রোমেল রহমান
মাঝরাইতের কারবার
একদল কুকুর মাঝরাতে ঢুকে পড়ল নগরপিতার শোবার ঘরে! ঘুম থেকে জেগে তিনি হতভম্ব হয়ে ভয়ার্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন…
–কারা তোমরা?
–আমরা আপনার শহরের কুকুরেরা পিতা!
–কী চাই?
–এরকম আকালের দিনে কী আর চাই বুঝতে পারতেছেন না? খাবার চাই!
–কী বলিস এইসব? আমি তো জনগণের…
–উহু, নগরপিতা হয়ে বসে আছেন মানে আপনি এই নগরের সকল পিতা! এখন খাবারের ব্যবস্থা করেন। আমরা না খেয়ে মারা যাচ্ছি লগডাউনের গুতায়!
–তোমাদের জন্য কোনও বরাদ্দ নেই!
–যে পরিমাণ ত্রাণ চুরি হচ্ছে তার থেকে কিছু ছড়িয়ে দিলেই তো আমরা বেঁচে যাই!
–উপায় নেই! মানুষই পাচ্ছে না ঠিকঠাক আর তোমরা…!
–এসব টাল্টুবাল্টু আমাদের সাথে কইরা লাভ নাই! আমরা ভিত্রের সব খবরাখবর জানি! এহন ব্যবস্থা নেন!
–কাল নগর ভবনে আসো!
–নগর ভবনে আমাদের ঢুকতে দেয় না আপনের পোষা মানুষ গুলান!
–আচ্ছা আমি বলে রাখব, কাল ঢুকতে দেবে! এখন যাও!
–বলে রাখলেও লাভ নাই! কাল আপনার দপ্তরে গেলে আপনি আমাদের ভাষা বুঝতে পারবেন না!
–কেন পারব না বাপেরা! এই যে ঝরঝর করে বুঝতে পারছি!
–এইটা তো মাঝরাইতের কারবার! দপ্তরের চেয়ারে বস্লে আপনি আমাদের ভাষা বুঝতে পারেন না! চিনবেনই না! মানুষই চেনেন না! আর আমরা তো কুকুর!
–না না! আমি কসম খেয়ে বলছি আমি চিনব এবং তোমাদের খাবারের ব্যবস্থা করব! কর্পোরেশন দায়িত্ব নেবে!
–আপনি কিছুই নেবেন না! বড়জোর নেবার ভান করবেন! বড়জোর একটা ‘কুকুর দানাপানি’ প্রকল্প বের করে সেইটা দেবেন আপনার ভাইপো ভাগ্নেদের! দিনের বেলায় আপনি আপনার দলের গরিব কর্মীদেরই চেনেন না!
–আমি কসম খেয়েছি! আমি ব্যবস্থা নেব এখন যাও তোমরা!
–উহু! যাইতে আসি নাই পিতা! আসছি পেট ভরতে!
–কিন্তু তোমাদের কী খাওয়াব আমি? বাসায় তো এতজনের খাবার নাই?
–আপনেরে খাইতে আসছি আমরা!
–আপনার মাংস খাব পিতা!
–কী বলো এইসব?
–সত্য বলতেছি! দুঃসময়ে পিতাকে খেয়ে পুত্ররা বাঁচবে এতে দোষের কিছু নাই!
২৩ এপ্রিল ২০২০
সিংহভোজ
দুর্ভিক্ষে চিড়িয়াখানার প্রাণীদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে গেল এতটাই যে, একটা বানর শুকিয়ে এতটাই চিমসা মেরে গেল যে, খাঁচার শিকের ফাঁক গলে সে বেরিয়ে এল বাইরে; কিছুক্ষণ ঘুরে সে আবিষ্কার করল, লঙ্গরখানায় খাবার দেয়া হচ্ছে অভুক্ত দরিদ্র মানুষদের, খাবারের লোভে সে লঙ্গরখানার ভিড়ের সামনে এসে চেঁচিয়ে বলল…
–পালাও পালাও সিংহ আসছে! খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে গেছে ক্ষুধার্ত সিংহ! পালাও সবাই…!
