অনির্বাণ ভট্টাচার্য
লেখক গদ্যকার, কবি
মহেশ জেনার সঙ্গে আলাপ আছে ভাইজান? আমাদের মহেশ? মহারাষ্ট্রের সঙ্গলি ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনে একটা কনস্ট্রাকশন সাইটে ছিল। লকডাউন। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ। চার ঘণ্টা। আপনাদের অবশ্য এরকমই হয়। টাকা বন্ধ, হঠাৎ। ট্রেন বন্ধ, হঠাৎ। সেই মহেশ। ওর টুইটার অ্যাকাউন্ট নেই। তবে একটা সাইকেল আছে। ওর বন্ধুত্ব। আদর। পোষা কুকুরের মতো। তেরি মেহেরবানিয়া। ভাইজান, আপনাদের সেই বাইসাইকেল চোরের মতো। আপনাদের সিনেমার সঙ্গে মেলাবেন, দেখবেন মিল পাচ্ছেন। ইতালি, আমাদের এই পচা ভারত, বেরোজগারি, মৃত্যু, গরিবি, সব এক। সেই দেশের মহেশ জেনা। সঙ্গলি থেকে ওড়িশার জয়পুর। ওর গ্রাম। কীভাবে এল? একটা সাইকেল। সতেরোশো কিলোমিটার। মাঝে ছোট ছোট ধাবাগুলোয় ঘুম। একটু আধটু খাওয়া। রোড ম্যাপ নেই। বারবার যাতায়াতে মহেশ রেলস্টেশনের নামগুলো জানত। মুখস্থ ছিল। জিজ্ঞেস টিজ্ঞেস করে ওভাবেই এল। আলিবাবার বাড়ি। চকের দাগ। কে এলি? আলি এলি? নাহ, মহেশ এল। আর এমন একটা সময় এল, যখন মহেশদের গ্রাম মহেশকে ঢুকতে দিল না। আপনাদের গিনেসে মহেশের কোনও রেকর্ড নেই। তবু, মহেশ আছে। একটা আইসোলেশন ক্যাম্পে। চোদ্দ দিন। মহেশ জানে, সতেরোশো কিলোমিটার সাইক্লিং-এর কষ্ট এর চেয়ে অনেক, অনেক কম ছিল। বাইসাইকেল চোর বলছিলাম না? এ এক অন্য বাইসাইকেল চোর। এখানে ছেলে হাত ধরে নেই। ছেলে চলতে পারে না। মোহাম্মদ ইকবাল। দিনমজুর। রাজস্থানের ভরতপুর থেকে ইউপির বেরিলি। ভরতপুরের রারহা গ্রামের সাহেব সিংয়ের বারান্দা থেকে দেখতে পাওয়া সাইকেলটা। ইকবালের বাচ্চাটা। পঙ্গু। সাহেব সিং পরের দিন একটা চিঠি পেয়েছিলেন। বাচ্চাটার কথা। এতটা রাস্তা। তিন চারটে রাজ্য। সাইকেলটা দরকার ছিল। ইকবালের চিঠি। ভাষা। ‘…কিঁউকি ও বিকলাঙ্গ হ্যায়। চল নেহি সকতা’। ঠিকরে বেরোনো কষ্ট। পেইন। বার্জো দম্পতি। বিজয় বার্জো। শিবানী বার্জো। ওরাও ওড়িশার। তামিলনাড়ুর পেরুমানাল্লুরের দুজন মাইগ্র্যান্ট পনেরোশো টাকা ঘরভাড়া দিয়ে থাকত। কীভাবে টাকা দেবে এখন? খাওয়ার টাকা শেষ হয়ে আসছে। অনুরোধ? মানবতা? ওসব চলে না ভাইজান। বাড়িওলা লোক ভাড়া করে মারধর করল। পুলিশ শুনে বিজয়দের পাশে থেকেছে। কিন্তু কতদিন? একদিন শিথিল হবেই, না