নন্দিনী সঞ্চারী
লেখক কবি ও শিক্ষিকা
দেশে অনলাইন শিক্ষার ধুম উঠিয়াছে। কচি, বুড়ো, ছোটদের ইশকুল বড়দের ইশকুল সবাই বলিতেছে অন লাইনে থাকো। এইদিকে আবার ইহাদের জ্যাঠা ইউনেসকো জ্বলজ্বল করিয়া লিখিয়া দিয়াছেন Learning never stops। সুতরাং থামিয়া থাকিলে চলিবে কেন? সমস্ত মাস্টারকুল বুঝিয়া গেলেন কষিয়া ছেলেদের অঙ্ক বাংলা ইংরিজি ভুগোল ইতিহাস শিখাইতে হইবে। ব্যস, ঘটাং ঘটাং খচাক খচাক করিয়া বাপ মা মাস্টার দিদিমণি সব লাগিয়া গেল লাইন বরাবর চলিতে। (না এ সে রেললাইনের রাস্তা আর বিছানা নয়)। ঝুম বুম, হোয়া কোয়া, ব্যাঙাউট না ছাতা কি ব্যাঙাচিআউট, সব নামাইয়া গলগল করিয়া বিদ্যে ঢালিতে শুরু করিলেন।
এদিকে নিন্দুকেরা বলাবলি করিতেছে, ‘এ কী হল! গরিব মানুষের বাচ্চা শিখবে কী করে! তাদের তো স্মার্ট ফোন টোন নেই।’ আহাম্মকের দল ইহাও জানে না গরিব কভুও মানুষের বিশেষণ হয় না। অর্থাৎ, গরিব হইলে মানুষ থাকে না, হয় বুরবক। নিন্দুকেরাও ছাড়িবার পাত্র নয়। তাহারাও ষাঁড়ের ন্যায় চেঁচাইতেছে, ‘ওই আপ্নাগো ইউনেস্কোর ছাইটে গোটা গোটা লেখা রয়েসে Hi tech, Low tech আর No tech-এর কথা। আমরা ওই নো টেককেই নিলাম।’ পাজির দল নিন্দুক খালি খাওয়া বুঝিয়াছে। পেটে ভাত না থাকিলেও যে শিক্ষা সম্ভব, তাহা যদি ইহারা বুঝিত।
এইসব প্যাঁচাল শুনিয়া আমাদের বিশুমাস্টারের খুবই কৌতূহল হইল অনলাইন শিখন শিখিতে। বাড়িতে আপন পুত্র বেসরকারি স্কুলে ক্লাসটাস করিতেছে। কিন্তু গিন্নির তদারকিতে সেই দিকে বিশেষ যাইতে পারেন না, যদি উন্মুক্ত দেহ ক্যামেরায় ধরা পড়িয়া যায়। কয়েকদিন ভাতঘুম দিয়া উঠিয়া টিভিতে অনলাইন ক্লাসও দেখিয়াছেন। নিজের বিষয় বাংলার ক্লাস শুনিতে গিয়া খ্যাক খ্যাক করিয়া হাসিয়াও ফেলিয়াছিলেন চুপি চুপি। কিন্তু অনলাইন শিক্ষার কৌতূহল নিবৃত্ত হয় নাই। তাই এক নিস্তব্ধ দ্বিপ্রহরে তিনি কম্পিউটার খুলিয়া বসিলেন। খুলিয়াই তাঁহার চক্ষুস্থির। ইহারা করিয়াছে কী! করোনাকালে পৃথিবীব্যাপী শিক্ষা লইয়া এত গবেষণা চলিতেছে— ইহা তো জানাই ছিল না। গালভরা নাম তাহার Inclusive Distant Education। সে কত দিন পূর্বে নেতাজি ওপেন হইতে একখানি ডিগ্রি লইবার সময় দূরশিক্ষায় এসব ইন্টারনেট শিক্ষাব্যবস্থা দেখিয়াছিলেন বিশুবাবু। সেইসব সাইবার ক্যাফের বালকটিই করিয়া দিয়াছিল। কিন্তু এইখানে তো কীভাবে শিক্ষকরা কথা বলিবেন, কোন সিস্টেম ব্যবহার করিবেন তাহার বিশদ বর্ণনাসহ ভুরি ভুরি কথা লিখা। যদিও তাহার অর্ধেকের বেশি বিশুবাবু বুঝিতেই পারিলেন না, তবুও তাঁহার মনটা ভরিয়া উঠি্ল। আর কী সুন্দর সেই সব নাম— পেপার এয়ারপ্লেন, সী-সঅ। এতদসর্বস্ব তাঁহার অজানা আছিল! আগে খেয়াল করিলে ছাত্রদের না জানি কতকিছু শিখানো যাইত।
