স্বপন ভট্টাচার্য
লেখক ভূতপূর্ব প্রধান অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, মৌলানা আজাদ কলেজ
চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের গত ১লা মে সংখ্যায় চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্যকর্মী জয়ন্ত ভট্টাচার্য একটি অতি গুরুত্বপুর্ণ লেখায় করোনার বায়োলজি সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করেছেন।[1] করোনা সংক্রান্ত গবেষণায় প্রায় রোজই নতুন নতুন তথ্য সংযোজিত হচ্ছে এবং এত দ্রুততার সঙ্গে তা হচ্ছে যে জীবাণুটির আদি-মধ্য-অন্ত সম্পর্কে কেউই একশোভাগ গ্যারান্টি দিয়ে কিছু বলতে পারছেন না। আমার এই লেখাটি সেই করোনা বায়োলজির পরিসরে একটি সীমাবদ্ধ সংযোজন। জয়ন্তবাবুর আলোচিত কর্পোরেট বায়োলজি স্বতন্ত্র আলোচনা দাবি করে, সে আলোচনায় আমি অন্তত এই লেখায় যাব না।
জীবের বিবর্তনের ধারা অর্থাৎ ইভোলিউশনারি বায়োলজির চর্চা করেন যারা তাদের মধ্যে ভাইরোলজিস্টদের জায়গা খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্যালিওভাইরোলজি বলে একটা স্বতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্র আছে যেখানে বিজ্ঞানীরা এখনকার চেনাজানা ভাইরাসগুলোর বংশপরিচয় নিয়ে মাথা ঘামিয়ে চলেছেন। তার কারণ, ভাইরাসের বিবর্তনের ইতিহাসের সঙ্গে বহুলাংশে জড়িয়ে আছে মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস। মানুষের জিনতন্ত্রের মধ্যে স্থায়ীভাবে ঘাঁটি গেড়েছে বহু অধুনা ‘বিলুপ্ত’ ভাইরাস অর্থাৎ তাদের জিনসমষ্টি। বিলুপ্ত কথাটাকে বিশেষিত করবার কারণ হল এই যে, ভাইরাস এমনই এক বস্তু যার কিনা পোষকদেহের বাইরে কোনওরকম সক্রিয়তাই নেই, তার আবার বিলুপ্তি হয় কী করে? প্রকৃতিতে তার উপস্থিতি নিঃসাড় এবং সেভাবেই যে সে লক্ষ কোটি বছর ধরে পড়ে নেই তা কে বলতে পারে? ধরা যাক, ডাইনোসরাসের দেহে সংক্রমণকারী ভাইরাস ছিল যারা, ডাইনোরা অবলুপ্ত হবার পর তাদের কী হল? তারাও কি অবলুপ্ত হয়ে গেল? নাকি তারা হোস্টের অভাবে বেকার পড়ে আছে কোনও উল্কাগহ্বরে, সাইবেরিয়া বা মেক্সিকোর কোথাও? নাকি সেখান থেকে তারা পাখিতে, গিরগিটিতে, টিকটিকিতে বিকল্প হোস্টের সন্ধান পেয়ে ঢুকে পড়েছে এবং আজও বহাল তবিয়তে আছে? তাহলে তো বলতে হয় প্রাণীর— বা বলা ভালো হোস্টের— বিবর্তন যে ইতিহাসের কথা বলে তার এক-দুখানা চ্যাপটার ভাইরাস বা ভাইরাসদের লেখা। ওটা না পড়লে এটা পুরো পড়া যাবে না। এই কারণে প্যালিওভাইরোলজির এত কদর।
আদি
