কিসের ভয় সাহসী মন: ভারভারা রাও এবং অন্যান্যরা

প্রতিভা সরকার

 



লেখক প্রাবন্ধিক, গল্পকার, সমাজকর্মী। পেশায় অধ্যাপক

 

 

 

ভারভারা রাওয়ের নাম প্রথম শুনি ১৯৮১ সালে ইন্দ্রাভেল্লি আদিবাসী বিদ্রোহের সময়। এখন তো সেসব চুকেবুকে গেছে, ভুলে গেছে সবাই কীভাবে প্রায় ১০০ জন আদিবাসীর রক্তে লাল হয়েছিল তৎকালীন অন্ধ্রপ্রদেশে আদিলাবাদের ইন্দ্রাভেল্লি, স্বাধীন ভারতের জালিয়ানওয়ালাবাগ।

জন্মসূত্রে আদিবাসী নয় এমন মহাজনেরা এলাকায় ঢোকে ব্যবসা করবে বলে। তারপর সাধাসিধে মানুষগুলোর কাছ থেকে দেদার খরিদ করতে থাকে কেন্দুপাতা, মহুয়ার শুকনো ফল, তেঁতুল ইত্যাদি। তারপর শুরু হয় কম দামে কেনা জিনিসগুলো চড়া দামে বেচা, বেশি ফলনের জন্য পরে শোধ করে দিলেও হবে এই আশ্বাসে গরীবকে দাদনের টাকা দেওয়া। সেই টাকা শোধ করতে পারে না যখন তখন শুরু হয় জমি বন্ধক নেওয়া। অ-আদিবাসীদের হাতে চলে যায় জমির পর জমি। এগুলো পর পর ঘটতে থাকে অনিবার্যভাবেই। তারপর একসময় আদিবাসীরা অবাক হয়ে দেখে নাম হয়তো বদলায়নি, কিন্তু সব অর্থেই জমির হাতবদল হয়ে গেছে। মহাজনই এখন জমির আসল মালিক। তাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। মালিকানার কথা উঠলেই নাকের ডগায় ওড়ে তাড়া তাড়া কাগজ— দাদনের কাগজ, ঋণের কাগজ, বন্ধকের কাগজ।

মুখ বুজে আর কত সওয়া যায়! তাই ২০শে এপ্রিল, ১৯৮১, শিঙার শব্দে সবাই এসে জড়ো হল পাহাড়ের পাথুরে ছায়ায়, জংলা জমিতে। গ্রামকে গ্রাম জুটল এসে সেই সভায়। এত বড় অন্যায়ের বিহিত তো চাই। এসে দেখে তাদের আগেই পৌঁছে গেছে অসংখ্য পুলিশ। সশস্ত্র এবং মারমুখো। নকশালি আন্দোলন এলাকায় বন্ধ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

সভা শুরু হতে না হতে নেমে আসে আক্রমণ, লুটিয়ে পড়ে বাইরের আগ্রাসনের বিহিত চাইতে আসা ভূমিপুত্ররা। ৫০০০-এর বেশি লোক জড়ো হয়েছিল সেদিন ইন্দ্রাভেল্লিতে। সরকারি হিসেবে মৃত ১৩ জন। বেসরকারি হিসেবে ১০০ জনের ওপর।

সেদিনও সুবিচার পায়নি আদিবাসীরা, আজও তা তাদের অধরা। খাদ্য শিক্ষা স্বাস্থ্য কর্মসংস্থান সবেতে বঞ্চনা। সাংবিধানিক অধিকারকে উড়িয়ে দিয়ে আজও চলছে তাদের জমি দখল করা। দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না, তাই জমি দখলের বাসনায় আদিবাসী মেয়েকে বিয়ে করে বহিরাগতরা, যদিও সংসারে তাদের স্থান পরিচারিকার ঊর্ধ্বে কখনওই নয়। অথবা বিতারণই ভাগ্য। এখনও অনেক এলাকায় এই ট্রাডিশন সমানে চলছে।