লকডাউন না, পুলিশের চোখ। আর তখনই চোরাগোপ্তা আঘাত। লাঠি। হয়ত, ভ্যানিশ। তামিলনাড়ুর আলিয়ারের আইএমটি মহেশ্বর। বাইরে থেকে আসা মাইগ্র্যান্টদের ভিড়। একটা ঘরে দমবন্ধ অনেকজন। নাহ, সবজির দোকান খুলতে দেবে না কেউ। জল দেবে না। কী বলছেন? এসেনশিয়াল? পরিযায়ীদের আবার এসেনশিয়াল কী? ঘরে জল নেই, খাবার নেই। বেরোতে দেখলেই লাঠি। মাথা ফাটল ওদের। পুলিশ পরে এলেও এসেছিল। তবু বলছি, কতদিন? ওদের খাবার, জল, কতদিন? মহারাষ্ট্র ভাইজান। একটা মহানগরী। একটা বস্তি। একটা স্লামডগ। তবে লাখপতি নয়। আপনাদের ভাষায় পরিযায়ী শ্রমিকগুলো ওরই কাছাকাছি কোথাও না কোথাও থাকে। যেমন ত্রিবেণী যাদব। ঝাড়খণ্ড থেকে আসা ত্রিবেণী ওখানে আটকে গিয়ে একটা আট ফুট বাই আট ফুটের ঘরে সাতজন কোওয়ার্কারকে নিয়ে থাকে। সম্বল শেষ হচ্ছে। কাছেই ধারাভি। সংক্রমণ। ভয়। খয়রানি রোড। মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশের মোট ১৮০০০ শ্রমিক খয়রানির আইসোলেশন সেন্টারগুলোতে আটকে। কোনও সাহায্য নেই। আধিকারিক নেই। আশ্বাস নেই। সরকারি স্তরে পুলিশ ছাড়া আর অন্য কোনও পেশার লোক দেখেনি ওরা এই কদিনে। শিবাজির রাজ্যে গল্পের অভাব নেই। একজন বছর তিরিশের মাইগ্র্যান্ট। আসামের নওগাঁও-এর লোক। মহারাষ্ট্রের আকোলা সরকারি মেডিকেল কলেজের আন্ডারে ভর্তি হল। খাওয়ার টাকা নেই। রোগ। করোনা পজিটিভ। একদিন ভোর পাঁচটা। লোকটা নিতে পারেনি। বেড থেকে একা উঠে গেল। গলা ছিঁড়ে দিল রেজরে। নাহ, করোনা ওকে কাড়তে পারেনি। রেজর কাড়ল। অসমে ওর কে আছে? বিয়ে শাদি? বউ? ওর আর কোনও দেশেই ফেরা হল না ভাইজান। নাম? থাক না। ওদের কোনও নাম থাকে? ছিল কোনওদিন? নিয়তিগুলো ছিল। থাকবে। যেমন বিবেকানন্দের আছে। বিবেকানন্দ মানে আপনাদের ছবির ওই লোকটা না। ঝাড়খণ্ডের বিবেকানন্দ শর্মা। বেঙ্গালুরুতে ছুতোর মিস্ত্রির কাজ করে। সম্বল শেষ হতে হতে এখন বাসস্টপের সামনে লেবুজল দেওয়া ভাতের জন্য ভোর থেকে লাইন দেয়। এক বছরের মেয়েটাকে জল ছাড়া আর কিছু খাওয়ানোর নেই। বউ খিদের জ্বালায়, অপুষ্টিতে ভুগছে। কোথায় পাবে বুকের দুধ। মাতৃত্ব জ্বালা ভাইজান। পিতৃত্ব জ্বালা। জীবনে প্রথমবার হয়ত ভিক্ষে করতে হবে বিবেকানন্দকে। লুধিয়ানায় আটকে পড়া তিলক মাহাতো। সোয়ান চ্যারিটি থেকে তিলকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে হাজার টাকা দিয়েছিল। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ভাইজান। ওই হাজারের ভেতর আটশো কেটে নিল মিনিমাম ব্যালেন্সের নন মেন্টেন্যান্সের দোহাই দিয়ে। সোয়ান পাল্টা লড়ল। কিছু এনজিও লড়ল। শেষমেশ পেল। মহামারি আপনাদের ইতিহাস অনুযায়ী এবছর থাকবে, পরের বছর থাকবে, কীসব ইমিউনিটি না কী যেন হবে, তারপর তো যাবে। কিন্তু এই ভোগান্তি, টাকা মেরে নেওয়ার জাতীয় জবরদখল— খোলাবাজারে দেশ থেকে এসব কবে যাবে ভাইজান? কোনওদিন না। ওই হাজার টাকা শেষ হলে তিলক ঠিক করেছে পাশের একটা গুরদোয়ারায় খাবার দেয়। যাবে। উত্তরাখণ্ডের তানহাও হমস্টে। করবেট ন্যাশনাল পার্কের পাশে লাক্সারি। আর বাইরেটা? ফটোগ্রাফার সুনন্দ সেনের ক্যামেরা ভাইজান। ট্র্যাপ ক্যামেরা। কী ধরা পড়ল জানেন? পরিযায়ী দল। হাঁটছে। তার ঠিক পনেরো মিনিট আগে। ওই রাস্তায়। বাঘ। মানুষখেকো। রাতে স্থানীয়রা সে রাস্তায় একা যান না কোনওভাবেই। পরিযায়ীদের আসল মানুষখেকো গরিবি। বেরোজগারি। সংক্রমণ, বাঘ এসব ছোটি সি বাত। সুরাটের কাপড়ের কল থেকে ইউপি-র গোরোখপুর আসছে তিলোকি কুমার। ওর বন্ধুরা। খাবার? যা আছে তাতে দুদিন চলবে। তারপর? তিলোকি হাসছে। ‘খানা তো মিল যায়েগা সাহিব, এক পুরানি চপ্পল দে দো’। তিলোকির, তিলোকিদের পায়ের চামড়া দেখা যাচ্ছে না। রাজস্থানের আলোয়ার থেকে ইউপি আসা একটা কনস্ট্রাকশন সাইটের শ্রমিকের দল এক একজন সর্বস্ব বেচে ছত্রিশশো সত্তর টাকা দিয়ে একটা প্রাইভেট বাসের টিকিট পেয়েছে। দীনেশ আর মিথিলা জয়সোয়ালরা অবশ্য একটা অটো পেয়েছিল। মুম্বইয়ের গ্লাস ফ্যাক্টরির শ্রমিক। সেখান থেকে ইউপির বাস্তি। পনেরোশো কিলোমিটার। মিথিলারা চারদিন ধরে আসছে। যদি না মাঝে কিছু হয়…। কী হয়? রেললাইন পড়তে পারে। ভাইজান, আমরা অনলাইনে ইউপি যাওয়ার শ্রমিক পাসের জন্য অ্যাপ্লাই করতে পারি। তবে, পাব না, জানেন। তখন আমাদের হাঁটতে হবে মহারাষ্ট্রের জালনার স্টিল ফ্যাক্টরি থেকে ভুসাওয়াল অবধি। ওখান থেকে স্পেশাল ট্রেন। যদি নেয়। মাঝে বাঁদনাপুর। রাস্তা থেকে রেললাইনে উঠব। এখন তো চলছে না কিছু। লাইনের পাশে ঝোপঝাড়। সাপ। লাইনই ভরসা। কারমাদ অবধি আসব। ভোর পাঁচটা পনেরো। আর পারব না ভাইজান। ঘুম। আওয়াজ। গলা। ধড়। মাথা। আমরা ষোলোজন। কিছু মনে নেই তারপর। শুধু মনে আছে, শীর্ষ আদালতে বলা হয়েছে রেললাইন ঘুমনোর জায়গা না। যাওয়ার জায়গা। এক বিন্দুতে মিলিয়ে যাওয়ার।