পিছনে তাকিয়ে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে করোনাভাইরাসের সংক্রামক ভূমিকার প্রথম রেকর্ড ১৯১২তে, যখন জার্মানিতে পশুচিকিৎসকেরা একটা জ্বরে ভোগা দুর্বল বিড়ালের মধ্যে এমন একটা ফুলে যাওয়া পেটের উপসর্গ দেখতে পান যা তখন পর্যন্ত নতুন।[2] ওই পশুচিকিৎসকেরা অবশ্য জানতেন না যে ওই একই সংক্রমণে দু সপ্তাহ যেতে না যেতে কোনও কোনও শূকরের প্রতিটি বাচ্চা মারা পড়ে এবং মুরগির ব্রঙ্কাইটিস হয় ব্যাপকহারে। এই সংক্রমণগুলোর জন্য যে এমন একটা ভাইরাসই দায়ী যার আকৃতি সূর্যের চারপাশের বিচ্ছুরণ করোনার মত তা ১৯৬০-এর আগে বোঝা যায়নি। সম্ভবত ইংল্যান্ডের একটি রিসার্চ গ্রুপ প্রথম এর নামকরণ করেন ‘করোনাভাইরাস’। চরিত্র বিশ্লেষণ করে বোঝা গেল এই জীবাণুটি রীতিমত ভার্সাটাইল। যা কুকুরের জীবাণু তা বেড়ালকে এবং যা বেড়ালের মৃত্যুর কারণ তা শূকরছানাদের চোখ ফোটার আগেই মেরে দেয়, কিন্তু মানুষও যে তার ভিকটিম হতে পারে তা চিনের ২০০২-০৩এর SARS মহামারির আগে বোঝা যায়নি। SARS-Cov-2, যা আজকের পৃথিবীটাকে দৃশ্যত বদলে দিল, তা হল সেই ফ্যামিলির নবতম সদস্য। আকারে ভাইরাসদের মধ্যে রীতিমত জায়েন্ট।
করোনার বংশগতির খবরাখবর জমা থাকে যে RNA অণুর মধ্যে তার সাইজও সমীহ জাগানো। এইডসের জীবাণুর তুলনায় তা তিন গুণ এবং জাতভাই ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের তুলনায় তা দ্বিগুণ বড়। কিন্ত তার থেকেও বড় চিন্তার ব্যাপার হল এই যে, করোনাভাইরাসের সংখ্যাবৃদ্ধির জরুরি কোনও কোনও ধাপে ভুলভ্রান্তি বদলে নেবার ক্ষমতা বা প্রুফরিডিং মেকানিজম আছে। কেন বলছি চিন্তার কারণ? একটা করোনা RNA হোস্টের কোষের মধ্যে ঢুকে দুটো কাজ করে। এক, তার নিজের ছানাপোনার জন্য তড়িৎগতিতে প্রোটিন তৈরির কাজ শুরু করে দেয় এবং দুই, ঐ ছানাদের জন্যই নিজের কপি বানানো শুরু করে দেয় যাতে প্রতিটি আত্মজ হোস্টের কোষ থেকে মুক্ত হবার আগে এক কপি করে RNA পেয়ে যায়। এই কপি বানানোর প্রক্রিয়াটা কিন্তু ভুলের সম্ভাবনায় ভরা, আর এই ভুলের মাশুল হতেই পারে মারাত্মক। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, মানুষের রক্তের জিনের কথা। প্রতিলিপি তৈরির সময় মানুষের ভ্রূণকোষ যদি রক্তের জিনে ভুলবশত এসে যাওয়া একটামাত্র ভুল যৌগকে চিনে উঠতে না পারে তা হলে যে শিশু জন্মাবে, সারাজীবন সে অ্যানিমিয়ার শিকার হয়েই বাঁচবে। স্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন সেই শরীরে তৈরি হবে না, হবে একটা মিউটেটেড হিমোগ্লোবিন। রক্ত নেওয়াই তার ভবিতব্য। বস্তুত, কোষ বিভাজনের সময় প্রতিবার এই ভুল ঘটে যাবার সম্ভাবনা ষোলো আনা, কিন্তু বাস্তবে, নবজাতকদের মধ্যে এই জাতীয় ‘ভুল’ জিন নিয়ে জন্মানোর হার যে সব সময়েই স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম তার কারণ হল কোষের মধ্যেকার ঐ প্রুফরিডিং ক্ষমতা। যে ক্ষমতার বলে কোষ নিজেই বিভাজিত হবার আগে এই জাতীয় ভুলভ্রান্তিগুলো সংশোধন করে নিতে পারে। প্রকৃতি কোষকে এই ভুল সামলে নেবার ক্ষমতা দিয়েছে বলেই না কনজেনিটাল ত্রুটি নিয়ে জন্মানো শিশু এখনও ব্যতিক্রম।