এই মানুষগুলোকে নিয়েই ভারভারা রাওয়ের রাজনীতি, তাঁর কবিতা, উপন্যাস, অন্য লেখালিখি। সেটাই তাঁর অপরাধ, তাই আজ অশীতিপর কবিকে ভীমা কোরেগাঁওয়ের ছুতোয় এরেস্ট করে কারান্তরালে আটকে রাখা হয়। এখন শোনা যাচ্ছে ভঙ্গুর স্বাস্থ্যের এই মানুষটির সঙ্গে বাক্যালাপেরও হুকুম নেই কারও। নিজের স্ত্রীও একমাসে মোটে একবার কথা বলতে পারেন তাঁর সঙ্গে।

অর্ধেক জীবন তো কেটে গেল জেলখানায়। ১৯৭৩-এ মিসায় এরেস্ট হন ভারভারা। অন্ধ্র প্রদেশের হাইকোর্ট দেড়মাস পরে তাকে মুক্তি দেয়। রায়ে বলা হয়েছিল সরকার লেখক শিল্পীদের বিরুদ্ধে এই আইন প্রয়োগ করতে পারে না, যদি না তাদের লেখালিখি প্রত্যক্ষভাবে দায়ী হয় কোনও শারীরিক সংঘর্ষের জন্য। কিন্তু ভবি তো অত সহজে ভোলে না, তাই কয়েক মাসের মধ্যেই সরকার তার বিরুদ্ধে সেকান্দ্রাবাদ ষড়যন্ত্র মামলা আনে এবং ১৯৭৪ তাকে আবার জেলে ঢোকায়।

একবছর বাদে জামিনে মুক্তি পেলেও তখন বেজে গেছে এমার্জেন্সির দামামা। আবার মিসায় আটক। যেদিন এমার্জন্সি উঠল, মিসায় আটক অন্য বন্দিরা ছাড়া পেলেও জেলগেটে ভারভারাকে আটকে দেওয়া হয়, নতুনভাবে আবার মিসায় চালান করে দেওয়া হয়। মুক্তি পেলেন যখন জনতা দলের সরকার ক্ষমতায় এসে অ্যাক্টটাই তুলে দিল।

দলমতনির্বিশেষে রাজনীতিকরা এই মানুষটিকে কেন এত ভয় পায় সে এক রহস্য। তার ক্ষুরধার কলম, সাহিত্যের সবগুলি শাখায় দক্ষ পদচারণা, সাংগঠনিক শক্তি, মেহনতি মানুষের জন্য আত্মোৎসর্গ, কোনটা বেশি ভীতিপ্রদ কে জানে, কিন্তু ১৯৮৩ সালে এনটি রামা রাও দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেই ভারভারাকে ছটি কেসে ফাঁসিয়ে দেন। তাকে হত্যা করবার প্রবল চেষ্টা চলতে থাকে। তার বাড়িতে সাদা পোশাকের পুলিশ এবং খুনিরা একাধিকবার ঢুকে পড়ে, হামলা চালায়। সঙ্গীসাথীদের ওপর চলতে থাকে লাগাতার নির্যাতন। ছায়াসঙ্গী সহকর্মীকে খুন করা হয়। নিজের রাজ্যে ইচ্ছেমতো চলাফেরার স্বাধীনতাও ছিল না। সব দেখেশুনে ভারভারা রাও সিদ্ধান্ত নেন সেকেন্দ্রাবাদ ষড়যন্ত্র মামলায় তিনি নিজের জামিন বাতিল করে কারান্তরালে শাসকের নির্ধারিত অত্যাচারিত এবং বন্দি জীবনই বরণ করে নেবেন।

বিপন্নতা কত গভীর হলে, শাসন কত প্রাণঘাতী হলে তবে মানুষ এমন করতে পারে!

রাষ্ট্র চিরকাল ভারভারার মতো মানুষদের বিপন্ন দেখতে চেয়েছে। সে সাইবারাবাদের জন্মদাতা চন্দ্রবাবু নাইডু হোক বা নবনির্মিত তেলেঙ্গানার শাসক বা খোদ দিল্লির মসনদে বসা শাইনিং ইন্ডিয়ার প্রবক্তারা, যাদের চন্দ্রশেখর আজাদ ডাকেন “কালা আংরেজ” বলে, এই ব্যাপারে সব শেয়ালেরই এক রা— এইরকম মানুষেরা রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক। ফলে ছলেবলেকৌশলে আটকে রাখো এদের। বয়স, অসুস্থতা, নির্দোষিতার অকাট্য প্রমাণ বা অন্য কোনও কারণেও যেন মুক্তি না মেলে এদের।