ক্ষুধার্ত মানুষগুলো আনন্দিত হয়ে বলল…
–যাক্! খিচুড়ির সঙ্গে সিংহের মাংস খাওয়া যাবে!
২৩ এপ্রিল ২০২০
মামলা
এক বৃদ্ধ থানায় এসে অফিসারকে বলল…
–আমি একটা মামলা করতে চাই!
–আচ্ছা! কী বিষয়ে, কার নামে?
–বিষয় হচ্ছে মহামারি! এই মহামারির জন্য একদল খেতে পারছে আরেকদল আধপেট খাচ্ছে আর অন্যদল না খেয়ে মরছে! এসবের মধ্যে একটা দল চুরি আর মাল স্টক করে পয়সাওয়ালা হচ্ছে!
–আচ্ছা! এই চুরি টুরি নিয়ে? এদের কারও নামে।
–হ্যাঁ! এই সমস্ত অপরাধটা যিনি করাচ্ছেন মানে চেয়ে চেয়ে দেখছেন তার নামে! লাভের বেলায় তো তিনি পুরোটাই নেন! এখন মামলা নেবেন না কেন?
অফিসার বলল, বেশ তো আপনি অভিযোগ দায়ের করুন! আমরা দেখব! তো কার নামে মামলা করবেন আপনি? কোনও ব্যবসায়ী নাকি নেতা? নাম কী তার?
–খোদা!
২৩ এপ্রিল ২০২০
নসিব
চার পাঁচদিন ভাত জোটেনি! বুনো আলু আর হাবিজাবি খেয়ে কাটাতে হয়েছে! ত্রাণের টিকিট জোটানো লিয়াজুর ব্যাপার! তবে ভাগ্য আজ ভালো, আচমকা আর্মিদের একটা ট্রাক এসে কয়েকশো মানুষকে একেকটা ভারী বস্তা ধরিয়ে দিয়ে গেছে! উত্তেজনায় সিঁদুর হাঁপানির টান উঠে গেল! সে ভাবেইনি তার কপালে জুটবে! ডোমপাড়ার মাঝবয়সী সিঁদু হাঁপানির জন্য পরিশ্রমের কাজ করতে পারে না ভালো! কয়েকটা পাঁপড় টাপর বিক্রি করে টিকে ছিল। কিন্তু মহামারি লাগায় তার কপালের ভাত কয়েকদিনের মধ্যে উবে গেল! ভরসা হিসেবে তখন জঙ্গলে নেমে যেতে হল। সেখানে জন্মানো বুনো আলু খেয়ে কাটছে আজ চার-পাঁচ দিন। আজ সে ভাত খাবে! ত্রাণের বস্তাটা কাঁখে তুলেই তার শ্বাসকষ্টটা জাঁকিয়ে উঠল! বাড়ি কোনও মতে পৌঁছাতে পারলেই হাঁড়িতে চাল তুলে দেবে! ফলে হাঁপাতে হাঁপাতে সিঁদু ছুটতে লাগল বাড়ির দিকে! পথে কয়েকটা ছেলেপেলে যারা কদিন আগেও মাঠে খেলে বেড়াত তারা ঘিরে ধরল সিঁদুকে! একজনের হাতে চাকু দুজনের হাতে দুটো গরান! সিঁদু বুঝে ফেলল কপাল মন্দ তার! একজন হ্যাঁচকা টানে ত্রাণের বস্তাটা ছিনিয়ে নিল! সিঁদু জড়ানো কণ্ঠে বলে উঠল…
–চালটুকু দিয়ে দে বাপ!
–ভাগ্!
–আর সব নিয়ে যা শুধু চালটুকু দে বাপ!
–চুপ হারামজাদা! আরেকটা কথা বললে পেট নামিয়ে দেব!
–চারদিন ভাত খাই না, একটু ভাত খাব, চালটুকুন দে!