করোনাভাইরাস নিয়ে বলতে গিয়ে তার প্রুফরিডিং ক্ষমতা নিয়ে এত কথা বললাম এই কারণে যে, কপি তৈরির সময় ভুল করে ফেললেও, তা সংশোধন করে মিউটেটেড হবার সম্ভাবনা অনেক কমিয়ে ফেলে এই জীবাণু। RNA ভাইরাসগুলোর মধ্যে এই ক্ষমতা একটু ব্যতিক্রমী। ব্যতিক্রমী বলেই রিবাভিরিন জাতীয় যে ড্রাগগুলি মিউটেশন প্রণোদিত করে অন্য RNA ভাইরাস যেমন হেপাটাইটিস সি ইত্যাদিকে অকেজো করে ফেলে তা এদের বেলায় কাজ করতে পারল না। একই সঙ্গে মিউটেশন হয়ে তা প্রকৃতিতেই কমজোরি হয়ে যাবে তার সম্ভাব্যতাও যা আশা করা গিয়েছিল তার তুলনায় কমে গেল বলা যায়। মিউটেশন অবশ্য ভাইরাসের শক্তিশালী হয়ে উঠবার একটা উপায়ও বটে। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মিউটেটেড হবার সম্ভাবনা করোনার তুলনায় তিনগুণ বেশি। ফলে এটি মানুষের শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে তিনগুণ বেশি ঘোল খাওয়াতে পারে। যে কোনও ভ্যাকসিনকে এড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের করোনার তুলনায় অনেক বেশি হবার কথা। কেননা ইনফ্লুয়েঞ্জা মিউটেশন আহ্বান করে আর করোনাভাইরাস মিউটেশন প্রত্যাখ্যান করে অর্থাৎ, শুধরে নিতে পারে। জেনেটিকসের ডিকশনারিতে ‘ইনফিডেল’ বা অবিশ্বাসী কথাটার অর্থ হচ্ছে কপি তৈরির সময় অনবরত ভুল কপি তৈরি করা। সে হিসেবে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের জিন রীতিমত ইনফিডেল আর করোনাভাইরাস অন্তত এই পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে অনেকটা লক্ষ্মীমন্ত। তবুও যে তাকে কাবু করা যাচ্ছে না সহজে তার কারণ আমাদের প্রতিরক্ষাতন্ত্রকে বাইপাস করার অন্য মেকানিজম তাদের আছে।
প্যালিওভাইরোলজিস্টরা বলেছেন করোনাভাইরাসের উদ্ভব ১০০০০ থেকে ৩০ কোটি বছর আগের যে কোনও সময়ে হয়ে থাকতে পারে।[3] এর ডজন ডজন প্রকরণের মধ্য থেকে সাতটি প্রকরণ মানুষে সংক্রমণ ঘটায়। এদের মধ্যে চারটি মামুলি সর্দিকাশি ঘটিয়েই ছেড়ে দেয়। এই চারের দুটি পাওয়া যায় ইঁদুর জাতীয় প্রাণীতে এবং বাকি দুটি বাদুড়ে। তিনটি প্রকরণ মারাত্মক, এরা হল SARS-Cov যা ২০০২-০৩ এর Severe Acute Respiratory Syndrome (SARS), MERS-Cov যা Middle East respiratory syndrome (MERS) এবং এই এখনকার জীবাণুটি যাকে আমরা SARS-Cov-2 নামে চিনেছি। এই তিনটে প্রকরণই যে কোনও এককালে বাদুড়েই ছিল এবং বাদুড় থেকেই মানুষে এসেছে এমন মনে করার অনেক কারণ আছে। এমনিতে বাদুড়ে আজ পর্যন্ত ৬১ রকমের এমন ভাইরাসের সন্ধান পাওয়া গেছে যারা মানুষের কোনও না কোনও রোগ ঘটাতে পারে।