দেশের দরকার রাজস্বখাতে ব্যয়বর্ধন, আরও লিকুইডিটির সঞ্চার নয়

প্রসেনজিৎ বোস, রোহিত 

 



একটা কথা সবাই বুঝছে, আর্থিক মন্দায় টাকা ছড়ালে লাভ নেই। কারণ সামগ্রিকভাবে চাহিদার অবনমন ঘটেছে বলে ঋণগ্রহণ এবং অর্থেরও তেমন চাহিদা নেই। The Wire পত্রিকায় এই নিয়েই লিখলেন অর্থনীতিবিদ প্রসেনজিৎ বোস এবং জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোহিতচার নম্বর প্ল্যাটফর্মের পাঠকদের জন্য সেই নিবন্ধের ভাষান্তর। লেখাটি অনুবাদ করেছেন সত্যব্রত ঘোষ

 

 

মাঝারি, ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র উদ্যোগ, কর্মচারী প্রভিডেন্ট ফান্ড অ্যাকাউন্ট-হোল্ডার এবং রাজস্বদাতাদের চাঙ্গা করতে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন সংস্থাগুলির দায় পরিশোধের জন্য যে অতিরিক্ত সাহায্যের কথা ঘোষণা করেছেন, তা নরেন্দ্র মোদির ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ে তোলার ঘোষণায় ছন্দপতন ঘটাল। মোদি গত মঙ্গলবারে (১২ মে) যে আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন, তা যোগ করলে, মোট ২০ লক্ষ কোটি টাকা দাঁড়ায়। এই প্যাকেজ ভারতের জিডিপি-র প্রায় ১০ শতাংশ।

আমরা আশা করেছিলাম, অর্থমন্ত্রী প্রথমে স্পষ্টতার সঙ্গে বুঝিয়ে দেবেন যে এই কুড়ি লক্ষ কোটি টাকা কীভাবে ও কোন কোন খাতে খরচ করা হবে। না, সেই বিষয়ে একটি কথাও তিনি বলেননি। এমনকি MSME, EPF অ্যাকাউন্ট-হোল্ডার এবং রাজস্বদাতাদের সাহায্য করলে অর্থকোষে কী প্রভাব পড়বে, তা নিয়েও তিনি চুপ। এতে মোদি সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতায় বড় প্রশ্ন উঠছে। যে কুড়ি লক্ষ কোটি টাকার কথাটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যের সিংভাগটাই ব্যয় করেছেন, তা যদি শুধুমাত্র অতিরিক্ত লিকুইডিটি সঞ্চারের লক্ষ্যেই হয়, সেক্ষেত্রে বলতে হবে এটা শুধু একটি অর্থহীন নীতিই নয়, জনগণকে বিভ্রান্ত করবার একটি সুচিন্তিত প্রয়াস।

ঋণগ্রহীতার দায় পরিশোধের জন্য সাহায্য আর অর্থকোষ থেকে খরচ করা দুটি আলাদা ব্যাপার। প্রথমটিতে অর্থনীতিতে টাকার উপস্থিতি এবং ঋণব্যবস্থার ওপর প্রভাব পড়ে। দ্বিতীয়টিতে সরাসরি সামগ্রিক চাহিদা বাড়ে এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটে। এটা প্রায় সবাই বুঝেছেন যে একটি আর্থিক মন্দার সময়ে লিকুইডিটি বাড়ানোয় বিশেষ কাজ হয় না কারণ সামগ্রিক চাহিদা কমতে থাকে, সঙ্গে ঋণের চাহিদা এবং টাকারও ঘাটতি হয়। এই লিকুইডিটি-র ফাঁদ থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে আমাদের প্রচুর বিনিয়োগ করতে হবে। নগদ আয়ের হস্তান্তর করতে হবে এবং অতিরিক্ত ক্রয়ক্ষমতা তৈরি করতে হবে। আর্থিক মন্দার মাঝে এগুলি তখনই করা সম্ভব হয়, যখন অর্থকোষের ঘাটতির প্রসারণ ঘটিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য অতিরিক্ত খরচ করা যাবে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (IMF) নিয়ম অনুযায়ী সরকারের নেওয়া ব্যবস্থাকে দুভাবে চিহ্নিত করা হয়— ‘লাইনের উপরে’ এবং ‘লাইনের নিচে’। ‘লাইনের উপরে’ বললে রাজস্ব এবং সরকারি খরচ জাতীয় ব্যবস্থাগুলিকে বোঝান হয়, যার সঙ্গে অর্থকোষের সম্পর্ক আছে। ‘লাইনের নিচে’ বলতে বোঝায় অর্থকোষের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন ব্যবস্থাগুলিকে। এই দুটিকে একসঙ্গে যুক্ত করে প্যাকেজ হিসেবে ঘোষণা একটা বড়সড়ো ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়।