–মর তুই!
–এক মুঠো দে বাপ! পায়ে ধরি! এক মুঠো চাল দে!
ছেলেগুলোর মধ্যে একজন বস্তাটার মুখ আলগা করে উঁকি দিয়ে একটা পুটুলি বের করে ছুঁড়ে দিল সিঁদুর দিকে!
–নে আলু খা!
২৩ এপ্রিল ২০২০
কালা মুর্গি
এক মহিলা একটা কালো মুর্গি কোলে নিয়ে রাস্তায় হেঁটে হেঁটে বিক্রির চেষ্টা করে! পথচারীদের ধরে ধরে বলতে থাকে, ‘মুর্গিটা কিনলে আমার উপকার হয়, প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাইতে পারি!’ কেউ কেউ তাকে পাগল ভাবল, কেউ কেউ ভাবল ঝামেলা আছে! আবার কেউ কেউ হেসে দিয়ে বলল, ‘আমার কাছে টেকা নাই মা, অভাবে আছি!’ একটা গাড়ি থামতেই মহিলাটি এগিয়ে গেল! গাড়ির ভেতরের মহিলাটিকে বলল, ‘কালা মুর্গিটা কিনা নেন! কাজে দিব!’ গাড়িওয়ালি মহিলাটি কিছু একটা অনুভব করল এবং হাত বাড়াল! মুর্গিটা দেবার সময় মুর্গিটা একটা ডিম পেড়ে দিল এবং সেটা মুর্গিওয়ালি মহিলাটি হাতের মধ্যে নিয়ে নিল এবং একগাল হেসে দিয়ে বলল, ‘মুর্গিটা আপনের, ডিমটা আমার!’ তারপর গাড়িওয়ালি টাকা বাড়িয়ে দিল! এই দৃশ্য দেখে ফেলল ফুটপাতের এক পানওয়ালা! সে বলে উঠল, ‘এই যে কী হইল এইসব?’ মুর্গিওয়ালি মহিলা বলল, ‘কালা মুর্গিটারে নগদ টাকা আর ডিম বানায় নিলাম!’ তারপর মহিলাটি ডিম সহ বাসে উঠল মুর্গি বিক্রির টাকায় এবং রাজধানী পৌঁছে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের গেটে গিয়ে বলল, ‘প্রধানমন্ত্রীরে খবর দেও! বল কালা মুর্গিওয়ালি আসছে!’ সিকিউরিটির লোকেরা চোখ সরু করে চরম সন্দেহের নজরে দেখল! একজন তাকে বিদেয় করে দিতে চাইল! মহিলাটি সুন্দর করে দৃঢ় স্বরে বলল, ‘আমারে ভাগায় দিলে কিন্তু আর খুঁইজা পাবা না! বিপাকে পড়বা! প্রধানমন্ত্রীর এখন আমারে প্রয়োজন! তারে বলো, কালা মুর্গিওয়ালি আসছে! বললেই দেখবা ডাক আসবে!’ মহিলার কথার মধ্যে কিছু একটা ছিল যা নিরাপত্তাকর্মীদের নাড়া দিল! তারা ভেতরে খবর পাঠায়! নিরাপত্তার সকল সিঁড়ি ডিঙিয়ে ডিমটা স্ক্যান করে শেষমেশ প্রধানমন্ত্রীর সামনে হাজির করা হয় মুর্গিওয়ালিকে! প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে একটা স্মিত হাসি দিয়ে মুর্গিওয়ালি তার আঁচলের তলা থেকে ডিমটা বের করে এবং ফুঁ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিমটা ফুটে একটা কালা মুর্গি বের হয়ে কক্ক্ কক্ক্ কক্… স্বরে ডাকতে থাকে! তারপর মুর্গিওয়ালি প্রধানমন্ত্রীর কানে কানে কিছু একটা বলে! পরেরদিন থেকে দেখা যায় জাতীর উদ্দেশ্যে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর সকল ভাষণে মাইক্রোফোনের সামনে সেই কালা মুর্গিটাকে!