[4] করোনা তার মধ্যে একটি বটে। কিন্তু বাদুড়ে তা নিরীহ, টেরই পাওয়া যায় না যে সেটা আছে, কারণ বাদুড়ের সংক্রামিত কোষ যে কেমিক্যাল সিগন্যাল দেয় তা সহযোগিতার, ডিসট্রেস সিগন্যাল নয়। মানুষে সেটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল কীভাবে? মিউটেশন হার যার এত কম সে হোমিনিড দেহের প্রোটেকশন দেওয়া লক্ষ লক্ষ বছরের ইমিউনিটিকে বোকা বানাচ্ছেই বা কীভাবে? এখানেই আসে রিকম্বিনেশন তত্ত্ব। সম্ভবত বাদুড় থেকে মানুষে আসার পথে মধ্যবর্তী কোনও হোস্টে দুটি আলাদা আলাদা করোনাভাইরাস দুটো আলাদা আলাদা RNA-র খণ্ড বিনিময় করে অনন্য হয়ে উঠেছে। ২০০৩-এর SARS-Cov-এর ক্ষেত্রে সেটা ছিল সিভেট ক্যাট বা ভাম-বেড়াল যা চিনে ভক্ষ্য। এবারের ক্যান্ডিডেট হিসাবে প্যাঙ্গোলিনের নাম উঠে এসেছে। তবে এসব তত্ত্বের কোনওটাই এখনও প্রমাণিত নয়। বরং দেখা যাচ্ছে, ইয়ুনান বাদুড়ের দেহে বাসা বাঁধা করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের যে অংশ মানুষের কোষের বিশেষ গ্রহীতা অণুর সঙ্গে জোড় বাঁধে (Receptor binding domain) তার সঙ্গে SARS-Cov-2-র স্পাইক প্রোটিনের তেমন মিল নেই। যদিও জেনেটিক্যালি এদের ৯৬% মিল আছে।[5] অপরপক্ষে প্যাঙ্গোলিনের করোনাভাইরাস ভ্যারাইটির স্পাইক প্রোটিনের সঙ্গে SARS-Cov-2-র স্পাইক প্রোটিনের মিল প্রায় ষোলোআনা যদিও এদের জিনতন্ত্রের মধ্যে মিল ৯০% যা জেনেটিক্সের ভাষায় যথেষ্ট সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে বিবেচিত হবার নয়।[6] সুতরাং, চিনকে গালি যতই দেওয়া হোক না কেন, হতেও পারে এ দুয়ের কেউই SARS-Cov-2-র পূর্বসূরি নয়। একদল ভাইরোলজিস্ট মনে করছেন SARS-Cov-2 একেবারে নতুন তৈরি হওয়া জীবাণু মোটেই নয়, অন্তত ১৪০ বছর আগে এদের বিবর্তন ঘটেছে প্যাঙ্গোলিনে বাসা বাঁধা করোনাভাইরাসের আদি প্রকরণ থেকে। প্রথমে এরা কেবল বাদুড়ে সংক্রমণশীল ছিল, মানুষে এদের তখনও রুচি ছিল না। গত ৩০-৭০ বছর সময়ের মধ্যে কোনও সময়ে মানুষে সংক্রমণকারী প্রকরণটি এই লাইন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বতন্ত্র হয়ে গেছে, এবং তা হয়েছে তাদের স্পাইক প্রোটিনের মানুষের কোষকে বেঁধে ফেলার ক্ষমতা অর্জনের মধ্য দিয়ে।[7] সুতরাং চিনের ল্যাবরেটারিতে গড়ে ওঠার তত্ত্ব তো আগেই গিয়েছে, এমন কি চিনের ফুড মার্কেট থেকেই নভেল হয়ে ওঠার তত্ত্বও প্রশ্নের মুখে পড়ে গেছে নভেল করোনাভাইরাসের বিবর্তন উপাখ্যান পড়ে উঠতে পারার ফলে।
মধ্য
