ভাইরাসের ধর্ম, রাজনীতির ভাইরাস

শুভাশিস মৈত্র

 



লেখক পেশায় সাংবাদিক

 

 

 

এই লেখার বিষয়, করোনা ভাইরাস এবং সাম্প্রদায়িকতা। চরম দক্ষিণপন্থীরা অনেক দিন পরে নরেন্দ্র মোদির মতো একজন ‘দক্ষ’ নেতা পেয়েছেন, যিনি প্রায় হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতো ‘ক্রাউড’-কে পরিচালিত করতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কথা বলছি না। বলছি, নেতা নরেন্দ্র মোদির কথা। আর নরেন্দ্র মোদি, একা হাতে বদলে দিচ্ছেন ভারতীয় রাজনীতির ভাষা। ধরুন, থালা বাজানোর কর্মসূচি। বা আলো জ্বালানো। এই ‘ভাষা’য় যে সাড়া তিনি আদায় করে নিলেন, আর তার যে বাড়াবাড়ি, সবই সাফল্যের প্রমাণ। এই ধরনের ভাষায় আগে এই দেশে রাজনীতি হয়নি। তিনি যখন বক্তৃতা দেন, তখনও, মাঝে মধ্যেই ‘প্রশ্ন-উত্তর’ ‘ফর্ম্যাট’-এ নিয়ে চলে যান তাঁর বক্তৃতাকে। সেখানে তিনি অবাস্তব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, মানুষকে সেই প্রতিশ্রুতি বিশ্বাসও করাচ্ছেন। যে মানুষ মাঠে গিয়ে বক্তৃতা শোনে না, দেশের সেই অংশের মানুষের কী করা উচিত? সেটা এখন আর তিনি সংসদে বলছেন না। বলছেন সরাসরি দূরদর্শনে। ‘ডাইরেক্ট কনট্যাক্ট’। ছাত্র-ছাত্রীদের কীভাবে ভাবা উচিত, তা-ও তিনি সরাসরি বলছেন।

তিনি সংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন না। তাঁর জমানায় জবাব চাওয়ার মতো সাংবাদিকও বিরল প্রজাতি। আর যারা চাইতে পারে, তাদের সে সুযোগও নেই। আম কী করে খেতে হবে, বা ধরুন, রুটি কী করে ভাজতে হয়, এই সব মামুলি বিষয়ের বাইরে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনও আলোচনায় যেতে চান না। এর সঙ্গে আমজনতার জন্য আছে হিন্দু-মুসলমান-পাকিস্তান-কাশ্মির-এনআরসি-সিএএ-র একটা হাতে গরম ‘হেট’-চালিসা’। বা ঘৃণার পাঁচালিও বলা যেতে পারে। দেশের প্রতিটি ঘটনার একটা সাম্প্রদায়িক ‘এডিশন’ তৈরি করা হচ্ছে। কী রকম? অনেকেরই হয়তো জানা, তবু একবার পর পর মিলিয়ে দেখুন, প্রথম থেকে করোনা ভাইরাসের সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা কী পরিমাণ দক্ষতা এবং চাতুর্যের সঙ্গে ছড়িয়ে দেওয়া হল সারা দেশে।

সারা পৃথিবী জুড়ে মানুষ খুন করে ভারতে ঢোকার পর আবিষ্কৃত হল, করোনা ভাইরাসেরও একটা ‘ধর্ম’ আছে। এবং, সেটা ইসলাম ধর্ম।  বিজেপি নেতাদের টুইট, হিন্দুত্ববাদীদের কথাবার্তা, টুইট, হোয়াট্‌সঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির প্রচার শুনলে কারও এমনটাই মনে হতে পারে।

বিজেপির আইটি সেল-এর প্রধান অমিত মাল্যব্য গত পয়লা এপ্রিল টুইট করে বলেছেন, “Delhi’s dark underbelly is exploding! Last 3 months have seen an Islamic insurrection of sorts, first in the name of anti-CAA protests from ShaheenBagh to Jamia, Jaffrabad to Seelampur. And now the illegal gathering of the radical TablighiJamaat at the markaz. It needs a fix!”

