের দুর্দশা। অনেকটা পথ হেঁটে আসার পরে কমপ্লেক্সের সিকিউরিটির থেকে শুনতে হচ্ছে, ‘ভাগো হিঁয়াসে। এখন কোনও কাজ হবে না। যান। বেরিয়ে যান।’ কাজের লোকেদের মেঘভর্তি মুখের সামনে হঠাৎ হাজির হয়ে যাচ্ছে নিউজ চ্যানেলের বুম। ‘কাজে না এলে আমাদের চলবে দাদা বলেন?’ ‘বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়াব, তারও পয়সা নেই।’ ‘দারোয়ান ভিতরে ঢুকতেই দিল না।’ আজ এক টেলিভিশন চ্যানেলে দেখলাম, এক তরুণী কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, ‘বাইরের সিকিউরিটি গার্ড দিয়ে তাড়িয়ে দিল। দিদি মোবাইল ধরল না। সিকিউরিটি থেকে দিদিদের ফ্ল্যাটে জোর করে ফোন করালাম। এপ্রিল মাসের মাইনে চাওয়াতে দিদি ফোনে ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, ভুলে যা।’ ওই তরুণীর দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল তখন। অন্য চ্যানেলে একই খবরে ওই তরুণীর জায়গায় কোনও বৃদ্ধা। বাড়িতে দুধের শিশুর বদলে হয়তো পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্বামী। ক কমপ্লেক্সের জায়গায় খ কমপ্লেক্স। কলকাতা উত্তর থেকে কলকাতা দক্ষিণ।
ওয়ালপেপারের মতো দেওয়ালের সঙ্গে আটকে থাকা, পাতলা টিভির বিশাল পর্দাতে আমাদের এই শোক-কথা দেখে বড় আনন্দ হয়। যে লোকগুলো পেটের দায়ে কাজে আসতে চাইছে, তাদের এক ফোনে ভাগিয়ে দেওয়া সম্ভব করতে পারার মধ্যে এক দারুণ তৃপ্তি আছে বৈকি। নাই বা হতে পারলাম কোনও জুটমিলের মালিক, কিন্তু দরজার সামনে এক অলিখিত ‘কাজ বন্ধ’ লিখে দেওয়ার ক্ষমতা তো আমরাও রাখি। লকডাউনের বাজার আমাদের এই ক্ষমতার হাত আরও শক্ত করেছে। যে সংস্থায় কাজ করি আমরা, এপ্রিলের দুর্দিনে তার ব্যবসা লাটে ওঠার পরেও বেতনের পুরো টাকা পকেটে পোরার জন্য আশা করেছি। লকডাউন যত দিন চলবে, আমাদের সাদা কলার সেই আশাই করতে থাকবে। স্টে হোম স্টে সেফ-এর আশীর্বাদে নেটফ্লিক্স, হটস্টারে সিনেমা দেখে ক্লান্ত হওয়ার পরেও সংস্থা যদি পাঁচ শতাংশ পে-কাটের প্রস্তাব জানায়, চেনা বৃত্তে তার ম্যানেজমেন্টের নামে তুমুল নিন্দা করি। আর সেই আমরাই, কাজের লোকদের বলি, এপ্রিলের টাকার কথা ভুলে যেতে। এমন কি, সেই টাকা নিতে আসার জন্য বাড়ির দরজার সামনেও পা রাখতে দিই না তাঁদের। মনে রাখি না, তাঁদের মধ্যে অনেকে কিন্তু নিজেরাই কাজে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। আমরা করতে দিইনি। তুড়ি মেরে ওঁদের অনুরোধ উড়িয়ে দেওয়ার সময় মাথাতেই থাকে না আমরা গড়ে যা রোজকার করি, তাঁদের রোজগার হয়ত তার পঞ্চাশ ভাগের এক ভাগ। অনন্যোপায় হয়ে তাঁদের ফোনটা ধরতে যখন বাধ্য হই, আমাদের ভিতরে থাকা অর্থনীতিবিদ বলে ওঠেন, কাজ না করে পয়সা চাওয়া অর্থনীতির নিয়মের বিরুদ্ধে যায়। আমাদের নিজেদের বানানো নিয়মের আর যুক্তির শিকলে ওঁদের এমনভাবে বেঁধে ফেলি যাতে ওঁরা সেখান থেকে বেরোতে না পারেন আর। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বিদ্যের কাছে ওঁদের হাইস্কুল-ফেল বিদ্যে সঙ্গত কারণেই হার মানে। বোকা বানিয়ে আমরা হাসি। সাতশ টাকাতে জোমাটো স্যুইগিতে দিন দুয়েকের বিরিয়ানি হয়ে যায়।
তবে মর্জির গ্রাফটাও তো শেয়ার বাজারের মতো। এক মাসের মাইনেটা পুরো ‘মেরে’ দেওয়ার পর, ঘরের কাজ করে, হাউসহোল্ড কোরস্-এর ছবি ভিডিও হোয়্যাটঅ্যাপ-ফেসবুকে এন্তার প্রচার করার ক্লান্তির পর, কোমরে পিঠে ব্যথা হওয়ার পর আমাদের কারও কারও অবশ্য মনে হচ্ছে, এ বারে ওদের ডেকে নিলেই হত। সিকিউরিটিকে দিয়ে থার্মাল স্ক্রিনিং করে, স্যানিটাইজার দিয়ে মোটামুটি ‘ধুয়ে নিয়ে’ ভিতরে ঢুকিয়ে নেব। পাশের ফ্ল্যাটের নন্দিতাদি, নিচের তলার সুমিতদা, বাঁদিকের টাওয়ারের ডক্টর মুখার্জি— পরিচিত সবার বাড়ির কাজই করিয়ে নেওয়া যাবে একটা লোককে দিয়ে। গ্রাউন্ড ফ্লোরের কমন এরিয়ায় যে স্টোররুমটা আছে সেখানেই থাকবে লকডাউন না ওঠা পর্যন্ত। প্রতিদিনই তো খাবার অতিরিক্ত থাকে বাড়িতে। বাড়তিটা ফেলা যাবে না, দিয়ে দেব। গোগ্রাসে খাবে ক্ষিদে পেটে। মোটামুটি এমনটাই ঠিক করে রেখেছিলাম আমরা কয়েক জন। ব্লু-প্রিন্ট রেডি ছিল। লোকগুলো গরীব। ভেবেছিলাম, মে মাসের পনেরো কুড়ি দিনের মাইনের লোভে কমপ্লেক্সের দরজা খুলে দিলেই গুটি গুটি করে ঢুকে পড়বেন আমাদের ‘মনোনীত’ কাজের লোকেরা।
কোথাও কোথাও হিসেবে হয়ত ভুল হয়ে গিয়েছিল। কাজের দিদিকে ফোন করার পর এটাও যে শুনতে হতে পারে, মাথায় আসেনি। ‘কার শরীরে কী আছে…’, এত বড় সাহস!
অবশ্য এটা বলার সময় সেই কাজের দিদিরও, দিদিদেরও গালদুটো ভিজে যাচ্ছিল কি না, তা জানতে আমাদের বয়েই গিয়েছে।