যে ভাইরাসের মিউটেশন সংশোধিত হয়ে যায় উচ্চ হারে সে তো খুব বেশি বৈচিত্র প্রদর্শনে অক্ষম, মনোটোনাস যাকে বলে, তার উপর এর উদ্ভবও নাকি ঘটে গেছে বহু আগে— তাহলে তাকে আমরা নভেলই বা বলছি কেন আর তাকে কাবুই বা করতে পারছি না কেন? এর উত্তর আছে ওর রিকম্বিনেশন ক্ষমতার মধ্যে। আগেই বলেছি মানুষের দেহে বাসা বাঁধে সাতটি ভ্যারাইটি, যার মধ্যে চারটি কেবল আপার রেস্পিরেটরি ট্র্যাক্ট অর্থাৎ নাক, গলা, ল্যারিংক্স— এই পর্যন্ত, এর বেশি নামে না। অপর পক্ষে ২০০২-এর SARS এবং ২০১২-র MERS প্রকরণ দুটো শ্বাসতন্ত্রের উর্ধাংশে তেমন সুবিধে করতে পারত না, তাদের খেল ছিল সরাসরি ফুসফুসে পৌঁছে যাবার পরে। এই কারণেই তাদের সংক্রমণে মৃত্যুহার ছিল অনেক বেশি, যদিও সংক্রমণের হার ছিল কম। আমাদের দুর্ভাগ্য, আজকের SARS-Cov-2 এ দুটোই পারে। এই কারণে আপনি ঠিক কতটা ভাইরাসের মুখে পড়েছেন সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। দূরত্ব মানলেন, দু মিটার দূরে দাঁড়ানো করোনবাহকের হাঁচি, কাশি, নিশ্বাস থেকে আপনার নাক দিয়ে ঢুকে পড়ল আট-দশটি ভাইরাস কণিকা— আপনি কিন্তু সামান্য সর্দিকাশিতেই সেরে উঠবেন, এত কম ভাইরাল লোড নিয়ে আপনার নাক গলা পেরিয়ে তারা আপনার ফুসফুস অবধি পৌঁছাতে পারবে এমন সম্ভাবনা কম। আর, মনে করুন মানলেন না কিছুই আর শতাধিক ভাইরাস কণিকা আপনার পার্শ্ববর্তিনীর দেহ থেকে আপনার শরীরে ঢুকে পড়ল— তাহলে কিন্তু আপনার আপার রেস্পিরেটরি ট্র্যাক্ট তাদের আটকে রাখতে পারবে এমন নিশ্চয়তা কম, তাদের কিছু লালারসের মাধ্যমে পৌঁছে যেতে পারে আপনার ফুসফুসে। এই কারণে করোনাকবলিত রোগীদের অভিজ্ঞতা এত ভিন্ন ভিন্ন। সংক্রমণের পথটা যেহেতু নাক, গলা হয়ে ফুসফুসে, সেহেতু প্রথমে স্বাদহীনতা, সর্দি-কাশি জ্বর এবং তার পরে ভাইরাস যদি ফুসফুসে পৌঁছে যেতে পারে তাহলে শ্বাসকষ্ট এবং তজ্জনিত উপসর্গগুলি। বুঝতেই পারছেন, এর প্রথম পর্যায়ের উপসর্গ যদি নিরীহ করোনার মত হয় তাহলে দ্বিতীয় পর্যায়েরগুলো হল মারক SARS বা MERS জীবাণুর মত। ভাইরলজিস্টরা বলছেন “It is an unfortunate and dangerous combination.”[8] দুটি আলাদা আলাদা প্রকরণের মধ্যে এই ‘ডেঞ্জারাস কম্বিনেশন’ ঘটে যাবার সু্যোগ কোথায়? সুযোগ যে কোনও প্রাণীতে যা একই সঙ্গে এই দুই টাইপ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে বা হয়েছিল, সে মানুষও হওয়া খুবই সম্ভব। একটা হোস্টের মধ্যে নিরীহ করোনার RNA এবং SARS বা MERS করোনার RNA যদি খণ্ড বিনিময় করে নতুন একটা রিকম্বাইনড RNA তৈরি করতে পারে এবং সেই RNAকে কেন্দ্রে রেখে যদি অ্যাসেম্বলি লাইন ধরে বেরিয়ে আসতে থাকে তাদের পরের প্রজন্মের প্রতিনিধিদল, তাহলে তারা হবে নভেল। আমাদের বিপদে ফেলে দেওয়া SARS-Cov-2 হল এই রকম নভেল যাদের আমরা ফিউশন পার্টিকলও বলতে পারি।
