প্রকৃতির প্রতিশোধে পঙ্গপাল, দেশব্যাপী খাদ্য সঙ্কটের ভ্রূকুটি

অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 



লেখক প্রযুক্তিবিদ্যার ছাত্র ও গবেষক

 

 

 

 

দাবানল শস্যহানি ঝড় মহামারি
একত্রে ঘটিলে জেনো রাজা দুরাচারী

রাজা দুরাচারী এমনটা বলতে সাহস হয় না। বললে পরে সিডিশনের চার্জ আসতে পারে। কিন্তু বছরটা যে একেবারেই ভালো যাচ্ছে না। কেশযুক্ত, পলিতকেশ অথবা কেশবিহীন– যত রকমের বিশেষজ্ঞকেই আজ টিভির পর্দায় এনে বসানো হোক না কেন, সকলেরই বক্তব্য অনুরূপ– “এমনটা যে হবে কখনও ভাবিনি, এমনটা আমাদের জীবদ্দশাতে কখনও ঘটেনি।” ‘অভূতপূর্ব’ শব্দটির ব্যবহারিক উদাহরণ। আজ প্রকৃতির প্রতিশোধের সময় আসন্ন। সত্যিই কি তাই?

প্রভিডেন্স ইত্যাদির কথায় যাব না। মারণ ভাইরাস, অথবা দুর্দান্ত ঝড় উমপুনের খতিয়ান জানা আছে আপনাদের। তার সঙ্গে আবার নতুন বিপদের মতো, কোথা থেকে যেন ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপালেরা আসতে শুরু করেছে পশ্চিমের রাজ্যগুলিতে। উত্তরাখণ্ডের একাধিক জায়গাতে আবার চোখে পড়েছে দাবানলের দাপট। স্বদেশের ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা। কিন্তু ভাইরাস থেকে শুরু করে, এমন প্রত্যেকটি বিষয়ে যে একটি জিনিস বারংবার আমাদের চোখে পড়তে পেরেছে, সেটি হল সামগ্রিক পরিকল্পনার অভাব। পরামর্শকে অবহেলা, এবং ক্ষেত্রবিশেষে সিদ্ধান্ত নিতে অনীহা। এমনকি সিদ্ধান্ত না নেওয়ার মতো গা-জোয়ারিও চোখে পড়েছে। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও, ‘কুছ পরোয়া নেহি’– এই মনোভাবটিই অঞ্চলের পরে অঞ্চলে বিপদ ডেকে এনেছে। সাধারণ মানুষ নির্বিচারে ভাইরাসের কবলে পড়েছেন, অনাহারের মুখে পড়েছেন— এমনকি মৃত্যুর মুখে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। সরকার সেই সমস্ত তথ্যকে অস্বীকার করেছে, অবজ্ঞা করেছে। পঙ্গপালের বিষয়টিতেও অন্যথা হয়নি তার।

জানুয়ারি মাস থেকেই এদেশে পঙ্গপাল-হানার খবর পাওয়া যাচ্ছিল। প্রতি বছরেরই এই সময়টায় এই পঙ্গপালের ঝাঁক আমাদের দেশের পশ্চিমাঞ্চলে আক্রমণ চালায়। এমন কিছু নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু এবছর সেই তীব্রতা বেড়েছিল, এবং তা বেড়েই চলেছে। জানা যাচ্ছে যে ১২ই জানুয়ারি ২০২০ অবধি, পঙ্গপালেরা এদেশের প্রধান দুটি রাজ্য, রাজস্থান এবং গুজরাতের প্রায় ৩,৭০,০০০ হেক্টর জমির ওপরে প্রভাব বিস্তার করেছিল, যে সংখ্যাটা ১৯৯৩তে ছিল ৩,১০,৪৮২ হেক্টর। সাতাশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ আক্রমণ। বারমের, চুরু, যোধপুর, নগৌর, জয়সলমীর, জালোর, ঝুনঝুনু, সিকার, শ্রীগঙ্গানগর এবং বিকানেরে ক্ষতি হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। ২৬শে ডিসেম্বর, ২০১৯– দৈর্ঘ্যে ৯ কিলোমিটার এবং প্রস্থে ৩ কিলোমিটারের একটি অতিকায় পঙ্গপালের ঝাঁক বারমেরের শস্যক্ষেতগুলিতে আক্রমণ চালায়। মরু পঙ্গপালের এই প্রজাতিটি মাত্র ৩ মাসের প্রজননে নিজেদের সংখ্যাকে বিশগুণ অবধি বাড়িয়ে ফেলতে পারে। কোথা থেকে এসেছিল এই মারণ-ঝাঁক? আর কেনই বা হঠাৎ এই বিশাল সংখ্যাতে আক্রমণ?

সমস্যার মূলে রয়েছে কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। বিশদ তথ্য ঘাঁটলে পরে দেখা যাবে যে, কমবেশি ২০১৮-১৯ সাল থেকেই কিন্তু এই পঙ্গপাল হানার সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল। বিশেষ রকমের এই মরু পঙ্গপালের প্রজাতিটি শুকনো-বালির জায়গাতে ডিম পাড়তে ভালোবাসে। আবার, তারপরে যদি বৃষ্টি না হয়— তাহলে কিন্তু তাদের অধিকাংশ প্রজননই বিফলে যায়। হয়তো বা এই অদ্ভুত বৈপরীত্যের মাধ্যমেই প্রকৃতিদেবী এদের প্রজননের ওপরে একটি জটিল ব্যবহারিক ভারসাম্যের ব্যবস্থা তৈরি করে রেখেছিলেন। কিন্তু বাধ সাধল মানুষের লোভ– জলবায়ু পরিবর্তন। ইয়েমেন, জিবুতি, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, ইরান, আফগানিস্তানের মতো দেশে ডিম পাড়বার সময়ে, ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টির সুযোগ পেল পঙ্গপালেরা। মরুভূমিতে আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় সুবিধে হয়ে গেল তাদের। ঝাঁক পুষ্ট হল। সমস্যার এখানেই শেষ নয়। এই প্রথম দফার প্রজননের পর আবহমণ্ডলের বায়ুস্রোত বেয়ে বেয়ে তারা এসে পড়ল ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে। ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা জারি করতে হল। হ্যাঁ, এই পঙ্গপালের কারণেই। কারণ, পাকিস্তানের প্রায় ৪০ শতাংশ ক্ষেতের ফসল এই পতঙ্গের দল সাফ করে দিয়েছে। সেই দেশ এখন খাদ্যসঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে। করাচির মতো শহরেও পঙ্গপালের দল তাণ্ডব চালিয়েছে।