যাওয়া তো নয় যাওয়া। গাড়ি নেই। তবু যাওয়া থাকে। যেমন মহেশের কথা বলেছিলাম শুরুতেই। ওর বন্ধুরা। গোটা দেশ জুড়ে। যাদের সাইকেল নেই। শক্তি নেই। পা আছে। পরিবার আছে সঙ্গে। মধ্যপ্রদেশ। মহারাষ্ট্র থেকে ইউপি ফেরা একটা শ্রমিক বোঝাই ট্রাক মধ্যপ্রদেশের সাগর জেলার কাছে উল্টে গেল। ফেরার তাড়া। বড় বেশি তাড়া। নজন। শেষ। গুনা। সেই মধ্যপ্রদেশ। শুরু, শেষ, একই। নিয়তি একই। তবে এবার ছয়ের জায়গায় নটা লাশ। বাকি চুয়ান্ন সঙ্কটজনক। সীমান্তে। দুই অনন্তের মাঝে। মহারাষ্ট্র থেকে ইউপির মাঝে বারবার পেরোনো সেই মধ্যপ্রদেশ। নরসিংহপুর-সিওনি সীমান্ত। রাত সাড়ে তিনটেয় একটা আম বোঝাই ট্রাকের বেসামাল স্টিয়ারিং। আমের গাদায় লুকোনো কয়েকজন। আম খেতে নয়, লুকোতে সাহায্য করল ওদের। মৃত্যু দেখে ফেলল। আমের স্তূপে, রঙে, খিদের গন্ধে ওদের পাঁচ পাঁচটা শরীর। নিথর। পাঞ্জাব থেকে বিহারে আসতে ইউপি পড়ে। পড়ে মুজফফরনগর। রাত এগারোটায় ঘালাওলি চেকপোস্টের পাশে ওরা ছজন। হাই স্পিড ট্রাক। দলা পাকানো ঘরে ফেরার গান। ছবি। এবার আরেকটু সরে ইউপির আওরাইয়া জেলা। মিহাউলি গ্রাম। দিল্লি, রাজস্থান থেকে বাংলা, ঝাড়খণ্ড, বিহারের দিকে আসা ট্রেলার ট্রাক উঠে গেল চায়ের দোকানে দাঁড়ানো ডিসিএম ট্রাকের উপর। দুটোই শ্রমিক বোঝাই। চব্বিশ জন নিয়তির দিকে যাওয়া পরিযায়ীর ঘর স্বজনহারা। উত্তর দিনাজপুর, পুরুলিয়া স্বজনহারা। বছর ছাব্বিশের নীতিন কুমার হরিয়ানার সোনপত থেকে উত্তর প্রদেশের রামপুরে ফিরছিল। রাস্তায় ট্রাকের ধাক্কা। নীতিন অনেক দূরে চলে গেল। হায়দ্রাবাদ থেকে কর্নাটকের রায়চুড়ের দিকে যাওয়া একটা আট জনের দল। আবার অ্যাক্সিডেন্ট। শেষ। ওদের মধ্যে একটা আঠারো মাসের বাচ্চা ছিল। টডলার। মহারাষ্ট্রের ভাসাই থেকে গুজরাট বর্ডার পেরিয়ে রাজস্থান যাওয়া একটা চারজনের দলকে পুলিশ তাড়া করল, ট্রাক চাপা দিল, শুধু কাজটুকু, খাবারটুকু দেওয়া হল না। দিল্লির তুঘলকাবাদে কাজ করত রনবীর সিং। বয়স। হার্টের রোগ। তবু বাড়ি তো ফিরতে হবে। মধ্যপ্রদেশের মোরেনা গ্রামে। অনেকটা, অনেকটা ভাইজান। দুশো কিলোমিটার হাঁটল। আগ্রার কাছে একটা দোকানে দাঁড়াল। দোকানি শুতে দিল। জল