এদের স্পাইকগুলোকে ভাইরোলজিস্টরা বলছেন ‘পাওয়ার স্পাইক’। কোষের ভিতরে ঢুকতে গেলে সবরকম করোনাকেই আগে চিনে নিতে হয় আমাদের কোষপর্দার গায়ে থাকা এক ধরনের যৌগকে। আমরা অনেকেই জেনে গেছি এদের নাম হল ACE2 রিসেপটর বা গ্রহীতা। এর একটা বড়সড় রাসায়নিক নামও আছে যা এই মুহূর্তে না জানলেও লেখার মূল উদ্দেশ্য ব্যহত হবে না। রিসেপটর বলা হয় কারণ এরা আদর করে ভাইরাসের বহিরাবরণীর গায়ে থাকা কাঁটা কাঁটা প্রোজেকশনগুলোকে এক গভীর বাঁধনে বেঁধে ফেলে। আজকাল বাচ্চারাও করোনা বললে গোলাকৃতি বল এঁকে তার গায়ে এঁকে দেয় কাঁটা— করোনার পাওয়ার স্পাইক। মানুষের শরীরে সব শিরা ধমণীর প্রাচীরে এই ACE2 রিসেপটর থাকে বটে, কিন্তু বিশেষভাবে ঘন পরিমাণে থাকে ফুসফুসের বায়ুথলিগুলোর লাইনিং-এ। স্পাইক আর তার গ্রহীতার মধ্যে চেনাজানা এবং সংযোগ ঘটে গেলে হোস্ট কোষ নিজেই স্পাইকটাকে খণ্ডিত করে ফেলে, যে ঘটনাকে বলে ‘ক্লিভেজ’। এটা হয়ত কোষ প্রতিরক্ষার তাগিদে করে কিন্তু তার ফল হয় উল্টো। খণ্ডিত অংশগুলো আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং পরিণত হয় ‘ফিউশন পেপটাইডে’ যা কোষপর্দার বাধাকে অতিক্রম করে কোষের মধ্যে ঢুকে পড়ে, আর একবার ঢুকে পড়তে পারলে ভাইরাসই কোষের প্রভু— কোষের সমস্ত কার্যকলাপ পরিচালিত হয় এরপর থেকে তার অর্ডারে। নভেল করোনাভাইরাসের একটা সত্যিকারের নভেল এবং চিন্তায় ফেলে দেবার মত বৈশিষ্ট্য হল এদের এই ক্লিভেজ পয়েন্ট।
স্পাইককে কাটার কাজে মানুষের ফুসফুসের বায়ুথলির কোষগুলি যে এনজাইম ব্যবহার করে তার নাম হল ‘ফিউরিন’, যা সাধারণত ইবোলা, ডেঙ্গি বা এইডস এবং ফ্লু ভাইরাসের ভাইরাসরা ব্যবহার করে থাকে, করোনাভাইরাসেরা নয়। এই একটা ক্ষমতা SARS-Cov-2কে ১০০ থেকে ১০০০ গুণ শক্তিশালী করেছে তার অন্য সমস্ত ভাই-বেরাদরের তুলনায় কারণ ফুসফুসের কোষে ফিউরিনের পরিমাণ প্রচুর, অপরিমেয়। লুইসিয়ানার প্রফেসর রবার্ট গ্যারির কথা তুলে দিতে পারি: “When I saw SARS-CoV-2 had that cleavage site, I did not sleep very well that night.”[9] কোথা থেকে পেল এই ভয়ঙ্কর ক্লিভেজ সাইট আমাদের আজকের নভেল জীবাণুটি? তবে কী এদের বিবর্তনের পথে কখনও কোথাও রিকম্বিনেশন ঘটে গিয়েছিল ইবোলা বা HIV-র মত কোনও জীবাণুর সঙ্গে? নভেল করোনার উৎস ও বিবর্তনে এটাকেই বিজ্ঞানীরা বলছেন last piece of puzzle. যতক্ষণ না পর্যন্ত সেটা বোঝা যাচ্ছে ততক্ষণ উহানের লাইভ ফুড মার্কেট, ততক্ষণ পর্যন্ত বাদুড়, প্যাঙ্গোলিন— এ সবই অনুমান মাত্র।
অন্ত
