অত্রিয় ঘোষ
‘রাম গরুড়ের ছানা, হাসতে তাদের মানা।’ আর হাসবই বা কী করে, এমনিতেই সব বন্ধ, তার উপর সকাল থেকে বরফ পড়ছে। ছোটবেলায় ‘আবোল-তাবোল’ বইতে পড়েছিলাম বোম্বাগড়ের কথা। কি অদ্ভুত সে দেশ, অদ্ভুত সব কাণ্ড হয়ে সেখানে। আজ আমেরিকার পেনস্যল্ভানিয়ায়, পাহাড় ঘেরা এই ছোট্ট স্টেট কলেজ শহরটাকেই বোম্বাগড় বলে মনে হচ্ছে। তা না হলে এপ্রিল মাসের শেষে বরফ পড়ে!
আজকাল আমার প্রায়ই মনে হয় আমরা এক কিম্ভূত দুনিয়াতে বাস করছি, অনেকটা ‘বকচ্ছপ’- এর মত। আবোল-তাবোলের কল্পনা এসে এইবার স্বাভাবিকের ‘মুণ্ডু চেপে’ বসেছে। বিচিত্র সব ঘটনা ঘট্ছে। কুমড়োপটাশ ভাইরাসের রুপ ধরে হঠাৎ এসে হাজির। তার ভয়ে কেউ টয়লেট-পেপারের জন্য মারামারি করছে, আবার কেউ এপ্রিল মাসে পটকা ফাটাচ্ছে। থালা-বাসনদের হয়েছে ভারি মুশকিল, বেচারারা একদম ‘স্পিক টি নট্’ , মার খাচ্ছে পটা-পট্। দেশে দেশে একুশে আইন জারি, হাঁচতে-কাশতে টিকিট্ লাগছে। পুলিশ ‘হাঁচলে পরে বিন্ টিকিটে, দম্দমাদম্ লাগায় পিঠে’। ইতালিতে নিজেদের বারান্দা থেকেই একসাথে গান জুড়েছেন কত ভীষ্মলোচন শর্মা। ইন্টারনেটের দৌলতে সেই গানা দিচ্ছে হানা, ‘দিল্লী থেকে বর্মা’। এই গান শুনতেই একদল ডলফিন এসে জুটেছে সাগরপারে।
এরই মধ্যে, এক সম্ভাব্য গোঁফ চুরির দায়ে, ওয়ার্ল্ড হেল্থ অরগানাইজেসনকে জরিমানা করেছেন হেড অফিসের বড়বাবু। তাই হয়ত সে রাম গরুড়ের ছানার মত মুড্ অফ করে বসে আছে। বড় বড় ওস্তাদেরা যখন নানান অজুহাত দিচ্ছেন, তখন বড়বাবু নিজেই গন্ধ শুঁখে বিচার করে বললেন, ‘গন্ধ তো নয় মন্দ’। এখন তার কড়া হুকুম, খোলা রাখতে হবে জিম্, আর চুল ছাঁটার সেলুন। এই দুটোকেই অবশ্য এসেনশিয়াল-সার্ভিস বলে ধরে নেওয়া যায়। জিম্ ও সেলুনে গিয়ে সুন্দর না হতে পারলে ট্যাঁশগরুরা টিক্-টিক্ করবে কি করে? এই প্যানডেমিকের বাজারে এই কথা কেউ ভেবে দেখেছে? গরু বলে কি আর মানুষ নয়?
এত সব গণ্ডগোলের মধ্যে টাকচূড় নগরের তিন বুড়ো পণ্ডিত হাজির। পোস্তা থেকে ফিরে তাঁরা জানালেন এই ভাইরাসটি বেশ ‘সৎপাত্র’। আক্রান্তদের মধ্যে যখন মাত্র ২-৪% মারা যাছে, ‘এমন কি আর মন্দ ছেলে’। শত হক এই ভাইরাসটির জন্যই তো আজ আকাশের রঙ ফিরেছে, এটাই হয়তো দরকার ছিল। বাবুরাম সাপুড়ের সাপের মতই এই ভাইরাসটির ‘নেই কোনও উৎপাত, খায় শুধু দুধ ভাত’। পটা-পট্ রুগি ধরে টপা-টপ্ স্যানিটাইজার গিলিয়ে দিলেই সব ফিট্-ফাট্ হয়ে যাবে। আর গোমূত্র দিলে তো কথাই নেই, ভাইরাস থেকে ব্যাকটেরিয়া সব দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম্ বলে পালাবে। না না, এরকম আমি বলছি না, কাগজের রুগি কেটে ডাক্তারি বিদ্যা রপ্ত করা কিছু ডাক্তার বলছেন। তাদের কথা শুনে পৃথিবীর সব থেকে উন্নত দেশের নানান জায়গায় লকডাউনের প্রতিবাদ হচ্ছে। প্রচুর মানুষ পথে নেমেছেন। তাদের দাবি এই নিরীহ ভাইরাসের জন্য সব বন্ধ করে রাখার কোনও মানেই নেই, অনেক টাকার ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা, এই প্রতিবাদ বাড়ি থেকে করলে কেমন হত, ‘প্রতিবাদ ফ্রম হোম’ যাকে বলে।
সত্যি, চারিদিকে সব কাণ্ড যত দেখি, তত মনে হয় আমরা আবোল-তাবোলের দেশে আছি। স্বাভাবিকের থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছি। এরকম একটা সময়ের কথা কল্পনা করেই হয়ত সুকুমার রায় আবোল-তাবোল লিখে গেছেন। তা না হলে প্রায় একশ বছর আগের লেখা আজ অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়ে কী করে? খুড়োর কলে এখন ভ্যাক্সিন ঝুলছে, সেই কলের জোরেই আজ মানবজাতি তার দিকে দ্বিগুণ বেগে ছুটছে।