দিল। ঘাম। অন্ধকার। রণবীরের হার্ট আর পারেনি। যেমন পারেনি বছর বাষট্টির গঙ্গারাম ইয়েলেঙ্গে। সুরাতের নিউ সিভিল হাসপাতাল থেকে কিছুটা সুস্থ হয়ে মাজুরাগেটের কাছে বাড়ির দিকে ফিরছিল। গাড়ি নেই। খালাসির কাজ করা ভাইপোকে নিয়ে ফিরতে ফিরতে সেই অন্ধকার। নিয়তি। মহারাষ্ট্রের থানে থেকে ভাসাই রোড রেলস্টেশন আসতে হার্টের পেশেন্ট বছর পঁয়তাল্লিশের হরিশচন্দ্র শঙ্করলালকে তিরিশ কিলোমিটার হাঁটতে হল। ভাসাই থেকে একটা শ্রমিক স্পেশাল। ট্রেন। যেভাবে হোক উঠে পড়তে হবে। দরজা, ছাদ, টয়লেট, মেঝে। বসার সিট। একসময় রাজস্থান। ঘর। ভাসাই স্টেশন দেখতে পেয়েছিল হরিশ। ওই তো সামনে। আঃ। বাকিটা পারছে না কেন? শুয়ে পড়ল হরিশ। স্টেশন হল। ট্রেন হল না। বাড়ি হল না। অন্ধকার। তামিলনাড়ুর থেনি জেলার রসিঙ্গাপুরম। একটা দশ জনের মাইগ্র্যান্ট দল জঙ্গলের শর্ট রুট ধরে ফিরছিল। শুকনো জঙ্গল। আগুন। ওরা বোঝেনি। পাঁচজন পারলেও বাকি পাঁচজন পারল না। একটা বাচ্চা মেয়ে ছিল। বছর পাঁচ হয়তো। দগ্ধ। জীবন্ত। সতী। এবং বছর বারোর জামলো মাকদাম। মুড়িয়া উপজাতি। ছত্তিশগড়ের আদেদ গ্রামে সুকমতি আর আন্দুরামের শোকের সময় নেই। আটটার ভেতর চারটে সন্তান বেশি বয়সের মুখ দেখেনি। চলে গেছে। পাঁচে গেল জামলো মাকদাম। অন্ধ্রে লঙ্কা কুড়োতে যাওয়া জামলো বলেছিল, ঘর ভরে লঙ্কা আনবে। বাকিগুলোও জামলো হবে, জানে সুকমতি। রেশন পাল্টাতে হবে। কার্ডে ভুল। জামলো মরে গেলে বিপিএল কার্ড পেয়েছিল ওরা। তাতেও ভুল। জামলোর আধার কার্ডে ওর নাম জামলো না। লেখা আছে জিতা মাকদাম। তাই, আইনত জামলো মরেনি। জামলো লঙ্কা ভরে আনবে। ভাতের পাশে লঙ্কা। আঃ। সুকমতি মাই থেকে ছোট ছেলেটাকে সরাতে সরাতে ঘুমের ভেতর পাশ ফেরে। ঠোঁটে লাল। রক্ত। ঝাল। লঙ্কা।
সুরাট। দেশের মাইগ্র্যান্ট পপুলেশনের সবচেয়ে বড় সেন্টার। ক্ষোভ। বিক্ষোভ। ভাঙচুর। খাবার দাও। টাকা দাও। পুলিশ। আটক। দেশদ্রোহী। তাই না? কেরল। আলোর দিক। রাজস্থানের ভরতপুরের বিনীত জঙ্গিদ কেরলের কাসরগড়ে কাজের জায়গায় আটকে আছে। সরকার পাশে আছে। খাবারটুকু পাচ্ছে। এতদিনের কাজে কিছু সহায়, সম্বল জমেছে। সেসব দিয়েই পিএম রিলিফ ফান্ডে পাঁচ হাজার টাকা। কুর্নিশ? ভাইজান, ওসব শব্দ বিনীতদের ডিফাইন করতে যথেষ্ট নয়। ঘরে বউ আর দুবছরের বাচ্চা নিয়ে ও বহুদিন হাসিখুশি থাকুক। হরিয়ানার