আর তো দেরি করা উচিত নহে। ভাবামাত্রই কার্যারম্ভ। স্কুলের উদ্যোগেই পাইয়া গেলেন ছাত্রদিগের ফোন নম্বর। যোগাযোগ শুরু করিলেন বিশুবাবু। দশম শ্রেণি।
প্রথম কল। ধরিল ছাত্র নাজিবুদ্দিনের বাবা “নাজিবুদ্দি বাড়ি নেই স্যার, রেশন তুলতে গেছে; আইলে আপনার ফোন করতে বলি এই।”
দ্বিতীয় কল ছাত্রী রুক্সানাই তুলিল। স্যারের ফোন পাইয়া তাহার আনন্দের সীমা নাই, সমস্ত বলিবার পর মনে হইল সে বিষয়টি বুঝিয়াছে, স্বস্তি পাইলেন বিশুবাবু।
তৃতীয় কল সুমনাকে, না জানি কে ফোন তুলিল, উচ্চৈঃস্বরে তিন মিনিট বুঝাইবার পর ‘রং নাম্বার’ বলিয়া ক্ষ্যান্ত দিলেন বিশুমাস্টার।
চতুর্থটি রজতকে, চিরকালই সে কিঞ্চিৎ ঠোঁটকাটা, ঈষৎ ভয়েই ছিলেন বিশুবাবু, কী না বলিয়া বসে ছেলেটা। আশ্চর্য, ফোন তুলিয়া অসম্ভব শান্ত গলায় কথা বলিল রজত, “স্যার, বাড়িতে বাবা অসুস্থ, ছোট ভাইবোন রয়েছে। নেট ভরাতে পারলে নিশ্চয়ই ক্লাস করব, স্যার। না করলে পরে পড়াগুলো বলে দেবেন তো?” কী যেন বলিতে গিয়া চুপ করিয়া যাইল রজত। ফোনটিও কাটিয়া গেল।
এইরূপ ঘন্টাখানেকের প্রচেষ্টায় আমাদিগের বিশুমাস্টার জনাচল্লিশেক ছাত্রের সহিত যোগাযোগ করিতে পারিলেন। কিছু ফোন বাজিল না, কিছু বাজিয়া বাজিয়া থামিয়া গেল। পঞ্চাশ ছাত্রছাত্রীর ক্লাসে জনা পনেরো নিশ্চিত হইল। একবার ভাবিলেন, বাকিদের কী হইবে? তাহারা কি বঞ্চিত হইল? কিন্তু চেষ্টায় তো ত্রুটি ছিল না। যে সুযোগ গ্রহণ করিতে পারিল না, সে তাহারই দোষ। তিনি শুনিয়াছিলেন উচ্চশিক্ষায়ও এসব ব্যবস্থা আসিতেছে। কাহারও সুবিধা থাকুক বা না থাকুক, তাহা ভাবিবার বিষয় হইতে পারে না। এত ভাবিলে তো শিক্ষার পথ রুদ্ধ হইয়া যাইবে। যাহাদের সামর্থ্য আছে, তাহারাই শিখুক অন্তত। স্থির করিলেন আগামীকাল হইতেই ক্লাস শুরু করিয়া দিবেন। পরদিনের লেসনপ্ল্যান এখনই প্রস্তুত করিতে হইবে।
হঠাৎ ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিল। তাঁহার আট বৎসরের পুত্র পার্শ্বে আসিয়া গা ঘেঁষিয়া বসিয়াছে। চক্ষুভরা টসটসে জল। কী হইল? তাহার মাতা নিশ্চয় কিছু লইয়া তিরস্কার করিয়াছে।
“কী হয়েছে সোনা?”
“তুমি মাকে বলবে না তো?”
“না। তুমি বলো।”
“আমার মোবাইলে এত ক্লাস করতে ভালো লাগে না বাবা। আমি সবকিছু শুনতেও পাই না ভালো করে। আজ টেস্টে সবাই নাকি গুড পেয়েছে, আমি পাইনি। কালও টেস্ট আছে। আমি আবার কম নম্বর পাব।”
হঠাৎ যেন আপন শিশুকালের কথা মনে পড়িয়া গেল বিশুবাবুর। কী ভাবিয়া পুত্রকে বলিলেন, “চল আমরা ছাদে গিয়ে খেলা করি, তারপর ওখানে তোকে সপ্তর্ষিমণ্ডল চেনাব।”
নাজিবুদ্দিন, সুমনা, রজতরাও হয়ত এসময়ে অন্য কিছু শিখিতেছে।
দারুন সময়োপযোগী লেখা