অর্থাৎ, বিজেপির কাছে সিএএ-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হল ইসলামিক জেহাদ। তবলিগি জমায়েত ছিল ষড়যন্ত্র। অনুগত মূলধারার মিডিয়ার একটি বড় অংশও কোভিড-এর গল্প তাদের ‘টোয়েন্টিফোর ইন্টু সেভেন’ প্রচারমাধ্যমে বিষাক্ত মুসলমানবিরোধী করে তুলেছিল সেই সময়ে। তবলিগি জামাত নামে সংগঠনটি লকডাউন ঘোষণার আগে দিল্লিতে এক ধর্মীয় সমাবেশের আয়োজন করে। এই সমাবেশ সংক্রমণের একটা বড় কেন্দ্রবিন্দু বলে চিহ্নিত হয়। ব্যস, এই খবরটি মুসলমানদের হেয় প্রতিপন্ন করা, তাদের দুশমন হিসেবে চিহ্নিত করার কাজে ব্যবহার শুরু হয়ে যায়। ভাবখানা যেন, মুসলমানরাই এই ভাইরাস আবিষ্কার করেছে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে এক ধরনের জেহাদ হিসেবে এই ভাইরাস তারা ছড়িয়েছে।

তবলিগি জামাতের কয়েক হাজার কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষের জমায়েতের জন্য দেশের ২৫-২৬ কোটি মুসলিমকে দায়ী এবং দোষী করা হল। কখনও সরাসরি, কখনও বা ঘুরিয়ে বলা হল করোনা ছড়ানোর জন্য মুসলিমরা দায়ী। করোনার জীবাণুতে এই ভাবেই হিন্দুত্ববাদীরা ধর্ম খুঁজে পেয়েছে। যদিও প্রায় ওই একই সময়ে এবং তার পরেও বিজেপি নেতাদের আত্মীয়-পরিজনের জন্মদিনে, বিয়েতে, শিবরাজ সিং চৌহানের শপথে, রামনবমীতে হিন্দুত্ববাদীদের বহু জমায়েতের খবর বিভিন্ন সময়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তা নিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা চুপ। হিন্দুত্বাদীদের আদর্শ, ফ্যাসিবাদী হিটলারের অনুগামীরা বলতেন, “ক্রমাগত প্রচার চালিয়ে যেতে পারলে মানুষকে আমরা বিশ্বাস করাতে পারি, নরকটাই আসলে স্বর্গ, মানুষকে বিশ্বাস করানো যায়, তার চূড়ান্ত বিপর্যস্ত জীবনটাই দুর্দান্ত সুন্দর আর সুখের।” করোনা এবং ইসলামকে নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের প্রচার দেখে মনে হতেই পারে, দেশি হিটলারেরা ময়দানে নেমে পড়েছে।

প্রচার কীভাবে চলছে দেখে নিন। গত ৬ এপ্রিল। উদিপি-চিকমাগালুরের বিজেপি সাংসদ শোভা করন্দলাজে সংবাদমাধ্যমকে বললেন, এক জন তবলিগি জামাত সদস্য, যিনি কর্নাটকের বেলাগাভি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন, তিনি নাকি হাসপাতালের কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে চলেছেন, কিছু বলতে গেলে থুথু ছিটিয়ে দিচ্ছেন তাঁদের দিকে, আর অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে নাচছেন। হইহই পড়ে গেল এই খবরে। এই খবর বেরনোর পর ওই জেলার ডেপুটি কমিশনার জানিয়েছেন, এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও বলেছে, উদিপি-চিকমাগালুরের বিজেপি সাংসদ শোভা করন্দলাজে সংবাদমাধ্যমকে যা বলেছেন, একেবারেই ঠিক নয়। এমন কোনও ঘটনাই ঘটেনি। গোটা খবরটাই মিথ্যা। এই যে দলের একজন সাংসদ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এমন একটা সাম্প্রদায়িক কাজ করলেন, তার জন্য কিন্তু তাঁকে দল কোনও শাস্তি দেয়নি। যেমন শাস্তি পাননি নাথুরাম গডসেকে দেশপ্রেমিক বলার জন্য ভোপালের সাংসদ প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর। যেমন, গণপিটুনিতে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্তরা জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর তাদের বাড়িতে ডেকে মালা পরিয়ে মিষ্টি খাওয়ানোর জন্য দলে নিন্দিত হননি বিজেপির প্রাক্তন মন্ত্রী জয়ন্ত সিন্‌হা। শাস্তি এঁরা পান না, কারণ, এঁরা প্রত্যেকেই যে যার নির্দিষ্ট অ্যাসাইনমেন্ট পূর্ণ করছেন।