এই ছলবলকৌশলের ব্যাপারটা খুব প্রণিধানযোগ্য। নাহলে ভারভারা রাও, সুধা ভরদ্বাজ, সোমা সেন, অরুণ ফেরেইরা, ভার্নন গঞ্জালভেস, গৌতম নওলাখা এবং হালে আনন্দ তেলতুম্বড়ের গ্রেপ্তার এবং বিনা বিচারে দীর্ঘ হাজতবাসকে ঠিকভাবে বোঝা যাবে না, বোঝা যাবে না ভীমা কোরেগাঁওয়ের ঘটনাবলির তাৎপর্য।

ভীমা কোরেগাঁও পুণের একটি ছোট গ্রাম, ২০১৮-র ১লা জানুয়ারিতে যা খবরের শিরোনামে উঠে আসে। এক প্রাচীন ঐতিহাসিক তাৎপর্য এই জায়গাটির রয়েছে। কারণ এইখানে দুশো বছর আগে পেশোয়া বাহিনী এবং ব্রিটিশ সৈন্যদলের মধ্যে লড়াই হয়েছিল। প্রথম দলে ছিল উচ্চবর্ণের মানুষের প্রাবল্য, দ্বিতীয় দলে দলিতদের। ঔপনিবেশিকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে লড়াই করলেই যে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা যায় না, ভীমা কোরেগাঁওয়ের যুদ্ধকালীন জটিল পরিস্থিতি তার প্রমাণ। দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত মাহাররা ছিল যোদ্ধার জাত, যুদ্ধই ছিল তাদের বৃত্তি। যুদ্ধ যখন আসন্ন, তখন পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাওয়ের সম্মুখে তারা নতজানু হয়ে বিদেশি বানিয়াদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আর্জি জানায়। কিন্তু অস্পৃশ্য ছোট জাতের সাহায্য ছাড়া যে জয় তাইই অধিক গৌরবান্বিত এই বিবেচনায় চিরকালের মতোই মাহারদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। মনে রাখতে হবে এটা সেই সময় যখন দলিতদের গলার সঙ্গে বাঁধা দড়িতে ঝুলতো মাটির খুরি, যাতে মুখে থুথু এলে ধরিত্রীমাতাকে অপবিত্র না করে ঐ খুরিকে ব্যবহার করা যায়। আর পেছনে ঝুলত ভূলুণ্ঠিত ঝাঁটা যাতে চলার সময় অবমানবের অপবিত্র পায়ের ছাপ নিজে থেকে মুছে যায়!

পেশোয়া-বাহিনীর ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায় এই স্পৃশ্য অস্পৃশ্যের দাবাখেলায়। মাত্র ৫০০ মাহার ব্রিটিশের অধীনে লড়াই করে ২৫০০০ উচ্চবর্ণের যোদ্ধাকে রণক্ষেত্রে শুইয়ে দেয়। বিজয়ীর কাছে তখন আর এটা নিছক যুদ্ধজয় ছিল না, এটা ছিল উচ্চবর্ণের জাতিবিদ্বেষের মুখে একটি সপাট থাপ্পড় এবং সমস্ত রকম বঞ্চনা, অপমানের বিরুদ্ধে ‘মুহতোড়’ জবাব। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে এখানে নিহত মাহার সৈনিকদের স্মরণে একটি স্মারক স্তম্ভ স্থাপিত হয়। ১৯২৭ সাল থেকে প্রত্যেক বছর সেখানে দলিত অস্মিতা যাপন ও বিজয় উৎসবের ধারাকে পরিচিতি দেন স্বয়ং বাবাসাহেব আম্বেদকর।