অন্তে অন্ত নিয়ে কিছু বলা যাবে কিনা বা আদৌ তা উচিত হবে কিনা তা নিয়ে একটা সংশয় মুসাবিদা করেই বাকি কথা লিখতে বসা উচিত। একটা নতুন ধরনের জীবাণু দুনিয়ায় হ্যাভক ঘটিয়ে দেবার পর যখন ডাক্তার-বদ্যি যখন মাথার চুল ছিঁড়ছে তখন নভেল করোনার ঠিকুজিকুষ্ঠি খুঁজে বার করা— তা কি নেহাত শৌখিন জমিদারি নয়? যদি মনে রাখি যে এখনও আমাদের হাতে কোনও ওষুধ নেই এবং এখনও হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়ে কাবু হবার কোনও লক্ষণ নেই তার, তাহলে বুঝতে পারব ওই অতীত ঘাঁটার কাজ আর কিছুই নয় একটা অ্যাকিলিস হিল খুঁজে বার করার চেষ্টা। আদতে এই ভাইরাস কীভাবে কাবু হবে, আদৌ কাবু হবে কিনা সেটা এখনও অনুমানের বিষয়। কেউ কেউ বলছেন SARS বা MERS জীবাণুর মত এটাও মিউটেশন হতে হতে দুর্বল হয়ে পড়বে অথবা মানুষের শরীরের পক্ষে মোটামুটি বন্ধুভাবে থাকার মত সহনশীল হয়ে উঠবে। গুয়াংঝাউর সান-ইয়াৎ-সেন ইউনিভার্সিটির Guo Deyin, যিনি করোনাভাইরাসের উপর কাজ করে আসছেন, বলছেন SARS-Cov-2-র জিনোম এত স্টেবল যে মিউটেশন হয়ে এটা ক্রমশ দমে যাবে তা মনে হয় না। এঁরা মনে করছেন যতদিন অসুস্থ মানুষ থেকে সুস্থ মানবশরীরে যাবার সুযোগ থাকবে ততদিন এরা সক্রিয় থেকে যাবে। ক্লাউস স্টর যিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার SARS ডিভিশনের প্রধান ছিলেন, বলছেন প্রুফরিডিং ক্ষমতা থাকার জন্য নভেল করোনার প্যাথোজেনিসিটি খুব একটা বদলানোর নয়, বরং আগামী দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে বিশ্বের ৭৩০ কোটির মধ্যে বেশিরভাগ সংক্রামিত হবে, এবং যারা সেরে উঠবে তাদের মধ্যে ‘রোবাস্ট’ প্রোটেকশন থাকবে।[10] তারপরে, এটা থাকবে যেমন আছে সাতটির মধ্যে চারটি যেগুলোর কথা আমরা আগেই বলেছি। সর্দি কাশি হবে, অল্প জ্বরজারি, কিন্তু সম্ভবত পরবর্তীকালে আপার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্টেই সীমাবদ্ধ থাকবে এদের সংক্রমণ। ক্লাউস স্টর জোরের সঙ্গে বলছেন, দু বছর পরে নভেল করোনার হাত থেকে বাঁচতে কোনও ভ্যাকসিন লাগবে না। এও কি একটা অনুমান মাত্র? এর উত্তর খুঁজতেও করোনা-পরিবারের ঠিকুজি কুলুজি ঘেঁটে দেখতে হবে আমাদের।
মানবপ্রেমী সাতটি প্রকরণের মধ্যে আগেই বলেছি তিনটি অর্থাৎ SARS, MERS এবং SARS-Cov-2, যাকে বলে কিলার, কিন্তু বাকি চারটে নেহাতই নিরীহ। এগুলোর পরিচয় সংখ্যায়। OC43 ও HKU1 আমাদের দেহে এসেছিল ইঁদুরজাতীয় প্রাণী থেকে আর 229E and NL63 এসেছিল বাদুড় থেকে। প্রত্ন-ভাইরোলজির ছাত্ররা বলছেন এরা কিন্তু চিরকাল এত নিরীহ ছিল না। উদাহরণ হিসেবে OC43-র কথা ধরা যেতে পারে। এটা নাকি ১৮৯০তে ইঁদুর থেকে মানুষে এসেছিল এবং যথারীতি তখনও একটা ইন্টারমিডিয়েট হোস্ট ছিল এবং তা হল গরু— বিফ। বলা হচ্ছে ১৮৮৮-৮৯-এর অতিমারি যা বিশ্বে ১০ লক্ষ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল এবং যার জন্য এতাবৎকাল সকলে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসকে দুষে এসেছে তা আসলে হয়েছিল এখন অবিবাদী ওই OC43 সংক্রমণে।