গত ৪ এপ্রিলের ঘটনা। হিমাচলপ্রদেশের বিজেপি-প্রধান রাজীব বিন্দাল বললেন, কেন্দ্র ও রাজ্য যখন করোনা রুখতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে তখন তবলিগি জামাতের সদস্য এবং আরও কিছু লোকজন কেন্দ্র ও রাজ্যের এই মহৎ প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করতে মানববোমা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ৯ এপ্রিল, মহারাষ্ট্রের প্রক্তন বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফাড়নবিশ বললেন, দিল্লির নিজামুদ্দিন থেকে যে তবলিগি জামাত সদস্যরা ফিরেছেন তারা প্রত্যেকে একেকজন মানববোমা।

নেতারা যখন বলছেন মানববোমা, তখন ক্যাডারদের তো দায়িত্ব পড়েই যায় সেই মানববোমার উপর হামলা করার। হলও তাই। গত ৬ এপ্রিলের ঘটনা। উত্তর-পশ্চিম দিল্লির বাওয়ানার বাসিন্দা ২২ বছরের মেহবুবকে ঘিরে ধরে আক্রমণ করা হল। কারণ মেহবুব ভোপালে গিয়েছিলেন তবলিগি জামাতের অনুষ্ঠানে। সেখান থেকে পুলিশ তাকে আটক করে। তার যথাযথ ডাক্তারি পরীক্ষা হয়। সে রোগমুক্ত, এই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে পুলিশ এসকর্ট করে নিয়ে এসে গ্রামে ফিরিয়ে দিয়ে যায়। কিন্তু রটিয়ে দেওয়া হল, তবলিগি জামাতের সভা থেকে জীবাণু নিয়ে এসে ইচ্ছাকৃতভাবে গ্রামে রোগ ছড়াতে চাইছে মেহবুব। আর নেতারা তো বলেই দিয়েছেন, তবলিগি জামাত থেকে যারা ফিরছে তারা মানববোমা। ফলে তার শাস্তি প্রাপ্য। তাকে প্রকাশ্যে বেধড়ক পেটানো হল জুতো এবং লাঠি দিয়ে। এমন কৃতিত্বের ছবিও তোলা হল মোবাইলে। সাফল্যের সেই ছবি এর পর ছড়ানো হল নিজেদের মধ্যে, যাতে অন্যরাও উৎসাহ পায় এই ধরনের কাজে।

গত ১৭ এপ্রিল উত্তরপ্রদেশের মিরাটে একটি নামী ক্যান্সার হাসপাতাল দৈনিক খবরের কাগজে পাতাজুড়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে বলল, মুসলিমরা এখানে চিকিৎসা করাতে এলে রোগী এবং রোগীর সঙ্গে যাঁরা আসবেন তাদের যে কোভিড-১৯ হয়নি তার ডাক্তারি সার্টিফিকেট লাগবে। খুব এমার্জেন্সি পরিস্থিতি হলে হাসপাতাল সেই পরীক্ষা করাবে, এবং তার জন্য ব্যক্তিপিছু ৪৫০০ টাকা দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ হয়। পরে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের এক অফিসার নোটিস পাঠিয়ে বলেন, ভারতের মতো সেকুলার দেশে এমন বিভাজনমূলক বিজ্ঞাপন দেওয়া যায় না। পরের দিন ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে ওই বিজ্ঞাপনের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে।