২০১৮ সালের ১লা জানুয়ারি তেমনই এক সমাবেশ হয়েছিল ভীমা কোরেগাঁও গ্রামে। মানুষ যখন বিজয়স্তম্ভকে ঘিরে প্রবল ভিড়ে জোট বেঁধেছে, অভিযোগ তখন হঠাতই সেখানে দলিতদের ওপর ইট পাথর নিয়ে চড়াও হয় গেরুয়া ঝান্ডাধারীরা। অগ্নিসংযোগ, লুঠতরাজের ঘটনা ঘটে। বহু মানুষ আহত হয়। প্রাণহানিও ঘটে। অথচ কৌশলে এই বিক্ষোভকে জুড়ে দেওয়া হয় ঠিক তার আগের দিন বিকেলে পুণেতে সংঘটিত এলগার পরিষদের (বাংলা অর্থ উচ্চকিত আমন্ত্রণ) সঙ্গে। বিরোধী রাজনীতিক, অ্যাক্টিভিস্ট এবং প্রাক্তন বিচারকদের এই বিরাট সমাবেশে মোদিজমানার স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতার বিরুদ্ধে প্রবল আওয়াজ তোলা হয়েছিল। সেই মঞ্চ থেকেই নাকি প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে ভীমা কোরেগাঁওয়ের বিক্ষোভকারীদের এবং সেইজন্যই নাকি অমন ধুন্ধুমার কাণ্ড, এই অপবাদে রাষ্ট্র তার নিপীড়নের যন্ত্রগুলিকে সচল করে তোলে। নির্বিচার ধরপাকড় শুরু হয়ে যায়। পুলিশি অত্যাচার দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদেরও রেহাই দেয় না।

দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না। এর পরপরই পুনেতে এক ব্যক্তি কোর্টে যায় এলগার পরিষদের বক্তৃতায় উস্কানি দেওয়া হয়েছে এই অভিযোগ নিয়ে। সেই সঙ্গে আবিষ্কৃত হয় এক মাওবাদী চিঠি যাতে নাকি স্বয়ং মোদির প্রাণনাশের ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। উড়ো চিঠিকে বেদবাক্য ধরে নিয়ে সম্পূর্ণ দোষ চাপিয়ে দেওয়া হল মাওবাদী রাজনীতির ওপর। উঠে এল নতুন শব্দবন্ধ “শহুরে নকশাল” (urban naxal)। গ্রেপ্তার করা হল ভারভারা রাও সহ ওপরে যত নামের উল্লেখ করা হয়েছে, প্রত্যেককে।

কিন্তু এটা ঘটনা যে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাঁরা বেশিরভাগই সেদিন এলগার পরিষদে উপস্থিত ছিলেন না। এমনকি অনেকে অনেক দূরে অন্য শহরে ছিলেন সেই সময়। তার অর্থ কি তবে এই যে রাষ্ট্রীয় পেষণের বিরুদ্ধে যারা উচ্চকিত হবে তাদের সবার ওপরেই যে কোনও সময়ে নামিয়ে আনা যাবে শাস্তির খড়্গ? ভীমা কোরেগাঁও কেবলমাত্র একটি অছিলা, আসলে অন্য সময়েও যাঁরা লাগাতার গলা তুলেছেন বিজেপিশাসিত ভারতের নানা অন্যায় নিয়ে, তাদের এই ছুতোয় জেলে ঢোকানো্র একমাত্র কারণ অন্য সাহসী মনেদের ভয় দেখানো এবং প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করা। সেটাই আবার প্রমাণ হল এতদিন বাদে আনন্দ তেলতুম্বড়ের গ্রেপ্তারির মধ্য দিয়ে।