২৩ এপ্রিল ২০২০
গাধা(-)মন্ত্রী
স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঘুমের মধ্যে দেখতে লাগল একটা গাধা তার বুকের উপর উঠে দাঁড়িয়ে কাশছে! একটু পরপর হাঁচিও দিচ্ছে! সম্ভবত সামান্য শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তার! মন্ত্রী জিজ্ঞাস করল, ‘তুমি কে?’ গাধা বলল, ‘আমি গাধা!’ মন্ত্রী বলে ওঠে, ‘কী বিষয়? তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী?’ গাধাটা একটা হাঁচি দিয়ে বলে ওঠে, ‘মানুষের সঙ্গে গাধার যে সম্পর্ক, আপনার সঙ্গে আমার তাই!’ মন্ত্রী চুপ করে যায়! গাধা আবার বলে, ‘মন্ত্রী সাব, আমাগোর জন্য কি মাস্কের ব্যবস্থা করা যায়? হাঁচি কাশি নিয়া আছি খুব বিপাকে! হাঁচি দিলেই লোকজন এক লাফে দূরে সইরা যায়! তার উপ্রে খাদ্যসঙ্কট!’ মন্ত্রী বলে ওঠে, ‘আমার কাছে তথ্য নাই যে গাধাদের ব্যাপারে আমাদের কাছে কী পরিমাণ স্বাস্থ্য সামগ্রী মজুদ আছে! তবে আমরা ব্যবস্থা নেব!’ গাধা বলে, ‘মন্ত্রী সাব ব্যবস্থা কবে নিবেন? মরলে?’ মন্ত্রী বলে ওঠে, ‘না না আপনারা জীবিত থাকতেই আমরা ব্যবস্থা নেব আশা রাখি! আর মরে গেলে মাস্ক পরিয়ে গোর দেবার ব্যবস্থা নেব! আমরা আশাবাদী আপনাদের মৃত্যুহার হবে সব থেকে কম!’ গাধা বলে, ‘তাইলে কি আমরা ভেন্টিলাইজার মেশিনও পাব যদি ফুসফুস ঘের খায়?’ মন্ত্রী বলে, ‘আমি ফুসফুস কমিটির প্রধান বানিয়েছি এক গাড়লকে যে ফুসফুস খুলে সাবান দিয়ে ডলে ডলে করোনামুক্ত করে আবার লাগিয়ে দেয়, তার সঙ্গে আলাপ করে জানাই?’ গাধা বলে, ‘সব(ই) আপনার ইচ্ছা!’ তার পরদিন থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে যখনই টেলিভিশনে দেখা যায় কথা বলতে, জনগণ দেখতে পায়; মন্ত্রীর মুখের জায়গায় একটা গাধার মুখ! এবং তারা বলে, ‘লোকটা কি মানুষ নাকি গাধা?’
২৩ এপ্রিল ২০২০
ধূর্ততা
একটা শেয়াল শহরে ঢুকে পড়ল! শহরে চলছিল খাদ্যাভাব ফলে সে কোথাও খাবার খুঁজে পেল না এবং জঙ্গলে ফেরার রাস্তাও খুঁজে পাচ্ছিল না! হঠাৎ সে দেখল কয়েকজন লোক একদল ক্ষুধার্ত কুকুরকে খাবার দিচ্ছে! চুপি চুপি শেয়ালটা লোকগুলোর পিছু নিয়ে তাদের অফিসে পৌঁছে গেল! সেখানে গিয়ে সে কুকুর খাওয়ানো লোকগুলোকে বলল…
–আমি ভীষণ ক্ষুধার্ত! আপাতত আমি একজন কুকুর! আমাকে খাবার দাও!
লোকগুলো তাকে ভালো করে দেখে বলল…
–আপাতত আমরা আমাদের জাতের বাইরে কাউকে খাবার দেই না!
২৩ এপ্রিল ২০২০