এসব তো চলছে। সঙ্গে চলছে ফেক নিউজে মুসলমানবিরোধী অপপ্রচার। মহারাষ্ট্রের পালঘরের ঘটনা তার কুৎসিততম নজির। আপনাদের অনেকেরই মনে আছে, গত ১৬ এপ্রিল গভীর রাতে মহারাষ্ট্রের পালঘরে স্থানীয় জুনা আখড়ার দুই সাধু সুশীল গিরি মহারাজ ও চিকানে মহারাজ কল্পবৃক্ষগিরি একটি গাড়িতে চড়ে সুরাতে যাচ্ছিলেন। তাঁদের গাড়ি চালাচ্ছিলেন নীলেশ তেলগানে নামে এক যুবক। পরিচিত একজনের শেষকৃত্যে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন তাঁরা। পালঘরের কাছে বেশ কয়েকজন তাদের গাড়ি আটকায়। রটিয়ে দেওয়া হয়, এরা শিশুদের কিডনি চুরির ব্যবসা করে। কিডনি বিক্রি করে টাকা উপার্জনের জন্য বেশ কয়েকটি শিশুকে চুরি করে ওই গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এইগুজবে ক্ষিপ্ত জনতা গাড়ি থেকে নামিয়ে বেধড়ক মারধর করে ওই তিনজনকে। খবর পেয়ে পুলিশ তাঁদের উদ্ধার করতে আসে। পুলিশের উপরেও হামলা করে উত্তেজিত জনতা। ভাঙচুর করা হয় পুলিশের গাড়ি। বেশ কিছুক্ষণ পর পুলিশ তিনজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালেই মারা যান ওই তিনজন। স্রেফ গুজবের জেরে মর্মান্তিক এই ঘটনা ঘটে। কিন্তু, এই ঘটনার পর থেকেই সক্রিয় হয়ে ওঠে হিন্দুত্বাদীদের হোয়াট্‌সঅ্যাপ বাহিনী। সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয় ফেক নিউজ। বলা হয়, “দেখুন তিনজন হিন্দু সাধুকে কীভাবে খুন করছে মুসলমানরা। মহারাষ্ট্র সরকার সাধুদের পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় তদন্তভার সিআইডিকে দেয়। তদন্তের দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র আট ঘণ্টার মধ্যে এই ঘটনায় জড়িত মোট ১০১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের নামও প্রকাশ করা হয়। এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনিল দেশমুখ বলেছিলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া বেশ কয়েকটি ভিডিও আমি দেখেছি। যাতে এডিট করে বিশেষ প্রযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন শব্দ বদল করা হয়েছে। ইচ্ছা করে এই ঘটনার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতাকে জড়ানো হচ্ছে।”

মুসলিম রেস্তোরাঁ-মালিক খাবারে থুথু মিশিয়ে ক্রেতাকে খাবার বিক্রি করছে, মুসলিম ফলবিক্রেতা ফলে থুথু লাগিয়ে বিক্রি করছে, এমন ফেক ভিডিও, ফেক ছবিও সম্প্রতি ভাইরাল করানো হয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই, ঘৃণা ছড়াও। এই ঘৃণা ছড়ানোর ব্যাপারটাও কিন্তু মোটেই নতুন নয়। অনেক দিন ধরেই চলছে। ২০১৫ সালে বিজেপি সাংসদ তেজস্বী সূর্য এক টুইটে লিখেছিলেন, “৯৫ শতাংশ আরব মহিলার বিবাহিত জীবন সুখের হয় না। তাদের সব সন্তান আসলে যৌনতার ফসল, ভালোবাসার নয়।” যদিও কিছুক্ষণ পরেই ওই সাংসদ টুইটটি ডিলিট করে দেন। কিন্তু ততক্ষণে তার বহু স্ক্রিনশট নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে পরিচিত কুয়েতের আবদুর রহমান নাশার সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই টুইট পোস্ট করে প্রতিবাদ জানান। নাশার ভারতের পিএমও-কে এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও ট্যাগ করেন টুইটারে। তিনি লেখেন, “প্রধানমন্ত্রী দেখুন, একজন ভারতীয় সাংসদ আরবের মহিলাদের সম্পর্কে কী ধরনের মন্তব্য করেছেন। আমরা আরববাসীরা চাই, তাঁর সাংসদ পদ বাতিল করা হোক।” যদিও ওই গুণধর সাংসদকে কোনওই শাস্তি পেতে হয়নি।