আনন্দ তেলতুম্বড়ে, বাবাসাহেবের সেই একনিষ্ঠ অনুসারক, যিনি হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রথম সারির যোদ্ধা, অ্যাক্টিভিস্ট। পশ্চিমবঙ্গে খড়্গপুর আইআইটির এই প্রাক্তন মনস্বী অধ্যাপক নিজেও দলিত কৃষকের সন্তান। ভীমা কোরেগাঁওতে যেভাবে বিজয়োৎসব পালিত হয়, আনন্দ তা সম্পূর্ণ সমর্থন করেন না কেন সেই বিষয়ে বিস্তর লেখালিখি, এলগার পরিষদে তাঁর অনুপস্থিতি, ইজরায়েলি স্পাই ও হ্যাকার সংস্থা পেগাসাসের দ্বারা তাঁর ফোন হ্যাকড হওয়া কোনওটাই প্রশাসনের কাছে তাঁর নির্দোষিতার প্রমাণ হয়ে উঠতে পারেনি। তারা শুধু বলে গেছে আনন্দের কম্পিউটার থেকে মোদিহত্যার ষড়যন্ত্র সম্বলিত চিঠি পাওয়া গেছে। আনন্দ কী নির্বোধ যে হ্যাকড হবার পরেও ষড়যন্ত্রের চিঠি সযত্নে কম্পিউটারে সাজিয়ে রাখবেন? ইউএপিএতে তাঁকে আটক করার দীর্ঘ চেষ্টা সফল হল ২০২০ সালের ১৬ই মার্চ, যেদিন সুপ্রিম কোর্ট আনন্দ তেলতুম্বড়ের আগাম জামিনের আবেদন খারিজ করে দেয়। রোমিলা থাপার, প্রভাত পট্টনায়ক এবং নোয়াম চমস্কির মতো বুদ্ধিজীবীরা এই গ্রেপ্তারের বিরোধিতা করেছেন, কিন্তু মোদি প্রশাসন তাতে কর্ণপাত করেনি। এই করোনা অতিমারির মধ্যে যখন সুপ্রিম কোর্ট নিজেই বলছে গুটিকয়েক মারাত্মক অপরাধী ছাড়া আর সমস্ত কয়েদিকে প্রাণের খাতিরে মুক্ত করা হোক, তখন অধ্যাপক তেলতুম্বড়ের মতো বিশ্ববিখ্যাত ম্যানেজমেন্ট গুরুকে গারদের ওপারে ঠেলে দেওয়া কীরকম মানবতা!

সঙ্কীর্ণ সেলের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কেমন থাকবেন ভারভারা, সোমা, সুধা, গৌতম, আনন্দ ও অন্যান্যরা তাই নিয়ে সরকারের কোনও মাথাব্যথা নাইই থাকতে পারে। কিন্তু আপামর ভারতবাসী, যাদের হয়ে এঁরা হিন্দুত্ববাদ, গোরক্ষাজনিত হত্যা, দলিত আদিবাসী সংখ্যালঘুর ওপর আক্রমণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন তাঁদের কি গলা তোলবার কোনও দায় নেই?

দেখেছি, অনেকে জঙ্গলমহলে কিষেণজির রক্তোন্মাদনা এবং পরবর্তী ঘটনাবলিতে জড়িয়ে দেন ভারভারা রাওদেরকে, প্রশ্ন তোলেন মত ও বিশ্বাসের পার্থক্য নিয়ে। তখন ভলতেয়ারের সেই বিখ্যাত উক্তি স্মরণ না করে উপায় থাকে না— তোমার কথাকে সম্পূর্ণ সমর্থনযোগ্য মনে করি না, কিন্তু তা যাতে তুমি বলতে পারো তার জন্য প্রাণও দিয়ে দিতে পারি— I disapprove of what you say, but will defend to the death your right to say it.

পরিস্থিতি এত জটিল ও গোলমেলে, বড় ফ্যাসিস্ট-ছোট ফ্যাসিস্ট লোকদেখানো ঝগড়ার আড়ালে এমনভাবে নখে শান দেওয়া ঐক্য গড়ে তুলছে যে এখন কে কী রাজনীতিতে বিশ্বাসী এবং আমার নিজস্ব বিশ্বাসের কত দূরে তার অবস্থান সেই চুলচেরা বিচারে না গিয়ে, কার বিরুদ্ধে সেই রাজনীতির অভিমুখ যেন সেদিকে মনোযোগ দিলেই ভালো হয়।

উপরন্তু যাদের মুক্তির দাবীতে উত্তাল হওয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা, তাদের আদর্শনিষ্ঠার ওপর কোনও প্রশ্নচিহ্ন নেই, কখনও ছিলও না। সরকারের মতে তারা গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক। তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী। দাঙ্গাফাসাদ বাধিয়ে, দেশের প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করে এরা অস্থিরতার বাতাবরণ সৃষ্টি করতে চায়। এইসব অভিযোগের স্বপক্ষে প্রমাণ জোগাড় করবার আগেই সরকার এদের জেলে ঢুকিয়েছে, তাও আবার এমন অ্যাক্টে যাতে বিচারের আগেই দীর্ঘদিন আটকে রাখা যায়। আসলে অতি দক্ষিণপন্থী সরকারের বাড়বাড়ন্তের পথে সূচিমুখ কাঁটা এই বুদ্ধিজীবীরা। দৃঢ় প্রতিরোধের বিশাল ঢেউ। দাভোলকার, পানেসার বা গৌরী লঙ্কেশের মতো সবাইকে তো আর গুলি মেরে চুপ করানো যায় না। চক্ষুলজ্জা বলেও তো একটি ব্যাপার আছে! তাই এদের জন্য বরাদ্দ জেলের লপসি।