এরপর, মার্চ-এপ্রিল-মে– এই তিনমাসে রাজস্থান এবং গুজরাটের মরু অঞ্চলে পঙ্গপালেদের দ্বিতীয় দফার প্রজনন শুরু হল। প্রথমদিকে তারা বালি পেল, শুকনো জমি পেল। ডিম পাড়া হয়ে গেল। তারপর এল বৃষ্টি। মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাত দেখা গেল এই ঊষর মরু অঞ্চলগুলিতে। ফল দাঁড়াল মারাত্মক। প্রথম দফার প্রজননে যে পঙ্গপালেরা তিনমাসে বেড়ে বিশগুণ হয়ে দাঁড়াচ্ছিল, সংখ্যার হিসেবে– এখন সেই একই সময়ে তাদের সংখ্যা বাড়ছে প্রায় চারশোগুণ। পশ্চিম এশিয়া এবং আফ্রিকা থেকেও পাকিস্তানের দিকে, আরও নতুন ঝাঁক আসার ঘটনাও বন্ধ হয়নি। এরপর জুন মাসের প্রথম দিকে গরম এবং শেষ দিকের বর্ষাতে ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত এলাকার বিস্তীর্ণ অংশে আবার নতুন একদফার প্রজনন ঘটে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞেরা আশঙ্কা করছেন। এরই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে আছড়ে পড়া সুপার সাইক্লোন আমফান ঝড়ের কারণে ভারতবর্ষের আকাশে বা বায়ুমণ্ডলে বইতে থাকা চলতি বায়ুস্রোতগুলিও ঘেঁটে গিয়েছে। আর সেই ঘেঁটে যাওয়া বায়ুস্রোতে ভর করেই পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এমনকি মহারাষ্ট্রেও পঙ্গপালেরা পৌঁছিয়ে যেতে পেরেছে। রাজস্থানের ৩৩টি জেলার মধ্যে ২২টিতে দাপিয়ে বেড়িয়েছে এই পতঙ্গের দল। কেবল এই একটি রাজ্যেই ৩৮,৩০৮ হেক্টর পরিমাণ জমির ফসল নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৮০০০ কোটি টাকা। সবুজ রাজ্য পাঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশের কৃষক সম্প্রদায় এখন থেকেই আতঙ্কের রাত জাগতে শুরু করেছেন। এমনকি যে বর্ষার মরসুমে তাঁরা চাষ করেন, তার পূর্ব-নির্ধারিত সময়সীমাটিকেও কোনওভাবে পিছিয়ে দেওয়া যায় কি না– সেই বিষয়েও তাঁরা ভাবনাচিন্তা করতে শুরু করেছেন। দেখা যাচ্ছে যে, গত দেড় দুবছরে ভারতবর্ষ ছাড়াও এশিয়া এবং আফ্রিকার প্রায় ৬০টি দেশের ৩ কোটি বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই পঙ্গপালের প্রভাব দেখা গিয়েছে। লক্ষণ ভালো ঠেকছে না। কারণ অঙ্কের হিসেব বলছে, এক বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত একটি পঙ্গপালের ঝাঁক (ডিসেম্বরে রাজস্থানে হানা দেওয়া ঝাঁকটির বিস্তার ছিল প্রায় ১২ বর্গ কিলোমিটার) সংখ্যার হিসেবে সর্বোচ্চ ১৫ কোটি সংখ্যক পঙ্গপালকে বহন করতে পারে। আর এই সংখ্যক পঙ্গপাল একদিনে, সাড়ে সাত লক্ষ মানুষের সমপরিমাণ খাদ্যকে খেয়ে শেষ করে দিতে পারে। অঙ্কটা সত্যিই ভয়ের। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য যে এত বড় মাশুল দিতে হবে, তা বোধহয় কখনও ভেবে দেখিনি কেউ।

এর শেষ কোথায় জানা নেই। ভাইরাস, পঙ্গপাল, দাবানল, খাদ্যসঙ্কট, পরিযায়ী শ্রমিক সমস্যা– এ বছরটা ভালো যাচ্ছে না। তবুও আজ আশা রাখতে অন্যায় দেখছি না। সেই আশাটুকুকে বাঁচিয়ে রাখাটাই আজ বোধহয় আরও বেশি করে বাঞ্ছনীয়। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হল এই যে, গত কয়েকটা মাসে আমরা যা কিছু দেখলাম, যা কিছু জানলাম, শিখলাম– সেসব আমরা মনে রাখব তো? জলবায়ু পরিবর্তনকে আর কোনওদিনও আমাদের মিথ বলে মনে হবে না তো? অথবা, আগামীতে কোনওদিন আবার আমরা সেই বিশিষ্ট বিচারপতির মতো জনসমক্ষে মুখ ফসকে বলে বসব না তো, যে “মানুষ হাঁটছে তো কী হয়েছে, এসব আদালতের বিচার্য নয়!”

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...