পৃথিবীতে এপিডেমিকের ইতিহাস নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেছেন, তাঁরা দেখিয়েছেন, অতীতেও কীভাবে ইউরোপে প্লেগের সময় বারবার সংখ্যালঘু ইহুদিদের বিরুদ্ধে ঠিক এই ধরনের অভিযোগই আনা হয়েছিল, যা ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা সংখ্যলঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে আনছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী টিভিতে বহু কিছু বলছেন। কিন্তু মুসলিমদের বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র, এই সুপরিকল্পিত আক্রমণ নিয়ে সেখানে তিনি কিছুই বলেননি। বললেন পরে, টুইটে এবং ইংরেজি ভাষায়। এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা নিয়ে তাঁর দলের কর্মীদের বিরুদ্ধে, নেতাদের বিরুদ্ধে, সাংসদদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তা নিয়ে হিন্দিতে না-বলে, টিভিতে না-বলে কেন তিনি ইংরেজিতে টুইট করলেন? তার কারণ, সম্ভবত, সারা পৃথিবীতে এই নিয়ে নিন্দা হচ্ছে, সেই চাপে পড়ে। বিদেশিদের উদ্দেশেই সম্ভবত তাঁর এই বক্তব্য। গত ১৯ এপ্রিল টুইটে কী বলেছেন তিনি, দেখে নেওয়া যাক। তিনি বলে্ছেন- “COVID-19 does not see race, religion, colour, caste, creed, language or borders before striking. Our response and conduct thereafter should attach primacy to unity and brotherhood.”

মনে করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য বাইরের দেশের জন্য। বিশেষ করে আরব দেশগুলির জন্য। কারণ, ওই সব দেশে বহু ভারতীয় কাজ করেন। তাঁরা বছরে যে অর্থ পাঠান, তা কয়েক বিলিয়ন ডলার। বিজেপি নেতা সাংসদদের আচরণে প্রশ্ন উঠেছে সেই সব দেশে। প্রায় ৮০ লক্ষ ভারতীয় কাজ করেন আরব দেশগুলিতে। তাঁরা সেখানে কোনও রকম অসুবিধায় পড়লে সেই চাপ এসে পড়বে মোদি সরকারের উপর।

তার উপর এখন এই করোনা-সময়ে নতুন কাজ তো দূরের কথা, কাজ হারাচ্ছেন কোটি-কোটি মানুষ, এই মুহূর্তে দেশে বেকারি সর্বকালীন রেকর্ড ছুঁয়েছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের সব থেকে বড় কূটনৈতিক মঞ্চ ‘অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কোঅপারেশন’ বেশ শক্ত ভাষায় ভারতের সমালোচনা করে বলেছে, “ভারত জুড়ে যে মুসলিম বিদ্বেষের পরিবেশ তৈরি হয়েছে তা বন্ধ করতে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিক সে দেশের সরকার। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী ভারতের সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষিত করা হোক।”

কেন দেশের বাইরে মোদি সরকার সমালোচিত হচ্ছে, তার একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। হাসপাতালে মেল ওয়ার্ড থাকে। ফিমেল ওয়ার্ড থাকে। আপনি কখনও শুনেছেন ‘মুসলিম ওয়ার্ড’? হিন্দুরা নাকি মুসলিমদের সঙ্গে থাকবে না— সিদ্ধান্ত নিচ্ছে গুজরাতের বিজেপি সরকার। ঠিক যেমন জার্মানিতে ফ্যাসিস্টরা ইহুদিদের স্কুল আলাদা করে দিয়েছিল। গত ১৭ এপ্রিল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে এই খবর প্রকাশিত হওয়ার পর দেশের ভিতরে তেমন হইচই হয়নি। কারণ অনুগত মিডিয়া ব্যাপারটাকে কার্যত এড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু বিদেশের বহু সংবাদমাধ্যম এই খবরের ফলো-আপ করেছে। ঘটনাটি কোনও বেসরকারি হাসপাতালে ঘটেনি। ঘটেছে খাস সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র, আমদাবাদ সিভিল হসপিটালে। সেখানে ১২০০ বেড আছে। বেড ভাগাভাগি করে তৈরি করা হয়েছে হিন্দুরোগীদের ওয়ার্ড এবং মুসলিম রোগীদের ওয়ার্ড। কে এই মধ্যযুগীয় সিদ্ধান্ত নিল? হাসপাতালের মেডিক্যাল সুপার গুনবন্ত রাঠোড় সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি রাজ্য সরকারের নির্দেশে এই কাজ করেছেন।

এই সুপরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক রাজনীতি লাভাস্রোতের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। যদিও এখনও প্রায় ৬০ কোটি মানুষের ভোট হিন্দুত্ববাদীরা পায় না, কিন্তু তারা অসহায়ভাবে দেখছে, তাদের  হয়ে কথা বলার মতো রাজনৈতিক শক্তিগুলো পালছেঁড়া নৌকার মতো দিশাহীন ভেসে চলেছে এদিক থেকে ওদিকে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...