উদাহরণস্বরূপ, ধরা যাক, সব কটি মাঝারি, ক্ষুদ্র আর অতি ক্ষুদ্র উদ্যোগে সরকার এক লক্ষ টাকা করে মূলধন ভর্তুকি হস্তান্তর করে দিল। সেক্ষেত্রে সেই ব্যবস্থাকে ‘লাইনের উপরে’ বলে চিহ্নিত করা হবে। এতে একই সঙ্গে উদ্যোগগুলিতে বিনিয়োগ এবং ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। এর জন্য সরকারের এক থেকে দেড় লক্ষ কোটি অতিরিক্ত ব্যয় হবে, যার ফলে গুণিতকের মাধ্যমে উৎপাদনের পরিমাণ বিনিয়োগের থেকে বেশি হতে পারে।

আবার মাঝারি, ক্ষুদ্র আর অতি ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলির জন্য লিকুইডিটি সাহায্য আর ঋণ জামিনের ঘোষণা করলে তা মুলত ‘লাইনের নিচে’ হিসেবেই চিহ্নিত হতে পারে। ব্যাঙ্কে পর্যাপ্ত লিকুইডিটি রয়েছে। সমস্যা হল, আগামীদিনের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে ঋণগ্রহীতাদের ঋণ নেওয়ায় অনিচ্ছা। ঠিক এই কারণেই ব্যাঙ্কগুলি তাদের উদ্বৃত্ত লিকুইডিটি রিজার্ভ ব্যাঙ্কে রেখে দিচ্ছে। মজার কথা হল, সাংবাদিক সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী ব্যাঙ্কগুলির এই টাকা জমা রাখা নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন।

কোভিড-১৯ অতিমারির ফলে যে আর্থিক সঙ্কট সৃষ্টি চলছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন কংগ্রেস রাজস্বক্ষেত্রে উদ্দীপনা আনার জন্য একটি নতুন আইন প্রণয়ন করেছে। আমেরিকায় কংগ্রেশনাল বাজেট অফিস (CBO) তাদের রাজস্ব ঘাটতির যে আনুমানিক হিসেবটি করেছে, তার পরিমাণ এক ট্রিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২০-তে ৩.৭ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। অতএব, আমেরিকায় রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২.৭ ট্রিলিয়ন ডলার, যা সেই দেশের জিডিপি-র প্রায় ১৩ শতাংশ।

লিকুইডিটি সাহায্য বা আর ঋণ জামিনের সংখ্যাগুলি যেমন ইচ্ছা উল্লেখ করে আমাদের অর্থমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমের হেডলাইন দখল করছেন ঠিকই, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। আমাদের জানা দরকার রাজস্ব উদ্দীপকের পরিমাণটা কত, অর্থাৎ এই অতিমারি আর লকডাউনের আঘাতে ভারতের অর্থনীতিতে রাজস্ব ঘাটতি কতখানি বেড়েছে। আমেরিকায় CBO যে খসড়া হিসেবটা করেছে, সেভাবে রাজস্ব ঘাটতির একটা স্বচ্ছ হিসেব তুলে ধরা হোক, এই মুহূর্তে সেটাই আমাদের দরকার।

২০১৯-২০ অর্থবছরে ভারতের রাজস্ব ঘাটতি ছিল প্রায় ৭.৭ লক্ষ কোটি টাকা, অর্থাৎ জিডিপি-র ৩.৮ শতাংশ। গত ১লা ফেব্রুয়ারিতে যে কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করা হয়, তাতে ২০২০-২১ সালের জন্য যে আনুমানিক ঘাটতি তুলে ধরা হল তার পরিমাণ প্রায় ৮ লক্ষ কোটি টাকা। এই অঙ্কটা এখন কত বৃদ্ধি পেয়েছে? এই অঙ্কটাই এই মুহূর্তে ভারতে রাজস্বক্ষেত্রে উদ্দীপকের প্রকৃত পরিমাণ। ১২ লক্ষ কোটি টাকার যে বর্ধিত ঋণগ্রহণের প্রয়োজনীয়তার কথা সম্প্রতি ঘোষণা করা হয়েছে, সেই অনুযায়ী হিসেব করলে উদ্দীপকের অঙ্ক দাঁড়ায় মাত্র ৪ লক্ষ কোটি টাকা, অর্থাৎ জিডিপি-র ২ শতাংশ।

মোদি সরকারের যদি শুধুমাত্র এইটুকুই এগোনোর ক্ষমতা থাকে, তাহলে জনসাধারণকে ভুল বুঝিয়ে কেন বলা হল যে ২০ লক্ষ কোটি টাকার সাহায্য দেওয়া হচ্ছে? এই ঘোষণা এই চরম দুর্দিনে দেশের গরিব খেটেখাওয়া মানুষগুলির প্রতি চরম অসংবেদনশীলতা প্রকাশ-ই শুধু নয়, ভারতীয় অর্থনীতির পক্ষেও ক্ষতিকারক।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...