এই আবোল তাবোলের দুনিয়াতে গত এক মাস হল আমার ইউনিভার্সিটি বন্ধ, ল্যাবও। রিসার্চ বন্ধ তাই পিএইচডি-র শেষ প্রায় ৬-মাস পিছিয়ে গেছে। চাকরি খুঁজছি, খুঁজছি কিন্তু পাচ্ছি না। সব কম্পানিতে হায়ারিং-ফ্রিজ চলছে। দেশ ছেড়ে পড়তে বা রিসার্চ করতে আসা, আমার মত অনেক স্টুডেন্ট আছে এখানে। তাদের মধ্যে কারুর রিসার্চ স্টাইপেন্ড বন্ধ হয়ে গেছে। বাড়ি থেকে যে টাকা চাইবে অনেকেরই সেই ক্ষমতা নেই। আর ক্ষমতা থাকলেও সুযোগ নেই লকডাউনে। চাকরি করে যারা, অনেকেরই চাকরি গেছে। ১-২ মাসের মধ্যে নতুন চাকরি না পেলে আমেরিকা ছেড়ে গুড-বাই হতে হবে। কিন্তু এই সময় নতুন চাকরি কে দেবে, দিলেও ভিসা হবে কি? পরিবার আছে, এডুকেশন-লোন আছে, তাই গুড-বাই হলে চলবে কি করে? এদিকে বাড়িতে খবরটা জানানোও যাবে না, মা-বাবা চিন্তা করবেন। সব মিলিয়ে, ব্যাগ ভর্তি বই আর বুক ভর্তি আশা নিয়ে স্বপ্নের দেশে পাড়ি দেওয়া অভিবাসীদের অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। স্বপ্নের দেশটা যে নিজের দেশ নয়, এখানে আমরা যে প্রাওরিটি-লিস্ট এ খুব উপরে নই, সেটা মাঝে মাঝেই টের পাচ্ছি। তাও বলবো, পৃথিবীর নানান কোণে অনেক অনেক মানুষের থেকে আমরা হয়তো অনেকটাই ভালো আছি।
সত্যি, খুব খারাপ নেই মোটেই। ল্যাব বন্ধ, তাই ‘হোক্ না সকাল, হোক্ না বিকাল, হোক্ না দুপুর বেলা, নেই তো আমার আপিস যাওয়া, নেই কো কাজের ঠেলা।‘ ইউনিভার্সিটির সব ক্লাস এখন অন-লাইন, তাই স্টুডেন্টরা বাড়ি চলে গেছে। এই ছোট্ট শহর-এ লোক নেই বেশি। ভাইরাসে আক্রান্তদের সংখ্যাও কম। খাবার-দাবার জিনিস-পত্র সব ডেলিভারি আসছে বাড়িতে, একটু ধুয়ে-মুঝে নিলেই হল। বড় শহরের সব রকম সুবিধা রয়েছে, কিন্তু এখন লোক কম থাকায় বড় শহরের অসুবিধাগুলো নেই। বিকেলের দিকে বাড়ির পেছনের পার্কে হাটতে যাই। চেনা-অচেনা কিছু লোকের সাথে দেখা হয়। কেউ কুকুর নিয়ে যায়, কেউ বাচ্চাদের নিয়ে। একটা দুটো ছেলে একা-একাই বল পেটায়। সবাই দূর থেকে মিষ্টি হেসে ‘গুড ইভনিং’ জানায়, আর দূর থেকেই হাত নেড়ে চলে যায়। পুরোনো বন্ধুদের সাথে আড্ডা হচ্ছে ভিডিও কলে, এমনিতে তো সময় পাওয়া যায় না। অনেকগুলো ভাল বই পড়া হল, ভাল সিনেমা দেখা হল এই সুযোগে। কয়েকটা ভাল রান্নাও শিখে নিয়েছি। আসলে বাঙালি তো, তাই ‘খাই খাই’ টা কমে নি।
হুঁকোমুখো হ্যাংলার মত আমার বাড়িও বাংলা। মা-বাবা দিদা আছেন। বাবা ডাক্তার, তাই প্রায় রোজ হাসপাতাল যায়। বাবার বয়স ৬০ পেরিয়েছে, তাও রোজ যাওয়া চাই। মুখে সেই এক কথা, ‘ভয় পেয়োনা, ভয় পেয়োনা, করোনা আমায় মারবে না, সত্যি বলছি, কুস্তি করে, আমার সাথে পারবে না।‘ অনেক লোকের জীবন বাবার উপর নির্ভর জেনেই আমি খুব বেশি আপত্তি করতে পারছি না। শুধু সারাদিন একটাই চিন্তা মনের মধ্য ঘোরে, নিজের ভালোবাসার মানুষদের থেকে ৮০০০ মাইল দূরে রয়েছি আমি। দরকার পড়লে তাদের কাছে পৌছোতে পারব কি? স্বপ্নের দেশে আরামে থাকার এই হল ‘একশো টাকা ট্যাক্সো’। ইশ, গুপি-বাঘার জুতো জোড়া যদি আজ থাকতো! কিন্তু আমেরিকা এসে প্রচণ্ড দাপটে ইংরিজি বলার ফাঁকে গুপি-বাঘা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। হয়ত কোন মেঘের প্রাসাদে বসে মণ্ডা-মিঠাই খাচ্ছে আর বলছে, ‘কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়’।
Sukumar Ray miti miti hashlen r bollen “Aj o tahole amar lekha ta kauke inspire kore.” 🙂
Eto bhalo likhecho Dada. Khub bhalo laglo pore. Aro lekho future e erom. Sukumar Ray ke mone rakhche keu. Dekhe bhalo laglo. ?
Darun likhechis….we want more…