ঠিকই, ভারতীয় গণতন্ত্র ধ্বংস হবার মুখে। কিন্তু তা ভারভারা, সুধা, সোমা, গৌতম বা আনন্দের জন্য নয়, তা এই অতি দক্ষিণপন্থী সরকারের জন্য, সরকারেরই প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায়। আমরা দিনের আলোয় মানুষ পিটিয়ে মারা থেকে ভ্রাতৃঘাতী বীভৎস দাঙ্গাপরিযায়ী শ্রমিককে নাগরিকের ন্যূনতম অধিকার থেকে বঞ্চনা, তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া, সবই কত দ্রুত দেখে নিলাম! এর মধ্যে কোনটির জন্য কারারুদ্ধ বুদ্ধিজীবীরা দায়ী?

স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে লেখা হয়েছিল আমাদের সংবিধান, যার প্রতি এঁরা দায়বদ্ধ। সে দায়বদ্ধতার কাছে প্রতিটি নাগরিক অনন্য বা unique। যেমন বাবাসাহেব বলেছিলেন, ভারতীয় প্রজাতন্ত্রে একজন মানুষের একটি ভোট। তার মানে এক মানুষ সমান সমান এক ভোট। কিন্তু তার মানে এই নয় যে একজন মানুষ সমান সমান আর একজন মানুষ। জাত ধর্ম লিঙ্গ বর্ণ নির্বিশেষে অনন্য যে মানুষ, তারই সমানাধিকারের কথা বলে আজ কারাপ্রাচীরের আড়ালে এই শ্রদ্ধেয় মানুষগুলো। মুক্তির আনন্দ, কর্মক্ষেত্রের উদ্দীপনা, প্রিয়জনের সান্নিধ্য, যত্ন, চিকিৎসাবর্জিত জীবনে আছে শুধু শেকলের আওয়াজ আর অতিমারির রক্তচক্ষু।

আমরা এই অবস্থার অবসান চাই। আমরা চাই গৌতম নওলাখা, সুরেন্দ্র গ্যাডলিং, রোনা উইলসন, সোমা সেন, মহেশ রাউত, সুধীর ধাওয়ালে, সুধা ভরদ্বাজ, অরুণ ফেরেইরা, ভার্নন গঞ্জালভেস, আনন্দ তেলতুম্বড়ে এবং ভারভারা রাওকে এই মুহূর্তে মুক্তি দেওয়া হোক। আমরা চাই স্বক্ষেত্রে ফিরে যান তারা, ভারভারা জীবনের শেষ কটি দিন বৈপ্লবিক সাহিত্যরচনায় মগ্ন থাকুন। মিথ্যা অভিযোগ অপ্রমাণিত হবেই। আন্দোলন করবার সংবিধানসম্মত অধিকারও কেউ কেড়ে নিতে পারে না।

সাহসী মন চিরকালই মৃত্যুঞ্জয়ী! তার হারাবার থাকে কেবল শৃঙ্খল।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. লেখাটা পড়ে অনেক জিনিষ পরিষ্কার হল। ওরা সবাই যে সাজানো মামলায় আটক, তা দিনের আলোর মত পরিষ্কার। শাসকদলের নির্লজ্জ দমনপীড়নের কোনও সীমা নেই। “আমরা চাই গৌতম নওলাখা, সুরেন্দ্র গ্যাডলিং, রোনা উইলসন, সোমা সেন, মহেশ রাউত, সুধীর ধাওয়ালে, সুধা ভরদ্বাজ, অরুণ ফেরেইরা, ভার্নন গঞ্জালভেস, আনন্দ তেলতুম্বড়ে এবং ভারভারা রাওকে এই মুহূর্তে মুক্তি দেওয়া হোক।” — এ বিষয়ে আমি ও আমরা সবাই একমত এবং একজোট।

  2. অভিনন্দন। প্রাঞ্জল ভাষায় দৃপ্ত লেখনীতে সুচিন্তিত লেখার প্রকাশ।

আপনার মতামত...