[11] এখনও OC43 ব্যাপকভাবে ছড়ায় মানুষের মধ্যে, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এখন সংক্রামিত এবং ইমিউনড, তার জন্য কোনও ভ্যাকসিন লাগে না। এটা অবশ্য নিশ্চিত করে বলা যাবে না যে নভেল করোনার ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটতে চলেছে, কেন না বাঁদরে SARS-Cov-2 ইনজেক্ট করে দেখা গেছে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় বটে কিন্তু তার স্থায়িত্ব নিয়ে বলবার মত সময় এখনও অতিক্রান্ত হয়নি যা আমাদের বলে দেবে যারা সেরে উঠছেন তারা বরাবরের মত সেরে উঠছেন কি না! গরু, বিড়াল, মুরগিতে করোনাভাইরাস কিন্তু এখনও আগের মতই মারক সংক্রমণ এবং সারা পৃথিবীর পশু চিকিৎসকেরা এখনও তাদের বাঁচানোর মত একটা ভ্যাকসিনের জন্য হাপিত্যেশ করে বসে রয়েছেন। মানুষের জন্য ভ্যাকসিন বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোর লক্ষ্মী। তাঁর পায়ের ছাপ ঘরে ঘরে ঢুকবে, বছর বছর ঢুকবে তাদের এই প্রত্যাশাকুসুম বিকশিত হবার সুযোগ এনে দিয়েছে নভেল করোনা। ভ্যাকসিন একটা বেরোবে, একাধিকও বেরোতে পারে অনতিবিলম্বে, তবে তা প্রত্যাশিত এবং দীর্ঘস্থায়ী অনাক্রমণ্যতা মানুষের শরীরকে দেবে কিনা তা বলবে সময়।
[1] জয়ন্ত ভট্টাচার্য; চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম; ১ মে ২০২০
[2] David Cyranoski; Nature; Vol 581; p.22-26; 7 May 2020
[3] Graham, R. L., Donaldson, E. F. & Baric, R. S. Nature Rev. Microbiol. 11, 836–848 (2013).
[4] Brook, C. E. et al. eLife 9, e48401 (2020)
[5] Zhou, P. et al Nature 579, 270–273 (2020).
[6] Zhang, T., Wu, Q. & Zhang, Z. Curr. Biol. 30, 1346–1351 (2020).
[7] Boni, M. F. et al. Preprint at bioRxiv.
[8] Wölfel, R. et al. Nature
[9] টীকা নং ২ দ্রষ্টব্য
[10] ঐ
[11] Vijgen, L. et al. J. Virol. 79, 1595–1604 (2005).
স্থপন বাবু আপনার এই প্রতিবেদন পড়ে মনে হল চিন দায়মুক্ত! সত্যি ই কি তাই?
দায়ি করার মত প্রত্যক্ষ কিছু পাওয়া যাচ্ছে না যে। অপ্রত্যক্ষ দায় আছে। সেটা আমি আমার এই প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত ‘নজরে কেন চিন ‘ প্রবন্ধে আলোচনা করেছি।
অনেক নতুন তথ্য জানতে পারলাম স্যার। আরো এরকম লেখা পাওয়ার আশায় রইলাম।
পড়লাম। খুব ভালো লেখা। অজস্র হাবিজাবি আলোচনার মধ্যে এই academic discourse চমকপ্রদ। বিশেষতঃ আমাদের কাছে, আমরা যারা এই প্রথাগত জ্ঞানের বাইরে। লেখাটা পড়ানোর জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।