রোহতকে পাঁচশো কুড়ি মাইগ্র্যান্ট একটু ভালো আছে। ওরা বলছে, এটাই ওদের সেকেন্ড হোম। ঘর। মালদার মানিকচকের এনায়েতপুর হাইস্কুলে একশো পঁচিশ জনের মাইগ্র্যান্ট লেবারারের দল। বিহারে গিয়ে কোনওমতে ফেরা মোহাম্মদ আলাউদ্দিন, রিজওয়ান বা অসমের কোকরাঝড় থেকে আসা আটকে পড়া সোহেল আনসারি। তিন ফুট? সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং? সোহেলের মনে হচ্ছে ওরা কোনও স্টেশন চত্বরে আছে। ভিড়। লোকাল ট্রেন আসছে। আলিয়া মুসা ওখানে বাকি আরও চোদ্দ জন মহিলার সঙ্গে আছে। একটা টয়লেট। হাইজিন? হাসালে ভাইজান। দিল্লির কাপাসপাড়ার ছজন টেলর। মালিকের কাপড়ের দোকানে সেলাইয়ের কাজ। একটা ঘরে ওরা ছজন। আমিনুদ্দিন, রুস্তম, আব্দুল। রুটি আর নুন দিয়ে পনেরো দিনের লড়াই। মালিকের ভাড়ার তাগাদা। মাসে পাঁচ হাজার। রেশনের টাকা দেওয়ার চাপ। কতদিন? সাইকেল। আব্দুল রহমান পাঁচশো কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে একটা ট্রাক পেয়ে ইউপি ফিরছে। বিহারের দিকে যাওয়া রুস্তম মিয়া এখনও চালাচ্ছে। অন্তহীন সাইকেল রাস্তা। জো জিতা ওহি…। সব খেলায় জেতা হয় না। হয় টিকে থাকা। কোনওমতে টিকে থাকা। গঞ্জাম থেকে হেঁটে বালাসোর এলেও গ্রামে জায়গা হয়নি কালিয়া বিন্ধানির। একটা পাবলিক টয়লেটে কোয়ারেন্টিন। ওখানেই খাওয়া। শৌচ। তিনদিন। মধ্যপ্রদেশের মৌ থেকে ইন্দোর আসছে রাহুল। গরুর গাড়ি। জোড়া গরুর ভেতর একটা বেচে খাবার কিনেছে। বাকি রাস্তাটা যেতে হবে। পরিবার সঙ্গে। রাহুল নিজে বাকি চারপেয়েটাকে কাঁধ দিচ্ছে। ভাইরাল হিউম্যান বুলোক কার্ট। এমপি থেকে ইউপি পাঁচশো কিলোমিটার হাঁটা যুবতী শ্রমিক রাজাবেতির একটা মেয়ে হয়েছে গাছের নিচে। ললিতপুরে রাস্তার ধারে হঠাৎ পেট চেপে বসে পড়েছিল ও। ওর বর তান্তু কোথায় দাই পাবে? ডাক্তার পাবে? কন্যাসন্তান। ‘জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি’। ইটানগর। অরুণাচল। পেটে দুনম্বর বাচ্চা নিয়ে লড়ছে মর্জিনা বানো। অপুষ্টি, ভয়, অসমে কাজ করতে যাওয়া স্বামীর জন্য দুশ্চিন্তা। চল্লিশ বছরের উপু বানো রাস্তার নোংরা প্লাস্টিক, কাপড় সংগ্রহ করে। বিক্রি টিক্রি করে দুবেলা একমুঠো ভাত যোগান হয়। ওসব বন্ধ। মর্জিনার মতো শেষ চিন্তাটা নেই যদিও। উপু বিধবা। অন্য ভয় আছে। রোগ ছাড়াও। দেশের দিকে দিকে বিদ্বেষ। রোগ ছড়াচ্ছে নাকি মুসলমানেরাই। খারাপ ব্যবহার। পড়শি ঘরে, দোকানে। কোনও ভ্যাক্সিন, ওষুধ নেই এই রোগের। কোনও দেশেই।
ভাইজান, আপনাদের কীসব অ্যাক্ট ফ্যাক্ট ছিল না? ইন্টারস্টেট মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কমেন অ্যাক্ট ১৯৭৯? কেন করেন এসব? বই বাড়াতে? আমাদের তো বলা হয় না। মালিক চুক্তি করে না। কেন করবে? দায়িত্ব বাড়বে যে। দেশের মোট কাজ করা লোকজনদের মধ্যে শুনলাম ৭৬ শতাংশ পাকাপাকি মাইনে পায়। বাকি চব্বিশের কোনও ঠিকঠাক নেই। ভালনারেবল। মিথ্যে, ভাইজান মিথ্যে। একটু পিছিয়ে যান। তামিলনাড়ু সরকার বলল রাজ্যে মোট ১.৩৪ লাখ পরিযায়ী শ্রমিক আছে। ২০১৪। একটা বিল্ডিং ভেঙে পড়ল। খোঁজ হল। সার্ভে হল। সংখ্যাটা আসলে নাকি দশ লাখেরও ওপরে। এসবই চলছে। আর দেশের বারোটা সবচেয়ে কর্মহীন রাজ্য থেকে কাতারে কাতারে আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি মহারাষ্ট্র, কেরল, হরিয়ানায়। পড়ুন, ‘মরে’ বেড়াচ্ছি।
আর পারছি না। একটা হেস্তনেস্ত দরকার। একটা সাইকেল দরকার। মহেশের মতো। অনেকদূর যাব। ও লিড করবে। আমাদের চিৎকার। কষ্ট। যন্ত্রণা। সুখস্মৃতি। তারপর গান। মহেশের ঠোঁটে একটা শিস। গজল। রাহাত ইন্দোরি। ‘হামারে মুহ সে জো নিকলে ওঁহি সাদাকাত হ্যায়/ হামারে মুহ মে তুমহারি জুবান থোরি হ্যায়’। মুম্বই থেকে বিদর্ভ হাঁটা মুম্বই-নাসিক হাইওয়ের উপর কাঁধে মাসি বাচেলা বাইকে বয়ে নিয়ে যাওয়া বিশ্বনাথ সিন্দে ব্যথা ভুলে কোরাস মেলাবে। প্রেগন্যান্ট স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে একটা কৃত্রিম কার্ট তৈরি করে মধ্যপ্রদেশের দিকে সাতশো কিলোমিটার যাওয়া রামুর গলা, হাসি। ‘ইয়ে দোস্তি, হাম নেহি…’। পাঞ্জাব থেকে ঝাঁসি, আটশো কিলোমিটার হাঁটা ট্রলি ব্যাগটার উপর ঘুমনো বাচ্চাটাকে জাগিয়ে ওর মা বলবে, আগ্রা এসেছে। তাজমহল দেখবি না বেটা? পেয়ার দেখবি না? মহব্বত?
আমাদের কারও মাইনে লাগবে না। অনলাইন পাস লাগবে না। স্পেশাল ট্রেন লাগবে না। রেশন লাগবে না। খাবার লাগবে না। প্যাকেজ লাগবে না। শুধু একটা ঝট করে চলে যাওয়া চাই। ওই ষোলোজনের মতো। হঠাৎ। একটা আত্মহত্যার অধিকার। আমাদের দেশ, ভাইজান, আমরা জেনে গেছি থেমে গেছে অনেকদিন।
‘কিঁউকি ও বিকলাঙ্গ হ্যায়। কিঁউকি ও চল নেহি সকতা…’